নিফাক বা মুনাফিকী কাকে বলে এবং পরিণতি কি?
নিফাকের সংজ্ঞা:
নিফাকের আভিধানিক অর্থ:
(نفق) নূন, ফা ও কাফ বর্ণগুলোর সমন্বয়ে গঠিত শব্দটি অভিধানে দুটি
মৌলিক ও বিশুদ্ধে অর্থে ব্যবহার হয়। প্রথম অর্থ দ্বারা কোন কিছু বন্ধ হয়ে
যাওয়া ও দূরীভূত হওয়াকে বুঝায় আর দ্বিতীয় অর্থ দ্বারা কোন কিছুকে গোপন
করা ও আড়াল করাকে বুঝায়।
নিফাক শব্দটি ‘নাফাক’ শব্দ হতে নির্গত। ‘নাফাক’ অর্থ, জমির অভ্যন্তরে
বা ভূ-গর্ভের গর্ত যে গর্তে লুকানো যায়, গোপন থাকা যায়। আর নিফাককে নিফাক
বলে নাম রাখা হয়েছে, কারণ মুনাফিকরা তাদের অন্তরে কুফরকে লুকিয়ে রাখে বা
গোপন করে।[1]
ইবনে জুরাইজ রহ. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, মুনাফেক বলা হয়, যার কথা তার
কাজের বিপরীত, সে যা প্রকাশ করে অন্তর তার বিপরীত, তার অভ্যন্তর বাহির হতে
সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং তার প্রকাশ ভঙ্গি বাস্তবতার সাথে সাংঘর্ষিক।[2]
নিফাকের প্রকার:
নিফাক দুই প্রকার: এক. বড় নিফাক দুই. ছোট নিফাক।
ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন, নিফাক কুফরের মতই। বড় নিফাক ও ছোট
নিফাক। এ কারণেই অধিকাংশ সময়ে বলা হয়ে থাকে, কোন কুফর আছে যা মানুষকে
ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয় আবার কোন কুফর আছে যা মানুষকে ইসলাম থেকে খারিজ
করে না। অনুরূপভাবে নিফাকও দু ধরনের; কিছু আছে যা মানুষকে ইসলাম থেকে খারিজ
করে দেয়, তাকে বলা হয়, নিফাকে আকবর বা বড় নিফাক। আর কিছু আছে তা
মানুষকে ইসলাম থেকে খারিজ করে না, তাকে বলা হয় নিফাকে আসগর বা ছোট
নিফাক।[3]
এক. বড় নিফাক এর সংজ্ঞা:
বড় নিফাক বা নিফাকে আকবর হল, মুখে ঈমান ও ইসলামকে প্রকাশ করা আর
অন্তরে কুফরকে গোপন রাখা। রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর যুগে
এ প্রকারের নিফাকই ছিল। কুরআনে করীম এ প্রকারের মুনাফিকদের কাফের বলে
আখ্যায়িত করে এবং তাদের নিন্দা করেন। আল্লাহ তা‘আলা জানিয়ে দেন যে, এ
ধরনের মুনাফেক জাহান্নামের একেবারেই নীচের স্তরে অবস্থান করবে এবং তারা চির
জাহান্নামী হবে। তারা কখনোই জাহান্নাম থেকে বের হতে পারবে না।
আল্লামা ইবনে রজব রহ. বলেন, নিফাকে আকবর হল, একজন মানুষ আল্লাহ, তার
ফেরেশতা ও রাসূলগণ, আখিরাত দিবস এবং আসমানি কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান প্রকাশ
করা আর অন্তরে উল্লিখিত বিষয় সমূহের প্রতিটির প্রতি ঈমানের পরিপন্থী অথবা
যে একটির প্রতি ঈমানের পরিপন্থী বিষয়কে গোপন করা।[4]
ফিকহবিদগণ মুনাফিকদের ক্ষেত্রে যিন্দীক শব্দটিও ব্যবহার করে থাকেন। তারা মুনাফিকদের যিন্দীক বলে আখ্যায়িত করেন।
আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রহ. বলেন, “যিন্দীকের দল, তারা হল, যারা ইসলাম ও
রাসূলদের আনুগত্য প্রকাশ করে এবং কুফর, শিরক, আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি
বিদ্বেষকে গোপন করে। তারা অবশ্যই মুনাফেক এবং তারা জাহান্নামের সর্ব নিম্নে
অবস্থান করবে। আর তাতেই তারা চিরকাল অবস্থান করবে”। [5]
দুই. নিফাকে আমলী বা ছোট নিফাক:
নিফাকে আমলী বা ছোট নিফাকে লিপ্ত হল তারা, যাদের অন্তরে আল্লাহর উপর
বিশ্বাস আছে এবং তাদের আক্বীদা সঠিক, তবে গোপনে দীনি আমলসমূহের উপর আমল
করাকে ছেড়ে দেয়, আর প্রকাশ করে যে, সে আমল করে যাচ্ছে। এ ধরনের নিফাককে
নিফাকে আমলী বা ছোট নিফাক বলে।
আল্লামা ইবনে রজব রহ. বলেন, “নিফাকে আসগর বা ছোট নিফাক হল, আমলের
নিফাক। অর্থাৎ, কোন মানুষ নিজেকে নেক-কার বলে প্রকাশ করা আর অন্তরে এর
পরিপন্থী বিষয়কে গোপন করা”।[6]
একজন মুসলিমের অন্তরে সে ঈমানদার হওয়া সত্ত্বেও নিফাকে আসগর বা ছোট
নিফাক একত্র হতে পারে। তাতে তার ঈমান নষ্ট হবে না। যদিও এটি কবিরা
গুনাহসমূহের অন্যতম কবিরা গুনাহ। কিন্তু নিফাকে আকবর বা বড় নিফাক ঈমানের
সাথে একত্র হতে পারে না। কারণ, এটি ঈমানের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তাই কোন
বান্দা যখন আল্লাহর উপর ঈমান আনে, তার মধ্যে নিফাকে আকবর থাকতে পারে না।
কিন্তু যখন কোন মানুষের অন্তরে নিফাকে আসগর প্রগাঢ় ও মজবুত হয়ে
গেঁথে বসে, তখন তা কখনো বান্দাকে বড় নিফাকের দিকে নিয়ে যায় এবং তাকে
দ্বীন থেকে পরিপূর্ণ রূপে বের দেয়। ফলে সে ঈমান হারা হয়ে মারা যাওয়ার
আশংকা থাকে। এ জন্য নিফাকে আমলীকে কখনোই খাট করে দেখার অবকাশ নাই।
হে পাঠক বন্ধুরা! তুমি যদি তোমার মধ্যে নিফাকের কোন গুণ বা চরিত্র
দেখতে পাও বা অনুভব কর, তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তা তুমি বর্জন
কর। অন্যথায় দিন দিন তা তোমার মধ্যে আরো বেড়ে যাবে। আর যখন তুমি তোমার
মধ্যে নিফাকের গুণকে বাড়তে দিবে, সে তোমাকে ধীরে ধীরে কুফরের দিকে
পৌঁছাবে। তখন তোমার পরিণতি যে কত ভয়াবহ হবে তা তুমি নিজেই বুঝতে পার।
আল্লাহ আমাদের সকলকে হেফাযত করুন। আমীন।
আর নিফাকে আমলী বান্দাকে চির জাহান্নামী করে না বরং, তার বিধান
অন্যান্য কবিরা গুনাহ কারীর মতই। আল্লাহ চাইলে তাকে ক্ষমা করে দিয়ে
জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, আর যদি তিনি চান তাকে তার গুনাহের কারণে শাস্তি
দিবেন। তারপর তার ঠিকানা হবে জান্নাত। এ গুনাহের থেকে মাপ পাওয়ার জন্য
তাকে অবশ্যই খালেস তওবা করতে হবে।
দ্বীনের মধ্যে নিফাকের ধরন:
দ্বীনের বিষয়ে মুনাফেকি দুই ধরনের হতে পারে এক- মৌলিক, দুই- আকস্মিক সংঘটিত।
মৌলিক নিফাক দ্বারা উদ্দেশ্য হল, যে নিফাকের পূর্বে সত্যিকার ইসলাম
ছিল না বা ইসলাম অতিবাহিত হয়নি। অনেক মানুষ আছে যারা দুনিয়ার ফায়দা লাভ ও
পার্থিব স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে নিজেকে মুসলিম বলে আখ্যায়িত করে,
মূলত: সে তার জীবনের শুরুতেই অন্তর থেকে ইসলামকে গ্রহণ করেনি ও আল্লাহর উপর
ঈমান আনয়ন করেনি, সুতরাং এ লোকটি তার জীবনের শুরু থেকেই একজন খাঁটি
মুনাফিক, যদিও সে মুখে ইসলাম প্রকাশ করে বা মুসলিম সমাজে বসবাস করে। আবার
অনেক লোক এমন আছে যারা সত্যিকার অর্থে মুসলিম, ঈমানে তারা সত্যবাদী। কিন্তু
বিভিন্ন ধরনের বিপদ-আপদ ও মুসিবত যদ্বারা আল্লাহ তা‘আলা তাদের ঈমানের
পরীক্ষা নিয়ে থাকে, তাতে তারা সফলকাম হতে পারেনি এবং ঈমানের উপর অটল থাকতে
পারেনি। ফলে তাদের অন্তরে ইসলামের সন্দেহ- সংশয় সৃষ্টি হয় এবং তারা
ইসলাম হতে মুরতাদ হয়ে যায়। তাদের উপর মুরতাদের বিধান প্রয়োগ করা
হবে। আবার অনেক মানুষ আছে তারা দুনিয়ার কোন সুবিধা যা মুসলিম থাকলে লাভ
করত, তা হতে বঞ্চিত হবে, এ আশংকায় সে তার মুরতাদ হওয়াকে গোপন রাখে। আর
মুসলিম সমাজেই মুসলমানের নামে বসবাস করে। সে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেয় না যে
আমি মুরতাদ। বরং যখন কোন সুযোগ পায়, তখন ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে
বিষোদাগার করে এবং বিদ্বেষ ছড়ায়। এ ধরনের মুনাফেক আমাদের সমাজে অনেক
রয়েছে। তারা ইঁদুরের মত মুসলমানদের সমাজে আত্ম গোপন করে আছে। যখনই সুযোগ
পায় ইসলাম ও মুসলিমদের ক্ষতি করতে কার্পণ্য করে না। আর সব সময় তারা
সুযোগের অপেক্ষায় থাকে।
একজন মুসলিম যখন কোন মুসলিম সমাজে বসবাস করে তারপর যখন সে মুরতাদ হয়ে
যায়, তাকে অবশ্যই দুর্নামের ভাগি হতে হবে এবং সামাজিক মর্যাদা হারাতে
হবে। এ কথা আমাদের কারোই অজানা নয়। আমাদের সমাজে এ ধরনের মুনাফেক অসংখ্য।
যারা বাস্তবে ইসলামের অনুশাসনে বিশ্বাস করে না এবং আল্লাহর উপর ঈমান আনে
না। কিন্তু তারা সমাজে নিজেদের মুসলিম বলে প্রকাশ করে এবং মুসলিম হওয়ার
সুবিধাও ভোগ করে, অপর দিকে বিজাতিদের সাথে তাল মিলিয়ে তাদের থেকেও সুবিধা
নেয়। তারা ইসলামের শত্রুদের দালালি করে। মুসলিম সমাজে বসবাস করে মুসলিমদের
কিভাবে ক্ষতি করবে এ চিন্তায় তারা বিভোর থাকে।
নিফাক থেকে ভয় করা:
হে মুসলিম ভাইয়েরা! নিফাককে কঠিন ভয় করতে হবে। আমরা যাতে আমাদের
