সফর তিন প্রকার:
এক – প্রশংসনীয় সফর :
যে সফর আল্লাহর আদেশ বা নিষেধ র্কাযকর করার উদ্দেশ্যে হয়। যেমন-হজ-ওমরা পালন অথবা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ, দ্বীনের দাওয়াত, ইলমেদ্বীন শিক্ষা, আত্মীয়তার সর্ম্পক বজায় রাখা অথবা দ্বীনি ভাইদের সাথে সাক্ষাত ইত্যাদি উদ্দেশ্যে সফর করা।
দুই – নিন্দনীয় সফর :
এমন কোন খারাব উদ্দেশ্যে সফর করা, যার অনুমতি ইসলামী শরীয়ত প্রদান করেনি। যেমন- কোন পীর, বুজুর্গ বা ওলীর মাযার ও কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা। অথবা হারাম বা নিষিদ্ধ ব্যবসার উদ্দেশ্যে সফর করা। যেমন- মদ বা নেশা জাতীয় কোন বস্তু ক্রয়-বিক্রয় বা আমদানি-রপ্তানি ইত্যাদি উদ্দেশ্যে সফর করা। এ ছাড়াও যে কোন অসৎ কাজ, অশ্লীল বিনোদন ও ফাসাদ সৃষ্টি করা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করা।
দুনিয়াবী কোন বৈধ কাজের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করা। যেমন- বৈধ কোন ব্যবসা বাণিজ্য, হালাল ও রুচিশীল বিনোদন ইত্যাদি। এ ধরনের সফর কখনো কখনো প্রশংসনীয় সফরের অন্তর্ভূক্ত হয়। যখন এর সাথে ভাল নিয়্যত এবং শরীয়ত সম্মত কোন উদ্দেশ্য জড়িত থাকে এতে সাওয়াবও লাভ হয়। যেমন- টাকা উর্পাজনের উদ্দেশ্য নিজেকে কারো মুখাপেক্ষী না করা, মানুষের নিকট হাত পাতা হতে বিরত থাকা এবং ছেলে-মেয়েদের জন্য হলাল খাদ্যের জোগাড়- ইত্যাদি।
সফরের বৈশিষ্ট
ইসলামী শরীয়তে সফরের একাধিক বৈশিষ্ট্য আছে।
১-পবিত্রতার সাথে সম্পৃক্ত :
মুসাফিরের জন্য লাগাতার তিন দিন তিন রাত পর্যন্ত পায়ে মোজা পরিধান করে রাখা বৈধ। সালাতের সময় পানি না পাওয়া গেলে তার জন্য তায়াম্মুম করা বৈধ। তবে র্বতমানে এ বিষয়ে নমনীয়তা প্রদর্শন করা বৈধ নয়। বর্তমানে এমন অনেক স্থান আছে, যেখানে কোন প্রকার কষ্ট করা ছাড়াই পানি পাওয়া যাবে।
মুসাফিরের জন্য লাগাতার তিন দিন তিন রাত পর্যন্ত পায়ে মোজা পরিধান করে রাখা বৈধ। সালাতের সময় পানি না পাওয়া গেলে তার জন্য তায়াম্মুম করা বৈধ। তবে র্বতমানে এ বিষয়ে নমনীয়তা প্রদর্শন করা বৈধ নয়। বর্তমানে এমন অনেক স্থান আছে, যেখানে কোন প্রকার কষ্ট করা ছাড়াই পানি পাওয়া যাবে।
২-সালাতের সাথে সম্পৃক্ত:
মুসাফির চার রাকাত বিশিষ্ট সালাতকে দুই রাকাতে আদায় করবে। এছাড়া যোহরের সালাত আছরের সাথে একত্রে আদায় করতে পারবে এবং মাগরিবের সালাত এশার সাথে একত্রে আদায় করবে। অনুরূপভাবে নফল সালাত, যোহর, মাগরীব ও এশারের সালাতের সুন্নাত না পড়ার ও অনুমতি আছে। তবে বিতিরের সালাত, ফযরের সালাতের দুই রাকাত সুন্নাত, তাহিয়্যাতুল মসজিদ, চাশতের সালাত -ইত্যাদি ও এ জাতীয় নফল সালাত দায় করতে হবে। এছাড়া মুসাফিরের জন্য যানবাহনের উপর নফল সালাত আদায় করা জায়েয আছে। এতে ক্বিবলামুখী হওয়া তার জন্য জরুরী নয়। যে সকল নেক আমল সফর করার কারণে পালন করতে সক্ষম হয় না, আল্লাহ তাআলা আমল না করা সত্ত্বেও তাকে তার বিনিময়ে সাওয়াব প্রদান করবেন। যেমন-আবু মুসা আশআরী রা.-এর হাদীস তিনি বলেন-
