Tuesday, June 26, 2018

শির্কের পরিচয় ও পরিণতি

শির্কের পরিচয় ও পরিণতি

আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “বলুন, হে জাহেল সম্প্রদায় তোমরা কি আমাকে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ইবাদাত করতে আদেশ করছ? (৬৪)। নিশ্চয়ই আপনার প্রতি এবং আপনার পূর্ববর্তীদের প্রতি ওয়াহী করা হয়েছে, যদি আপনি আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থাপন করেন তাহলে আপনার যাবতীয় কর্ম নষ্ট হয়ে যাবে এবং আপনি অবশ্যই তিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবেন (৬৫)। অতএব আপনি আল্লাহরই ইবাদাত করুন এবং কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত থাকুন (৬৬)। তারা আল্লাহকে যথার্যরূপে বুঝে মর্যাদা দিতে পারেনি, কিয়ামতের দিন গোটা পৃথিবী থাকবে তাঁর হাতের মুঠোতে এবং আসমান সমূহ ভাঁজ করা অবস্থায় থাকবে তাঁর ডান হাতে। তিনি পুত ও পবিত্র এবং তারা যে শির্ক করে তা থেকে তিনি অনেক উর্ধ্বে (৬৭)। (সূরা যুমার)
আয়াত সমূহ অবতরণের প্রোপট:
আলোচ্য আয়াতগুলি সূরা যুমারের অন্তর্গত, সূরাটি মক্কার জাহিল বর্বর সমাজের অবস্থাকে কেন্দ্র করে অবতীর্ণ হয়। ইমাম ইবনু কাছীর (রহ) ইমাম ইবনু আবি হাতিম ও অন্যান্যদের বরাতে ইবুন আব্বাস (রা) হতে বর্ণনা করেন তিনি বলেন ঃ আজ মুশরিক সমাজ রাসূল (সা) এর কাছে প্রস্তাব দিল যে, তিনি যেন তাদের মা‘বুদদের ইবাদাত করেন, আর তারাও রাসূল (সা) এর মা‘বুদের ইবাদাত করবে। তখন তাদের প্রস্তাবের প্রতিবাদ করে এ আয়াত সমূহ অবতীর্ণ হয়। বলুন, হে জাহেল সম্প্রদায় তোমরা কি আমাকে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ইবাদাত করার আদেশ করছ? তাফসীর ইবনে কাসীর ৪/৬৫ পৃষ্ঠা
আয়াত সমূহের আলোচ্য বিষয়:
আলোচ্য আয়াত সমূহ মাক্কী যুগে অবতীর্ণ হয়, মাক্কী সূরার আলোচ্য বিষয়গুলো ছিল তাওহীদ বা আল্লাহর একত্বতা এর নির্দেশ এবং তাওহীদ বিদ্ধংসী শির্কের প্রতিবাদ ও নিষেধ। একই সূত্রে আলোচ্য আয়াতগুলির বিষয় বস্তু হলো নিম্নরূপ:
১। জাহিল মুশরিকদের কর্ম ও প্রস্তাব তথা গায়রুল্লাহর ইবাদাত প্রত্যাখ্যান ও কঠোর প্রতিবাদ।
২। মুহাম্মদ (সা) এবং পূর্ববর্তী নাবী রাসূলদের প্রতি ওয়াহির অন্যতম বিষয় শির্ক হতে বিরত থাকা।
৩। শির্কের কারণে মানুষের সকল সৎকর্ম বিনষ্ট হয়ে যায় এবং ইহকাল ও পরকাল তিগ্রস্ত হয়।
৪। প্রকৃত মাবুদ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলারই ইবাদত করতে হবে এবং তারই কৃতজ্ঞশীল হতে হবে।
৫। মুশরিকরা আল্লাহর একত্বতা না মানার কারণে আল্লাহর সঠিক মর্যাদা দিতে পারেনি, অতএব আল্লাহকে যথাযথ মর্যাদা প্রদান সম্ভব হতে পারে তাঁর তাওহীদ বা একত্বতার সকল দিকগুলি পূর্ণভাবে পালনের মাধ্যমে, তাওহীদের একটি অন্যতম দিক হল তাঁর পুত পবিত্র গুণাবলী যেমনি ভাবে তাঁর জন্য শোভা পায় ঠিক তেমনি ভাবে সাব্যস্তকরা।
আয়াত সমূহের সংক্ষিপ্ত তাফসীর:
(৬৪) বলুন হে জাহেল সম্প্রদায়! তোমরা কি? ………….