মনের অজান্তে নেফাকের মধ্যে নিপতিত না হই সেদিকে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে।
মনে রাখতে হবে নিফাক অত্যন্ত খারাপ গুণ যা একজন মানুষের সামাজিক মর্যাদা
থেকে নিয়ে সব কিছুকেই ধ্বংস করে দেয়। মানুষের দুনিয়া ও আখিরাত উভয়
জাহানকে ধ্বংস করে দেয়। সমাজে সে ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়।
সাহাবীরা এবং তাদের পর সালফে সালেহীনরা নিফাককে কঠিন ভয় করতেন। এমনকি
আবু দারদা রা. হতে বর্ণিত, তিনি যখন সালাতে তাশাহহুদ পড়ে শেষ করতেন, তখন
তিনি আল্লাহর নিকট নিফাক হতে পরিত্রাণ কামনা করতেন এবং তিনি বেশি বেশি
আশ্রয় প্রার্থনা করত। তার অবস্থা দেখে একজন সাহাবী তাকে জিজ্ঞাসা করলেন,
«ومالك يا أبا الدرداء أنت والنفاق؟، فقال دعنا عنك، فو الله إن الرجل ليقلب عن دينه في الساعة الواحدة فيُخلع منه»
অর্থ, কি ব্যাপার হে আবু দারদা! তুমি নিফাককে এত ভয় কর কেন? তখন সে
বলল, আমাকে আপন অবস্থায় থাকতে দাও। আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, একজন লোক
মুহূর্তের মধ্যেই তার দ্বীনকে পরিবর্তন করে ফেলতে পারে। ফলে সে দ্বীন হতে
বের হয়ে যায়।[7]
বড় বড় সাহাবীরাও নিফাককে ভয় করত। হানযালা রা. এর নিফাককে ভয় করার ঘটনা আমাদের নিকট সুপ্রসিদ্ধ। তিনি নিজেই তার ঘটনার বর্ণনা দেন।
অর্থ, হানযালা রা. হতে বর্ণিত একদিন আবু বকর রা. এর সাথে
আমার সাক্ষাত হলে, সে আমাকে বলে, হে হানযালা তুমি কেমন আছ? আমি উত্তরে
তাকে বললাম, হানযালা মুনাফেক হয়ে গেছে! আমার কথা শুনে আবু বকর রা. বলল,
সুবহানাল্লাহ! তুমি কি বল? তখন আমি বললাম, আমরা যখন রাসূল [সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর দরবারে থাকি রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম] আমাদের জান্নাত ও জাহান্নামের কথা আলোচনা করে তখন আমরা যেন
জান্নাত ও জাহান্নামকে দেখতে পাই। আর যখন আমরা রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম] এর দরবার থেকে বের হয়ে আসি এবং স্ত্রী, সন্তান ও দুনিয়াবি
কাজে লিপ্ত হই, তখন আমরা অনেক কিছুই ভুলে যাই। তখন আবু বকর রা. বলল,
আল্লাহর শপথ করে বলছি! আমাদের অবস্থাও তোমার মতই। তারপর আমি ও আবু বকর
উভয়ে রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর দরবারে উপস্থিত হয়ে তার
নিকট প্রবেশ করি এবং বলি হে আল্লাহর রাসূল! হানজালা মুনাফেক হয়ে গেছে!
রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] বলল, তা কিভাবে? আমি বললাম হে
আল্লাহর রাসূল! আমরা যখন আপনার দরবারে উপস্থিত থাকি তখন আপনি আমাদের
জান্নাত জাহান্নামের আলোচনা করেন, তখন আমাদের অবস্থা এমন হয়, যেন আমরা
জান্নাত ও জাহান্নামকে দেখছি! আর যখন আমরা আপনার দরবার হতে বের হই এবং
স্ত্রী, সন্তান ও দুনিয়াবি কাজে লিপ্ত হই, তখন আমরা অধিকাংশই ভুলে যাই।
তখন রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] আমাদের বললেন, আমি ঐ সত্ত্বার
শপথ করে বলছি, যার হাতে আমার জীবন, যদি আমার নিকট থাকা অবস্থায় তোমাদের
যে অবস্থা হয়, সে অবস্থা যদি তোমাদের সব সময় থাকতো, তাহলে ফেরেশতারা
তোমাদের সাথে তোমাদের বিছানায় ও চলার পথে সরাসরি মুসাফা করত। তবে হে
হানাযালা! কিছু সময় এ অবস্থা হবে, আবার কিছু সময় অন্য অবস্থা হবে।[8] [এ
নিয়ে তোমাদের ঘাবড়ানোর কিছু নাই। এতে একজন মানুষ মুনাফেক হয়ে যায় না।]
হাদিসে হানযালা রা. মুনাফেক হয়ে গেছে, এ কথার অর্থ হল, তিনি আশংকা
করেন যে, তিনি মুনাফেক হয়ে গেছেন। কারণ, তিনি দেখলেন যে রাসূল
[সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর মজলিশে তার অবস্থার যে ধরন হয়ে
থাকে, সেখান থেকে উঠে চলে গিয়ে যখন স্ত্রী, সন্তান, পারিবারিক কাজ ও
দুনিয়াদারিতে লেগে যান, তখন তার অবস্থা আর ঐ রকম থাকে না। হানযালা রা. তার
এ দ্বৈত অবস্থাকেই মুনাফেকী বলে আখ্যায়িত করেন। রাসূল [সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম] তাকে জানিয়ে দেন যে, এ তো কোন নিফাক নয়, আর মানুষ
সর্বদা একই অবস্থার উপর থাকার বিষয়ে দায়িত্বশীল নয়। কিছু সময় এক রকম
থাকবে আবার কিছু সময় অন্য রকম থাকবে এটাই স্বাভাবিক।[9] [একজন মানুষের
ঈমানও সব সময় এক রকম থাকে না। কখনো ঈমান বাড়ে আবার কখনো ঈমান কমে। আল্লাহ
তা‘আলা কথা, আল্লাহর দ্বীনের কথা জান্নাত জাহান্নামের কথা আলোচনা হলে, তখন
মানুষের ঈমান বাড়ে আর যখন মানুষ দুনিয়ার কাজ কর্মে লিপ্ত হয় তখন
মানুষের ঈমান কমে। আমাদের উচিত হল, আমরা বিজ্ঞ আলেম ওলামা ও সালফে
সালেহীনদের মজলিশে গিয়ে তাদের থেকে কুরআনের আলোচনা ও হাদিসের আলোচনা শোনা।
তবে এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, যারা বাণিজ্যিক বক্তা, মানুষকে আকৃষ্ট করার
জন্য বিভিন্ন ধরনের কিচ্ছা কাহিনী, দুর্বল হাদিস, বানোয়াট হাদিস ও মিথ্যা
কল্প কাহিনী দিয়ে ওয়াজ করে তাদের মজলিশে উপস্থিত হওয়া থেকে বিরত থাকবে]
খলিফাতুল মুসলিমিন ওমর রা. যাকে দুনিয়াতে জান্নাতের সু-সংবাদ দেয়া
হয়েছে, তিনিও নিফাককে ভয় করতেন। যেমন, হুযাইফা রা. হতে বর্ণিত হাদিস।
অর্থ, হুযাইফা ইবনুল ইয়ামন রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার ওমর
রা. কে একটি জানাযায় হাজির হতে দাওয়াত দেয়া হলে, তিনি তাতে অংশ গ্রহণ
করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন অথবা বের হওয়ার ইচ্ছা করেন। আমি তার পিছু
নিয়ে তাকে বললাম! হে আমিরুল মুমিনীন আপনি বসুন! কারণ, আপনি যে লোকের
জানাযায় যেতে চান সে ঐসব মুনাফিকদের অন্তর্ভুক্ত। তখন তিনি বললেন, আমি
তোমাকে আল্লাহর শপথ দিয়ে বলছি! তুমি বলতো আমি কি তাদের অন্তর্ভুক্ত? তিনি
বললেন, না। তোমার পর আমি আর কাউকে এভাবে দায়মুক্ত ঘোষণা করব না[10]।
ইবনে আবি মুলাইকা রহ. বলেন, আমি রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম] এর ত্রিশ জন সাহাবীকে স্বচক্ষে দেখতে পেয়েছি, তারা
প্রত্যেকেই নিজের নফসের উপর নিফাকের আশংকা করেন। তাদের কেউ এ কথা বলেনি:
তার ঈমান জিবরীল বা মিকাইলের ঈমানের মত মজবুত।[11]
আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রহ. বলেন, আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, কাওমের
লোকদের অন্তরসমূহ ঈমান ও বিশ্বাস এবং নিফাকের কঠিন ভয়ে ভরে গেছে। তাদের
ছাড়া অনেক এমন আছে যাদের ঈমান তাদের গলদেশ অতিক্রম করেনি। অথচ তারা দাবি
করে তাদের ঈমান জিবরীল ও মিকাইলের ঈমানের মত।[12]
তাদের উল্লেখিত উক্তির অর্থ এ নয় যে, তারা ঈমানের পরিপন্থী আসল নিফাক
বা বড় নিফাককে ভয় করছে। বরং তারা ভয় করছে ঈমানের সাথে যে নিফাক একত্র
হতে পারে তাকে। অর্থাৎ ছোট নিফাক। সুতরাং এ নেফাকের কারণে সে মুনাফিক
মুসলিম হবে মুনাফেক কাফের হবে না।[13]
কুরআন ও হাদিসে মুনাফিকদের চরিত্র:
কুরআনে করীম ও রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর পবিত্র
হাদিসের অসংখ্য জায়গায় মুনাফিকদের আলোচনা এসেছে। তাতে তাদের চরিত্র ও
কর্মতৎপরতা আলোচনা করা হয়েছে। আর মুমিনদেরকে তাদের থেকে সতর্ক করা হয়েছে
যাতে তাদের চরিত্র মুমিনরা অবলম্বন না করে। এমনকি আল্লাহ তা‘আলা তাদের নামে
একটি সুরাও নাযিল করেন। মুনাফিকদের চরিত্র:
১. মুনাফিকদের অন্তর রুগ্ন ও ব্যাধিগ্রস্ত:
মুনাফিকদের অন্তর রুগ্ন ও ব্যাধিগ্রস্ত থাকে। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে করীমে এরশাদ করেন,
﴿فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٞ فَزَادَهُمُ ٱللَّهُ مَرَضٗاۖ وَلَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمُۢ بِمَا كَانُواْ يَكۡذِبُونَ﴾ [البقرة: 10]
অর্থ, তাদের অন্তরসমূহে রয়েছে ব্যাধি। অতঃপর আল্লাহ তাদের ব্যাধি
বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব। কারণ তারা
