Tuesday, June 26, 2018

সালাতে একাগ্রতা ও খুশুর জন্য ৩৩ টি উপায়

সালাতে একাগ্রতা ও খুশুর জন্য ৩৩ টি উপায় ।

সালাতে একাগ্রতা ও খুশু

মহান আল্লাহ ইরশাদ করছেন,
وَقُومُوا لِلهِ قَانِتِينَ ﴿البقرة : ২৩৮﴾
এবং আল্লাহর জন্য দাঁড়াও বিনীত হয়ে। (আল-বাকারা : ২৩৮)
আরও ইরশাদ হচ্ছে,
وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى الْخَاشِعِينَ . الَّذِينَ يَظُنُّونَ أَنَّهُمْ مُلَاقُو رَبِّهِمْ وَأَنَّهُمْ إِلَيْهِ رَاجِعُونَ ﴿البقرة:৪৬﴾
আর তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও। নিশ্চয় তা বিনয়ী ছাড়া অন্যদের উপর কঠিন। যারা বিশ্বাস করে যে, তারা তাদের রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে এবং তারা তাঁর দিকে ফিরে যাবে। (আল-বাকরা : ৪৫-৪৬)
সালাত ইসলামের একটি শরীরিক ইবাদত, বড় রুকন। একাগ্রতা ও বিনয়াবনতা এর প্রাণ, শরিয়তের অমোঘ নির্দেশও। এদিকে অভিশপ্ত ইবলিশ মানবজাতিকে পথভ্রষ্ট ও বিপদগ্রস্ত করার শপত নিয়ে অঙ্গীকার করেছে,
‘তারপর অবশ্যই তাদের নিকট উপস্থিত হব, তাদের সামনে থেকে ও তাদের পেছন থেকে এবং তাদের ডান দিক থেকে ও তাদের বাম দিক থেকে। আর আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না’। (আল-আরাফ : ১৭)
কাজেই তার মূল উদ্দেশ্য মানবজাতিকে সালাত হতে বিভিন্ন ছলে-বলে অন্য মনস্ক করা। ইবাদতের স্বাদ, সওয়াবের বিরাট অংশ থেকে বঞ্চিত করার নিমিত্তে সালাতে বিভিন্ন ধরনের ওয়াসওয়াসা ও সন্দেহের অনুপ্রবেশ ঘটানো। তবে বাস্তবতা হল, শয়তানের আহবানে মানুষের বিপুল সাড়া, দ্বিতীয়ত, সর্বপ্রথম সালাতের একাগ্রতা পৃথিবী থেকে উঠিয়ে নেয়া, তৃতীয়ত, শেষ জমানা। এ হিসেবে আমাদের উপর হুজায়ফা রা. এর বাণী প্রকটভাবে সত্যতার রূপ নিয়েছে। তিনি বলেন,
‘সর্বপ্রথম তোমরা নামাজের একাগ্রতা হারা হবে, সর্ব শেষ হারাবে সালাত। অনেক নামাজির ভেতর-ই কোনো কল্যাণ বিদ্যমান থাকবে না। হয়তো মসজিদে প্রবেশ করে একজন মাত্র নামাজিকেও সালাতে বিনয়ী-একাগ্রতা সম্পন্ন দেখবে না।’ (মাদারিজুস সালিকিন, ইবনুল কায়্যিম ১/৫২১)
তা সত্বেও কতক মানুষের আত্মপ্রশ্ন, অনেকের সালাতে ওয়াসওয়াসা ও একাগ্রতাহীনতার অভিযোগ।
বিষয়টির আলোচনার প্রয়োজনীয়তা অত্যধিক অপরিসীম। সে জন্যেই নিম্নে বিষয়টির উপর সামান্য আলোকপাতের চেষ্টা করা হয়েছে।আল্লাহ তাআলা বলেন,
‘মুমিনগণ সফলকাম, যারা সালাতে মনোযোগী’। (সূরা আল-মুমিনূন: ১-২) অর্থাৎ আল্লাহ ভীরু এবং সালাতে স্থির।
‘খুশু হল-আল্লাহর ভয় এবং ধ্যান হতে সৃষ্ট স্থিরতা, গাম্ভীর্যতা ও নম্রতা।(‘দার-আশশুআব প্রকাশিত ইবনে কাসির : ৬/৪১৪)
‘বিনয়াবনত এবং আপাত-মস্তক দীনতাসহ আল্লাহর সমীপে দন্ডায়মান হওয়া’। (আল-মাদারেজ : ১/৫২০)
মুজাহিদ বলেন, ‘কুনুতের অর্থ : আল্লাহর ভয় হতে উদ্‌গত স্থিরতা, একাগ্রতা, অবনত দৃষ্টি, সর্বাঙ্গীন আনুগত্য। (তাজিমু কাদরিস সালাত ১/১৮৮)
খুশু তথা একাগ্রতার স্থান অন্তর তবে এর প্রভাব বিকশিত হয় অঙ্গ-প্রতঙ্গে। ওয়াসওয়াসা কিংবা অন্যমনস্কের দরুন খুশুতে বিঘ্নতার ফলে অঙ্গ-প্রতঙ্গের ইবাদতেও বিঘ্নতার সৃষ্টি হয়। কারণ, অন্তকরণ বাদশাহ আর অঙ্গ-প্রতঙ্গ আজ্ঞাবহ-অনুগত সৈনিকের ন্যায়। বাদশার পদস্খলনে সৈনিকদের পদস্খলন অনস্বীকার্য। তবে কপট ও বাহ্যিকভাবে খুশু তথা একাগ্রতার ভঙ্গিমা নিন্দনীয়। বরং ইখলাসের নিদর্শন হল একাগ্রতা প্রকাশ না করা।
হুজায়ফা রা. বলতেন, ‘নেফাক সর্বস্ব খুশু হতে বিরত থাক। জিজ্ঞাসা করা হল, নেফাক সর্বস্ব খুশু আবার কি? উত্তরে বললেন, শরীর দেখতে একাগ্রতাসম্পন্ন অথচ অন্তর একাগ্রতা শূন্য।’
ফুজায়েল বলেন, ‘আগে অন্তরের চেয়ে বেশী খুশু প্রদর্শন করা ঘৃণার চোখে দেখা হত।’
জনৈক বুজুর্গ এক ব্যক্তির শরীর ও কাঁধে খুশুর আলামত দেখে বললেন, এই ছেলে ! খুশু এখানে, বুকের দিকে ইশারা করে। এখানে নয়, কাঁধের দিকে ইশারা করে। (মাদারিজ: ১/.৫২১)
সালাতের ভেতর খুশু একমাত্র তারই অর্জিত হবে, যে সবকিছু ত্যাগ করে নিজেকে সালাতের জন্য ফারেগ করে নিবে এবং সবকিছুর ঊর্ধ্বে সালাতকে স্থান দিবে। তখনই সালাতের দ্বারা চোখ জুড়াবে, অন্তর ঠান্ডা হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
সালাতেই আমার চোখের শান্তি রাখা হয়েছে। (মুসনাদু আহমাদ: ৩/১২৮)
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে মনোনীত বান্দাদের আলোচনায় খুশুর সহিত সালাত আদায়কারী নারী-পুরুষের কথা উল্লেখ করেছেন এবং তাদের জন্য ধার্যকৃত ক্ষমা ও সুমহান প্রতিদানের ঘোষণা প্রদান করেছেন। ( সূরা আল-আহজাব : ৩৫) খুশু বান্দার উপর সালাতের দায়িত্বটি স্বাভাবিক ও হালকা করে দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَاسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى الْخَاشِعِينَ. ﴿البقرة:৪৫﴾
আর তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও। নিশ্চয় তা খুশুওয়ালা-বিনয়ী ছাড়া অন্যদের উপর কঠিন। ( সূরা আল-বাকারা : ৪৫)
অর্থাৎ সালাতের কষ্ট বড় কঠিন, তবে খুশু ওলাদের জন্য কোন কষ্টই নয়।” (তাফসিরে ইবনে কাসির : (১/১২৫) খুশু যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমন কঠিন ও দূর্লভ, বিষেশ করে আমাদের এ শেষ জামানায়। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘এই উম্মত হতে সর্ব প্রথম সালাতের খুশু উঠিয়ে নেয়া হবে, এমনকি তালাশ করেও তুমি কোনো খুশু ওয়ালা লোক খুঁজে পাবে না।’ (তাবরানি)
 খুশু তথা একাগ্রতার হুকুম
 নির্ভরযোগ্য মত অনুসারে খুশু ওয়াজিব। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, আল্লাহ তাআলার বাণী,وَ
”তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর, তবে সালাতে একাগ্রতা বঞ্চিতদের জন্য তা খুব কঠিন।” (সূরা আল-বাকারা : ৪৫)- এর মাধ্যমে খুশুহীনদের দুর্নাম ও নিন্দা করা হয়েছে। অর্থাৎ খুশু ওয়াজিব। কারণ, ওয়াজিব তরক করা ছাড়া কারো দুর্নাম করা হয় না।
 অন্যত্র বলেন,
”মুমিনগণ সফল, যারা সালাতে একাগ্রতা সম্পন্ন…তারাই জান্নাতুল ফেরদাউসের উত্তরাধিকারী হবে।” ( সূরা আল-মোমেনুন : ১-১১) এ ছাড়া অন্যরা তার অধিকারী হবে না। এর দ্বারাও প্রমাণিত হয়, খুশু ওয়াজিব। খুশু হল বিনয় ও একাগ্রতার ভাব ও ভঙ্গি। সুতরাং যে ব্যক্তি কাকের মত মাথা ঠোকরায়, রুকু হতে ঠিক মত মাথা উঁচু করে না, সোজা না হয়ে সেজদাতে চলে যায়, তার খুশু গ্রহণ যোগ্য নয়। সে গুনাহগার-অপরাধি। (মাজমুউল ফতওয়া : ২২/৫৫৩-৫৫৮)
 রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
”পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আল্লাহ তাআলা ফরজ করেছেন। যে ভাল করে ওজু করবে, সময় মত সালাত আদায় করবে এবং রুকু-সেজদা ঠিক ঠিক আদায় করবে, আল্লাহর দায়িত্ব, তাকে ক্ষমা করে দেওয়া। আর যে এমনটি করবে না, তার প্রতি আল্লাহর কোনো দায়িত্ব নেই। শাস্তিও দিতে পারেন, ক্ষমাও করতে পারেন। (আবু দাউদ : ৪২৫, সহিহ আল-জামে : ৩২৪২)
 রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন,
”যে সুন্দরভাবে ওজু করে, অতঃপর মন ও শরীর একত্র করে দু’রাকাত সালাত পড়ে, (অন্য বর্ণনায়-যে সালাতে ওয়াসওয়াসা স্থান পায় না) তার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। (অন্য বর্ণনায়- তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব।) (বোখারি : ১৫৮, নাসায়ি : ১/৯৫)
 খুশু ও একাগ্রতা সৃষ্টি করার কয়েকটি উপায়
 খুশু তৈরীর উপায় ও বিষয় নিয়ে গবেষণা করার পর স্পষ্ট হয় যে, এগুলো দু’ভাগে ভিবক্ত।
এক. খুশু তৈরী ও শক্তিশালী করণের উপায় গ্রহণ করা।
দুই. খুশুতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী বিষয়গুলো পরিহার ও দুর্বল করা।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, খুশুর সহায়ক দুটি জিনিস। প্রথমটি হল- নামাজি ব্যক্তির প্রতিটি কথা, কাজ, তেলাওয়াত, জিকির ও দোয়া গভীর মনোযোগ সহকারে আদায় করা। আল্লাহকে দেখে এসব আদায় করছি এরূপ নিয়ত ও ধ্যান করা। কারণ, নামাজি ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কথপোকথন করে। হাদিসে জিবরীলে ইহসানের সংজ্ঞায় এসেছে,
”আল্লাহর ইবাদত কর, তাকে দেখার মত করে। যদি তুমি তাকে না দেখ, সে তো অবশ্যই তোমাকে দেখে।” ( বোখারি মুসলিম )
এভাবে যতই সালাতের স্বাদ উপভোগ করবে, ততই সালাতের প্রতি আগ্রহ বাড়বে। আর এটা সাধারণত ঈমানের দৃঢ়তার অনুপাতে হয়ে থাকে। ঈমান দৃঢ় করারও অনেক উপায় রয়েছে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, ”তোমাদের দুনিয়ার তিনটি জিনিস আমার নিকট প্রিয়। নারী ও সুগন্ধি, আর সালাত তো আমার চোখের প্রশান্তি।”
আরেকটি হাদিসে এসেছে, ”ও বেলাল, সালাতের মাধ্যমে (প্রশান্তি) মুক্তি দাও।”
দ্বিতীয়টি হল- প্রতিবন্ধকতা দূর করা। অন্তরের একাগ্রতা বিনষ্টকারী জিনিস ও চিন্তা-ফিকির পরিত্যাগ করা। যা ব্যক্তি অনুসারে সকলের ভেতর হয়ে থাকে। যার ভেতর প্রবৃত্তি ও দ্বীনের ব্যাপারে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কিংবা কোনো জিনিসের প্রতি আসক্তি রয়েছে, তার ভেতর ওয়াসওয়াসাও অধিক হবে। (মাজমুউল ফতওয়া : ২২/৬০৬-৬০৭ )
 খুশু সৃষ্টি ও শক্তিশালী করণের উপায়সমূহ
 এক. সালাতের জন্য প্রস্ততি গ্রহণ ও তৈরী হওয়া।
যেমন, মুয়াজ্জিনের সাথে সাথে আজানের শব্দগুলো উচ্চারণ করা এবং আজান শেষে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে প্রমাণিত নিম্নোক্ত দোয়া পড়া।
আজান-ইকামতের মাঝখানে দোয়া করা, বিসমিল্লাহ বলে পরিশুদ্ধভাবে ওজু করা, ওজুর পরে দোয়া পড়া। যেমন,
মুখ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য মেসওয়াকের প্রতি যত্নশীল থাকা, যেহেতু কিছক্ষণ পরেই সালাতে তেলাওয়াত করা হবে পবিত্র কালাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
”তোমরা কোরআন পড়ার জন্য মুখ ধৌত কর।” ( বর্ণনায় বায্‌যার)