পূর্বের আয়াতগুলিতে আলোচিত হয়েছে যে, সবকিছুর একমাত্র স্রষ্টা হলেন আল্লাহ তাআলা এবং সবকিছুর কর্তত্ব একমাত্র তাঁরই হাতে, সুতরাং তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কারো ইবাদাত চলতে পারে না, তাই আল্লাহর দাসত্ব বর্জন কারী জাহেল মুশরিকদের প্রতিবাদ করা হল।
(৬৫-৬৬) “নিশ্চয় আপনার প্রতি এবং আপনার …………” মানব জাতির পথ প্রদর্শক হলেন নাবী রাসূলগণ, তাঁরা কখনও মনগড়া পথে প্রদর্শন করেন না, বরং তাদের প্রদর্শন হলো ওয়াহী ভিত্তিক। সকল নাবী রাসূলদের প্রতি কঠোর হুসিয়ারী ছিল শির্ক বর্জনের ব্যাপারে। এমনকি সর্বশ্রেষ্ঠ ও শেষ নাবী মুহাম্মদ (সা) কেও একই সূত্রে লাল সংকেত দেয়া হয়েছে যে, শির্কে লিপ্ত হলে কোন রেহাই নেই। জীবনের সকল সৎকর্ম বাতিল হয়ে যাবে এবং তিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। মূলতঃ শির্ক হলো সবচেয়ে বড় নাফরমানী ও অকৃতজ্ঞতা। এজন্য সাথে সাথেই আবার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে বরং একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত কর এবং কৃতজ্ঞশীল হও।
(৬৭) “তারা আল্লাহকে যথাযথরূপে বুঝে মর্যাদা দিতে পারেনি। …………” যারা আল্লাহর তাওহীদ বা একত্ববাদকে পূর্ণভাবে স্বীকার করতে পারেনি তারা কখনও আল্লাহকে যথাযথরূপে মর্যাদা দিতে পারেনি।
এরপর আল্লাহ নিজেই তাঁর বড়ত্ব ও মহত্বের দিকটি তুলে ধরেছেন। সহীহ বুখারীতে এসেছে:
عن عبدالله بن مسعود ان يهوديا جاء الى النبي صلي الله عليه وسلم فقال يا محمد ان الله يمسك السماوات على اصبع والارضين علي اصبع والجبال علي اصبع والشجر علي اصبع والخلائق على اصبع ثم يقول : انا الملك : فضحك رسول الله صلى الله عليه وسلم حتى بدت نواجذه ثم قرأ : (وما قدروا الله حق قدره………..) وفى رواية فضحك رسول الله تعجبا وتصديقا له (حديث 7414)
সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রা) হতে বর্ণিত তিনি বলেন: একদা এক ইয়াহুদী আলিম নাবী (সা) এর কাছে আসলেন এবং বললেন: হে মুহাম্মদ (সা) আমরা আমাদের গ্রন্থে পাচ্ছি যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা হাতের এক আঙ্গুলে আসমান সমূহ, এক আঙ্গুলে যমিন সমূহ, এক আঙ্গুলে পাহাড় পর্বত, এক আঙ্গুলে গাছ পালা এবং আরেক আঙ্গুলে বাকী সকল সৃষ্টি সমূহ রাখবেন অতঃপর তিনি বলবেন! আমিই মহারাজা। ইহা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) হেসে ফেললেন এমনকি তাঁর মুখের সম্মুখের দাঁতগুলি বের হয়ে গেল। অতঃপর নবী (সা) আশ্চার্য হয়ে ইয়াহুদীর কথার সত্যায়নে وما قدروا الله حق… আয়াত পাঠ করে শুনালেন। (সহীহ বুখারী: হাদীস নং ৭৪১৪)