মিথ্যা বলত। [বাকারাহ: ১০]
আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রহ. বলেন, সন্দেহ, সংশয় ও প্রবৃত্তির ব্যাধি
তাদের অন্তরকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলছে, ফলে তাদের অন্তর বা আত্মা ধ্বংস হয়ে
গেছে। আর তাদের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা ও নিয়তের উপর খারাপ ও নগ্ন মানসিকতা
প্রাধান্য বিস্তার করছে। ফলে তাদের অন্তর একদম হালাক বা
ধ্বংসের উপক্রম। বিজ্ঞ ডাক্তাররাও এখন তার চিকিৎসা দিতে অক্ষম। আল্লাহ
তা‘আলা
বলেন, ﴿فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٞ فَزَادَهُمُ ٱللَّهُ مَرَضٗاۖ ﴾ [তাদের
অন্তরসমূহে রয়েছে ব্যাধি। অতঃপর আল্লাহ তাদের ব্যাধি আরো বাড়িয়ে
দিয়েছেন।]
২. মুনাফিকদের অন্তরে অধিক লোভ-লালসা:
মুনাফিকরা অধিক লোভী হয়ে থাকে। যার কারণে তারা পার্থিব জগতকে বেশি ভালোবাসে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
অর্থ, হে নবীÑপতিœগণ, তোমরা অন্য কোন নারীর মত নও। যদি তোমরা তাকওয়া
অবলম্বন কর, তবে (পরপুরুষের সাথে) কোমল কণ্ঠে কথা বলো না, তাহলে যার অন্তরে
ব্যাধি রয়েছে সে প্রলুব্ধ হয়। আর তোমরা ন্যায়সঙ্গত কথা বলবে। [আহযাব:
৩২]
অর্থাৎ, যে ব্যক্তির অন্তরে ঈমান দুর্বল থাকে, সে তার দুর্বলতার কারণে
লোভী হয়ে থাকে। আর সে তার ঈমানের দুর্বলতার কারণে ইসলাম বিষয়ে সন্দেহ
পোষণকারী একজন মুনাফেক। যার ফলে সে আল্লাহ তা‘আলার দেয়া বিধানকে
গুরুত্বহীন মনে করে এবং হালকা করে দেখে। আর অন্যায় অশ্লীল কাজ করাকে কোন
অন্যায় মনে করে না।[14]
৩. মুনাফিকরা অহংকারী ও দাম্ভিক:
মুনাফিকরা কখনই তাদের নিজেদের দোষত্রুটি নিজেরা দেখতে পায় না। তাই
তারা নিজেদের অনেক বড় মনে করে। কারো কোন উপদেশ তারা গ্রহণ করে না, তারা
মনে করে তাদের চাইতে বড় আর কে হতে পারে? আল্লাহ তা‘আলা তাদের অহংকারী
স্বভাবের বর্ণনা দিয়ে বলেন,
﴿وَإِذَا قِيلَ لَهُمۡ تَعَالَوۡاْ يَسۡتَغۡفِرۡ لَكُمۡ رَسُولُ ٱللَّهِ لَوَّوۡاْ رُءُوسَهُمۡ وَرَأَيۡتَهُمۡ يَصُدُّونَ وَهُم مُّسۡتَكۡبِرُونَ﴾
[المنافقون: 5]
অর্থ, আর তাদেরকে যখন বলা হয় এস, আল্লাহর রাসূল তোমাদের জন্য ক্ষমা
প্রার্থনা করবেন, তখন তারা তাদের মাথা নাড়ে। আর তুমি তাদেরকে দেখতে
পাবে, অহঙ্কারবশত বিমুখ হয়ে চলে যেতে। [সূরা আল-মুনাফিকুন: ৫]
এ আয়াতে অভিশপ্ত মুনাফিকদের বিষয়ে সংবাদ দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা
বলেন,﴿وَإِذَا قِيلَ لَهُمۡ تَعَالَوۡاْ يَسۡتَغۡفِرۡ لَكُمۡ رَسُولُ ٱللَّهِ لَوَّوۡاْ رُءُوسَهُمۡ وَرَأَيۡتَهُمۡ يَصُدُّونَ وَهُم مُّسۡتَكۡبِرُونَ﴾ “আর
তাদেরকে যখন বলা হয় এস, আল্লাহর রাসূল তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা
করবেন, তখন তারা তাদের মাথা নাড়ে। আর তুমি তাদেরকে দেখতে পাবে, অহঙ্কারবশত
বিমুখ হয়ে চলে যেতে”।
অর্থাৎ, তাদের যা পালন করতে বলা হল, অহংকার ও অহমিকা বশত বা নিকৃষ্ট
মনে করে তারা তা পালন করা হতে বিরত থাকে। এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা তাদের
শাস্তি দিয়ে বলেন,
﴿سَوَآءٌ عَلَيۡهِمۡ أَسۡتَغۡفَرۡتَ لَهُمۡ أَمۡ لَمۡ
تَسۡتَغۡفِرۡ لَهُمۡ لَن يَغۡفِرَ ٱللَّهُ لَهُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَا
يَهۡدِي ٱلۡقَوۡمَ ٱلۡفَٰسِقِينَ ٦ ﴾ [المنافقون: ٦]
অর্থ, তুমি তাদের জন্য ক্ষমা কর অথবা না কর, উভয়টি তাদের ক্ষেত্রে
সমান। আল্লাহ তাদেরকে কখনো ক্ষমা করবেন না। অবশ্যই আল্লাহ পাপাচারী
সম্প্রদায়কে হেদায়েত দেন না।
৪. মুনাফিকদের চরিত্র হল, আল্লাহ তা‘আলার আয়াতসমূহের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
অর্থ, মুনাফিকরা ভয় করে যে, তাদের বিষয়ে এমন একটি সূরা অবতীর্ণ
হবে, যা তাদের অন্তরের বিষয়গুলি জানিয়ে দেবে। বল, ‘তোমরা উপহাস করতে থাক।
নিশ্চয় আল্লাহ বের করবেন, তোমরা যা ভয় করছ’। [তওবা: ৬৪]
আয়াতের ব্যাখ্যা: মুনাফিকরা সব সময় এ আশংকা করত যে, আল্লাহ
তা‘আলা তাদের অন্তরে যা আছে, তা মুমিনদের নিকট একটি সূরা নাযিল করে জানিয়ে
দিবেন। তাদের এ আশংকার প্রেক্ষাপটে আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেন।
কারো মতে, আল্লাহ তা‘আলা তার রাসূলের উপর এ আয়াত নাযিল করেন, কারণ,
মুনাফিকরা যখন রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর কোন দোষ বর্ণনা,
তার বা মুসলিমদের কোন কর্মের সমালোচনা করত, তখন তারা নিজেরা বলাবলি করত,
আল্লাহ আমাদের গোপন বিষয় প্রকাশ করে না দেয়। তাদের কথার প্রেক্ষাপটে
আল্লাহ তা‘আলা তার নবীকে বলেন, আপনি তাদের ধমক ও হুমকি দিয়ে
বলুন, ﴿ٱسۡتَهۡزِءُوٓاْ إِنَّ ٱللَّهَ مُخۡرِجٞ مَّا تَحۡذَرُونَ﴾ [‘তোমরা
উপহাস করতে থাক। নিশ্চয় আল্লাহ বের করবেন, তোমরা যা ভয় করছ’]
৫. মুমিনদের সাথে বিদ্রূপ:
মুনাফিকরা মুমিনদের সাথে বিদ্রূপ করত। তারা যখন মুমিনদের সাথে মিলিত
হত, তখন তারা মুমিনদের সাথে প্রকাশ করত যে, তারা ঈমানদার আবার যখন তারা
তাদের কাফের বন্ধুদের সাথে মিলিত হত, তখন তারা তাদের সাথে ছির অন্তরঙ্গ।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
আর যখন তারা মুমিনদের সাথে মিলিত হয়, তখন বলে ‘আমরা ঈমান এনেছি’ এবং
যখন গোপনে তাদের শয়তানদের সাথে একান্তে মিলিত হয়, তখন বলে, ‘নিশ্চয় আমরা
তোমাদের সাথে আছি। আমরা তো কেবল উপহাসকারী’। আল্লাহ তাদের প্রতি উপহাস
করেন এবং তাদেরকে তাদের অবাধ্যতায় বিভ্রান্ত হয়ে ঘোরার অবকাশ দেন। [সূরা
বাকারাহ: ১৪, ১৫]
আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রহ. বলেন, মুনাফিকদের দুটি চেহারা: একটি চেহারা
দ্বারা তারা মুমিনদের সাথে সাক্ষাত করত, আর আরেকটি চেহারা দ্বারা তারা
তাদের মুনাফেক -কাফের- ভাইদের সাথে সাক্ষাত করত। তাদের দুটি মুখ থাকত, একটি
দ্বারা তারা মুসলিমদের সাতে মিলিত হত, আর অপর চেহারা তাদের অন্তরে
লুকায়িত গোপন তথ্য সম্পর্কে সংবাদ দিত।
তারা কিতাব ও সুন্নাহ এবং উভয়ের অনুসারীদের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে
ফিরে যায় এবং তারা তাদের নিকট যা আছে তার উপর সন্তুষ্ট থাকে। আল্লাহর পক্ষ
থেকে নাযিল কৃত ওহীর বিধানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশকে অস্বীকার করত। তারা
মনে করত, তারাই বড় জ্ঞানী। হে রাসূল আপনি তাদের বলে দিন, তাদের জ্ঞান যতই
থাকুক না কেন, তা তাদের কোন উপকারে আসে না, বরং তা তাদের অন্যায় অনাচারকে
আরো বৃদ্ধি করে। আর আপনি কখনোই তাদের ওহীর প্রতি আনুগত্য করতে দেখবেন না।
তাদের আপনি দেখবেন ওহীর প্রতি বিদ্রূপ কারী। আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন
তাদের বিদ্রূপের বদলা
দেবেন। ﴿ٱللَّهُ يَسۡتَهۡزِئُ بِهِمۡ وَيَمُدُّهُمۡ فِي طُغۡيَٰنِهِمۡ يَعۡمَهُونَ﴾ [আল্লাহ
তাদের প্রতি উপহাস করেন এবং তাদেরকে তাদের অবাধ্যতায় বিভ্রান্ত হয়ে
ঘোরার অবকাশ দেন।] তারা তাদের কু-কর্মে আনন্দ ভোগ করতে থাকবে।
৬. মানুষকে আল্লাহর রাহে খরচ করা হতে বিরত রাখা:
মুনাফিকরা মানুষকে আল্লাহর রাখে খরচ করাকে অনর্থক মনে করে। তাই তারা মানুষকে আল্লাহর রাহে খরচ করতে নিষেধ করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
অর্থ, তারাই বলে, যারা আল্লাহর রাসূলের কাছে আছে তোমরা
তাদের জন্য খরচ করো না, যতক্ষণ না তারা সরে যায়। আর আসমানসমূহ ও যমিনের
ধনÑভাণ্ডার তো আল্লাহরই, কিন্তু মুনাফিকরা তা বুঝে না। [সূর فقرأ إِنَّ الله قَدْ صَدقَك يَا زْيُد»
অর্থ, যায়েদ ইবনে আরকাম রা. হতে বর্ণিত, আমি একদা একটি যুদ্ধে
আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই কে বলতে শুনি সে বলে, তোমরা মুহাম্মদের আশ পাশে যে সব
মুমিনরা রয়েছে, তাদের জন্য খরচ করো না, যাতে তারা তাকে ছেড়ে চলে যায়।
আর যদি তারা মদিনায় ফিরে আসে তাহলে মদিনার সম্মানী লোকেরা এ সব নিকৃষ্ট