সুন্দর পোষাক-পরিচ্ছদ পরিধান করে পরিপাটি হওয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন,يَا
”ও বনি আদাম, তোমরা প্রতি সালাতের সময় সাজ-সজ্জা গ্রহণ কর।” (সূরা আল আরাফ: ৩১)
আল্লাহর জন্য পরিচ্ছন্ন পোষাক পরিধান করা অধিক শ্রেয়। কারণ, পরিস্কার পরিচ্ছদ ও সুগন্ধির ব্যাবহার নামাজির অন্তরে প্রফুল্লতার সৃষ্টি করে। যা শয়নের কাপড় কিংবা নিম্নমানের কাপড় দ্বারা সম্ভব নয়। তদ্রুপ সালাতের প্রস্তুতি স্বরূপ, শরীরের জরুরি অংশ ঢেকে নেয়া, জায়গা পবিত্র করা, জলদি সালাতের জন্য তৈরী হওয়া ও ধীর স্থিরভাবে মসজিদ পানে চলা। আঙ্গুলের ভেতর আঙ্গুল দিয়ে অলসতার অবস্থা পরিহার করা। সালাতের জন্য অপেক্ষা করা। মিলে মিলে এবং কাতার সোজা করে দাড়ানো। কারণ, শয়তান কাতারের মাঝখানে ফাঁকা জায়গাতে আশ্রয় নেয়।
দুই : স্থিরতা অবলম্বন করা।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিটি অঙ্গ স্বীয় স্থানে ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন
সালাতে ভুলকারী ব্যক্তিকে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ”এভাবে না পড়লে তোমাদের কারো সালাত শুদ্ধ হবে না।”[১]
আবু কাতাদা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ”সালাতে যে চুরি করে, সেই সবচে নিকৃষ্ট চোর। সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল সালাতে কীভাবে চুরি করে ? তিনি বললেন, রুকু-সেজাদ ঠিক ঠিক আদায় করে না।” ( আহমাদ ও হাকেম) [২]
আবু আব্দুল্লাহ আশআরি রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
”যে ব্যক্তি রুকু অসর্ম্পর্ণ রাখে আর সেজাদাতে শুধু ঠোকর মারে, সে ঐ খাদকের মত যে দুই-তিনটি খেজুর খেল অথচ কোনো কাজে আসল না।”[৩] ( তাবরানি)
ধীরস্থিরতা ছাড়া খুশু সম্ভব নয়। কারণ, দ্রুত সালাতের কারণে খুশু নষ্ট হয়। কাকের মত ঠোকর মারার কারণে, সাওয়াব নষ্ট হয়।
তিন : সালাতে মৃত্যুর স্মরণ করা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ”তুমি সালাতে মৃত্যুর স্মরণ কর। কারণ, যে সালাতে মৃত্যুর স্মরণ করবে, তার সালাত অবশ্যই সুন্দর হবে। এবং সে ব্যক্তির ন্যায় সালাত পড়, যাকে দেখেই মনে হয়, সে সালাতে আছে।”[৪] (সিলসিলাতুল আহাদিসিস সহিহাহ)
আবু আইউব রা.-কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপদেশ দিয়ে বলেন,
”যখন সালাতে দাড়াবে, মৃত্যুমুখী ব্যক্তির ন্যায় দাড়াবে।”[৫] (আহমদ)
মৃত্যু প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য নিশ্চিত। কিন্তু তার সময়-ক্ষণ অনিশ্চিত। তাই শেষ সালাত চিন্তা করলে এ সালাতই এক বিশেষ ধরনের সালাতে পরিণত হবে। হতে পারে এটাই জীবনের শেষ সালাত।
 চার : পঠিত আয়াত ও দোয়া-দরূদে ফিকির করা, ও গভীর মনোযোগ দিয়ে তা অনুধাবন করার চেষ্টা করা এবং সাথে সাথে প্রভাবিত হওয়া।
কারণ, কোরআন নাজিল হয়েছে মূলত: চিন্তা-ফিকির ও গবেষণা করার জন্যই। আল্লাহ তাআলা বলেন,
كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِيَدَّبَّرُوا آَيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ ﴿২৯﴾ ( ص:২৯)
”জ্ঞানীদের উপদেশ গ্রহণ ও গবেষণার জন্য আমি একটি মোবারক কিতাব আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি।” (সূরা সাদ: ২৯)
আর এর জন্য প্রয়োজন পঠিত আয়াতের অর্থানুধাবন, উপদেশ গ্রহণ করণ ও জ্ঞানার্জন। তবেই সম্ভব- গবেষণা, অশ্রু ঝরানো ও প্রভাবিত হওয়া। আল্লাহ তাআলা রহমানের বান্দাদের প্রসংশা করে বলেন,
وَالَّذِينَ إِذَا ذُكِّرُوا بِآَيَاتِ رَبِّهِمْ لَمْ يَخِرُّوا عَلَيْهَا صُمًّا وَعُمْيَانًا ﴿৭৩﴾ ( الفرقان : ৭৩)
আর যারা তাদের রবের আয়াতসমূহ স্মরণ করিয়ে দিলে অন্ধ ও বধিরদের মত পড়ে থাকে না। (সূরা আল ফোরকান: ৭৩)
এর দ্বারাই বুঝে আসে তাফসিরের গুরুত্ব। ইবনে জারির রহ. বলেন, ”আমি আশ্চর্য বোধ করি, যে কোরআন পড়ে অথচ তাফসির জানে না, সে কিভাবে এর স্বাদ গ্রহণ করে।” (মাহমূদ শাকের কর্তৃক তাফসিরে তাবারির ভূমিকা: ১/১০)
গবেষণার আরো সহায়ক, বার বার একটি আয়াত পড়া এবং পুনঃপুনঃ তার অর্থের ভেতর চিন্তা করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আমল এরূপই ছিল। বর্ণিত আছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-
إِنْ تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ وَإِنْ تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ ﴿المائدة : ১১৮﴾
আয়াতটি পড়তে পড়তে রাত শেষ করে দিয়েছিলেন। ( ইবন খুযাইমা ও আহমাদ) [৬]
আয়াতের তেলাওয়াতের সাথে সাথে প্রভাবিত হওয়াও চিন্তার সহায়ক। হুজায়ফা রা. হতে বর্ণিত,
”আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে কোনো এক রাতে সালাত পড়েছি। লক্ষ্য করেছি, তিনি একটি একটি করে আয়াত পড়ছিলেন। যখন আল্লাহর প্রশংসামূলক কোনো আয়াত আসতো, আল্লাহর প্রশংসা করতেন। যখন প্রার্থনা করার আয়াত আসতো, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন। যখন আশ্রয় চাওয়ার আয়াত আসতো, আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাইতেন।” (সহিহ মুসলিম : ৭৭২)
আরেকটি বর্ণনায় আছে, ”আমি এক রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সালাত পড়েছি। তার নিয়ম ছিল, রহমতের কোনো আয়াত আসলে, আল্লাহর কাছে রহমত চাইতেন। শাস্তির আয়াত আসলে আল্লাহর নিকট শাস্তি হতে পানাহ চাইতেন। আল্লাহর পবিত্রতার আয়াত আসলে, আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করতেন।” (তাজিমু কাদরিস সালাত: ১/৩২৭)
এ ঘটনাগুলো তাহাজ্জুতের সালাতের ব্যাপারে।
সাহাবি কাতাদা ইবনে নুমান এর ঘটনা, ”তিনি এক রাতে সালাতে দাড়িয়ে, বার বার শুধু সূরায়ে এখলাস পড়েছেন। অন্য কোন সূরা পড়েননি।” (বোখারি – ফতহুল বারি : ৯/৫৯, আহমাদ : ৩/৪৩)
সালাতে তেলাওয়াত ও চিন্তা-ফিকির করার জন্য কোরআন হিফজ করা এবং সালাতে পড়ার দোয়া-দরূদ মুখস্থ করাও একাগ্রতা অর্জনে সহায়ক।
তবে নিশ্চিত, কোরআনের আয়াতে চিন্তা-গবেষণা করা এবং এর দ্বারা প্রভাবিত হওয়া একাগ্রতা অর্জনের জন্য বড় হাতিয়ার। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَيَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ يَبْكُونَ وَيَزِيدُهُمْ خُشُوعًا ﴿১০৯﴾ (الإسراء :১০৯)
‘আর তারা কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়ে এবং এটা তাদের বিনয় বৃদ্ধি করে’। (সূরা ইসরা : ১০৯)
এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা বর্ণনা করছি, যার দ্বারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সালাতে চিন্তা, একাগ্রতা এবং কোরআনের আয়াতে গবেষণার চিত্র ফুটে উঠবে, আরো ফুঠে উঠবে এগুলোর প্রয়োজনীয়তা। তাবিয়ী রহ. বলেন, আমি এবং উবাইদ ইবনে ওমায়ের আয়েশা রা.-এর নিকটি গমন করি। উবাইদ আয়েশাকে অনুরোধ করলেন, আপনি আমাদেরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একটি অতি আশ্চর্য ঘটনা শুনান। আয়েশা রা. এ কথা শুনে কেঁদে ফেললেন, অতঃপর বললেন, এক রাতে উঠে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আয়েশা তুমি আমাকে ছাড়, আমি আমার প্রভুর ইবাদত করি। আমি বললাম, আল্লাহর কসম, আমি আপনার নৈকট্য পছন্দ করি এবং আপনার পছন্দের জিনিসও পছন্দ করি। আয়েশা রা. বলেন, তিনি উঠে ওজু করলেন এবং সালাতে দাড়ালেন। আর কাঁদতে আরাম্ভ করলেন। কাঁদতে কাঁদতে বক্ষ ভিজে গেল। আরো কাঁদলেন, কাঁদতে কাঁদতে মাটি পর্যন্ত ভিজে গেল। বেলাল তাঁকে (ফজরের) সালাতের সংবাদ দিতে এসে দেখেন, তিনি কাঁদছেন। বেলাল বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কাঁদছেন! অথচ আল্লাহ আপনার আগে-পরের সকল গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন ? রাসূল বললেন, আমার কি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হতে মনে চায় না? আজ রাতে আমার উপর কয়েকটি আয়াত অবর্তীণ হয়েছে, যে এগুলো পড়বে আর এতে চিন্তা ফিকির করবে না, সে ক্ষতিগ্রস্ত। অর্থাৎ নিম্নোক্ত আসুরায়ে ফাতেহার পর আমিন বলাও আয়াতের সাথে সাথে প্রভাবিত হওয়ার একটি নমুনা। এর সাওয়াবও অনেক। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”যখন ইমাম আমিন বলে, তোমরাও আমিন বল। কারণ, যার আমিন ফেরেস্তাদের আমিনের সাথে মিলবে, তার পূর্ববর্তী সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।” ( সহিহ েিবাখারি : ৭৪৭)
তদ্রুপ ইমামের سمع الله لمن حمده এর জায়গায় মুক্তাদির ربنا ولك الحمد، বলা। এতেও রয়েছে অনেক সাওয়াব। রেফাআ জারকি রা. বলেন, আমরা একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পেছনে সালাত পড়ছিলাম। যখন তিনি রুকু হতে سمع الله لمن حمده বলে মাথা উঠালেন, পিছন থেকে একজন বলল, ربنا ولك الحمد حمدا كثيرا طيبا مباركا فيه، রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত শেষ করে বললেন, কে বলেছে? সে বলল আমি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি ত্রিশজনেরও বেশি ফেরেশতাদের লক্ষ্য করেছি, এর সাওয়াব লেখার জন্য দৌড়ে ছুটে আসছে। কে কার আগে লিখবে। ( বোখারি, ফাতহুল বারি ২/২৮৪)
 পাঁচ : প্রতিটি আয়াতের মাথায় ওয়াকফ করে করে পড়া।
এ পদ্ধতি চিন্তা ও বোঝার জন্য সহায়ক। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নতও বটে। উম্মে সালামা রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোরআন তেলাওয়াতের ধরন ছিল, প্রথমে بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ পড়তেন। এর পর ওয়াকফ করতেন। অতঃপর পড়তেন, الحمد لله رب العالمين এরপর ওয়াকফ করতেন। অতঃপর পড়তেন, الرحمن الرحيم এর পর ওয়াকফ করতেন। অতঃপর পড়তেন, مالك يوم الدين، এভাবে এক একটি আয়াত ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়তেন।
رواه أبوداود رقم (৪০০১) وصححه الألباني في الإرواء وذكر طرقه (২/৬০).