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলার মুষ্টি, ডানহাত এবং হাদীসে আঙ্গুল এর স্পষ্ট বর্ণনা এসেছে। তাই আহলিস্ সুন্নাহ ওয়াল জামাআত বলেন: কুরআন ও সহীহ হাদীসে আল্লাহ তা‘আলার যে সব গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য প্রমাণিত হয়েছে তা কোনরূপ অপব্যাখ্যা, বিকৃতি ও মাখলুকের সাথে সাদৃশ্য স্থাপন ছাড়াই আল্লাহ তা‘আলার জন্য যথাযোগ্য হিসাবে ঐ বিষয়গুলিকে বিশ্বাস করার নামই হল তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাত অর্থাৎ সুন্দর নাম ও গুণাবলীর েেত্র আল্লাহর একত্বতা। অপর পে ঐসব অস্বীকার, অপব্যাখ্যা, বিকৃতি করা একপ্রকার শির্ক। তাই আল্লাহ বলেন: “তারা যে শির্ক করে তা থেকে তিনি অনেক উর্দ্ধে।” সহীহ মুসলিম, কিতাবুর ফিতান।
শির্কের পরিচয়:
শির্ক একটি জঘন্যতম অপরাধ, বরং পৃথিবীর বুকে এর চেয়ে আর কোন বড় অপরাধ নেই, এজন্যই কুরআনের ভাষায় শির্ককে (ظلم عظيم) “মহা অন্যায় বা বড় যুলম” বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রশ্ন হতে পারে শির্ক আমাদের করণীয় কাজ নয় অতএব এর পরিচয় জানার কি প্রয়োজন? উত্তর হলঃ হ্যাঁ, ইহা আমাদের করণীয় কাজ নয় ঠিক, কিন্তু ইহা এমন অপরাধ যাতে লিপ্ত হলে মানুষের সকল সৎকর্ম বাতিল হয়ে যাবে। অতএব আমাদের কর্ম তথা ইবাদাতকে সার্থক করতে হলে শির্কের মত জঘন্য অপরাধ হতে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। সাহাবী হুযায়ফা (রা) বলেন:
كان الناس يسألونه عن الخير وكنت اسأله عن الشر مخافة أن يدركني الشر –
“মানুষেরা নবী (সা)কে কল্যাণকর বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করত, আর আমি জিজ্ঞাসা করতাম অকল্যাণকর বিষয় সম্পর্কে, এই আশাংকায় যে খারাপকে না চিনলে আমাদেরকে খারাপে পেয়ে যেতে পারে। সুতরাং শির্ক হতে বাঁচার জন্য এবং মানুষকে শির্ক থেকে সতর্ক করার জন্যই শির্ক এর পরিচয় জানা প্রয়োজন। সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ফিতান।
শির্কের শাব্দিক অর্থ:
শির্ক শব্দটি الشرك আরবী শব্দ হতে, যার আভিধানিক অর্থ হলো النصيب অর্থাৎ অংশ, শির্ক শব্দটি الاشراك ক্রিয়ার মূল হতেই বেশী ব্যবহার হয়, তখন এর অর্থ হবে جعل له شريكا “তাঁর শরীক বা অংশীদার নির্ধারণ করল”। আল মুজাম আল ওয়াসীত- ১/৪৮০ পৃষ্ঠা
অতএব ইসলামী পরিভাষায় শির্ক শব্দটি তাওহীদ এর বিপরীত। তাওহীদ অর্থ হল: একত্বতা, আর শির্ক বা ইশরাক অর্থ হল ঃ বহুত্বতা বা বহু ইশ্বরবাদ।
শির্কের পারিভাষিক অর্থ:
শির্ক এর পারিভাষিক সংগা বর্ণনা করতে গিয়ে বিভিন্নজন বিভিন্ন ভঙ্গিতে বিষয়টি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। ‘মাদখাল” গ্রন্থের প্রণেতা বলেন:
الشرك هو تسوية غير الله بالله فيما هو من خصائصه
আল্লাহ তা‘আলার বিশেষত্বের ক্ষেত্রে গায়রুল্লাহকে সমপর্যায় করে নেয়ার নাম শির্ক।