লোকদের বহিষ্কার করবে। আমি বিষয়টি আমার চাচা অথবা ওমর রা. কে বললে, তারা
বিষয়টি রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর নিকট আলোচনা করে।
রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলে আমি
তাকে বিস্তারিত বিষয়টি জানালাম। তারপর রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম] আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ও তার সাথীদের ডেকে জিজ্ঞাসা করলে, তারা
শপথ করে বলল, আমরা এ ধরনের কোন কথা বলি নাই। তাদের কথা শোনে রাসূল
[সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] তাদের কথা বিশ্বাস করল, আর আমাকে
মিথ্যুক সাব্যস্ত করল। এরপর আমি এত চিন্তিত হলাম ইতি পূর্বে আর কোন দিন আমি
এত চিন্তিত হই নাই। আমি লজ্জিত হয়ে ঘরে বসে থাকতাম। লজ্জায় ঘর থেকে বের
হতাম না। তখন আমার চাচা আমাকে বলল, আমরা কখনো চাইছিলাম না যে, রাসূল
[সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] তোমাকে মিথ্যুক সাব্যস্ত করুক বা তোমাকে
অস্বীকার করুক। তারপর আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত-
﴿إِذَا جَآءَكَ ٱلۡمُنَٰفِقُونَ قَالُواْ نَشۡهَدُ إِنَّكَ لَرَسُولُ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ يَعۡلَمُ إِنَّكَ لَرَسُولُهُۥ وَٱللَّهُ يَشۡهَدُ إِنَّ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ لَكَٰذِبُونَ﴾
[المنافقون: 1]
[যখন তোমার কাছে মুনফিকরা আসে, তখন বলে, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে,
নিশ্চয় আপনি আল্লাহর রাসূল এবং আল্লাহ জানেন যে, অবশ্যই তুমি তার রাসূল।
আর আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, অবশ্যই মুনাফিকরা মিথ্যবাদী] নাযিল করেন।
তারপর রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] আমাকে ডেকে পাঠান এবং আমাকে
এ আয়াত পাঠ করে শোনান এবং বলেন, হে যায়েদ! আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে
সত্যবাদী বলে আখ্যায়িত করেন।
৭. মুনাফিকদের মূর্খতা ও মুমিনদের মূর্খ বলে আখ্যায়িত করা:
মুনাফিকরা নিজেরা মূর্খ এ জিনিষটি তাদের চোখে ধরা পড়তো না। কিন্তু
তারা মুমিনদের মূর্খ বলে আখ্যায়িত করত। এ কারণেই তাদের যখন মুমিনদের
ন্যায় ঈমান আনার জন্য বলা হত, তখন তারা বলত, মুমিনরা-তো বুঝে না, তারা
মূর্খ, তাই তারা ঈমান এনেছে। আমরাতো মূর্খ নই, আমরা শিক্ষিত আমরা কেন ঈমান
আনব? আল্লাহ তা‘আলা তাদের বিষয়ে বলেন,
﴿وَإِذَا قِيلَ لَهُمۡ ءَامِنُواْ كَمَآ ءَامَنَ ٱلنَّاسُ قَالُوٓاْ أَنُؤۡمِنُ كَمَآ ءَامَنَ ٱلسُّفَهَآءُۗ أَلَآ إِنَّهُمۡ هُمُ ٱلسُّفَهَآءُ وَلَٰكِن لَّا يَعۡلَمُونَ﴾
[البقرة: 13]
আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘তোমরা ঈমান আন যেমন লোকেরা ঈমান
এনেছে’, তারা বলে, ‘আমরা কি ঈমান আনব যেমন নির্বোধরা ঈমান এনেছে’? জেনে
রাখ, নিশ্চয় তারাই নির্বোধ; কিন্তু তারা জানে না। [সূরা বাকারা: ১৩]
আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রহ. বলেন, যারা কুরআন ও হাদিসের আনুগত্য করে
তারা তাদের নিকট নির্বোধ, বোকা। তাদের জ্ঞান বুদ্ধি বলতে কিছুই নাই। আর
যারা ইসলামী শরিয়তের বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করতে চায় তারা তাদের নিকট
সেই গাধার মত যে বোঝা বহন করে। তার কিতাব বা ব্যবসায়ীর মালামাল দ্বারা তার
কোন লাভ হয় না। সে নিজে কোন প্রকার উপকার লাভ করতে পারে না। আর যারা
আল্লাহর উপর ঈমান আনে এবং তার আদেশের আনুগত্য করে তারা হল, তাদের নিকট
নির্বোধ, মূর্খ। তাই তারা তাদের মজলিশে তার উপস্থিতিকে অপছন্দ করত ও
তার দ্বারা তারা তাদের অযাত্রা হতো বলে বিশ্বাস করত।[15]
৮. কাফেরদের সাথে তাদের বন্ধুত্ব:
মুনাফিকরা কাফেরদেরকে তাদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করত। মুমিনদের তারা কখনোই
তাদের বন্ধু বানাত না। তারা মনে করত কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করলে তারা
ইজ্জত সম্মানের অধিকারী হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন
অর্থ, মুনাফিকদের সুসংবাদ দাও যে, নিশ্চয় তাদের জন্যই রয়েছে
যন্ত্রণাদায়ক আযাব। যারা মুমিনদের পরিবর্তে কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ
করে, তারা কি তাদের কাছে সম্মান চায়? অথচ যাবতীয় সম্মান আল্লাহর।
[সূরা নিসা: ১৩৮, ১৩৯]
আয়াতের ব্যাখ্যা: আল্লাহ তা‘আলা তার নবীকে বলেন, হে
মুহাম্মদ! بَشِّرِ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ তুমি ঐ সব মুনাফিকদের সুসংবাদ দাও, যে
সব মুনাফিকরা আমার দ্বীন অস্বীকারকারী ও বেঈমানদের সাথে বন্ধুত্ব করে
অর্থাৎ মুমিনদের বাদ দিয়ে তারা কাফেরদের তাদের সহযোগী ও বন্ধুরূপে গ্রহণ
করে, তারা কি আমার উপর অবিশ্বাসী বেঈমানদের সাথে বন্ধুত্ব করার মাধ্যমে
তাদের নিকট থেকে শক্তি, সামর্থ্য, সম্মান ও সাহায্য তালাশ করে?। তারা কি
জানে না? ইজ্জত, সম্মান, শক্তি সামর্থ্য-তো সবই আল্লাহর
জন্য। أَيَبۡتَغُونَ عِندَهُمُ ٱلۡعِزَّةَ [তারা কি তাদের কাছে সম্মান
চায়?] অর্থাৎ, তারা কি তাদের নিকট ইজ্জত তালাশ করে? আর যারা নিকৃষ্ট ও
সংখ্যালঘু কাফেরদের থেকে সম্মান পাওয়ার আশায় তাদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করে,
তারা কেন মুমিনদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করে না? তারা যদি মুমিনদের বন্ধুরূপে
গ্রহণ করত, তাহলে তারা ইজ্জত, সম্মান ও সহযোগিতা আল্লাহর নিকটই তালাশ করত।
কারণ, ইজ্জত সম্মানের মালিক তো একমাত্র আল্লাহ। যাবতীয় ইজ্জত সম্মান কেবলই
আল্লাহর। আল্লাহ বলেন, فَإِنَّ ٱلۡعِزَّةَ لِلَّهِ جَمِيعٗا [যাবতীয়
সম্মান আল্লাহর] তিনি যাকে চান ইজ্জত দেন, আর যাকে চান বে-ইজ্জত করেন।[16]
৯. তারা মুমিনদের পরিণতি দেখার অপেক্ষায় থাকে:
মুনাফিকরা সব সময় পিছনে থাকত, কারণ, তারা অপেক্ষা করত, যদি বিজয়
মুমিনদের হয়, তাহলে তারা মুমিনদের সাথে মিলে যায় আর যদি বিজয় কাফেরদের
হয়, তখন কাফিরদের পক্ষে চলে যায়। তাদের এ ধরনের অপকর্মের বর্ণনা দিয়ে
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
অর্থ, যারা তোমাদের ব্যাপারে (অকল্যাণের) অপেক্ষায় থাকে, অতঃপর
আল্লাহর পক্ষ থেকে যদি তোমাদের বিজয় হয়, তবে তারা বলে, ‘আমরা কি তোমাদের
সাথে ছিলাম না’? আর যদি কাফিরদের আংশিক বিজয় হয়, তবে তারা বলে, ‘আমরা কি
তোমাদের উপর কর্তৃত্ব করিনি এবং মুমিনদের কবল থেকে তোমাদেরকে রক্ষা
করিনি’? সুতরাং আল্লাহ কিয়ামতের দিন তোমাদের মধ্যে বিচার করবেন। আর আল্লাহ
কখনো মুমিনদের বিপক্ষে কাফিরদের জন্য পথ রাখবেন না। [নিসা: ১৪১]
আয়াতের ব্যাখ্যা: আল্লাহ তা‘আলা বলেন, হে
মুমিনগণ! ٱلَّذِينَ يَتَرَبَّصُونَ بِكُمۡ যারা তোমাদের পরিণতি জানার জন্য
অপেক্ষা করে। فَإِن كَانَ لَكُمۡ فَتۡحٞ مِّنَ ٱللَّهِ [যদি আল্লাহর পক্ষ
হতে তোমাদের বিজয় হয়।] অর্থাৎ, আল্লাহ তা‘আলা যদি তোমাদের দুশমনদের উপর
তোমাদের বিজয় দান করে এবং তোমরা গণিমতের মাল লাভ কর, তখন তারা তোমাদের
বলবে, أَلَمۡ نَكُن مَّعَكُمۡ আমরা কি তোমাদের সাথে যুদ্ধ করিনি এবং
তোমাদের সাথে লড়াই করিনি? তোমরা আমাদেরকে গণিমতের মাল হতে আমাদের ভাগ
দিয়ে দাও! কারণ, আমরা তোমাদের সাথে যুদ্ধে শরিক ছিলাম। অথচ তারা তাদের
সাথে যুদ্ধে শরিক ছিল না তারা জান প্রাণ চেষ্টা করত পরাজয় যাতে মুমিনদের
ললাটে থাকে। وَإِن كَانَ لِلۡكَٰفِرِينَ نَصِيبٞ আর যদি বিজয় তোমাদের
কাফের দুশমনদের হয়ে থাকে এবং তারা তোমাদের থেকে ধন-সম্পদ লাভ করে, তখন এসব
মুনাফিকরা কাফেরদের গিয়ে বলবে, أَلَمۡ نَسۡتَحۡوِذۡ عَلَيۡكُمۡ আমরা কি
তোমাদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করিনি? যার ফলে তোমরা মুমিনদের উপর বিজয়
লাভ করছ! তাদেরকে আমরা তোমাদের উপর আক্রমণ করা হতে বাধা দিতাম। আর তাদের