প্রতি আয়াতের মাথায় ওয়াকফ করা সুন্নত। যদিও পরবর্তী আয়াতের সাথে অর্থের মিল থাকে।
 ছয় : সুন্দর আওয়াজে তারতিল তথা ধীর গতিতে পড়া।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
আর স্পষ্টভাবে ধীরে ধীরে কোরআন আবৃত্তি কর। (আল-মুজ্জাম্মেল : ৪)
রাসূলুল্লাগ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তেলাওয়াতও ছিল, একটি একটি অক্ষর করে সুবিন্যস্ত।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তারতিল সহকারে সূরাগুলো তেলাওয়াত করতেন। একটি লম্বা সূরার তুলনায় পরবর্তী সুরাটি আরো লম্ব হত। ( সহিহ মুসলিম : ৭৩৩)
তারতিলের সাথে ধীরগতির পড়া খুশু ও একাগ্রতার সহায়ক। যেমন তাড়াহুড়ার সাথে দ্রুত গতির পড়া একাগ্রতার প্রতিবন্ধক। সুন্দর আওয়াজে তেলাওয়াত করাও একাগ্রতার সহায়ক। যেমন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপদেশ
”তোমরা সুন্দর আওয়াজে কোরআন তেলাওয়াত কর। কারণ, সুন্দর আওয়াজ কোরআনের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়।” (আল-হাকেম : ১/৫৭৫, সহিহ আল-জামে : ৩৫৮১)
তবে সাবধান! সুন্দর আওয়াজে পড়ার অর্থ অহংকার কিংবা গান-বাজনার ন্যায় ফাসেক-ফুজ্জারদের মত আওয়াজে নয়। এখানে সৌন্দর্যের অর্থ চিন্তার গভীরতাসহ সুন্দর আওয়াজ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ”সবচে’ সুন্দর আওয়াজে কোরআন তেলাওয়াতকারী ঐ ব্যক্তি যার তেলাওয়াত শুনে মনে হয় সে আল্লাহকে ভয় করছে।” (ইবনে মাজাহ : ১/১৩৩৯, সহিহ আল-জামে : ২২০২)
সাত : মনে করা আল্লাহ তাআলা সালাতের ভেতর তার ডাকে সাড়া দিচ্ছেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ”আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি সালাতকে আমার এবং আমার বান্দার মাঝে দু’ভাগে ভাগ করেছি। আমার বান্দা যা চাবে তা পাবে। যখন আমার বান্দা বলে,
الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ (সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলার যিনি সকল জগতের রব) আল্লাহ তাআলা বলেন, عبدي حمدني ( আমার বান্দা আমার প্রশংসা করল) যখন বলে, الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ ( পরম দয়ালু অতীব মেহেরবান) আল্লাহ বলেন, أثنى علي عبدي ( আমার বান্দা আমার গুণগান করল) যখন বলে, مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ ( বিচার-প্রতিদান দিবসের মালিক)আল্লাহ তাআলা বলেন, مجدني عبدي ( আমার বান্দা আমার যথাযথ মর্যাদা দান করল) যখন বলে, إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ ( আমরা কেবল আপনারই ইবাদত করি, কেবল আপনার কাছেই সাহায্য চাই) আল্লাহ তাআলা বলেন, هذا بيني وبين عبدي ولعبدي ما سأل، (এটি আমি ও আমার বান্দার মাঝে, আর আমার বান্দা যা প্রার্থনা করবে, পাবে) যখন বলে ( আমাদের সরল পথ দেখান, তাদের পথ, যাদের উপর আপনি অনুগ্রহ করেছেন। যাদের উপর (আপনার) ক্রোধ নিপতিত হয়নি এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়নি) আল্লাহ তাআলা বলেন, هذا لعبدي ولعبدي ما سأل. ( এটা আমার বান্দার জন্য, আর আমার বান্দা যা প্রার্থনা করবে পাবে) (সহিহ মুসলিম : ৩৯৫)
হাদিসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনো নামাজি এর অর্থ ধ্যানে রাখলে সালাতে চমৎকার একাগ্রতা হাসিল হবে। সূরা ফাতেহার গুরুত্বও প্রনিধান করবে যতেষ্টভাবে। যেহেতু সে মনে করছে, আমি আল্লাহকে সম্বোধন করছি, আর তিনি আমার কথার উত্তর দিচ্ছেন। সুতারাং এ কথপোকথনের যথাযথ মূল্যায়ন করা একান্ত কর্তব্য। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
”তোমাদের কেউ সালাতে দাড়ালে সে, মূলত: তার রব-আল্লাহর সাথে কথপোকথন করে। তাই খেয়াল করা উচিত কিভাবে কথপোকথন করছে।”
مستدرك الحاكم (১/২৩৬) وهو في صحيح الجامع رقم (১৫৩৮).
 আট : সামনে সুতরা রেখে সালাত আদায় করা এবং সুতরার কাছাকাছি দাড়ানো।
এর দ্বারাও সালাতে একাগ্রতা অর্জন হয়। দৃষ্টি প্রসারিত হয় না, শয়তান থেকে হেফাজত এবং মানুষের চলাচল থেকেও নিরাপদ থাকা যায়। অথচ এ সকল জিনিস দ্বারাই সালাতে অন্যমস্কতার সৃষ্টি হয়, সাওয়াব কমে যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
”তোমাদের কেউ যখন সালাত পড়বে, সামনে সুতরা নিয়ে নেবে এবং তার নিকটবর্তী হয়ে দাঁড়াবে।” (আবু দাউদ : ১৬৯৫/৪৪৬, সহিহ আল-জামে : ৬৫১)
সুতরার নিকটবর্তী হয়ে দাড়ানোতে অনেক উপকার নিহিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
”যখন তোমাদের কেউ সুতরার সামনে সালাত পড়বে, সুতরার নিকটবর্তী হয়ে দাড়াবে।”(আবু দাউদ : ১৬৯৫/৪৪৬, সহিহ আল-জামে : ৬৫১)
যাতে শয়তান তার সালাত নষ্ট না করতে পারে। সুতরার নিকটবর্তী হওয়ার সুন্নত তরিকা হলো, সুতরা এবং তার মাঝখানে তিন হাত ব্যবধান রাখা। সুতরা এবং সেজদার জায়গার মাঝখানে একটি বকরি যাওয়ার মত ফাক রাখা। (বোখারি -ফতহুল বারি : ১/৫৭৪, ৫৭৯)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও নির্দেশ দিয়েছেন, কেউ যেন সুতরার সামনে দিয়ে যেতে কাউকে সুযোগ না দেয়। তিনি বলেন, ”যখন তোমাদের কেউ সালাত আদায় করে, সালাতের সম্মুখ দিয়ে কাউকে যাওয়ার সুযোগ দিবে না। যথাসাধ্য তাকে প্রতিরোধ করবে। যদি সে অস্বীকার করে তবে তাকে হত্যা করবে। কারণ, তার সাথে শয়তান। ( সহিহ মুসলিম : ১/২৬০, সহিহ আল-জামে : ৭৫৫)
ইমাম নববি রহ. বলেন, ”সুতরার রহস্য হলো, এর ভেতর দৃষ্টি সীমাবদ্ধ রাখা, যাতায়াত বাধাগ্রস্থ করা, শয়তানের চলাচল রুদ্ধ করা। যাতে তার গমনাগমন বন্ধ হয়, সালাত নষ্ট করার সুযোগ না পায়। (সহিহ মুসলিম এর ব্যাখ্যা গ্রন্থ : ৪/২১৬)
নয় : ডান হাত বাম হাতের উপর রাখা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সালাতে দাড়াতেন, ডান হাত বাম হাতের উপর রাখতেন। তিনি বলেন, ”আমরা হলাম নবীদের জমাত। আমাদেরকে সালাতে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।”
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ”সালাতের ভেতর এক হাতের উপর আরেক হাত রাখার মানে কি? তিনি বলেন, এটি মহান আল্লাহর সামনে বিনয়াবনত অবস্থা।”
ইবনে হাজার রহ. বলেন, আলেমগণ বলেছেন, ”এটি অভাবী-মুহতাজ লোকদের যাঞ্চনা করার পদ্ধতি। দ্বিতীয়ত: এর কারণে অহেতুক নড়া-চড়ার পথ বন্ধ হয়, একাগ্রতা সৃষ্টিতে সহায়ক হয়। (ফতহল বারি : ২/২২৪)
দশ : সেজদার জায়গায় দৃষ্টি রাখা।
আয়েশা রা. হতে বর্ণিত,
”রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতের সময় মাথা অবনত রাখতেন এবং দৃষ্টি দিতেন মাটির দিকে।”
”রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাবা ঘরে প্রবেশ করে, বের হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সেজদার জায়গাতেই দৃষ্টি নিবন্ধ রেখেছেন।”
যখন তাশাহুদের জন্য বসবে, তখন শাহাদাত আঙ্গুলের প্রতি দৃষ্টি রাখবে। যেহেতু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে প্রমাণিত, ”তিনি যখন তাশাহুদের জন্য বসতেন, শাহাদাত আঙ্গুলের মাধ্যমে কিবলার দিকে ইশারা করতেন এবং সে দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ রাখতেন।”
رواه ابن خزيمة (১/৩৫৫ رقم ৭১৯) وقال المحقق : إسناده صحيح، وانظر صفة الصلاة ص: ১৩৯.
অন্য আরেকটি বর্ণনায় আছে, ”তিনি শাহাদাত আঙ্গুলের মাধ্যমে ইশারা করেছেন। আর দৃষ্টি এ ইশারা অতিক্রম করেনি।”رواه أحمد (৪/৩)، وأبو داود رقم (৯৯০).
একটি মাসআলা : অনেক নামাজির অন্তরে ঘোরপাক খায়, সালাতে চোখ বন্ধ রাখার বিধান কি? বিষেশত: এর দ্বারা অনেকে অধিক একাগ্রতাও উপলব্ধি করেন।
উত্তর : চোখ বন্ধ রাখা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে প্রমাণিত সুন্নত এর খেলাফ। যা পূর্বের বর্ণনাতে স্পষ্ট হয়েছে। দ্বিতীয়ত: এর দ্বারা সেজদার জায়গা ও শাহাদাত আঙ্গুলের প্রতি দৃষ্টি দেয়ার সুন্নত ছুটে যায়। আরো অনেক হাদিস বর্ণিত আছে, যার দ্বারা প্রতীয়মান হয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতে চোখ খোলা রাখতেন। যেমন, সালাতে কুছুফে জান্নাত দেখে ফলের থোকা ধরার জন্য হাত প্রসারিত করা, জাহান্নাম দেখা, বিড়ালের কারণে শাস্তি ভোগকারী নারীকে দেখা, লাঠির আঘাতে শাস্তি প্রাপ্ত ব্যক্তিকে দেখা, সালাতের সামনে দিয়ে অগ্রসরমান জানোয়ার ফিরানো, তদ্রুপ শয়তানের গলা চিপে ধরা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ্য করা এসব ঘটনা ছাড়াও আরো ঘটনা আছে, যার দ্বারা প্রতীয়মান হয় সালাতে চোখ বন্ধ রাখা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ নয়।
তবে চোখ বন্ধ রাখা মাকরূহ কি-না এ ব্যাপারে আলেমদের মতদ্বৈততা আছে। ইমাম আহমদসহ অনেকে বলেছেন, এটি ইহুদিদের আমল, সুতরাং মাকরূহ। অপর পক্ষ বলেছেন, এটি বৈধ, মাকরূহ নয়।… সঠিক উত্তর হলো, যদি চোখ খোলা রাখার কারণে, একাগ্রতায় কোনো বিঘ্নতা সৃষ্টি না হয়, তবে খোলা রাখাই উত্তম। আর যদি মসজিদের অঙ্গ-সজ্জা কিংবা প্রতিকূল পরিবেশের কারণে একাগ্রতাতে বেঘাত সৃষ্টি হয়, তাহলে চোখ বন্ধ রাখা মাকরূহ হবে না। বরং এ ক্ষেত্রে শরয়ি নিয়ম-কানুনের দৃষ্টিকোণ থেকে চোখ বন্ধ রাখা মোস্তাহাব হিসেবেই বিবেচিত। সংক্ষিপ্ত : زاد المعاد (১/২৯৩) ط. دار الرسالة.
 মুদ্দা কথা, সালাতে চোখ খোলা রাখাই সুন্নত। তবে একাগ্রতায় বিঘ্নতা সৃষ্টিকারী বস্তু হতে হেফাজতের জন্য চোখ বন্ধ রাখা মাকরূহ নয়।
 এগারো : শাহাদাত আঙ্গুলি দ্বারা ইশারা করা।
অধিকাংশ নামাজি এর ফজিলত ও একাগ্রতা সৃষ্টিতে এর ভূমিকা কত বেশি তা তো জানেই না, উল্টো একে ছেড়ে দিয়েছে একেবারে। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”লোহার তুলনায় এর আঘাত শয়তানের উপর অধিক কষ্টদায়ক।”
رواه الإمام أحمد (২/১১৯) بسند حسن كما في صفة الصلاة ص : ১৫৯.
কারণ, এর দ্বারা বান্দার মনে আল্লাহর একত্ব ও ইখলাসের কথা স্মরণ হয়। যা শয়তানের উপর বড়ই পিড়াদায়ক। الفتح الرباني للساعاتي (৪/১৫).