এ সংগার আলোকে বলা যায় আল্লাহর তাওহীদ যেমন তিন প্রকার (রুবুবিয়্যাহ বা প্রতিপালনে, উলুহিয়্যাহ বা ইবাদাতে ও আসমা ওয়াস সিফাত বা সুন্দর নাম ও গুণাবলীতে) ঠিক শির্কও একই ভাবে তিন প্রকার। কারণ আল্লাহর একত্বতা ও বিশেষত্ব যেহেতু তিন প্রকার অনুরূপ যারা তার বিশেষত্বে শির্ক বা অংশীকরণ করে তাও তিন প্রকার। আল মাদথাল লি দিরাসাতি আল আকীদাহ আল ইসলামীয়াহ- ১২৫ পৃষ্ঠা
অবশ্য শির্কের এ সংজ্ঞার সমর্থনে নাবী (সা) এর হাদীস পাওয়া যায়। নাবী (সা) বলেন:
اعظم الذنب أن تجعل لله ندا وهو خلقك
“সবচেয়ে বড় অপরাধ হল আল্লাহ তা‘আলা তোমার স্রষ্টা হওয়া সত্বেও তুমি তাঁর সমক নির্ধারণ করে নিবে।” সহীহ মুসলিম হাদীস নং (১৪১)
অতএব আল্লাহর বিশেষত্ব বিষয়ে কোন মাখুলককে সমক মনে করার নামই হল শির্ক। (মুজাম আল ফাযুল আকীদাহ ঃ ২৩৯ পৃষ্ঠা)
শির্কের প্রকারভেদ:
শির্কের প্রকারভেদ বর্ণনা করতে গিয়ে বিভিন্ন গবেষক বিভিন্নভাবে শ্রেণী বিন্নাস করেছেন। কেউ তাওহীদের প্রকারের সাথে শির্কেরও তিন প্রকার বর্ণনা করেছেন। আবার কেউ অন্যভাবে তিন প্রকার বলেন ঃ শির্কে আকবার, শির্কে আসগার ও শির্কে খাফী, (অপ্রকাশ্য) হতে পারে যেমন ঃ আল্লাহ ছাড়া গাইরুল্লাহর উপর নির্ভরশীল হওয়া, আবার যাহের (প্রকাশ্য) হতে পারে যেমন প্রতিবার উপাসনা করা। শির্কে আসগার, ইহাও খাফী (অপ্রকাশ্য) হতে পারে যেমন রিয়া বা লোক দেখানোর উদ্দেশ্য এবং যাহের (প্রকাশ্য) হতে পারে যেমন তাবিজ কবজ্ব পরিধান করা। আততামহীদ শরহু কিতাবুত তাওহীদ ৩৯ পৃষ্ঠা
অতএব শির্ক দুই প্রকার: শির্কে আকবার ও শির্কে আসগার
শির্কে আকবার এর সংজ্ঞা: ইহা হল কাউকে আল্লাহর সমক নির্ধারণ করে আল্লাহর মতই তার ইবাদত করা। অথবা বলা যেতে পারে যে, ইসলামের কোন ইবাদত গায়রুল্লাহর জন্য সম্পাদন করা, যেমন সালাত, সিয়াম, দান-সাদাকাহ, যবাহ, কুরবানী, নযর, মান্নত ইত্যাদি এ শির্কে লিপ্ত হওয়ার ফলে ঈমান নষ্ট হয়ে যায়।
শির্কে আসগারের সংজ্ঞা:
ইহা হল কর্মের ভঙ্গি ও কথাবার্তায় গায়রুল্লাহকে আল্লাহর সমপর্যায় করে নেয়া, যেমন সালাত আদায় করা হয় আল্লাহর জন্যই কিন্তু তা বিশেষ ভঙ্গিতে গুরুত্ব সহকারে আদায় করা হয় লোক দেখানের জন্য এবং কথাবার্তায় গায়রুল্লাহকে আল্লাহর সমপর্যায় করা হয় যেমন বলা হয় আল্লাহ যা চান এবং আপনি যা চান। অথবা বলা হয় ছাতা না হলে (বৃষ্টি হতে) বাঁচতে পারতাম না, ইত্যাদি। এ শির্কে লিপ্ত হওয়ার ফলে গুনাগার হয় কিন্তু ঈমান সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায় না।
শির্কে আকবার ও আসগারের মাঝে পার্থক্য:
উভয় প্রকারের সংজ্ঞায় কিছুটা পার্থক্য ফুটে উঠেছে। আরো কিছু পার্থক্য নিম্নে বর্ণনা করা হল: আল মাদখাল লি দিরাসাতিল আকীদাহ ইসলামীয়াহ: ১২৭ পৃষ্ঠা।