আমরা বিভিন্নভাবে অপমান, অপদস্থ করতাম। যার ফলে তারা তোমাদের আক্রমণ করা
হতে বিরত থাকে এবং যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করে। আর এ সুযোগে তোমরা
তোমাদের দুশমনদের উপর বিজয় লাভ
কর। فَٱللَّهُ يَحۡكُمُ بَيۡنَكُمۡ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِۗ আল্লাহ তা‘আলাই
তোমাদের মাঝে ও মুনাফিকদের মাঝে কিয়ামতের দিন ফায়সালা করবে। অর্থাৎ
আল্লাহ তা‘আলা মুমিন ও মুনাফিকদের মাঝে কিয়ামতের দিন ফায়সালা করবেন। যারা
ঈমানদার তাদের আল্লাহ তা‘আলা জান্নাত দান করবেন, আর যারা মুনাফিক তাদের
তিনি কাফের বন্ধুদের সাথে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন।[17]
১০. মুনাফিকদের চরিত্র হল, আল্লাহকে ধোঁকা দেয়া ও ইবাদতে অলসতা করা:
মুনাফিকরা তাদের ধারণা অনুযায়ী আল্লাহকে ধোঁকা দেয় এবং সালাতে তারা
অলসতা করে। তাদের সালাত হল, লোক দেখানো। তারা আল্লাহর ভয়ে ইবাদত করে না।
তারা ইবাদত করে মানুষের ভয়ে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
অর্থ, নিশ্চয় মুনাফিকরা আল্লাহকে ধোঁকা দেয়। অথচ তিনি তাদের ধোঁকা
(-এর জবাব) দান কারী। আর যখন তারা সালাতে দাঁড়ায় তখন অলস-ভাবে
দাঁড়ায়, তারা লোকদেরকে দেখায় এবং তারা আল্লাহকে কমই স্মরণ করে। [সূরা
নিসা: ১৪২]
আয়াতের ব্যাখ্যা: মুনাফিকরা তাদের ধারণা অনুযায়ী আল্লাহ
তা‘আলাকে ধোঁকা দেয়। কারণ, তাদের নিফাকই তাদের জান-মাল ও ধন-সম্পদকে
মুমিনদের হাত থেকে রক্ষা করে থাকে। মুখে ইসলাম ও ঈমান প্রকাশ করার কারণে,
আল্লাহর পক্ষ হতে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে নিষেধ করা হয়। অথচ, আল্লাহ
তা‘আলা তাদের অন্তরে তারা যে কুফরকে লুকিয়ে রাখছেন তা জানেন। তা সত্ত্বেও
তিনি তাদের সাথে যুদ্ধ করতে না করেন। এর দ্বারা তিনি দুনিয়াতে তাদের
সুযোগ দেন। আর যখন কিয়ামতের দিন আসবে, তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদের থেকে এর
বদলা নিবেন। তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তারা অন্তরে যে কুফরকে গোপন করত তার
বিনিময়ে তাদের জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে।
আর আল্লাহ তা‘আলার
বাণী: ﴿وَإِذَا قَامُوٓاْ إِلَى ٱلصَّلَوٰةِ قَامُواْ كُسَالَىٰ يُرَآءُونَ ٱلنَّاسَ﴾ [আর
যখন তারা সালাতে দাঁড়ায় তখন অলস-ভাবে দাঁড়ায়, তারা লোকদেরকে দেখায়]
মুনাফিকরা আল্লাহ তা‘আলা যে সব নেক আমল ও ইবাদত বন্দেগী মুমিনদের উপর ফরয
করেছেন, তার কোন একটি নেক আমল মুনাফিকরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে
করে না। কারণ, কীভাবে করবে তারা তো আখিরাত, পরকাল, জান্নাত, জাহান্নাম কোন
কিছুই বিশ্বাস করে না। তারা প্রকাশ্যে যে সব আমল করে থাকে তা কেবলই
নিজেদের রক্ষা করার জন্যই করে থাকে অথবা মুমিনদের থেকে বাঁচার জন্য করে
থাকে। যাতে তারা তাদের সাথে যুদ্ধ করতে না পারে এবং তাদের ধন-সম্পদ
ছিনিয়ে নিতে না পারে। তাই তারা যখন সালাতে দাঁড়ায় তখন অলসতা করে
দাঁড়ায়। সালাতে দাঁড়িয়ে তারা এদিক সেদিক তাকায় এবং নড়াচড়া করে।
সালাতে উপস্থিত হয়ে তারা মুমিনদের দেখায় যে, আমরা তোমাদের অন্তর্ভুক্ত
অথচ তারা মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত নয়। কারণ, তারা সালাত আদায় করা যে ফরয বা
ওয়াজিব তাতে বিশ্বাস করে না। তাই তাদের সালাত হল, লোক দেখানো সালাত,
আল্লাহকে সন্তুষ্টি করার সালাত নয়।
আল্লাহ তা‘আলার
বাণী- ﴿وَلَا يَذۡكُرُونَ ٱللَّهَ إِلَّا قَلِيلٗا﴾ [এবং তারা আল্লাহকে
কমই স্মরণ করে।] এখানে একটি প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে কি তারা আল্লাহর
যিকির কম করে বেশি করে না? উত্তরে বলা হবে, এখানে তুমি আয়াতের অর্থ যা
বুঝেছ, তা বাস্তবতার সম্পূর্ণ বিপরীত। আয়াতের অর্থ হল, তারা একমাত্র লোক
দেখানোর জন্যই আল্লাহর যিকির করে, যাতে তারা তাদের নিজেদের থেকে হত্যা, জেল
ও মালামাল ক্রোক করাকে প্রতিহত করতে পারে। তাদের যিকির আল্লাহর প্রতি
বিশ্বাস করা বা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্য নয়। এ কারণে আল্লাহ
তা‘আলা তাকে কম বলে আখ্যায়িত করেন। কারণ, তারা তাদের যিকির দ্বারা আল্লাহর
সন্তুষ্টি, নৈকট্য, ও সাওয়াব লাভ করাকে উদ্দেশ্য বানায়নি। সুতরাং তাদের
আমল যতই বেশি হোক না কেন তা বাস্তবে মরীচিকার মতই। যা বাহ্যিক দিক দিয়ে
দেখতে পানি বলে মনে হয় কিন্তু বাস্তবে তা পানি নয়।[18]
১১. দ্বিমুখী নীতি ও সিদ্ধান্ত হীনতা:
মুনাফিকরা দ্বৈতনীতির হয়ে থাকে। তাদের বাহ্যিক এক রকম আবার ভিতর আরেক
রকম। তারা যখন মুমিনদের সাথে মিলে তখন তারা যেন পাক্কা ঈমানদার, আবার যখন
কাফেরদের সাথে মিলিত হয় তখন তারা কাট্টা কাফের। তাদের এ দ্বি-মুখী নীতির
কারণে তাদের কেউ বিশ্বাস করে না। সবার কাছেই তারা ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়।
আল্লাহ তা‘আলা তাদের দ্বিমুখী নীতির সমালোচনা করে বলেন,
﴿مُّذَبۡذَبِينَ بَيۡنَ ذَٰلِكَ لَآ إِلَىٰ هَٰٓؤُلَآءِ وَلَآ إِلَىٰ هَٰٓؤُلَآءِۚ وَمَن يُضۡلِلِ ٱللَّهُ فَلَن تَجِدَ لَهُۥ سَبِيلٗا﴾
অর্থ, তারা এর মধ্যে দোদুল্যমান, না এদের দিকে আর না ওদের দিকে। আর
আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তুমি কখনো তার জন্য কোন পথ পাবে না। [সূরা নিসা:
১৪৩]
অর্থাৎ, মুনাফিকরা তাদের দ্বীনের ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে।
তারা সঠিকভাবে কোন কিছুকেই বিশ্বাস করতে পারে না। তারা বুঝে শুনে মুমিনদের
সাথেও নয় আবার না বুঝে কাফেরদের সাথেও নয়। বরং তারা উভয়ের মাঝে
সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে।[19]
অর্থ, আব্দুল্লাহ ওমর রা. হতে বর্ণিত, রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম] বলেন, মুনাফিকদের উপমা ছাগলের পালের মাঝে দড়ি ছাড়া বকরীর
মত। একবার এটিকে গুঁতা দেয় আবার এটিকে গুঁতা দেয়।[20]
ইমাম নববী রহ. বলেন, العائرة শব্দের অর্থ, সিদ্ধান্তহীন লোক, সে
জানেনা দুটির কোনটির পিছু নিবে। আর تعير অর্থ, ঘুরাঘুরি করা, ছুটাছুটি
করা।[21] মুনাফিকরাও অনুরূপ। তারা সর্বদা সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগতে থাকে।
তাদের চিন্তা ও পেরেশানির কোন অন্ত নাই। দুনিয়াতে এটি তাদের জন্য বড়
ধরনের আযাব। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের এ ধরনের আযাব থেকে হেফাযত করুন।
১২. মুমিনদের ধোঁকা দেয়া:
মুনাফিকরা মনে করে তারা আল্লাহ তা‘আলা ও মুমিনদের ধোঁকা দিয়ে থাকে,
প্রকৃত পক্ষে তারা কাউকেই ধোঁকা দেয় না। তারা নিজেরাই তাদের নিজেদের ধোঁকা
দেয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يُخَٰدِعُونَ ٱللَّهَ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَمَا يَخۡدَعُونَ إِلَّآ أَنفُسَهُمۡ وَمَا يَشۡعُرُونَ﴾ [البقرة: 9]
অর্থ, তারা আল্লাহকে এবং যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে ধোঁকা দিচ্ছে (বলে
মনে করে)। অথচ তারা নিজদেরকেই ধোঁকা দিচ্ছে এবং তারা তা অনুধাবন করে না।
[সূরা বাকারাহ: ৯]
আয়াতের ব্যাখ্যা: মুনাফিকরা তাদের রব ও মুমিনদের ধোঁকা দিত।
তারা তাদের মুখে প্রকাশ করত যে, আমরা আল্লাহতে বিশ্বাস করি, কিন্তু তাদের
অন্তরে তারা অবিশ্বাস, অস্বীকার ও সন্দেহ-সংশয়কে গোপন করত, যাতে তারা
তাদের জন্য অবধারিত শাস্তি- হত্যা, বন্দি করা ও তাদের বিরুদ্ধে অভিযান
ইত্যাদি হতে মুক্তি পায়। তারা মুখের ঈমান ও স্বীকার করাকে নিজেদের বাঁচার
হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করত। অন্যথায় তাদের উপর ঐ শাস্তি বর্তাত যা
অস্বীকারকারী কাফেরদের উপর বর্তায়। আর এটাই হল, মুমিনদের ও তাদের রবকে
ধোঁকা দেয়া।[22]
১৩. গাইরুল্লাহর নিকট বিচার ফায়সালা নিয়ে যাওয়া:
মুনাফিকদের অন্যতম স্বভাব হল, তারা বিচার ফায়সালার জন্য আল্লাহর
রাসূল সা. এর নিকট যেত না। তারা তাদের কাফের বন্ধুদের নিকট বিচার ফায়সালার
জন্য যেত। যাতে তারা তাদের প্রতিপক্ষকে ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত করতে
সক্ষম হয়। কারণ, তারা জানতো যদি ন্যায় বিচার করা হয়, তখন ফায়সালা তাদের
বিপক্ষে যাবে। আর রাসূল সা. কখনোই ন্যায় বিচার ও ইনসাফের বাহিরে যেতে
পারবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
অর্থ, তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা দাবী করে যে, নিশ্চয় তারা ঈমান
এনেছে তার উপর, যা নাযিল করা হয়েছে তোমার প্রতি এবং যা নাযিল করা হয়েছে
তোমার পূর্বে। তারা তাগূতের কাছে বিচার নিয়ে যেতে চায় অথচ তাদেরকে
নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাকে অস্বীকার করতে। আর শয়তান চায় তাদেরকে ঘোর
বিভ্রান্তিতে বিভ্রান্ত করতে। আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘তোমরা আস যা আল্লাহ
নাযিল করেছেন তার দিকে এবং রাসূলের দিকে’, তখন মুনাফিকদেরকে দেখবে তোমার
কাছ থেকে সম্পূর্ণরূপে ফিরে যাচ্ছে। [সূরা নিসা: ৬০, ৬১]
আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রহ. বলেন, যখন মুনাফিকদের আল্লাহ তা‘আলার
সুস্পষ্ট ওহীর বিধান, আল্লাহর কিতাব ও রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম] এর সুন্নাতের দিকে বিচার ফায়সালার জন্য আহ্বান করা হয়, তখন
তারা পলায়ন করে এবং তুমি তাদের দেখতে পাবে, তারা এ থেকে সম্পূর্ণ বিমুখ।
আর যখন তুমি তাদের বাস্তবতা সম্পর্কে জানতে পারবে, তখন তুমি দেখতে পাবে
তাদের মধ্যে ও বাস্তবতার মধ্যে বিশাল তফাৎ। তারা কোন ভাবেই আল্লাহর পক্ষ
হতে অবতীর্ণ ওহীর আনুগত্য করে না।[23]
১৪. মুমিনদের মাঝে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করা:
মুনাফিকরা চেষ্টা করে কিভাবে মুমিনদের মাঝে বিবাদ সৃষ্টি করা
যায়। তারা সব সময় মুমিনদের মাঝে অনৈক্য, মত বিরোধ ও ইখতেলাফ লাগিয়ে
রাখে। তারা একজনের কথা আরেক জনের নিকট গিয়ে বলে। চোগলখোরি করে বেড়ায়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
অর্থ, যদি তারা তোমাদের সাথে বের হত, তবে তোমাদের মধ্যে ফ্যাসাদই
বৃদ্ধি করত এবং তোমাদের মাঝে ছুটোছুটি করত, তোমাদের মধ্যে ফিতনা সৃষ্টির
অনুসন্ধানে। আর তোমাদের মধ্যে রয়েছে তাদের কথা অধিক শ্রবণকারী, আর আল্লাহ
যালিমদের সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞাত। [সূরা তওবা: ৪৭]
অর্থাৎ, ﴿لَوۡ خَرَجُواْ فِيكُم مَّا زَادُوكُمۡ إِلَّا خَبَالٗ﴾ যদি
তারা তোমাদের সাথে যুদ্ধে বের হত, তবে তারা তোমাদের ক্ষতি ছাড়া কোন উপকারে
আসত না। কারণ, তোমাদের মধ্যে ফ্যাসাদই বৃদ্ধি করত। কারণ, তারা হল,
কাপুরুষ ও অপদস্থ সম্প্রদায়। তাদের মধ্যে যুদ্ধ করা ও কাফেরদের মোকাবেলা
করার মত কোন সাহস তাদের
নাই। ﴿وَلَأَوۡضَعُواْ خِلَٰلَكُمۡ يَبۡغُونَكُمُ ٱلۡفِتۡنَةَ﴾ আর
তারা তোমাদের মাঝে ছুটোছুটি করত, একবার এদিক যেত, আবার ওদিক যেত, একজনের
কথা আরেক জনের নিকট গিয়ে বলত, চোগলখোরি করত, বিদ্বেষ চড়াত এবং তোমাদের
মধ্যে ফিতনা সৃষ্টির অনুসন্ধানে থাকত যা তোমাদের জন্য অকল্যাণ ও অশান্তি
ছাড়া আর কিছুই বয়ে আনত না। وَفِيكُمۡ سَمَّٰعُونَ لَهُمۡۗ আর তোমাদের
মধ্যে রয়েছে এমন লোক, যারা তাদের কথা অধিক শ্রবণকারী, অর্থাৎ, তাদের
আনুগত্য-কারী, তাদের কথাকে পছন্দ-কারী ও তাদের হিতাকাংখি। যদিও তারা তাদের
প্রকৃত অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে তারা অবগত নয়। ফলে এ সব অপকর্মের কারণে
মুমিনদের মাঝে বড় ধরনের ফ্যাসাদ ও বিবাদ তৈরি হতে পারে। যা তোমাদের
পরাজয়ের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালান করবে।[24]
১৫. মিথ্যা শপথ করা, কাপুরুষতা ও ভীরুতা:
মুনাফিকরা অধিক হারে মিথ্যা শপথ করে। তাদের যখন কোন অপকর্মের জন্য
জিজ্ঞাসা করা হয়, তখন তারা তা সাথে সাথে অস্বীকার করে এবং তারা তাদের
নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য মিথ্যা শপথ করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
অর্থ, আর তারা আল্লাহর কসম করে যে, নিশ্চয় তারা তোমাদের
অন্তর্ভুক্ত, অথচ তারা তোমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং তারা এমন কওম যারা ভীত
হয়। যদি তারা কোন আশ্রয়স্থল, বা কোন গুহা অথবা লুকিয়ে থাকার কোন
প্রবেশস্থল পেত, তবে তারা সেদিকেই দৌড়ে পালাত। [তওবা: ৫৬, ৫৭]
আয়াতের ব্যাখ্যা: আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াতে মুনাফিকদের আকুতি,
তাদের হৈ-চৈ ও তৎপরতা সম্পর্কে জানিয়ে দিয়ে
বলেন, وَيَحۡلِفُونَ بِٱللَّهِ إِنَّهُمۡ لَمِنكُمۡ আর তারা আল্লাহর নামে
কঠিন কসম করে বলে যে, নিশ্চয় তারা তোমাদের অন্তর্ভুক্ত, অথচ বাস্তবতা
হল, وَمَا هُم مِّنكُمۡ তারা তোমাদের
অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং وَلَٰكِنَّهُمۡ قَوۡمٞ يَفۡرَقُونَ তারা হল এমন এক
সম্প্রদায় যারা ভীরু। আর মুমীনরা হল সাহসী বীর, তারা কখনোই ভয় পায় না।
তাদের ভয়ই তাদেরকে শপথ করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে।
لَوۡ يَجِدُونَ مَلۡجَا যদি তারা কোন
আশ্রয়স্থল, বা مَغَٰرَٰتٍ কিল্লা পেত যেখানে গিয়ে তারা আত্মরক্ষা করতে
পারত, বা مُدَّخَلٗا কোন পাহাড়ের গুহা অথবা যমিনে লুকিয়ে থাকার কোন
প্রবেশস্থল বা গর্ত পেত, তবে তারা সেদিকেই দৌড়ে পালাত। তারা কখনোই তোমাদের
সাথে যুদ্ধ করত না। আল্লাহ
বলেন, لَّوَلَّوۡاْ إِلَيۡهِ وَهُمۡ يَجۡمَحُونَ অর্থাৎ, তারা তোমাদের রেখে
সে আশ্রয়স্থলের দিকে দৌড়ে পালাত। কারণ, তারা যে তোমাদের সাথে মিলিত হয়,
তা তোমাদের ভালোবাসায় নয় বরং বাধ্য হয়ে। বাস্তবে তারা চায় যে, যদি
তোমাদের সাথে না মিলে থাকতে পারত! কিন্তু মনে রাখতে হবে, প্রয়োজনের জন্য
আলাদা বিধান থাকে। অর্থাৎ তাদের বিষয়ে সব কিছু জানার পরও তোমরা যে তাদের
সাথে যুদ্ধ কর না বা তাদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নাও না, তা একটি বৃহত্তর
স্বার্থের দিক বিবেচনা ও একটি বিশেষ প্রয়োজনকে সামনে রেখে। অন্যথায় তাদের
অপরাধ কাফের ও মুশরিকদের চেয়েও মারাত্মক। এ কারণে তারা সব সময়
দুশ্চিন্তা, সিদ্ধান্তহীনতা ও পেরেশানিতে থাকে। আর ইসলাম ও মুসলিমরা সব
সময় ইজ্জত, সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে বসবাস করে থাকেন। আর যখনই মুসলিমরা
খুশি হয়, তা তাদের বিরক্তির কারণ হয়। তারা সব সময় পছন্দ করে, যাতে
তোমাদের সাথে মিলতে না হয়। তাই আল্লাহ
বলেন, ﴿لَوۡ يَجِدُونَ مَلۡجَا أَوۡ مَغَٰرَٰتٍ أَوۡ مُدَّخَلٗا لَّوَلَّوۡاْ إِلَيۡهِ وَهُمۡ يَجۡمَحُونَ﴾ অর্থাৎ, যদি
তারা কোন আশ্রয়স্থল, বা কোন গুহা অথবা লুকিয়ে থাকার কোন প্রবেশস্থল
পেত, তবে তারা সেদিকেই দৌড়ে পালাত।[25]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَإِذَا رَأَيۡتَهُمۡ تُعۡجِبُكَ أَجۡسَامُهُمۡۖ وَإِن يَقُولُواْ تَسۡمَعۡ لِقَوۡلِهِمۡۖ كَأَنَّهُمۡ خُشُبٞ مُّسَنَّدَةٞۖ يَحۡسَبُونَ كُلَّ صَيۡحَةٍ عَلَيۡهِمۡۚ هُمُ ٱلۡعَدُوُّ فَٱحۡذَرۡهُمۡۚ قَٰتَلَهُمُ ٱللَّهُۖ أَنَّىٰ يُؤۡفَكُونَ﴾
[المنافقون: 4]
অর্থ, আর যখন তুমি তাদের দিকে তাকিয়ে দেখবে, তখন তাদের শরীর তোমাকে
মুগ্ধ করবে। আর যদি তারা কথা বলে, তুমি তাদের কথা (আগ্রহ নিয়ে) শুনবে।
তারা দেয়ালে ঠেস দেয়া কাঠের মতই। তারা মনে করে প্রতিটি আওয়াজই তাদের
বিরুদ্ধে। এরাই শত্রু, অতএব এদের সম্পর্কে সতর্ক হও। আল্লাহ এদেরকে ধ্বংস
করুন। তারা কিভাবে সত্য থেকে ফিরে যাচ্ছে। [সূরা মুনাফিকুন:৪]
আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রহ. বলেন, দেহের দিক দিয়ে তারা খুব সুন্দর,