এজন্যই আমরা লক্ষ্য করি, সাহাবায়ে কেরাম রা. এর জন্য একে অপরকে উপদেশ দিতেন, নিজেরাও এ ব্যাপারে যত্নবান থাকতেন। অথচ এ গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত আজ আমাদের কাছে অবহেলা ও অমনোযোগের শিকার। হাদিসে এসেছে, ”সাহাবায়ে কেরাম এ জন্য একে অপরকে নাড়া দিতেন, সতর্ক করতেন। অর্থাৎ আঙ্গুলের ইশারার জন্য।”
رواه ابن أبي شيبة بسند حسن كما في صفة الصلاة ص: ১৪১، المصنف ( ১০/৩৮১ رقم ৯৭৩২) ط. الدار السلفية، الهند.
আঙ্গুলের ইশারায় সুন্নত হলো, তাশাহুদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আঙ্গুল কেবলার দিকে উঠিয়ে রাখা।
 বার : সালাতের ভেতর সব সময় একই সূরা ও একই দোয়া না পড়ে, বিভিন্ন সূরা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত বিভিন্ন দোয়া-দরূদ পড়া।
এর দ্বারা নতুন নতুন অর্থ ও ভাবের সৃষ্টি হয়। হ্যাঁ, এ আমল সে ব্যক্তিই করতে পারে, যার বিভিন্ন সূরা ও অনেক দোয়া মুখস্থ আছে। আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও এমননি করতেন। তিনি কোনো একটি সূরা বা কোনো একটি দোয়া বার বার এক জায়গায় পড়েননি। যেমন তাকবিরে তাহরিমার পরে নিম্নোক্ত দোয়াগুলো থেকে একেক সময় একেকটা পড়তেন।
১. আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত শুরু করে কিছু সময় চুপ থাকতেন। আমি একদিন জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল- আপনার উপর আমার পিতা-মাতা উৎসর্গ- তাকবির এবং কেরাতের মাঝখানে চুপ থাকেন কেন? তিনি বললেন, আমি এ সময় বলি,
২. আবু সাইদ, আয়েশা রা. ও অন্যান্যদের হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত শুরু করে এ দোয়াটি পড়তেন
৩. ইবনে ওমর রা. বলেন, আমরা একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সালাত আদায় করছিলাম, এক লোক বলল,
الله أكبر كبيرا، والحمد لله كثيرا، وسبحان الله بكرة وأصيلا.
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ কালিমাগুলো কে বলল ? আমাদের ভেতর থেকে একজন বলল, আমি বলেছি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি আশ্চর্য হলাম এর জন্য আসমানের সমস্ত দরজাই খুলে দেয়া হয়েছে। ইবনে ওমর রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে এ কথা শুনার পর আর কোন দিন এগুলো পড়া ছাড়িনি। ( সহিহ মুসলিম: ১/৪২০)
৪. আলী রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতে দাড়িয়ে বলতেন,
وجهت وجهي للذي فطر السموات والأرض حنيفا وما أنا من المشركين، إن صلاتي، ونسكي، ومحياي، ومماتي لله رب العالمين، لاشريك له وبذلك أمرت وأنا من المسلمين. اللهم أنت الملك لا إله إلا أنت. أنت ربي وأنا عبدك، ظلمت نفسي واعترفت بذنبي فاغفرلي ذنوبي جميعا إنه لا يغفر الذنوب إلا أنت واهدني لأحسن الأخلاق لا يهدي لأحسنها إلا أنت، واصرف عني سيئها، لا يصرف عني سيئها إلا أنت، لبيك وسعديك، والخير كله بيديك، والشر ليس إليك، أنا بك وإليك، تباركت وتعاليت، أستغفرك وأتوب إليك. ( أخرجه مسلم ১/৫৩৪)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহাজ্জুদের সালাত এ দোয়ার মাধ্যমে আরম্ভ করতেন।
اللهم رب جبرائيل، وميكائيل، وإسرافيل فاطر السموات والأرض، عالم الغيب والشهادة، أنت تحكم بين عبادك فيما كانوا فيه يختلفون. اهدني لما اختلف فيه من الحق بإذنك إنك تهدي من تشاء إلى صراط مستقيم.) أخرجه مسلم ১/৫৩৪(
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহাজ্জুদের সালাতে দাড়িয়ে কখনো নিম্নেক্ত দোয়া পাঠ করতেন :
ت) .)ا ৩/৩ و১১/১১৬و ১৩/৩৭১، ৪২৩،৪৬৫ ومسلم مختصرا بنحوه ১/৫৩২(
এ সমস্ত দোয়া হতে কোনো একটি সর্বদার জন্য নির্দিষ্ট করে পড়েননি।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. এ সকল দোয়া অনুসন্ধান করে বলেন,
১. সবচে’ উত্তম জিকির হলো যেগুলোতে শুধু আল্লাহর প্রসংশা ও গুণ-র্কীতন রয়েছে।
২. এর পর যেগুলোতে বান্দার ইবাদত-আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
৩. এর পর যেগুলোতে দোয়া-প্রার্থনা রয়েছে।
সবচে’ উত্তম জিকির যেমন,
سبحانك اللهم وبحمدك، وتبارت اسمك، وتعالى جدك، ولاإله غيرك.
এবং দোয়া,
الله أكبر كبيرا، والحمد لله كثيرا، وسبحان الله بكرة وأصيلا.
এ দুটি দোয়ার মাঝে প্রথমটির ফজিলত বেশী। কারণ, এতে আছে, কোরআনের পর সবচে’ মর্যদাশীল কলিমা, سبحانك اللهم وبحمدك এবং কোরআনের শব্দ وتبارت اسمك، وتعالى جدك এ জন্যই অধিকাংশ ওলামায়ে কেরাম এর মাধ্যমে সালাত আরাম্ভ করতেন। ওমর রা. এ দোয়া জোরে জোরে পড়তেন এবং মানুষদের শিক্ষা দিতেন। এর পর দ্বিতীয় প্রকার দোয়া যেমন, وجهت وجهي للذي فطر السموات…. এতে আনুগত্যের বর্হিপ্রকাশও রয়েছে, দোয়াও রয়েছে। প্রথম প্রকার দোয়া শেষে এ দোয়াটি পড়লে মূলত দোয়ার তিন প্রকারই পড়া হবে। তৃতীয় প্রকার দোয়া যেমন, اللهم باعد بيني وبين خطاباي… ইত্যাদি। (মাজমুউল ফতওয়া : ২২/৩৯৪-৩৯৫)
সালাতের ভেতর সূরা তেলাওয়াত করার সময়ও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সূরা পড়তেন। ফজর সালাতে সাধারণত পড়তেন, তেওয়ালে মুফাস্‌সল : ওয়াকিয়া, তুর, ক্বাফ। কেসারে মুফাস্‌সল : তাকওয়ীর, জিলজাল, সূরা নাস ও ফালাক। সূরা রোম, ইয়াসিন, এবং সাফ্‌ফাতও পড়েছেন। জুমার দিন ফজর সালাতে পড়তেন, সূরা সেজদাহ ও সূরা দাহর।
জোহর সালাতে এক এক রাকাতে ত্রিশ আয়াত পরিমাণ পড়তেন। সূরায়ে তারেক, বুরূজ এবং লাইলও পড়েছেন।
আছর সালাতে এক এক রাকাতে পনের আয়াত পরিমাণ পর্যন্ত পড়তেন। সূরা তারেক, বুরূজ এবং সূরা লাইলও পড়েছেন।
মাগরিব সালাতে কেসারে মুফাস্‌সল : সূরা ত্বীন পড়তেন। আবার সূরা মুহাম্মদ, তুর ও মুরসালাত ইত্যাদিও পড়েছেন।
এশার সালাতে আওসাতে মুফাস্‌সল : সূরা শামস, ইনশেকাক পড়তেন। মুয়াজ রা.-কে এশার সালাতে সূরায়ে আ’লা, কালাম এবং সূরায়ে লাইল পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
রাতের সালাতে লম্বা লম্বা সূরা পড়তেন। দুই’শ একশ পঞ্চাশ আয়াত পড়ার বর্ণনা পাওয়া যায়। কখনো এরচে’ কমও পড়েছেন।
রুকুর বিভিন্ন তাসবিহ, যেমন :
১- سبحان ربي العظيم.
২- سبحان ربي العظيم وبحمده.
৩- سبوح قدوس رب الملائكة والروح. ৪
– اللهم لك ركعت، وبك آمنت، ولك أسلمت، وعليك توكلت، أنت ربي، خشع لك سمعي وبصري ودمي ولحمي وعظمي وعصبي لله رب العالمين.
রুকু হতে উঠার পর তাসবিহ। যেমন,
১- سمع الله لمن حمده.
২- ربنا ولك الحمد.
৩- ربنا لك الحمد.
৪ – اللهم ربنا لك ولك الحمد.
৫ – ملء السموات ومل الأرض وملء ما شئت من شيئ بعد. أهل الثناء والمجد، اللهم لا مانع لما أعطيت، ولا معطي لما منعت، ولا ينفع ذا الجد منك الجد.
সেজদার তাসবিহ সমূহ। যেমন,
১- سبحان ربي الأعلى.
২ – سبحان ربي الأعلى وبحمده.
৩- سبوح قدوس رب الملائكة والروح.
৪- سبحانك اللهم ربنا وبحمدك اللهم اغفرلي.
৫- اللهم لك سجدت، وبك آمنت، ولك أسلمت، سجد وجهي للذي خلقه وصوره وشق سمعه وبصره، تبارك الله أحسن الخالقين.
দুই সেজাদার মাঝখানে পড়ার তাসবিহ। যেমন,
১- رب اغفرلي، رب اغفرلي.
২- اللهم اغفرلي وارحمني واجبرني وارفعني واهدني وعافني وارزقني.
তাশাহুদের বিভিন্ন শব্দ। যেমন,
১- التحيات لله والصلوات والطيبات، السلام عليك أيها النبي ورحمة الله وبركاته، السلام علينا وعلى عباد الله الصالحين، أشهد أن لا إله إلا الله وأشهد أن محمدا عبده وسوله.
২- التحيات المباركات الصلوات الطيبات لله، السلام عليك أيها النبي…الخ.
৩- التحيات الطيبات الصلوات لله، السلام عليك أيها النبي…الخ.
দরূদ শরীফের বিভিন্ন শব্দ। যেমন,
১- اللهم صل على محمد وعلى آل محمد كما صليت على إبراهيم وعلى آل إبراهيم إنك حميد مجيد، اللهم بارك على محمد وعلى آل محمد كما باركت على إبراهيم وعلى آل إبراهيم إنك حميد مجيد.
২- اللهم صل على محمد وعلى آل بيته وعلى أزواجه وذريته كما صليت على آل إبراهيم إنك حميد مجيد، وبارك على محمد وعلى آل بيته وعلى أزواجه وذريته كما باركت على آل إبراهيم إنك حميد مجيد.
৩- اللهم صل على محمد النبي الأمي وعلى آل محمد كما صليت على آل إبراهيم، وبارك على محمد النبي الأمي وعلى آل محمد كما باركت على آل إبراهيم، في العالمين إنك حميد مجيد.