১। শির্কে আকবার ইসলাম হতে বের করে দেয় পান্তরে আসগার বের করেনা।
২। শির্কে আকবার যাবতীয় আমল বাতিল করে দেয় পান্তরে শির্কে আসগার শুধু শির্কযুক্ত আমলটি বাতিল করে দেয়।
৩। শির্কে আকবার চিরস্থায়ী জাহান্নামী বানিয়ে দেয় পান্তরে শির্কে আসগার আল্লাহর ইচ্ছাধীন, আল্লাহ সাময়িক জাহান্নামে শাস্তি দিতে পারেন আবার মাও করে দিতে পারেন।
৪। শির্কে আকবারে লিপ্ত হলে ইসলাম হতে বের হয়ে যায় ফলে ইসলামে তার জান মালের কোন নিরাপত্তা থাকেনা, অপর পে শির্কে আসগারের কারণে ঈমান বাতিল হয়না কিন্তু দুর্বল হয়ে যায় বা কমে যায় তাই জান মালের নিরাপত্তা বহাল থাকে।
৫। শির্কে আকবারের অপরাধ আল্লাহ সঠিক তাওবা ছাড়া কখনও মা করবেন না, কিন্তু আসগারের অপরাধ আল্লাহর ইচ্ছাধীন সাময়িক শাস্তি দিতে পারেন অথবা মাও করে দিতে পারেন।
৬। শির্কে আকবারে লিপ্ত হলে জান্নাত হারাম হয়ে যায় পান্তরে আসগারের ক্ষেত্রে তেমনটি নয়। ইহা ছাড়া আরো অনেক পার্থক্য রয়েছে।
শির্কে লিপ্ত হওয়ার কারণ সমূহ:
মানুষ কোন কর্মে লিপ্ত হলে এর পিছনে কিছু সহায়ক কারণ থাকে, ঠিক তেমনি মহা অপরাধ শির্কে লিপ্ত হওয়ার পিছনেও কিছু উল্লেখযোগ্য কারণ রয়েছে, নিম্নে কয়েকটি আলোকপাত করা হল:
১। নেককার ও সৎ ব্যক্তিদের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা ঃ মানব জাতির মাঝে শির্কের উৎপত্তিই হয়েছে নেককার ও সৎ ব্যক্তিদের ব্যাপারে সীমালংঘনের কারণে। ইসলামে খালিক ও মালিক মহান আল্লাহর হক বর্ণনা করে দেয়া হয়েছে। অনুরূপভাবে মাখলুক নাবী রাসূল ও সৎ নেক্কার ব্যক্তিদের হক বর্ণনা করে দেয়া হয়েছে। সকলকে যখন যথাযথ হক বা অধিকার প্রদান করা হবে তখন কোন শির্কে লিপ্ত হওয়ার আশংকা থাকেনা, কিন্তু যখন অধিকার প্রদানে অতিরঞ্জিত করা হবে, মাখলুককে খালিকের পর্যায়ে নেয়া হবে, তখনই শির্কে লিপ্ত হবে। যেমনটি ঘটেছে নূহ (আ) এর গোত্রের নেক্কার সৎ লোকদের ব্যাপারে।
তাদের মৃত্যুর পর পরবর্তী লোকেরা শয়তানের কুমন্ত্রণায় আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের কাছেই অতিভক্তির ছলে ধরনা দিতে শুরু করল, শেষ পর্যায়ে তাদের কাছেই আবেদন নিবেদন শুরু হল। এভাবেই মানব জাতির মাঝে শির্কের প্রচলন শুরু হয়। যে ঘটনাটি সূরা নূহে এবং সহীহ বুখারী সহ বিভিন্ন গ্রন্থে বিস্তারিত ভাবে আলোচিত হয়েছে। সূরা নূহে আয়াত: ২৩, সহীহুল বুখারী হাদীস নং (৪৯২০)। আল বিদায়া ওয়ান নিহায়াহ- ১/১০৬ পৃষ্ঠা।
আমাদের মাঝে যে শির্কের ছয়লাব এর কারণ চিন্তা করলে একই বিষয়ে পৌঁছবে।
২। প্রশংসা, গুণগান ও দীনের ব্যাপারে অতিরঞ্জিত সীমালংঘন:
মানুষ যে যতই বড় হোক কখনও আল্লাহর সমপর্যায় পৌঁছতে পারেনা। চাই তিনি নাবী বা রাসূল হন, আর কোন পীর বা ইমাম হন। পূর্ববর্তী নাবীদের যেমন ঈসা (আ), উযাইর (আ) কে প্রশংসা ও গুণগান ইত্যাদিতে আল্লাহর সমতুল্য করে তোলা হয়েছে। যেমনটি অনেক বিদআতী ব্যক্তি নাবী মুহাম্মদ (সা) এর ব্যাপারেও করে থাকে। এ ল্েয নাবী (সা) কঠোর হুশিয়ারী দিয়েছেন। তিনি (সা) বলেন:
لاتطرونى كما أطرت النصارى ابن مريم فإنما أنا عبده فقولوا عبد الله ورسوله
“তোমরা আমার ব্যাপারে সীমালংঘন করনা, বাড়াবাড়ি করনা যেমন নাসারা বা খৃষ্টান সম্প্রদায় ঈসা ইবনে মারঈয়াম এর ব্যাপারে সীমালংঘন করেছে, আমি তো তাঁর (আল্লাহর) বান্দা মাত্র, অতএব তোমরা বল ঃ (মুহাম্মদ) আব্দুল্লাহ (আল্লাহর বান্দা) ও রাসূলুল্লাহ (তাঁর রাসূল)। সহীহ বুখারী ফতহুলবারী সহ- ৬/৪৭৮, ১২/১৪৪ পৃষ্ঠা
তিনি (সা) আরো বলেন: “সাবধান! তোমরা দীনের ব্যাপারে সীমালংঘন হতে বিরত থাক, কারণ তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা দীনের ব্যাপারে সীমালংঘন করেই ধ্বংস হয়েছে। নাসায়ী ৫/২৬০ পৃষ্ঠা ইবনে মাজাহ- ২/১০০৮ পৃষ্ঠা
দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে, বর্তমান মুসলিম সমাজ তাদের পীর, দরবেশ ও ওয়ালী আওলিয়াদের ব্যাপারে পূর্ববর্তী লোকদের চেয়ে কোন ভাবেই পিছিয়ে নেই। আল্লাহ আমাদের হিদায়াত দিন।
৩। কররের উপর মসজিদ নির্মাণ অথবা কবরকে মসজিদ রূপায়ন ঃ বর্তমান বিশ্বে শির্কের একটি অন্যতম কারণ হল কবরে মসজিদ নির্মাণ করা অথবা কবরকে মসজিদে পরিণত করা। মসজিদ এর অর্থ শুধু মসজিদ ভবন তৈরী করা নয় বরং সিজদার স্থান নির্ধারণ করার নামই হল মসজিদ। আজ মুসলিম সমাজে ওয়ালী, গাউছ ও কুতুবের দুহাই দিয়ে তাদের কবরগুলিকে মসজিদে পরিণত করেছে। নাবী (সা) বলেন:
لعنة الله على اليهود والنصارى اتخذوا قبور أنبيائهم مساجد
“ইয়াহুদ ও নাসারাদের উপর আল্লাহর লা‘নত বা অভিশাপ কারণ তারা তাদের নবীদের কবরকে মসজিদে পরিণত করেছে। সহীহ বুখারী: ফতহুল বারীসহ ১/৫৩২, ৩/২০০, ৬/৪৯৪
ইয়াহুদ ও নাসারা যদি লানত প্রাপ্ত হয় তাহলে এ উম্মাতের কবর পূজারীরা কেন লানত প্রাপ্ত হবে না।
নাবী (সা) মৃত্যু শয্যায় শতর্কবাণী করছেন! “সাবধান!” তোমাদের পূর্ববর্তীরা তাদের নাবী ও সৎব্যক্তিদের কবরকে মসজিদে পরিণত করেছে, অতঃএব সাবধান তোমরা কখনও কবরকে মসজিদে বা সিজদার স্থান বানিয়ে নিয়না। আমি তোমাদেরকে যে বিষয়ে কঠোরভাবে নিষেধ করছি। সহীহ মুসলিম: ১/৩৭৭
ইহা ছাড়াও আরো একাধিক কারণ রয়েছে যা মানুষকে শির্কে লিপ্ত করে দিয়েছে। শির্ক হতে বাঁচতে হলে অবশ্যই ঐ সব কারণ হতে বিরত থাকতে হবে, আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক দান করুন।
শির্কের পরিণতি:
পূর্বের আলোচনায় আমরা শির্কের পরিচয় অবগত হলাম, শির্ক হল সবচেয়ে বড় অপরাধ, ঈমান বিনষ্ট কারী, জান্নাত হারামকারী ও জাহান্নাম অপরিহার্যকারী। একজন ঈমানদারের জন্য এর চেয়ে আর কোন বড় পরিণতি হতে পারে না। বিষয়টিকে আরো পরিস্কার করার জন্য কুরআন ও হাদীসের আলোকে সংপ্তিভাবে নিম্নে আলোকপাত করা হল ঃ
১। কোন ব্যক্তি শির্কে আকবারে লিপ্ত হলে চূড়ান্ত ভাবে পথ ভ্রষ্ট এবং ঈমান ও ইসলাম হতে বের হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
وَمَن يُشْرِكْ بِاللّهِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلاَلاً بَعِيدًا
“আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অংশী স্থাপন করে সে চূড়ান্তভাবে পথভ্রষ্ট গুমরাহ হয়ে যায়। সূরা নিসা ঃ ১১৬
২। শির্কে আকবারের অপরাধ তাওবা ছাড়া কখনও মা হয়না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
إِنَّ اللّهَ لاَ يَغْفِرُ أَن يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ
নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সাথে অংশী স্থাপনের অপরাধ মা করেন না, অবশ্য শির্কের অপরাধ ছাড়া যাকে ইচ্ছা মা করেন। সূরা নিসা: ৪৮
৩। শির্কে আকবারে লিপ্ত হলে যাবতীয় সৎকর্ম বাতিল হয়ে যায়: আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
وَلَوْ أَشْرَكُواْ لَحَبِطَ عَنْهُم مَّا كَانُواْ يَعْمَلُونَ
যদি তারা শির্কে লিপ্ত হয় তাহলে তাদের পূর্বের সব সৎকর্ম ধ্বংস হয়ে যাবে।” সূরা আনআম: ৮৮
৪। শির্কে আকবারে লিপ্ত হলে জান্নাত হারাম এবং জাহান্নাম অপরিহার্য হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
إِنَّهُ مَن يُشْرِكْ بِاللّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللّهُ عَلَيهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ
“যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থাপন করে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে হারাম করে দেন এবং জাহান্নামে স্থান নির্ধারণ করে দেন। সূরা মায়িদাহ: ৭২
৫। শির্ক সবচেয়ে বড় যুলুম আল্লাহ তা‘আলা বলেন লোকমান হাকীম স্বীয় সন্তানকে উপদেশ দিচ্ছেন:
يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ
“হে প্রিয় বৎস তুমি আল্লাহর সাথে শরীক করনা কেননা শির্ক হলো সবচেয়ে বড় যুলম”। সূরা লুকমান: ১৩
৬। মুশরিক চিরস্থায়ী জাহান্নামী, আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ وَالْمُشْرِكِينَ فِي نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا
“নিশ্চয় আহলে কিতাবদের যারা কাফির হয়ে গেছে এবং যারা মুশরিক তারা চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে। সূরা বাইয়্যেনাহ: ৬
৭। শির্কে আসগারের কারণে ঈমান কমে যায় দুর্বল হয়ে যায় এবং শির্কে আকবারের দিকে পথ দেখায়।