মুখের দিক দিয়ে তারা খুব সাহিত্যিক, কথার দিক দিয়ে তার খুব ভদ্র, অন্তরের
দিক দিয়ে তারা সর্বাধিক খবিস নাপাক ও মনের দিক দিয়ে খুবই দুর্বল। তারা
খাড়া কাঠের মত খাড়া করা, যাতে কোন ফল নাই। গাছগুলোকে জড়ের থেকে উপড়ে
ফেলা হয়েছে, ফলে সে গুলো একটি দালানের সাথে খাড়া করে রাখা হয়েছে, যাতে
পথচারীরা পা পৃষ্ট না করে।[26]
১৬. তারা যা করেনি তার উপর তাদের প্রশংসা শুনতে পছন্দ করত:
মুনাফিকরা যে কাজ করে না তার উপর তাদের কোন ভৎসনা মানতে রাজি না।
এমনটি তারা কাজ না করে সে কাজের প্রশংসা শুনতে চায়। আল্লাহ তা‘আলা তাদের
অবান্তর চাহিদার নিন্দা করে বলেন,
﴿لَا تَحۡسَبَنَّ ٱلَّذِينَ يَفۡرَحُونَ بِمَآ أَتَواْ وَّيُحِبُّونَ أَن يُحۡمَدُواْ بِمَا لَمۡ يَفۡعَلُواْ فَلَا تَحۡسَبَنَّهُم بِمَفَازَةٖ مِّنَ ٱلۡعَذَابِۖ وَلَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمٞ﴾ [آل
عمران: 188]
অর্থ, যারা তাদের কৃতকর্মের প্রতি খুশী হয় এবং যা তারা
করেনি তা নিয়ে প্রশংসিত হতে পছন্দ করে, তুমি তাদেরকে আযাব থেকে মুক্ত মনে
করো না। আর তাদের জন্যই রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব। [স تَ
অর্থ, আবু সাঈদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত, মুনাফিকদের একটি জামাত রাসূল
[সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর যুগে রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম] যখন কোন যুদ্ধে বের হত, তখন তারা যুদ্ধে যাওয়া হতে বিরত
থাকতো। আর তারা রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর নির্দেশের
বিরুদ্ধে যুদ্ধে না গিয়ে আত্ম-তৃপ্তিতে ভুগত। আর রাসূল [সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম] যখন যুদ্ধ হতে ফিরে আসতো, তখন তারা তার নিকট গিয়ে
মিথ্যা অজুহাত দাঁড় করিয়ে অপারগতা প্রকাশ করত এবং তারা মিথ্যা শপথ করত।
আর তারা পছন্দ করত, যাতে তারা যে যুদ্ধে যায়নি তার জন্য যেন তাদের প্রশংসা
করা হয়। তারপর আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেন, ﴿لَا تَحۡسَبَنَّ ٱلَّذِينَ يَفۡرَحُونَ بِمَآ أَتَواْ وَّيُحِبُّونَ أَن يُحۡمَدُواْ بِمَا لَمۡ يَفۡعَلُواْ… ﴾ অর্থ, যারা তাদের কৃতকর্মের প্রতি খুশী হয় এবং যা তারা করেনি তা নিয়ে প্রশংসিত হতে পছন্দ করে…।[27]
১৭. মুনাফিকরা নেক আমলসমূহের দুর্নাম করত:
মুনাফিকরা মুসলিমদের ভালো কাজগুলোকে মানুষের সামনে খারাপ করে তুলে
ধরত। যতই ভালো কাজই হোক না কেন তাতে মুনাফিকরা তাদের স্বার্থ খুঁজত। যদি
তাদের স্বার্থ হাসিল হত তখন তারা চুপ থাকতো আর যখন তাদের হীন স্বার্থ হাসিল
না হত তখন তারা বদনাম করা আরম্ভ করত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمِنۡهُم مَّن يَلۡمِزُكَ فِي ٱلصَّدَقَٰتِ فَإِنۡ أُعۡطُواْ مِنۡهَا رَضُواْ وَإِن لَّمۡ يُعۡطَوۡاْ مِنۡهَآ إِذَا هُمۡ يَسۡخَطُونَ﴾
[التوبة: 58]
অর্থ, আর তাদের মধ্যে কেউ আছে, যে সদকা বিষয়ে তোমাকে দোষারোপ করে।
তবে যদি তাদেরকে তা থেকে দেয়া হয়, তারা সন্তুষ্ট থাকে, আর যদি তা থেকে
দেয়া না হয়, তখন তারা অসন্তুষ্ট হয়। [সূরা তওবা: ৫৮][28]
আয়াতের ব্যাখ্যা:
আল্লাহ তা‘আলা
বলেন,﴿وَمِنۡهُم مَّن يَلۡمِزُكَ فِي ٱلصَّدَقَٰتِ﴾ মুনাফিকদের একটি
জামাত আছে, যখন তুমি সদকা বণ্টন কর, তখন তারা সদকা বিষয়ে তোমাকে দোষারোপ
করে অর্থাৎ তোমার উপর দোষ চাপায় ও তোমার বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ
তুলে এবং তুমি যে বণ্টন করেছ, সে বিষয়ে তারা তোমাকে মিথ্যা অপবাদ দেয়।
মূলত: তারাই দোষী ও মিথ্যুক। তারা দ্বীনের কারণে কোন কিছুকে অপছন্দ করে না,
তারা অপছন্দ করে নিজেদের স্বার্থের জন্য। এ কারণে যদি তাদেরকে যাকাত দেয়া
হয়, তারা সন্তুষ্ট
থাকে, ﴿وَإِن لَّمۡ يُعۡطَوۡاْ مِنۡهَآ إِذَا هُمۡ يَسۡخَطُونَ﴾ আর যদি তা
থেকে তাদের দেয়া না হয়, তখন তারা অসন্তুষ্ট হয়।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
অর্থ, যারা দোষারোপ করে সদকার ব্যাপারে মুমিনদের মধ্য থেকে স্বেচ্ছা
দানকারীদেরকে এবং তাদেরকে যারা তাদের পরিশ্রম ছাড়া কিছুই পায় না। অতঃপর
তারা তাদেরকে নিয়ে উপহাস করে, আল্লাহও তাদেরকে নিয়ে উপহাস করেন এবং তাদের
জন্যই রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব। [সূরা তওবা: ৭৯]অর্থ, আব্দুল্লাহ ইবনে
মাসুদ রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমাদেরকে যখন সদকা করার জন্য নির্দেশ
দেয়া হল, তখন আমরা বাড়ী থেকে বহন করে সদকার মালামাল নিয়ে আসতাম।
সামর্থ্য অনুযায়ী কেউ বেশি নিয়ে আসত, আবার কেউ কম নিয়ে আসত। আবু আকীল
অর্ধ সা নিয়ে আসল আর অপর এক ব্যক্তি তার চেয়ে কিছু বেশি নিয়ে আসল। তখন
মুনাফিকরা বলল, আল্লাহ তা‘আলা তাদের এ সদকার প্রতি মুখাপেক্ষী নন, আর
দ্বিতীয় লোকটি যে একটু বেশি নিয়ে আসছে, তার সম্পর্কে বলল, সে তা কেবলই
লোক দেখানোর জন্যই করছে। তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদের কথার প্রেক্ষাপটে এ আয়াত
নাযিল
করেন- ﴿ٱلَّذِينَ يَلۡمِزُونَ ٱلۡمُطَّوِّعِينَ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ فِي ٱلصَّدَقَٰتِ وَٱلَّذِينَ لَا يَجِدُونَ إِلَّا جُهۡدَهُمۡ…﴾ [যারা
দোষারোপ করে সদকার ব্যাপারে মুমিনদের মধ্য থেকে স্বেচ্ছা দানকারীদেরকে এবং
তাদেরকে যারা তাদের পরিশ্রম ছাড়া কিছুই পায় না।…][29]
সব সময় তাদের বাড়াবাড়ি এবং তাদের অনাচার থেকে কেউ নিরাপদে থাকে না।
এমনকি যারা সদকা করে তারাও তাদের অনাচার থেকে নিরাপদ নয়। যদি তাদের কেউ
অনেক ধন-সম্পদ নিয়ে আসে, তখন তারা বলে, এ তো লোক দেখানোর জন্য নিয়ে
আসছে। আর যদি সামান্য নিয়ে আসে, তখন তারা বলে, আল্লাহ তা‘আলা তার সদকার
প্রতি মুখাপেক্ষী নয়।[30]
১৮. তারা নিম্নমান ও অপারগ লোকদের প্রতি সন্তুষ্টি:
মুনাফিকরা অপারগ মা’জুর লোকদের সাথে থাকতে পছন্দ করে। যারা ওজরের
কারণে ঘর থেকে বের হতে পারে না, তারা তাদের সাথে থাকাকে তাদের জন্য নিরাপদ
মনে করে। তাই তারা রাসূল সা. এর নিকট এসে বিভিন্ন ধরনের ওজর পেশ করে। যাতে
তাদের যুদ্ধে যেতে না হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَإِذَآ أُنزِلَتۡ سُورَةٌ أَنۡ ءَامِنُواْ بِٱللَّهِ وَجَٰهِدُواْ مَعَ رَسُولِهِ ٱسۡتئذَنَكَ أُوْلُواْ ٱلطَّوۡلِ مِنۡهُمۡ وَقَالُواْ ذَرۡنَا نَكُن مَّعَ ٱلۡقَٰعِدِينَ﴾
[التوبة: 86]
অর্থ, আর যখন কোন সূরা এ মর্মে নাযিল করা হয় যে, ‘তোমরা আল্লাহর
প্রতি ঈমান আন এবং তাঁর রাসূলের সাথে জিহাদ কর’, তখন তাদের সামর্থ্য বান
লোকেরা তোমার কাছে অনুমতি চায় এবং বলে, ‘আমাদেরকে ছেড়ে দাও, আমরা বসে
থাকা লোকদের সাথে থাকব’। [সূরা তওবা: ৮৬]
আল্লাহ তা‘আলা যারা শক্তি সামর্থ্য ও সব ধরনের উপকরণ থাকা সত্ত্বেও
জিহাদে শরীক হয় না এবং তারা রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর
নিকট যুদ্ধে না যাওয়ার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের
নিন্দা ও দোষারোপ করেন। তারা
বলে, ﴿ذَرۡنَا نَكُن مَّعَ ٱلۡقَٰعِدِينَ﴾ অর্থ, ‘আমাদেরকে ছেড়ে
দাও, আমরা বসে থাকা লোকদের সাথে থাকব’ তারা তাদের নিজেদের দোষী সাব্যস্ত
করতে কার্পণ্য করে না। সৈন্য দলেরা যুদ্ধে বের হলেও, তারা নারীদের সাথে ঘরে
বসে থাকতেও লজ্জা করে না। যখন যুদ্ধ সংঘটিত হয়, তখন তারা খুবই দুর্বল। আর
যখন তারা বেঁচে যায় তখন অতি কথন করে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্য এক আয়াতে
বলেন,
﴿أَشِحَّةً عَلَيۡكُمۡۖ فَإِذَا جَآءَ ٱلۡخَوۡفُ رَأَيۡتَهُمۡ يَنظُرُونَ إِلَيۡكَ تَدُورُ أَعۡيُنُهُمۡ كَٱلَّذِي يُغۡشَىٰ عَلَيۡهِ مِنَ ٱلۡمَوۡتِۖ فَإِذَا ذَهَبَ ٱلۡخَوۡفُ سَلَقُوكُم بِأَلۡسِنَةٍ حِدَادٍ أَشِحَّةً عَلَى ٱلۡخَيۡرِۚ أُوْلَٰٓئِكَ لَمۡ يُؤۡمِنُواْ فَأَحۡبَطَ ٱللَّهُ أَعۡمَٰلَهُمۡۚ وَكَانَ ذَٰلِكَ عَلَى ٱللَّهِ يَسِيرٗا﴾