তের : সালাতের ভেতর সেজদায়ে তেলাওয়াত পড়ার সাথে সাথে সেজদা করে নেয়া।
আল্লাহ তাআলা নবীদের গুণাগুন বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,
إِذَا تُتْلَى عَلَيْهِمْ آَيَاتُ الرَّحْمَنِ خَرُّوا سُجَّدًا وَبُكِيًّا ﴿৫৮﴾ ( مريم : ৫৮)
”যখন তাদের নিকট আল্লাহর আয়াত তেলাওয়াত করা হয়, তারা সাথে সাথে ক্রন্দনরত অবস্থায় সেজাদয় লুটিয়ে পড়ে।” (সূরা মরিয়ম: ৫৮)
ইবনে কাসির রহ. বলেন, সমস্ত ওলামাদের ঐক্যমতে নবী ও নেককার লোকদের অনুসরণার্থে এখানে সেজদা করা শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত। (ইবনে কাসির : ৫/২৩৮)
দ্বিতীয়ত: সালাতে সেজদায়ে তেলাওয়াত একাগ্রতা বৃদ্ধি করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَيَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ يَبْكُونَ وَيَزِيدُهُمْ خُشُوعًا ﴿১০৯﴾ (الإسراء : ১০৯)
‘আর তারা কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়ে এবং এটা তাদের বিনয় বৃদ্ধি করে’। ( সূরা ইসরা: ১০৯)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে প্রমাণিত, তিনি সূরা আন-নাজমের আয়াতে সেজদাতে সেজদা করেছেন।
আবু রাফে হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবু হুরায়রার সাথে এক দিন এশার সালাত আদায় করেছি। তিনি সূরা ইনশেকাক তেলাওয়াত করেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি সেজদা করলেন কেন? তিনি বলেন, আমি এ আয়াতের জায়গায় আবুল কাসেম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পিছনে সেজদা করেছি। সুতরাং আমৃত্যু এখানে সেজদা করেই যাব। (বোখারি : কিতাবুল আজান, বাবুল জেহরি বিল এশা)
অতএব সালাতের ভেতর সেজদায়ে তেলাওয়াতের প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা। উপরন্তু এর দ্বারা শয়তান অপমানিত ও হেয়প্রতিপন্ন হয়। ফলে নামাজির ক্ষতিও কম হয়।
আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, বনি আদম যখন আয়াতে সেজদা তেলাওয়াত করে সেজদা করে, শয়তান কাঁদতে কাঁদতে দূরে সরে যায়। আর বলে, আফসোস! বনি আদম সেজদার নির্দেশ পেয়ে সেজদা করেছে- তার জন্য জান্নাত। আর আমি সেজদার নির্দেশ পেয়ে অমান্য করেছি- আমার জন্য জাহান্নাম। (সহিহ মুসলিম : ১৩৩)
চৌদ্দ : শয়তান হতে আল্লাহর নিকট পানাহ চাওয়া।
কারণ, শয়তান মানুষের চির শত্রু। যার একটি লক্ষণ নামাজি ব্যক্তির একাগ্রতা নষ্ট করা এবং এতে সন্দেহ সৃষ্টি করা। মূলত: ইবাদত, জিকির ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহর ধ্যানে মশগুল প্রত্যেক ব্যক্তির অন্তরে শয়তান সন্দেহ ও অন্যমনস্কতা সৃষ্টির পায়তারাতে লিপ্ত থাকে। বান্দার উচিত এতে ধৈর্যধারণ করা এবং তাতে অটল-অবিচল থাকা। ঘাবড়ে না যাওয়া। তবেই শয়তানের প্রবঞ্চনা দূরীভূত হয়ে যাবে। “যেহেতু তার ষড়যন্ত্রগুলো আসলেই দূর্বল।”[৭]
আবুল আস রা. বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, শয়তান আমার এবং আমার সালাতের মাঝখানে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে এবং সালাতে সন্দেহ তৈরী করে দেয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”এ শয়তানটির নাম ‘খানজাব’, যখন তুমি এর প্ররোচনা অনুধবান করবে, আল্লাহর কাছে পানাহ চাবে এবং বাম পাশে তিন বার থুতু নিক্ষেপ করবে। তিনি বলেন, আমি এমনটি করেছি, আল্লাহ তাআলা আমার থেকে শয়তানের ওসওয়াসা দূর করেছেন।” ( সহিহ মুসলিম: ২২০৩)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”তোমাদের কেউ সালাতে দাড়ালে শয়তান ভুল-ভ্রান্তি ও সন্দেহ সৃষ্টির জন্য নিকটবর্তী হয়, ফলে এক পর্যায়ে সে রাকাত সংখ্যা ভুলে যায়। কারো এমন হলে, বসাবস্থায় দু’টি সেজদা করে নিবে।” ( رواه البخاري، كتاب السهو، باب السهو في الفرض والتطوع)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শয়তানের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আরো বলেন,
”তোমাদের কেউ সালাতের ভেতর বাতকর্ম হওয়া না-হওয়ার ব্যাপারে সন্দিহান হলে, সালাত ত্যাগ করবে না- যতক্ষণ না আওয়াজ শুনবে কিংবা র্দুগন্ধ পাবে।” (সহিহ মুসলিম : ৩৮৯)
শয়তানের প্ররোচনা আরো আশ্চর্য জনক, ”রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
তোমাদের কেউ সালাতে দাঁড়ালে শয়তান পায়ুপথ ফাঁক করে বায়ূ বের হয়েছে কিনা সন্দেহের সৃষ্টি করে, যদি কেউ এমনটি অনুভব করো, কানে আওয়াজ কিংবা নাকে গন্ধ না সুঁকে সালাত ছাড়বে না।”
رواه الطبراني في الكبير رقم (১১/২২২ رقم ১১৫৫৬)، وقال في مجمع الزوائد (১/২৪২): رجاله رجال الصحيح.
একটি মাসআলা : অনেক নামাজির সালাতে ‘খানজাব’ শয়তান নেক সুরতে ধোকা নিয়ে উপস্থিত হয়। সালাতের ভেতর অন্য ইবাদত যেমন দাওয়াতি কাজ কিংবা ইলমি কোনো বিষয়ে মগ্ন করে দেয়, যার ফলে সে বর্তমান সালাতও ভুলে যায়। অনেক সময় ওমর রা. এর আমল দ্বারা ধোকাটি আরো প্রবল করে। যেহেতু বর্ণিত আছে, তিনি সালাতে যুদ্ধের পরিকল্পনা ও ব্যুহ বিন্যাস করতেন। এর উত্তরের জন্য আমরা শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. এর দ্বারস্থ হলে, তিনি বলেন, ”ওমর রা. বলেছেন, আমি সালাতরত অবস্থায় যুদ্ধের পরিকল্পনা করি।” কারণ, ওমর রা. আমিরুল মুমেনিন যেমন ছিলেন, তেমনি তিনি আমিরুল জেহাদও ছিলেন। তাঁর উপর দুটি দায়িত্ব অর্পিত ছিল। অনেকটা জেহাদ রত সৈনিকের অবস্থার মত। দুটি দায়িত্ব যথাসাধ্য সুন্দরভাবে আঞ্জাম দেয়াই তার কর্তব্য। আল্লাহ তাআলা বলেন,
”হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন কোনো বাহিনীর সাথে সংঘাতে লিপ্ত হও, তখন দৃঢ়পদ থাক এবং উদ্দেশ্যে সফলতা অর্জন করার জন্য আল্লাহকে অধিক পরিমানে স্মরণ করো।” ( সূরা আনফাল : ৪৫)
আমরা সকলেই জানি যুদ্ধের ময়দানে অন্তরের একাগ্রতা আর নিরাপদ অবস্থায় অন্তরের একাগ্রতা সমান নয়। জেহাদের কারণে সালাতে সামান্য ত্রুটি আসলেও, ঈমান এবং আনুগত্যের বদৌলতে তা পুষিয়ে যায়। এ জন্যই জেহাদরত অবস্থার সালাত, নিরাপদ অবস্থার সালাতের তুলনায় হালকা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ”যখন তোমরা চিন্তামুক্ত হয়ে যাও, সালাত কায়েম কর তথা সমস্ত হক আদায় করে সালাত আদায় করো।” ( সূরা আন-নিসা : ১০৩)
তা সত্ত্বেও ঈমান এর তারতম্যের ভিত্তিতে মানুষেরও হুকুম ভিন্ন হয়ে থাকে। ওমরের জেহাদের চিন্তাসহ সালাত অনেকের চিন্তা বিহীন সালাতের চেয়ে উত্তম। তবুও বলব, ওমরের জেহাদের চিন্তা বিহীন সালাত, জেহাদের চিন্তাসহ সালাতের চেয়ে উত্তম। উপরন্তু ওমর রা. ইমামুল মুসলিমিন ছিলেন, হয়তো তিনি এ ছাড়া সময় পেতেন না। তার ব্যস্ততাও ছিল বেশি। দ্বিতীয়ত: সালাতে এমন কিছু জিনিস মনে পড়ে, যা অন্য সময় মনে পড়ে না। আর এখানেই শয়তানের সুযোগ। জনৈক বুযুর্গের একটি ঘটনা, কেউ তাকে বলেছিলো, আমি কিছু সম্পদ মাটিতে পুতে রেখেছিলাম, কিন্তু এখন তা ভুলে গেছি। তিনি বললেন, তুমি সালাতে দাড়াও, সে সালাতে দাড়ালে ঐ জিনিসের কথা মনে পরে যায়। তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, আপনি কিভাবে জানলেন? তিনি বললেন, আমার ধারণা ছিল, শয়তান তাকে সালাতে একাগ্রতার সুযোগ দিবে না। এ জিনিসটি মনে করে দিয়ে হলেও। কারণ, জিনিস নিয়ে তার কোনো ভাবনা নেই, তার ভাবনা হলো সালাত নিয়ে। মুদ্দা কথা, বুদ্ধিমান নামাজি স্বীয় সালাতে আপ্রাণ চেষ্টা করে একাগ্রতা ধরে রাখার জন্য। সুনিশ্চিত, আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত ইবাদত কিংবা গুনাহ পরিহার কোনটাই সম্ভব নয়। (মাজমুউল ফতওয়া : ২২/৬১০)
পনের : বুযুর্গানে দ্বীনের সালাতের অবস্থা পর্যলোচনা করা।
এর মাধ্যমেও সালাতে একাগ্রতা এবং খুশু সৃষ্টি হয়। ”তোমার যদি সুযোগ হত তাদের দেখার! সালাতে দাড়ানো সাথে সাথে তাদের অন্তরে আল্লাহর সামনে দন্ডায়মান হওয়ার ভাবের উদ্রেক হত, অন্তরে একাগ্রতা চলে আসতো, মস্তিষ্ক হতে সালাত ভিন্ন অন্য সব কিছু উধাও হয়ে যেত।”( الخشوع في الصلاة، ابن رجب ص : ২২.)
মুজাহিদ রহ. বলেন, ”আমাদের আকাবিরগণ সালাতে দাঁড়ালে আল্লাহর ভয়ে শঙ্কিত থাকতেন। কোনো দিকে দৃষ্টি ফিরাতেন না, এদিক সেদিক মাথা ঘুরাতেন না, কোনো জিনিস নিয়ে খেলা করতেন না, কিংবা দুনিয়াবি কোনো জিনিস সালাতে স্থান দিতেন না। তবে ভুলে কিছু ঘটে গেলে তা স্বতন্ত্র ব্যাপার।” تعظيم قدر الصلاة (১/১৮৮)
আলি রা. সম্পর্কে বর্ণিত আছে, ”সালাতের সময় হলে আঁতকে উঠতেন, চেহারা ফেকাশে হয়ে যেত। কেউ জিজ্ঞাসা করল, আপনার কি হয়েছে? বললেন, আমানতের সময় ঘনিয়ে আসছে, যে আমানত আসমান-জমিনের সামনে পেশ করা হলে, তারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে অপারগতা প্রকাশ করে। আর আমি তা গ্রহণ করি”।
সাইদ তানুখি সম্পর্কে কথিত আছে, সালাতে দাঁড়ালে অশ্রুতে দাড়ি ভিজে যেত।
জনৈক তাবেয়ি সম্পর্কে জানা যায়, সালাতে দাঁড়ালে তার রং বিবর্ণ হয়ে যেত, তিনি বলতেন, জান কার সামনে দাঁড়াবো আর কার সাথে কথপোকথন করবো? আফসোস কে আছে আমাদের ভেতর এমন!”
)سلاح اليقظان لطرد الشيطان، عبد العزيز السلمان ص : ২০৯ (
আমের ইবনু আব্দুল কায়েসকে জিজ্ঞসা করা হল, ”সালাতের ভেতর আপনার কোনো জল্পনা কল্পনা হয়? তিনি উত্তর দিলেন, সালাতের চেয়ে প্রিয় কোনো জিনিস আছে?-যার জল্পনা কল্পনা হতে পারে। প্রশ্নকারী বলল, আমাদের তো জল্পনা কল্পনা হয়। তিনি বললেন, কিসের? জান্নাত, তার নেয়ামতরাজি কিংবা এ ধরনের কিছুর? সে বলল, না- আমাদের জল্পনা-কল্পনা হয় ধন-সম্পদ আর সন্তানাদির। তিনি বললেন, এর চেয়ে আমার শরীর বর্মের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া ভাল”।
সাহাবি সা’দ ইবনু মুয়াজ রা. বলেন, আমার ভেতর তিনটি স্বভাব আছে, যদি সর্বদা এগুলো বিদ্যমান থাকতো, তাহলে আমিই আমি হতাম। সালাতে দাড়ালে আমার অন্তর এ ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জবান থেকে কোনো জিনিস শুনলে বিন্দু মাত্র আমার অন্তরে সন্দেহের সৃষ্টি হয় না। জানাযার সালাতে আমি অন্তরে যা বলছি এবং মৃত ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে যা বলা হচ্ছে এ ছাড়া অন্য কিছুর ভাবনা উদ্রেক হয় না। الفتاوى لابن تيمية (২২/৬০৫).
হাতেম রহ. বলেন, ”আল্লাহর নির্দেশ মনে করে সালাতের জন্য প্রস্তুত হই, আল্লাহর ভয়ে ভয়ে মসজিদ পানে চলি, নিয়ত সহকারে সালাত আরাম্ভ করি, আল্লাহর বড়ত্বের কথা চিন্তা করে তাকবিরে তাহরিমা বলি, মনোযোগ ও তারতিলসহ কোরআন তেলাওয়াত করি, একাগ্রতাসহ রুকু করি, নম্রতা নিয়ে সেজদা করি, পরিপূর্ণভাবে তাশাহুদের জন্য বসি, পুনরায় নিয়তসহ সালাম ফিরাই, কবুল না হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে নিজেকে সম্বোধন করি। আমৃত্যু সালাতের আবেদন সংরক্ষণ করতে চেষ্টা করি।
) الخشوع في الصلاة২৭-২৮. (
আবু বকর সবগি রহ. বলেন, ”আমি দুজন বড় ইমাম পেয়েছি, আফসোস তাদের থেকে ইলম অর্জন করতে পারিনি। প্রথমজন আবু হাতেম রাজি আর দ্বিতীয়জন মুহাম্মদ বিন নসর মারওয়াজি। ইবনে নসর এর সালাতের চেয়ে উত্তম সালাত আর কারো দেখিনি। শুনেছি, ভীমরুল তার ললাটে বসে দংশন করে রক্ত বের করে দিয়েছে, তবুও তিনি নড়াচড়া করেননি। মুহাম্মদ বিন ইয়াকুব আখরাম বলেন, মুহাম্মদ বিন নসর এর চেয়ে সুন্দর সালাত আর কারো দেখিনি। মশা তার কানে বসত তবু তিনি নিজের থেকে তা হটাতেন না। আমরা তার সালাতের সৌন্দর্য, একাগ্রতা এবং সালাতের প্রতি তার ভয় ও ভক্তি দেখে আশ্চর্য হতাম। অনেক সময় থুড়ি সিনার উপর রেখে শুষ্ক লাকড়ির ন্যায় দাড়িয়ে থাকতেন।”
)تعظيم قدر الصلاة (১/৫৮).(
”সালাতে দাড়ালে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ.- এর অঙ্গ-প্রতঙ্গগুলোতে কম্পন সৃষ্টি হত, যার ফলে ডান-বামে কাত হয়ে যেতেন।”
الكواكب الدرية في مناقب المجتهد ابن تيمية لمرعي الكرمي ص: ৮৩، دار الغرب الإسلامي.