৮। শির্কে আকবার পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে বড় অপরাধ নাবী (সা) বলেন:
أعظم الذنب أن تجعل لله ندا
“সবচেয়ে বড় অপরাধ হলো আল্লাহর সাথে শরীক করা।” সহীহ মুসলিম হাদীস নং ১৪১
৯। মুশরিকের সাথে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সা) এর কোন সম্পর্ক নেই। আল্লাহ বলেন:
وَأَذَانٌ مِّنَ اللّهِ وَرَسُولِهِ إِلَى النَّاسِ يَوْمَ الْحَجِّ الأَكْبَرِ أَنَّ اللّهَ بَرِيءٌ مِّنَ الْمُشْرِكِينَ وَرَسُولُهُ
“বড় হাজ্জের দিন আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের প হতে ঘোষণা যে, মুশরিকদের সাথে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের কোন সম্পর্ক নেই।” সূরা তাওবা: ৩
১০। মুশরিকরাই সর্ব নিকৃষ্ট আল্লাহ বলেন:
أُوْلَئِكَ هُمْ شَرُّ الْبَرِيَّةِ
“তারাই (কাফির ও মুশরিকরা) সৃষ্টি কূলের মাঝে সর্ব নিকৃষ্ট”। সূরা বাইয়্যিনাহ: ৬
ইহা ছাড়াও শির্কের পরিণতির আরো অনেক দিক রয়েছে আল্লাহ আমাদের এ জঘণ্য অপরাধ হতে রা করুন। দারসুল কুরআনের উপসংহারে আমরা বলতে পারি যে, আসমানের নীচে ও যমিনের উপরে সবচেয়ে জঘণ্যতম বড় অপরাধ ও মহাযুলম হল আল্লাহ তা‘আলার সাথে শির্ক করা। প্রতিটি মানুষের জন্য আল্লাহর প হতে সর্বপ্রথম নির্দেশ হলো তাঁর তাওহীদ বা একত্বতা পালন করা অপর পে সর্ব প্রথম নিষেধ হলো শির্কে লিপ্ত না হওয়া। কারণ শির্কে লিপ্ত হলে ঈমান বাতিল হতে আর দেরি হয়না, এমনকি দীর্ঘ জীবনের কঠর পরিশ্রমের ইবাদাত বন্দেগী ধ্বংস হতেও বাকী থাকে না। অতএব আমাদের ঈমান ইসলামকে মজবুত ও দৃঢ় করতে হলে ভয়াবহ অপরাধ শির্কের পরিচয় জেনে তা হতে বিরত থাকতে হবে। অবশ্য শির্ক খুবই সূক্ষ্ম বিষয় তাই পূর্ণভাবে উপলদ্ধি করাও কঠিন, এজন্য আল্লাহর কাছেই শির্ক হতে বাঁচার সহযোগিতা কামনা করতে হবে এবং এ বিষয়ে নবী (সা) এর শিখানো দু‘আ পাঠ করতে হবে। দু‘আটি হল:
اللهم إنى أعوذبك أن اشرك بك شيئا اعلمه واستغفرك لما لا اعلمه
“হে আল্লাহ! আমি জেনে শুনে তোমার সাথে শরীক করা হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি এবং অজানায় কিছু করে ফেললে তা হতে মা প্রার্থনা করছি।” আমীন
আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ খান মাদানী

No comments:

Post a Comment

প্রশ্ন: সুদী ব্যাংকে চাকুরী করার বিধান সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার কারণে যদি কেউ সারা জীবন সুদী ব্যাংকে চাকুরী করে তাহলে চাকুরী থেকে অব্যহতি নেয়ার পর তার জন্য করণীয় কি?

প্রশ্ন: সুদী ব্যাংকে চাকুরী করার বিধান সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার কারণে যদি কেউ সারা জীবন সুদী ব্যাংকে চাকুরী করে তাহলে চাকুরী থেকে অব্যহতি নেয়...