عن أبي موسى الأشعري رضي الله عنه عن النبي صلي الله عليه وسلم أنه قال إذا مرض العبد أو سافر كتب له مثل ما كان يعمل مقيما صحيحا. رواه البخاري:2774
যখন কোন বান্দা অসুস্থ হয় অথবা সফরে থাকে তখন সে মুকীম বা সুস্থ থাকাকালীন যে সকল আমল করত, তার জন্য ঐ সকল আমলের ছওয়াব লিপিবদ্ধ করা হয়। (বুখারী-২৭৭৪)
মুসাফিরের দুআ আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য:
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
ثلاث دعوات مستجابات لا شك فيهن، دعوة المظلوم ودعوة الوالد ودعوة المسافر. رواه البخاري -1828
তিনটি দুআ আল্লাহর নিকট কবুল হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। নির্যাতিত ব্যক্তির দুআ, মাতা পিতার দুআ, মুসাফিরের দুআ। (বুখারী-১৮২৮)
সফরের আদাব-শিষ্টাচার
সফরের পূর্বে সফর চলাকালে এবং সফর হতে ফিরে আসার পর অনেকগুলো আদব আছে। নিম্নে তা আলোচনা করা হল।
এক – সফরের পূর্বের আদাবসমূহ :
সফরের পূর্বে অনেকগুলো আদব আছে, মুসলমানের জন্য এগুলি পালন করা কর্তব্য।
১- পরার্মশ চাওয়া এবং ইস্তেখারা করা। কোন ব্যক্তির অন্তরে সফরের বাসনা জগ্রত হওয়া মাত্রই তার উচিত এমন একজন লোকের নিকট পরার্মশ চাওয়া যে তার হিতাকাঙ্খী এবং তার সার্বিক অবস্থা সর্ম্পকে জ্ঞাত। পরামর্শের পর যদি মনে করে এর মাঝে কল্যাণ রয়েছে, তখন সে ইস্তেখারা করবে। দুই রাকাত সালাত আদায় করবে এবং ইস্তেখারার দুআ পড়বে অতঃপর যার প্রতি তার মন ধাবিত হয়, সে অনুপাতে আমল করবে।
২- নতুনভাবে তওবা করবে। মানুষের দেনা-পাওনা পরিশোধ করে দায় মুক্ত হবে, এবং ওছিয়তনামা লিখবে। কারণ, সফরে কোন সময় কি অঘটন ঘটে তা তো বলা যায় না।
৩- নেককার-উত্তম সঙ্গী নির্বাচন করবে যিনি আল্লাহর ইবাদত-আদেশ নিষেধ পালনে সহযোগী হবে। কারণ, সফরে মানুষ তার সঙ্গীর সাথেই সব সময় থাকে। এতে তার সঙ্গীর প্রভাব তার উপর অবশ্যই পড়ে। অসৎ সঙ্গী নির্বাচণ হতে সম্পূর্ণ বিরত থাকবে। আর মনে রাখতে হবে একা একা সফর করা মাকরূহ।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একা সফর করা হতে নিষেধ করেন, তিনি বলেন-
الراكب شيطان والراكبان شيطانان والثلاثة ركب. رواه الترمذي-1598
একজন আরোহী শয়তান আর দুইজন আরোহী দুইটি শয়তান। তবে তিন জন আরোহী হল একটি জামাত। (তিরমিযি-১৫৯৮) তিনি আরো বলেন
لو يعلم الناس ما في الوحدة ما أعلم ما سافر راكب بليل وحده. رواه البخاري-277
একা সফর করার ক্ষতি সম্পর্কে যদি মানুষ জানতে পারতো যা আমি জানি তাহলে কেউই রাত্রে একা সফর করত না। (বুখারী-১৫৯৮) একাকী সফর করার কারণে কখনো কখনো সে ভীত সন্ত্রস্ত হতে পারে। বিভিন্ন ধরণের চিন্তা-ভাবনা তার মাথায় চাপতে পারে। অথবা কোথাও কোন বিপদ হলে বা অসুস্থ হয়ে পড়লে তখন তার সহযোগিতা করার মত কাউকে পাওয়া যাবে না -ইত্যাদি কারণে ইসলামী শরীয়ত একা সফর করাকে নিরুৎসাহিত করে।