কোথায় তাদের সালাত আর কোথায় আমাদের সালাত? আমরা কেউ তো সালাতে ঘড়ির প্রতি সৃষ্টি দেই, কেউ কাপড় ঠিক করি, কেউ নাক নিয়ে ব্যস্ত থাকি, কেউ আবার ক্রয়-বিক্রয় নিয়ে। অনেকে সালাতের ভেতরই টাকা-পয়সার হিসাব জুড়ে দেই, কেউ কার্পেট কিংবা মসজিদের শৈল্পিক কারুকার্য নিয়ে মগ্ন থাকি, আর কেউ পাশের লোকের পরিচয় জানতে চেষ্টা করি। আফসোস! এদের কেউ যদি দুনিয়ার বাদশার সামনে দাড়াতো, তাহলেও কি এতটুকু করার সাহস দেখাতো!?
ষোল : একাগ্রতার বৈশিষ্ট্য ও ফজিলত সম্পর্কে জানা।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”যে ব্যক্তি সালাতের সময় হলে সুন্দরভাবে ওজু করে এবং সুন্দরভাবে রুকু-সেজদা ও একাগ্রতাসহ সালাত আদায় করে, তার এ সালাত পূর্বের সকল গুনাহের কাফ্‌ফারা হয়ে যায়। যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো কবিরা গুনায় লিপ্ত না হয়। আর এ সুযোগ জীবন ভর।
( সহিহ মুসলিম : ১/২০৬)
একাগ্রতা ও খুশুর পরিমাণ অনুপাতে সালাতে সাওয়াব অর্জিত হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, বান্দাগণ সালাত আদায় করে কেউ পায় দশভাগ, নয়ভাগ, আটভাগ, সাতভাগ, ছয়ভাগ, পাঁচভাগ, চারভাগ, তিনভাগ আবার কেউ মাত্র অর্ধেক সাওয়াব অর্জন করে।
)رواه الإمام أحمد (৪/৩২১) وهو في صحيح الجامع (১৬২৬).(
যতটুকু মনোযোগ ততটুকু সাওয়াব। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবনে আব্বাস রা.-কে বলেন, সালাতে তুমি যতটুকু মনোযোগ দিবে ততটুকু সাওয়াব অর্জন করবে।
مجموع الفتاوى لابن تيمية (২২/৬১২).
একাগ্রতাসহ পরিপূর্ণভাবে সালাত আদায় করলেই গুনাহ মাফ হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”মানুষ সালাতে দাড়ালে সমস্ত গুনাহ তার মাথায় ও কাঁধে এনে রেখে দেয়া হয়। রুকু-সেজদা করতে থাকে আর তার গুনাহগুলো ঝরে পড়তে থাকে।”
رواه البيهقي في السنن الكبرى (৩/১০) وهو في صحيح الجامع.
মুনাওয়ী রহ. বলেন, যখন কোনো রুকন পূর্ণভাবে আদায় করে তার গুনাহের একটি অংশও ঝরে পড়ে। সালাত শেষ হওয়ার সাথে সাথে গুনাহও শেষ হয়ে যায়। তবে এ ফজিলত ঐ সালাতের জন্য যে সালাতে সমস্ত রুকন যথাযথ আদায় করা হয় এবং একাগ্রতা বিদ্যমান থাকে। কারণ, হাদিসে বর্ণিত ‘আব্‌দ’ এবং ‘কিয়াম’ শব্দ দুটি এ অর্থই প্রদান করে। অর্থাৎ একজন প্রকৃত গোলাম বিনয় নম্রতাসহ মহান পরাক্রমশালী প্রভুর সামনে দন্ডায়মান। (ফয়জুল কাদির : ২/৩৬৮)
একাগ্রতা সম্পন্ন ব্যক্তি সালাত শেষ করে শরীরে প্রসন্নতা অনুভব করে। তার মনে হয় আমার উপর বোঝা রাখা হয়েছিল, এখন যা হটানো হয়েছে। ফলে সে প্রফুল্লতা ও অনাবিল আনন্দ উপলব্ধি করে। এক পর্যায়ে মনে জাগে যদি সালাত হতে বের না হতাম আরো ভাল হত। কারণ, সালাত চোখের শীতলতা, রূহের সজীবতা, অন্তরের নিরাপদ আশ্রয় এবং দুনিয়ার শান্তিময় স্থান। সালাতের বাইরের মুহূর্তগুলো জেলখানা বরং আরো সংকীর্ণ মনে হয়। আসল প্রেমিকগণ বলেন, সালাতের মাধ্যমে আমাকে স্বস্তি দাও, সালাত হতে আমাকে মুক্ত করো না। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, হে বেলাল, সালাতের মাধ্যমে প্রশান্তি দাও। সালাত হতে বলেননি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন, আমার চোখের শীতলতা সালাতের ভেতর। ভাবনার বিষয়, যার পরম শান্তি সালাতের ভেতর সে কিভাবে সালাত ত্যাগ কিংবা সালাত না পড়ে থাকতে পারে!? الوابل الصيب৩৭.
 সতের : সালাতের ভেতর দোয়ার স্থানে খুব দোয়া করা। বিশেষ করে সেজদার ভেতর।
কারণ, আল্লাহর নিকট প্রার্থনা, তার সামনে বিনয়ীভাব, বান্দার একাগ্রতা ও খুশু বাড়িয়ে দেয়। দ্বিতীয়ত: দোয়া হচ্ছে ইবাদত, বান্দা যার জন্য আদিষ্ট। ইরশাদ হচ্ছে ”তোমাদের প্রভুকে আস্তে এবং ক্রন্দন রত অবস্থায় ডাকো।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ” যে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে না, আল্লাহর তার প্রতি অসুন্তুষ্ট।” رواه الترمذي كتاب الدعوات (১/৪২৬) وحسنه في صحيح الترمذي (২৬৮৬).
সালাতের বিভিন্ন স্থানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বিভিন্ন দোয়া প্রমাণিত আছে। যেমন, সেজদা, দুই সেজদার মাঝখানে, তাশাহুদের পরে। তবে সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ স্থান হলো সেজদা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”সেজদাতে বান্দা আল্লাহর অধিক নিকটবর্তী হয়ে যায়। তোমরা এতে বেশি বেশি দোয়া কর।” ( সহিহ মুসলিম : ২১৫)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, ”তোমরা সেজদাতে খুব দোয়া কর। এ দোয়াই কবুল হওয়ার ব্যাপারে বেশি আশা করা যায়। ” ( সহিহ মুসলিম : ২০৭)
সেজদায় পঠিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কতক দোয়া :
১- اللهم اغفرلي ذنبي دقه وجله، وأوله وآخره، وعلانيته وسره.
২- اللهم اغفر لي ماأسررت وما أعلنت.
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ”তোমরা তাশাহুদ শেষ করে আল্লাহর নিকট জাহান্নামের শাস্তি, কবরের আজাব, জীবন-মৃত্যুর ফেৎনা এবং দাজ্জালের ক্ষতি হতে পানাহ চাও।” তিনি নিজেও বলতেন,
اللهم إني أعوذبك من شر ما عملت ومن شر ما لم أعمل.
اللهم حاسبني حسابا يسيرا.
আবু বকর রা. কে বলতে শিক্ষা দিয়েছেন,
اللهم إني ظلمت نفسي ظلما كثيرا، ولا يغفر الذنوب إلا أنت، فاغفرلي مغفرة من عندك، وارحمني إنك أنت الغفور الرحيم.
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিতে তাশাহুদের পর বলতে শুনেছেন,
اللهم إني أسألك يا الله الأحد الصمد الذي لم يلد ولم يولد ولم يكن له كفوا أحد أن تغفرلي ذنوبي إنك أنت الغفور الرحيم،
এর পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে, তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। অপর ব্যক্তিকে বলতে শুনেছেন,
اللهم إني أسألك بأن لك الحمد، لا إله إلا أنت وحدك لا شريك لك، المنان يا بديع السموات والأرض، يا ذا الجلال والإكرام، يا حي يا قيوم، إني أسالك الجنة وأعوذبك من النار.
এর পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের বলেন, তোমরা বলতে পার সে কিসের মাধ্যমে দোয়া করেছে? তারা বলল, আল্লাহ এবং তার রাসূল-ই ভাল জানেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহর শপত! সে ইসমে আজমের মাধ্যমে দোয়া করেছে। যে নাম ধরে আহবান করলে, সাড়া দেয়া হয়। যার উসিলা দিয়ে প্রার্থনা করলে, আশা পূরণ হয়।
التخريج من صفة الصلاة ص: ১৬৩ ط.১১.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ জীবনে তাশাহুদ এবং সালামের মাঝখানে এ দোয়াটি পড়তেন।
اللهم اغفرلي ما قدمت وما أخرت، وما أسررت وما أعلنت، وما أسرفت، وما أنت أعلم به مني، أنت المقدم وأنت المؤخر، لا إله إلا أنت. )التخريج من صفة الصلاة ص: ১৬৩ ط.১১.(
আমাদের মধ্যে অনেকে ইমামের পিছনে তাশাহুদ ও দরূদ পড়ে সালামের অপেক্ষায় চুপ করে বসে থাকি। কি পড়বো তাও জানি না। এ দোয়াগুলো মুখস্থ করে নিলে আর চুপ করে বসে থাকতে হবে না।
আঠার : সালাতের পড়ে বর্ণিত দোয়াগুলো পড়া।
এগুলো পড়লে সালাতের ভেতর যে একাগ্রতা, বরকত ও খুশু অর্জিত হয়েছে, তা বিদ্যমান থাকবে। কারণ, সম্পাদিত ইবাদতের কার্যকারিতা বর্তমান রাখার জন্য পরবর্তী ইবাদত অপরিহার্য। সামান্য চিন্তা করলে বুঝা যায়, যে সালাতের পর সর্বপ্রথম জিকির, তিন বার এস্তেগফার। এর অর্থ সালাতের রুকন ও একাগ্রতায় সে ত্রুটি হয়েছে, তার ক্ষতিপূরণ করা। তদ্রুপ নফল সালাতও বেশি বেশি পড়া। কারণ, এর দ্বারা ফরজের ত্রুটি বিমোচন হয়।
এ পর্যন্ত আমরা সে সব আমল ও বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি, যার দ্বারা সালাতে একাগ্রতা ও খুশু অর্জিত হয়। এখন এমন কিছু বিষয়ের আলোচনা করবো, যা সালাতের একাগ্রতা ও খুশুতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। যেমন,
 ঊনিশ : সালাতের স্থান হতে সে সকল জিনিস দূরীভূত করা, যা সালাতের একাগ্রতায় বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে।
আয়েশা রা. কিরাম তথা কারুকার্য খচিত কিংবা রঙ্গিন এক জাতীয় পর্দার কাপড় দ্বারা ঘরের পার্শ্ব ঢেকে রেখেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এগুলো আমার কাছ থেকে হটাও। কারণ, সালাতের ভেতর এগুলো আমার সামনে বার বার ভেসে উঠে। (বোখারি, ফতহুল বারি :১০/৩৯১)
আরেকটি হাদিসে আছে, ”রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাবা ঘরে সালাত পড়ার জন্য প্রবেশ করেন। সালাত শেষে ওসমান আল-হাজবিকে বলেন, তোমাকে শিং দুটি আচ্ছাদিত করার হুকুম দিতে ভুলে গিয়ে ছিলাম। কাবা ঘরে এমন কোনো জিনিস থাকা উচিত নয়, যা নামাজির একাগ্রতা নষ্ট করে দেয়।” أخرجه أبوداود (২০৩০) وهو في صحيح الجامع (২৫০৪).
নামাজি ব্যক্তির উচিত, মানুষের চলাচলের রাস্তা, শোরগোল এবং হইচই-এর স্থান, আলাপ চারিতায়রত ব্যক্তিদের পার্শ্ব এবং গান-বাজনার স্থান পরিহার করা। এবং সম্ভব হলে প্রচন্ড গরম ও কনকনে শীতের স্থান এড়িয়ে সালাত পড়া। কারণ, এ জন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জোহর সালাত ঠান্ডা আবহাওয়ায় পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। ইবনুল কাইয়িম রহ. বলেন, ”প্রচন্ড গরম নামাজি ব্যক্তির একাগ্রতা ও খুশুতে প্রভাব ফেলে। ফলে সে অপ্রসন্ন ও অনীহাভাব নিয়ে ইবাদত আদায় করে। এ জন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত দেরিতে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। যাতে গরম পড়ে যায় আর নামাজির অন্তরের উপস্থিতি হয়। তবেই সালাতের উদ্দেশ্য তথা খুশু ও আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জিত হবে। )الوابل الصيب ط. دار البيان ص : ২২. (
 বিশ : সালাতের একাগ্রতায় বিঘ্ন ঘটাতে পারে এমন কারুকার্য খচিত, লেখা ও ক্যালিগ্রাফি সম্বলিত, রঙ্গিন ও ছবিযুক্ত কাপড় পরিধান না করা।
আয়েশা রা. বলেন, ”রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি কার্পেটে সালাত আদায় করার সময় তার কারুর্যের প্রতি নজর পড়ে। সালাত শেষ করে বলেন, এ কার্পেটটি আবু জাহাম ইবনে হুজায়ফার নিকট নিয়ে যাও, আমার জন্য একটি আনজাবিয়া তথা কারুকার্যহীন কাপড় নিয়ে আস। এ কার্পেটটি সালাতের ভেতর আমাকে অন্যমনস্ক করে দিয়েছে।”
(সহিহ মুসলিম : ১/৩৯১ হাদিস নং ৫৫৬)
এ থেকেই কারুকার্য খচিত কাপড় বিশেষ করে প্রাণীর ছবিযুক্ত কাপড় পরিহার করার আবশ্যকতা প্রতীয়মান হয়।
 একুশ : খাবারের চাহিদা নিয়ে সালাত না পড়া।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”খানার উপস্থিতিতে কোনো সালাত নেই।” ( সহিহ মুসলিম : ৫৬০)
সুতরাং যখন খানা তৈরী হয়ে যায় এবং সামনে উপস্থিত করা হয়, তখন আগে খানা খেয়ে নেয়া। কারণ, এমতাবস্থায় সালাতে একাগ্রতা আসে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”যখন রাতের খাবার উপস্থিত হয়ে যায়, তখন মাগরিবের আগে খানা খেয়ে নাও। তাড়াহুড়ো করো না। অন্য বর্ণনায় আছে, যখন খানা সামনে চলে আসে আর সালাতেরও সময় হয়ে যায়, তখন আগে খানা খেয়ে নাও। খানা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাড়াহুড়ো করো না।”
)متفق عليه، البخاري كتاب الأذان، باب إذا حضر الطعام وأقيمت الصلاة، وفي مسلم رقم (৫৭৫، ৫৫৯).(
বাইশ : পেশাব পায়খানার বেগ চেপে রেখে সালাত না পড়া।
কারণ, পেশাব পায়খানার বেগ থাকলে সালাতে একাগ্রতা আসবে না। এ জন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন, কেউ পেশাব চেপে রেখে সালাত পড়বে না।”
رواه ابن ماجه في سننه رقم (৬১৭) وهو في صحيح الجامع رقم (৬৮৩২).
যদি সালাতের কিছু অংশ ছুটেও যায়, তবুও প্রাকৃতিক প্রয়োজন সেরে নেয়া। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”তোমাদের কারো বাথরুমের প্রয়োজন মুহূর্তে সালাতের সময় হয়ে গেলে আগে বাথরুম সেরে নিবে।” (আবু দাউদ : ৮৮, সহিহ আল-জামে : ২৯৯)
বরং সালাতের মাঝখানেও পেশাব-পায়খানার বেগ হলে, সালাত ছেড়ে আগে প্রয়োজন সেরে নিবে। অত:পর অজু করে সালাত পড়বে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”খানার উপস্থিতে কোনো সালাত নেই, তদ্রুপ বাথরুম চেপে রেখেও কোন সালাত নেই।”[৮] ( সহিহ মুসলিম : ৫৬০)
কারণ, এর দ্বারা সালাতের একাগ্রতা দূরীভূত হয়ে যায়। স্মর্তব্য বাতকর্ম চেপে রাখাও এর অর্ন্তভুক্ত।
 তেইশ : ঘুমের চাপ নিয়ে সালাত না পড়া।
আনাস বিন মালেক রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”তোমাদের কারো সালাতে তন্দ্রাভাব হলে ঘুমিয়ে নাও। যাতে যা বল তা বুঝতে পার।” (সহিহ মুসলিম : ৫৬০)
অর্থাৎ সুয়ে পড় যাতে ঘুম চলে যায়। আরেকটি বর্ণনায় এসেছে, ”যখন তোমাদের কারো সালাতে তন্দ্রাচ্ছন্নভাব হবে সুয়ে পড়বে। যাতে ঘুম চলে যায়। কারণ, তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় এস্তেগফার করার সময় হয়তো নিজেকে অভিসম্পাত করে বসবে।” ( সহিহ বোখারি : ২০৯)
এ অবস্থা সাধারণত তাহাজ্জুদের সালাতে হয়। তখন দোয়া কবুলের সময় বদ দোয়াও হয়ে যেতে পারে। হ্যাঁ, ফরজ সালাতও এর অর্ন্তভুক্ত, যদি সময় বাকি থাকার নিশ্চয়তা থাকে।
فتح الباري، شرح كتاب الوضوء، باب الوضوء من النوم.
 চব্বিশ : আলাপচারিতায় রত ব্যক্তি কিংবা ঘুমন্ত ব্যক্তিদের পেছনে সালাত পড়বে না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”তোমরা কেউ ঘুমন্ত ব্যক্তি কিংবা আলাপচারিতায় রত ব্যক্তির পেছনে সালাত পড়বে না।”رواه أبو داود رقم (৬৯৪) وهو في صحيح الجامع رقم (৩৭৫) وقال: حديث حسن.
কারণ, আলাপচারিতায় রত ব্যক্তি তার কথপোকথনের দ্বারা নামাজির সালাতে বিঘ্নতা সৃষ্টি করবে। আর ঘুমন্ত ব্যক্তি হতে এমন কিছু প্রকাশ পেতে পারে, যার দ্বারা তার সালাতের একাগ্রতা নষ্ট হবে।
ইমাম খাত্তাবি রহ. বলেন, ”কথপোকথনে মশগুল ব্যক্তিদের পিছনে সালাত পড়া ইমাম শাফি রহ. ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. মাকরূহ বলেছেন। কারণ, তাদের কথপোকথন নামাজি ব্যক্তির সালাতে বিঘ্নতা সৃষ্টি করবে।” (আওনুল মাবুদ : ২/৩৮৮)
তবে, ঘুমন্ত ব্যক্তির পিছনে সালাত না পড়ার দলিলগুলোকে অনেক ওলামায়ে কেরাম দুর্বল বলেছেন।
منهم أبوداود في سننه كتاب الصلاة، تفريع أبواب الوتر : باب الدعاء، وابن حجر في فتح الباري شرح باب الصلاة خلف النائم، كتاب الصلاة.
ইমাম বোখারি রহ. তার সহিহ বোখারিতে একটি অধ্যায় কায়েম করেছেন, ‘বাবুস সালাতি খালফান্নায়েম’ তথা ঘুগন্ত ব্যক্তির পিছনে সালাত পড়ার অধ্যায় নামে। সেখানে তিনি আয়েশা রা. এর হাদিস উল্লেখ করেন, ”রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত পড়তেন, আর আমি তার সামনে বিছানায় বরাবর শুয়ে থাকতাম।” صحيح البخاري، كتاب الصلاة.
ইমাম মালেক, মুজাহেদ, তাউস রহ. প্রমুখ ঘুমন্ত ব্যক্তির পিছনে সালাত পড়াকে মাকরূহ বলেছেন। কারণ, ঘুমন্ত ব্যক্তি হতে এমন কিছু প্রকাশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা নামাজিকে অন্যমনস্ক করে দিতে পারে। فتح الباري، كتاب الصلاة.
পঁচিশ : সেজদার জায়গা হতে ধুলো-বালি কিংবা পাথর কুচি হটাতে ব্যস্ত না হয়ে যাওয়া।
বোখারি রহ. মুআইকিব রা. হতে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেজদার জায়গা হতে ধুলো বালি হটানো ব্যক্তিকে বলেছেন, ”যদি তোমার একান্ত প্রয়োজন হয়, তাহলে একবার।” (ফতহুল বারি : ৩/৭৯)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন, ”সালাত রত অবস্থায় সেজদার জায়গা মুছবে না। একান্ত প্রয়োজন হলে একবার।” رواه أبو داود رقم (৯৪৬) وهو في صحيح الجامع رقم (৭৪৫২).
এর কারণ হলো সালাতের একাগ্রতা বজায় রাখা, যাতে এর ভেতর অন্য কোনো কাজ প্রাধান্য না পায়। বরং সবচে’ উত্তম হলো সালাতের পূর্বেই সেজদার স্থান পরিস্কার করে নেয়া।
সালাতের ভেতর কপাল কিংবা নাক মোছাও এর অর্ন্তভুক্ত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাটির উপর, পানির উপর সেজদা করেছেন। সালাত শেষে তার লক্ষণও দেখা গেছে। তিনি প্রত্যেকবার উঠাবসায় মাটি-পানি কিছুই পরিস্কার করেননি। সালাতের একাগ্রতা এসব জিনিস ভুলিয়ে দেয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো বলেছেন-ই ”সালাতের কঠিন ব্যস্ততা রয়েছে।” (বোখারি : ফতহুল বারি : ৩/৭২)
মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বাতে আছে, সাহাবি আবু দারদার বলেন, ”আরবের নিকট সর্বাধিক প্রিয় সম্পদ, লাল উটের বিনিময়েও আমি সেজদার জায়গা হতে ধুলো বালি মোছা পছন্দ করি না।” ইয়াজ রহ. বলেন, ”আকাবেরগণ সালাত থেকে ফারেগ হওয়ার আগে কপাল মুছা মাকরূহ বলেছেন।” (ফতহুল বারি : ৩/৭৯)
 ছাব্বিশ : সূরা-কেরাত উচ্চস্বরে পড়ে অন্যদের সালাতে ব্যাঘাত সৃষ্টি না করা।
মুসল্লিদের নিজ সালাতের প্রতি যেমন যত্নবান থাকা জরুরি, তদ্রুপ অন্যদের সালাতে বিঘ্ন সৃষ্টি হতে পারে এমন কাজ করাও নিষিদ্ধ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”স্মরণ রেখ! তোমরা সকলেই আল্লাহর সাথে কথপোকথন কর। অতএব কেউ কাউকে কষ্ট দিবে না। অপরের চেয়ে উচ্চ আওয়াজেও পড়বে না।” অপর এক বর্ণনাতে আছে, ”একে অপরের চেয়ে জোর কন্ঠে তেলাওয়াত করবে না।” (ইমাম আহমদ : ২/৩৬, সহিহ আল-জামে : ১৯৫১)
একটি বর্ণনাতে আছে, ”এ হুকুমটি সালাতে।” (আবু দাউদ : ২/৮৩, সহিহ আল-জামে : ৭৫২)
 সাতাইশ : সালাতে এদিক সেদিক না তাকানো।
আবু জর রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ” (নামাজি) বান্দা যতক্ষণ পর্যন্ত এদিক সেদিক না তাকায়, আল্লাহ তার প্রতি মনোনিবেশন করে থাকেন। যখন এদিক সেদিক তাকায় আল্লাহ দৃষ্টি হটিয়ে নেন।” (আবু দাউদ : ৯০৯, হাদিসটি সহিহ)
সালাতের ভেতর ইলতেফাত তথা এদিক সেদিক তাকানো দু’ধরণের : অন্তরের ইলতেফাত, চোখের ইলতেফাত। উভয় ইলতেফাত নিষিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এলতেফাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তিনি বলেন, ”এ হলো কেড়ে নেয়া, এর মাধ্যমে শয়তান বান্দার সালাতের সাওয়াব কেড়ে নেয়।” رواه البخاري، كتاب الأذان، باب: الالتفات في الصلاة.
এলতেফাতের একটি উদাহরণ : কোনো ব্যক্তিকে বাদশাহ ডেকে এনে সামনে রেখে কথপোকথন করছে আর সে বাদশাহকে এড়িয়ে ডান-বামে তাকাচ্ছে। যার কারণে সে বাদশাহর কোনো কথাই বুঝতে পারেনি। কারণ, তার অন্তর এখানে উপস্থিত ছিল না। আপনার কি ধারণা- বাদশাহ এ ব্যক্তিকে কি করবে? কমপক্ষে স্বীয় দরবার হতে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে না?-অবশ্যই দিবে। এর বিপরীতে যে ব্যক্তি সর্বাঙ্গীন একাগ্রতা নিয়ে আল্লাহর সমীপে দন্ডায়মান। আল্লাহর প্রতিটি বাক্যে সে ধ্যান দিচ্ছে, তার বড়ত্ব ও মহব্বতে অন্তর ভরে আছে, ডানে-বামে তাকাতে লজ্জাবোধ করছে। এ দুজনের সালাতের ভেতর পার্থক্যের তুলনায় হাস্‌সান ইবনে আতিয়ার উক্তিই প্রযোজ্য। তিনি বলেন, একই সাথে দু’জন ব্যক্তি সালাত পড়ে, অথচ দু’জনের সালাতের মাঝখানে আসমান-জমিন র্পাথক্য। একজন আল্লাহর প্রতি মনোযোগী, অপরজন অন্যমনস্ক। الوابل الصيب، ص: ৩৬ ط. دار البيان.