৪- সফরের মাঝে যে সব বিষয়ে জানা থাকা দরকার তা পূর্বেই জেনে নিবে। যেমন- কছর সালাতের বিধান, একত্রে সালাত আদায়ের বিধান, তায়াম্মুম ও মুযার উপর মাছেহ করার বিধান ইত্যাদি।
৫- মহিলাদের জন্য মুহরিম ছাড়া সফর করা বৈধ নয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
لا يخلون رجل بامرأة إلا ومعها ذو محرم ولا تسافر المرأة إلا مع ذي محرم فقال له رجل يا رسول الله إن امرأتي خرجت حاجة وإني اكتتبت في غزوة كذا وكذا، قال انطلق فحج مع امرأتك. رواه مسلم-2291
একজন পর-পুরুষ একজন মহিলার সাথে কোন মুহরিম ছাড়া একাকী হতে পারবে না। এবং কোন মহিলা মুহরিম ছাড়া সফর করতে পারবে না। একথা বলার পর এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, ইয়া রাসুলাল্লাহ ! আমার স্ত্রী হজ্বের উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন। আর আমি অমুক যুদ্ধে তালিকাভুক্ত হয়েছি। (এখন আমি কি করবো?) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি চলে যাও এবং তোমার স্ত্রীর সাথে হজ্ব কর। (মুসলিম-২২৯১)
৬- যদি কোন প্রকার কষ্ট না হয় মানুষ তার সফর বৃহস্পতিবারে আরম্ভ করতে চেষ্টা করবে। কারণ, রাসুল সা, অধিকাংশ সময় বৃহস্পতিবারে সফর করতেন।
৭- তার পরিবার পরিজন এবং সাথী-সঙ্গীদের বিদায় দিবেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার সাহবীরা এরকমই করতেন। এসর্ম্পকে হাদীসে বর্ণিত আছে মুকীম মুসাফিরকে বলবে –
أستودع الله دينك وأمانتك وخواتيم عملك
আর মুসাফির মুকীমকে বলবে – أستودعك الله الذي لا تضيع ودائعه
সফর চলাকালে ও সফর থেকে ফিরে এসে করনীয়
এমন কিছু শিষ্টাচার আছে যেগুলো সফরের মধ্যে এবং সফর হতে ফিরে এসে পালন করা উচিত।
১-আল্লাহর যিকির দ্বারা সফর আরম্ভ করবে। আরোহণের সময়, বিশেষ করে সফরের শুরুতে হাদীসে বর্ণিত দুআ সমুহ পড়বে। ইবনে ওমর রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন সফরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে তার উটকে প্রস্তুত করতেন তখন তিনবার আল্লাহু আকবর বলতেন অতঃপর তিনি বলতেন-
سبحان الذي سخر لنا هذا وما كنا له مقرنين وإنا إلى ربنا لمنقلبون. اللهم إنا نسألك في سفرنا هذا البر والتقوى ومن العمل ما ترضى، اللهم هون علينا سفرنا هذا واطو عنا بعده، اللهم أنت الصاحب في السفر والخليفة في الأهل، اللهم إنا نعوذ بك من وعثاء السفر وكآبة المنظر وسوء المنقلب في المال والأهل. رواه مسلم-
২-জামাতের মধ্য হতে একজনকে আমীর নিযুক্ত করবে।
قال صلى الله عليه وسلم: إذا خرج ثلاثة في سفر فليؤمروا أحدهم. رواه أبوداود-2241
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যখন এক সাথে তিন জন সফরে বের হবে তখন একজনকে আমীর নিযুক্ত করবে। (আবু দাউদ -২২৪১)