তবে প্রয়োজনের ক্ষেত্রে ডান-বামে তাকানো কোনো দোষের নয়: ইমাম আবু দাউদ রহ. সাহাবি হানজালিয়া রা. হতে বর্ণনা করেন, ”রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুনাইন যুদ্ধের প্রাক্কালে সাহাবি আনাস বিন আবু মারসাদ আল-গানাবিকে পাহারাদারির জন্য গিরিপথে নিয়োজিত করেছিলেন, ভোরে ফজরের দু’রাকাত সুন্নত পড়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, আবু মারসিদের কোনো খবর আছে কি? তারা বলল, না-আমরা কোনো খবর পায়নি। একামত দেয়া হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত পড়াতে পড়াতে পাহাড়ের গিরিপথের পানে তাকাতে ছিলেন।” ( একটি দীর্ঘ হাদিসের সংক্ষিপ্ত রূপ : আবু দাউদ : ২১৪০)
প্রয়োজনের স্বার্থে এলতেফাতের আরো উদাহরণ : ”উমামা বিনতে আবিল আসকে সালাতে কোলে তুলে নেওয়া। আয়েশা রা.-কে দরজা খুলে দেয়া। শেখানোর উদ্দেশ্যে মিম্বারে চড়ে সালাত পড়া আবার নেমে যাওয়া। সূর্য গ্রহণের সালাতের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পেছনে হটে আসা। সালাতে বিঘ্নতা সৃষ্টির সময় শয়তানের গলা চেপে ধরা। সালাতের ভেতর সাপ মারার নির্দেশ প্রদান করা। সালাতের সামনে দিয়ে চলন্ত ব্যক্তিকে বাধা প্রদান করা, প্রয়োজনে তার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া। সালাতের ভেতর নারীদের হাতে হাত মারা এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইশারা করা। এ ধরনের আরো কিছু কাজ আছে যা প্রয়োজনে করা হলে একাগ্রতার প্রতিবন্ধক হিসাবে বিবেচনা করা হয় না। তবে এগুলোই প্রয়োজন ব্যতীত করা হলে একাগ্রতার প্রতিবন্ধক বলে বিচেচিত হবে।” (মাজমুউল ফাতাওয়া : ২২/৫৫৯)
আঠাইশ : আকাশের দিকে চোখ তুলে না তাকানো।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”তোমরা কেউ সালাতের মধ্যে আসমানের দিকে চোখ তুলে তাকাবে না। দৃষ্টি হরণ করে নেয়া হতে পারে।” (আহমদ : ১৫০৯৮, ২১৪৭৮, নাসায়ী : ১১৮১, সহিহ আল-জামে : ৭৬২)
অন্য বর্ণনায় আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ”মানুষের কি হলো ?-তারা কেন সালাতে আসমানের দিকে দৃষ্টি দেয় ? আরেকটি বর্ণনায় আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতে দোয়ার সময় আসমানের দিকে দৃষ্টি দিতে নিষেধ করেছেন।” (সহিহ মুসলিম : ৪২৯)
আরো কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ”তোমরা হয়তো এ থেকে বিরত থাকবে, অন্যথায় তোমাদের দৃষ্টি ছিনিয়ে নেয়া হবে।”
رواه البخاري في صحيحه كتاب الأذان، باب رفع البصر إلى السماء في الصلاة، وراه الإمام أحمد (৫/২৫৮)
ঊনত্রিশ : সালাতে সম্মুখ পানে থুতু নিক্ষেপ না করা।
এটি আল্লাহর সাথে আদব এবং সালাতের একাগ্রতা উভয়ের বিপরীত।
”রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ”তোমাদের কেউ সালাতের সময় সামনের দিকে থুতু নিক্ষেপ করবে না। কারণ, সালাতের সময় আল্লাহ তাআলা তার সামনে বিদ্যমান থাকেন।” (সহিহ বোখারি : ৩৯৭)
তিনি আরো বলেন, ”তোমাদের কেউ সালাতে দাড়িয়ে সামনের দিকে থুতু নিক্ষেপ করবে না। কারণ সে সালাতরত অবস্থায় আল্লাহর সাথে কথপোকথনে লিপ্ত থাকে। ডান দিকেও না, সেদিকে ফেরেশতা থাকে। বরং বাম দিকে কিংবা পায়ের নিচে নিক্ষেপ করে মাটি চাপা দিবে।” ( সহিহ বোখারি : ১৪১৬/৫১২)
বোখারির আরেকটি হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ”যে সালাতে দাড়ায় সে মূলত: আল্লাহর সাথে কথপোকথন করে। আল্লাহ কেবলা এবং তার মাঝখানেই থাকেন। সুতরাং কেবলার দিকে কেউ থুতু নিক্ষেপ করবে না। করলে বাম দিকে অথবা পায়ের নিচে।” ( সহিহ বোখারি : ১৪১৭/৫১৩)
বর্তমান সময়ে যেহেতু সব মসজিদই মোজাইক, টাইলস কিংবা কার্পেডিং করা থাকে, তাই প্রয়োজন হলে সাথে রুমাল রাখবে এবং তাতে থুতু রেখে পকেটে ভরে রাখবে।
ত্রিশ : হাই তোলা যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ করা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”সালাতে কারো হাই আসলে, যথাসম্ভব প্রতিরোধ করবে। কারণ, (হাইর মাধ্যমে) শয়তান ভেতরে প্রবেশ করে।” ( সহিহ মুসলিম : ৪/২২৯৩)
যার মাধ্যমে সে একাগ্রতা ভঙ্গের সুযোগ আরো বেশী পায়। আর নামাজির হাই তোলা দেখে তার খুশি হওয়া তো আছেই।
 একত্রিশ : কোমরে হাত রেখে না দাঁড়ানো।
সাহাবি আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, ”রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতের ভেতর কোমরে হাত রেখে দাঁড়াতে নিষেধ করেছেন।”
رواه أبوداود رقم (৯৪৭)، والحديث في صحيح البخاري كتاب العمل في الصلاة، باب الخصر في الصلاة.
জিয়াদ ইবনু সবিহ আল-হানাফি বলেন, ”আমি ইবনে ওমরের পাশে কোমরে হাত রেখে সালাত পড়লে তিনি আমার হাতে আঘাত করেন। সালাত শেষ করে বলেন, সালাতের ভেতর এভাবে কোমরে হাত বেধে দাড়াও?-অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটি নিষেধ করেছেন।”
رواه الإمام أحمد (২/১০৬) وغيره، وصححه الحافظ العراقي في تخريج الإحياء، انظر: الإرواء (২/৯৪).
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে সরাসরি শ্রুত আরেকটি হাদিসে আছে, ”মাজায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে জাহান্নামিরা স্বস্তির নিশ্বাস নিবে। আল্লাহ তোমার কাছে এর থেকে পানাহ চাই”
رواه البيهقي عن أبي هريرة مرفوعا. قال العراقي: ظاهرإسناده الصحة.
 বত্রিশ : সালাতের ভেতর কাপড় ঝুলিয়ে না রাখা।
”রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতের ভেতর কাপড় ঝুলিয়ে রাখতে নিষেধ করেছেন, মুখ বন্ধ রাখতেও।”
رواه أبوداود رقم (৬৪৩) وهو في صحيح الجامع (৬৮৮৩) وقال: حديث حسن.
খাত্তাবি বলেছেন, ”সাদ্‌ল তথা কাপড় ঝুলানোর অর্থ হলো, শরীর থেকে মাটি পর্যন্ত কাপড় ঝুলিয়ে রাখা।” (আউনুল মাবুদ : ২/৩৪৭)
মিরকাত গ্রন্থে আছে, ”সাদ্‌ল তথা সালাতে কাপড় ঝুলানো সর্বাবস্থায় নিষেধ। কারণ, এগুলো অহংকারের আলামত- যা সালাতের ভেতর আরো নিন্দনীয়। নেহায়া গ্রন্থের লেখক বলেছেন, সাদ্‌ল এর আকৃতি হলো, কাপড়ের দু’আচল দ্বারা পৃষ্ঠদেশ ও বক্ষদেশ আবৃত করে আচলদ্বয় ডান কাঁধ ও বাম কাঁধের উপর দিয়ে পিছনে নিক্ষেপ করা। রুকু-সেজদার জন্য এর ভেতর থেকে হাত বের করা। কেউ কেউ বলেছেন, এমনটি ইহুদিরা করত। অনেকে বলেছেন, সাদ্‌ল হলো, মাথা অথবা কাঁধের উপর কাপড় রেখে বক্ষদেশ কিংবা বাহুদ্বয়ের উপর দিয়ে দু’আচল নিচে ছেড়ে দেয়া। যার কারণে সম্পূর্ণ সালাত-ই শেষ হয় কাপড় দুরস্ত করতে করতে। এ অর্থহীন নড়াচড়াই সালাতের একাগ্রতা ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর বিপরীতে কাপড় বাধা থাকলে এ সমস্যাটি হয় না। বর্তমান যুগে কিছু কাপড় লক্ষ্য করা যায় (যেমন মরক্কোর আবাকাবা, এশিয়ার চাদর-শাল, সৌদিদের রুমাল) এমনভাবে তৈরি ও পরিধান করা হয়, যা দুরস্ত করতে করতে সালাত শেষ হয়ে যায়। এগুলো পরিত্যহ্য। অথবা এমনভাবে পরিধান করা যাতে সালাতে কোনো ধরনের সমস্যার সৃষ্টি না হয়। মুখ ঢাকার কারণ সর্ম্পকে ওলামাগণ বলেছেন, এর কারণে ভাল করে কেরাত পড়া কিংবা পরিপূর্ণভাবে সেজদা আদায় করা যায় না। তাই মুখ ঢাকাও নিষেধ।” (মিরকাতুল মাফাতিহ : ২/২৩৬)
 তেত্রিশ : আল্লাহ তাআলা বনি আদমকে সুন্দর আকৃতি ও সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রদান করেছেন। তাই এদের চাল-চলন ও উঠা-বসায় জীব-জানোয়ারের আকৃতি ও সাদৃশ্য ধারন করা দোষনীয়। বিশেষ করে সালাতের ভেতর।
এ জন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতে একাগ্রতার প্রতিবন্ধক কিংবা অপছন্দনীয় হালাত হতে নিষেধ করেছেন। বর্ণিত আছে, ”রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতের ভেতর তিনটি জিনিস হতে নিষেধ করেছেন : কাকের মত ঠোকর, চতুষ্পদ জানোয়ারের ন্যায় বসা ও উটের ন্যায় একই জায়গা নির্দারণ করা।” (আহমদ : ৩/৪২৮)
এর অর্থ হলো : ”মসজিদের কোনো একটি অংশ সালাতের জন্য নির্দারণ করে নেয়া, অন্য কোথাও না বসা। যেমন উটের অভ্যাস।”الفتح الرباني (৪/৯১).
আরেকটি বর্ণনায় আছে, ”রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মোরগের মত ঠোকর, কুকরের মত বসা এবং শিয়ালের ন্যায় এদিক সেদিক তাকাতে নিষেধ করেছেন।”
رواه الإمام أحمد (২/৩১১) وهو في صحيح الترغيب رقم (৫৫৬).
যেমন কুকুর দু’পা বিছিয়ে, দু’হাত দাড় করে নিতম্বের উপর বসে, তদ্রুপ বসতে নিষেধ করেছেন। অর্থাৎ দু’সেজদার মাঝখানে নামাজির পায়ের গোড়ালি দাড় করে তার উপর নিতম্ব রেখে উভয় হাত দিয়ে হাটু চেপে ধরে সামনের দিকে ঝুকে বসা।”
هذا تفسير الفقهاء، وأهل اللغة فالإقعاء عندهم أن يلصق الرجل أليتيه بالأرض وينصب ساقيه ويتساند إلى ظهره وفي الحديث (أنه صلى الله عليه وسلم أكل مقعيا)، مختار الصحاح، المادة : ق-ع- ا، للشيخ زين الدين محمد بن أبي بكر عبد الله القادر الرازي.
খুশু সালাতের প্রাণ, আর সালাত মহান আল্লাহর অন্যতম ইবাদত, খুশু বিহীন সালাত প্রাণহীন দেহের মত। সুতরাং আমাদের সালাতকে অর্থবহ ও মহান আল্লাহর দরবারে গ্রহনযোগ্য করতে হলে খুশু সহ সালাত আদায়ের বিকল্প নাই। সম্মানিত পাঠক সেই খুশু কিভাবে আমাদের সালাতে আসতে পারে সে বিষয়ে কিঞ্চিত ফর্মুলা আপনাদের সমিপে উপস্থাপন করা হল। আপনারা উপকৃত হলেই আমাদের শ্রম স্বার্থক বলে আমরা ধরে নিব। মহান আল্লাহ ভুল-ত্রুটি মার্জনা করে আমাদের এই সামন্য খেদমতটুকু কবুল করে নিন। এবং খুশুর সাথে সালাত আদায়ের তাওফিক দান করুন। আমিন।

No comments:

Post a Comment

প্রশ্ন: সুদী ব্যাংকে চাকুরী করার বিধান সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার কারণে যদি কেউ সারা জীবন সুদী ব্যাংকে চাকুরী করে তাহলে চাকুরী থেকে অব্যহতি নেয়ার পর তার জন্য করণীয় কি?

প্রশ্ন: সুদী ব্যাংকে চাকুরী করার বিধান সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার কারণে যদি কেউ সারা জীবন সুদী ব্যাংকে চাকুরী করে তাহলে চাকুরী থেকে অব্যহতি নেয়...