৩-যখন কোন উঁচা স্থানে আরোহন করেবে তখন সুন্নাত হল আল্লাহ আকবর বলবে। আর যখন নিচের দিকে অবতরণ করবে তখন সুবহানাল্লাহ বলবে।
قال جابر رضي الله عنه كنا إذا صعدنا كبرنا وإذا نزلنا سبحنا. رواه البخاري -2771
যাবের রা. বলেন আমরা যখন উপর দিকে আরোহন করতাম আল্লাহু আকবর(الله أكبر) বলতাম আর যখন নিচে অবতরণ করতাম সুবহানাল্লাহ (سبحان الله)বলতাম।(বুখারী-২৭৭১)
৪-যখন কোন ঘরে অবতরণ করবে তখন সুন্নাত হল খাওলা বিনতে হাকিমের হাদীসে উল্লে¬খিত দুআটি পাঠ করবে –
عن خولة بنت حكيم رضي الله عنها – أنها سمعت النبي صلي الله عليه وسلم يقول من نزل منزلا ثم قال أعوذ بكلمات الله التامات من شر ما خلق لم يضره شيء حتي يرتحل من منزله ذلك. رواه البخاري -4881
তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -কে বলতে শুনেছেন যে ব্যক্তি কোন স্থানে অবতরণ করার পর এ দুআ পড়বে
أعوبذ بكلمات الله التامات من شر ما خلق.
কোন কিছুই তার ক্ষতি করতে পারবে না। যতক্ষণ সে ঐ স্থান ত্যাগ না করে।
৫-যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রয়োজন শেষে পরিবার পরিজনের নিকট ফিরে আসবে। রাসুল বলেন –
السفر قطعة من العذاب يمنع أحدكم طعامه وشرابه و نومه فإذا قضى نهمته فليعجل إلى أهله. رواه البخاري -1677
সফর আযাবের একটি অংশ সফর একজন মানুষকে ঠিকমত খেতে দেয়না, পান করতে দেয়না এবং ঘুমাতে দেয়না। তাই যখন প্রয়োজন পুরণ হয়ে যাবে সে যেন তার পরিবার পরিজনের নিকট তাড়াতাড়ি ফিরে আসে। (বুখারী-১৬৭৭)
৬-যখন তার নিজ শহরে ফিরে আসবে তখন শুরুতে যে দুআ পড়ছিল তা আবার পুনরায় পড়বে। তবে- آيبون تائبون عابدون لربنا حامدون বাড়াবে।
৭-সফর হতে প্রত্যাবর্তন করা মাত্রই মসজিদে প্রবেশ করে দুই রাকাত সালাত আদায় করবে। কাব ইবনে মালেক রা. ঘটনা সম্বলিত হাদীসে বর্ণিত :
أن رسول الله صلي الله عليه وسلم كان إذا قدم من سفر بدأ بالمسجد فركع ركعتين. رواه البخاري -4066
তিনি বলেন যখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সফর হতে ফিরে আসতেন প্রথমে তিনি মসজিদে প্রবেশ করতেন। এবং দুই রাকাত সালাত আদায় করতেন। (বুখারী-৪০৬৬)
ওয়েব গ্রন্থনা : আবুল কালাম আযাদ আনোয়ার /সার্বিক যত্ন : আবহাছ এডুকেশনাল এন্ড রিসার্চ সোসাইটি, বাংলাদেশ।
সমাপ্ত
অনুবাদক : জাকেরুল্লাহ আবুল খায়ের
ترجمة : ذاكر الله أبو الخير
সম্পাদনা : আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
مراجعة : عبد الله شهيد عبدالرحمن
সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব
المكتب التعاوني للدعوة وتوعية الجاليات بالربوة الرياض
ترجمة : ذاكر الله أبو الخير
সম্পাদনা : আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
مراجعة : عبد الله شهيد عبدالرحمن
সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব
المكتب التعاوني للدعوة وتوعية الجاليات بالربوة الرياض
No comments:
Post a Comment