[الأحزاب: 19]
অর্থ, তোমাদের ব্যাপারে [সাহায্য প্রদান ও বিজয় কামনায়] কৃপণতার
কারণে। অতঃপর যখন ভীতি আসে তখন তুমি তাদের দেখবে মৃত্যুভয়ে তারা মূর্ছিত
ব্যক্তির ন্যায় চক্ষু উল্টিয়ে তোমার দিকে তাকায়। অতঃপর যখন ভীতি চলে
যায় তখন তারা সম্পদের লোভে কৃপণ হয়ে শাণিত ভাষায় তোমাদের বিদ্ধ করে। এরা
ঈমান আনেনি। ফলে আল্লাহ তাদের আমলসমূহ বিনষ্ট করে দিয়েছেন। আর এটা
আল্লাহর পক্ষে সহজ। [সূরা আহযাব: ১৯] যুদ্ধের বাইরে তারা অতি কথন করে এবং
তাদের গলাবাজির আর অন্ত থাকে না। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে তার সর্বাধিক
দুর্বল ও কাপুরুষ।[31]
১৯. মুনাফিকরা খারাপ কাজের আদেশ দেয় আর ভালো কাজ থেকে নিষেধ করে:
মুনাফিকরা মানুষকে খারাপ ও মন্দ কাজের দিকে আহ্বান করে। ভালো কাজের
দিকে ডাকে না। পক্ষান্তরে মুমিনরা তাদের সম্পূর্ণ বিপরীত, তারা মানুষকে
ভালো কাজের দিকে আহ্বান করে এবং মন্দ কাজ হতে বিরত রাখে। আল্লাহ তা‘আলা
বলেন,
অর্থ, মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারীরা একে অপরের অংশ, তারা মন্দ কাজের
আদেশ দেয়, আর ভাল কাজ থেকে নিষেধ করে, তারা নিজদের হাতগুলোকে সঙ্কুচিত
করে রাখে। তারা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছে, ফলে তিনিও তাদেরকে ভুলে
গিয়েছেন, নিশ্চয় মুনাফিকরা হচ্ছে ফাসিক। [সূরা তওবা: ৬৭]
আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের অবস্থার ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, তারা মুমিনদের
বিপরীত গুণের অধিকারী। কারণ, মুমিনরা মানুষকে ভালো কাজের আদেশ দেয়, আর
খারাপ কাজ হতে বারণ করে। পক্ষান্তরে
মুনাফিকরা﴿يَأۡمُرُونَ بِٱلۡمُنكَرِ وَيَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَقۡبِضُونَ أَيۡدِيَهُمۡۚ﴾ খারাপ
কাজের আদেশ দেয় এবং ভালো কাজ হতে নিষেধ করে। আর আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয়
করা হতে তারা তাদের হাত-দ্বয় গুটিয়ে রাখে। তারা আল্লাহর স্মরণকে ভুলে
যায়, আল্লাহ তা‘আলাও তাদের সাথে সে ব্যক্তির আচরণ করেন, যে তাদের ভুলে
যান। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা অন্য আয়াতে বলেন, তাদের বলা হবে আজকের দিন আমরা
তোমাদেরকে ভুলে যাব, যেমনটি তোমরা আজকের দিনের সাক্ষাতের দিনটি ভুলে
গিয়েছিলে, ﴿إِنَّ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ هُمُ ٱلۡفَٰسِقُونَ﴾ নিশ্চয় মুনাফিকরা
হল, সত্যের পথ হতে বিচ্যুত, আর গোমরাহির পথে পরিবেষ্টিত।[32]
২০. জিহাদকে অপছন্দ করা ও জিহাদ হতে বিরত থাকা:
মুনাফিকরা জিহাদকে অপছন্দ করে। তারা কখনোই আল্লাহর রাহে জিহাদ করতে
চায় না। এ কারণে তারা বিভিন্ন অজুহাতে জিহাদ হতে বিরত থাকে। আল্লাহ তা‘আলা
বলেন,
অর্থ, পেছনে থাকা লোকগুলো আল্লাহর রাসূলের বিপক্ষে বসে থাকতে পেরে
খুশি হল, আর তারা অপছন্দ করল তাদের মাল ও জান নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ
করতে এবং তারা বলল, ‘তোমরা গরমের মধ্যে বের হয়ো না। বল, ‘জাহান্নামের
আগুন অধিকতর গরম, যদি তারা বুঝত’। [সূরা তওবা: ৮১]
তাবুকের যুদ্ধে রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর সাহাবীদের
সাথে যারা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেনি সে সব মুনাফিকদের সমালোচনা করে বলেন,
তারা তাদের গৃহাভ্যন্তরে বসে থাকাকে পছন্দ করে
এবং ﴿وَكَرِهُوٓاْ أَن يُجَٰهِدُواْ بِأَمۡوَٰلِهِمۡ وَأَنفُسِهِمۡ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ﴾ আর
আল্লাহর রাস্তায় জান মাল দিয়ে জিহাদ করতে অপছন্দ করে। আর তারা একে অপরকে
বলে, ﴿لَا تَنفِرُواْ فِي ٱلۡحَرِّۗ﴾ তোমরা গরমের মধ্যে বের হয়ো না।
অর্থাৎ, তাবুকের যুদ্ধের অভিযান ছিল উত্তপ্ত গরমের মৌসুমে এবং ফসল কাটার
উপযুক্ত সময়। এ কারণেই মুনাফিকরা বলে তোমরা গরমের মধ্যে ঘর থেকে বের হয়ো
না। আল্লাহ তা‘আলা তার স্বীয় রাসূল কে বলেন, আপনি তাদের
বলুন, ﴿نَارُ جَهَنَّمَ أَشَدُّ حَرّٗاۚ لَّوۡ كَانُواْ يَفۡقَهُونَ﴾ তোমরা
আল্লাহর রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর আদেশের বিরোধিতা করার
মাধ্যমে জাহান্নামের যে পরিণতির দিকে যাচ্ছ, তা দুনিয়ার এ গরমের চেয়ে
আরো বেশি উত্তপ্ত। যদি তোমরা বুঝতে পারতে।[33] সুতরাং তোমাদের জন্য
জাহান্নামের আগুনের চেয়ে দুনিয়ার গরম অনেক সহনীয়। কিন্তু তোমরা এখন তা
বুঝতে পারছ না।
২১. অপমান ও অপদস্থের দায়িত্ব কাঁধে নেয়া:
মুনাফিকরা যুদ্ধ হতে বিরত থাকার জন্য অপমানিত হবে তবুও তারা যুদ্ধে
যাবে না। তাদের নিকট মান-সম্মান ও ইজ্জতের কোন দাম নাই। আল্লাহ তা‘আলা
বলেন,
অর্থ, আর স্মরণ কর, যখন মুনাফিকরা ও যাদের অন্তরে ব্যাধি ছিল তারা
বলছিল, ‘আল্লাহ ও তার রাসূল আমাদেরকে যে ওয়াদা দিয়েছিলেন তা প্রতারণা
ছাড়া আর কিছুই নয়। আর যখন তাদের একদল বলেছিল, ‘হে ইয়াসরিববাসী, এখানে
তোমাদের কোন স্থান নেই, তাই তোমরা ফিরে যাও। আর তাদের একদল নবীর কাছে
অনুমতি চেয়ে বলছিল, আমাদের বাড়িÑঘর অরক্ষিত, অথচ সেগুলো অরক্ষিত ছিল না।
আসলে পালিয়ে যাওয়াই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। [সূরা আহযাব: ১২, ১৩]
২২. মুমিনদের থেকে পিছে হটা
মুনাফিকদের চরিত্র হল, তারা সব সময় পিছু হটে থাকে। তারা কোন ভালো
কাজের পিছনে থাকে। সালাতে তারা সবার পিছনে আসে এবং পিছনের কাতারে দাঁড়ায়।
রাসূল সা. এর তালীমের মজলিশে তারা পিছনে থাকে। জিহাদে বের হলে তারা
মুমিনদের পিছনে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَإِنَّ مِنكُمۡ لَمَن لَّيُبَطِّئَنَّ فَإِنۡ أَصَٰبَتۡكُم مُّصِيبَةٞ قَالَ قَدۡ أَنۡعَمَ ٱللَّهُ عَلَيَّ إِذۡ لَمۡ أَكُن مَّعَهُمۡ شَهِيدٗا﴾
[النساء: 72]
অর্থ, আর তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ এমন আছে, যে অবশ্যই বিলম্ব করবে।
সুতরাং তোমাদের কোন বিপদ আপতিত হলে সে বলবে, ‘আল্লাহ আমার উপর অনুগ্রহ
করেছেন যে, আমি তাদের সাথে উপস্থিত ছিলাম না’। [সূরা নিসা: ৭২]
আয়াতের ব্যাখ্যা: এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের গুণাগুণ ও
তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেন, আল্লাহ তা‘আলা তাদের মুমিন বলে
সম্বোধন করেন এবং বলেন, হে মুমিনগণ! কিছু লোক আছে যারা তোমাদের অন্তর্ভুক্ত
ও তোমাদের সম্প্রদায়ের। আর তারা তোমাদেরই সাদৃশ্য। তারা মানুষের মধ্যে
প্রকাশ করে যে, আমরা তোমাদের দাওয়াত ও ধর্মের অনুসারী অথচ তারা এ দাওয়াত ও
ইসলাম ধর্মের অনুসারী নয়, সত্যিকার অর্থে তারা হল মুনাফেক। যার ফলে
তোমাদের দুশমনদের সাথে জিহাদ ও তাদের সাথে লড়াই করতে তারা বিলম্ব করে।
তোমরা মুমিনগণ ঘর থেকে বের হলেও তারা ঘর থেকে বের হয়
না। فَإِنۡ أَصَٰبَتۡكُم مُّصِيبَة যদি তোমাদের কোন মুসিবত তথা পরাজয় নেমে
আসে অথবা তোমাদের কেউ আহত বা শহিদ হয়, তখন তারা
বলে, ﴾ ﴿قَدۡ أَنۡعَمَ ٱللَّهُ عَلَيَّ إِذۡ لَمۡ أَكُن مَّعَهُمۡ شَهِيدٗا আল্লাহ
আমার উপর অনুগ্রহ করেছেন যে, আমি তাদের সাথে উপস্থিত ছিলাম না। কারণ, যদি
আমি তাদের সাথে উপস্থিত থাকতাম, তবে আমিও আক্রান্ত হতাম; আহত বা নিহত হতাম।
তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ হতে বিরত থাকাতে খুশি ও আনন্দ যোগায়। কারণ, সে তো
মুনাফিক। আল্লাহর রাস্তায় আক্রান্ত হলে বা শহীদ হলে যে সব সাওয়াব ও
বিনিময়ের ঘোষণা আল্লাহ তা‘আলা দিয়েছেন সে বিষয়ে সে বিশ্বাস করে না, বরং
সন্দেহ পোষণকারী। সে কখনোই সাওয়াবের আশা করে না এবং আল্লাহর আযাবকে ভয়
করে না।[34]
২৩. জিহাদ থেকে বিরত থাকতে অনুমতি চাওয়া:
মুনাফিকরা জিহাদে অংশ গ্রহণ করাকে অপছন্দ করে। তার জন্য তারা রাসূল
সা. এর দরবারে এসে বিভিন্ন ধরনের অহেতুক অজুহাত দাড় করায়। আল্লাহ তা‘আলা
বলেন,
﴿وَمِنۡهُم مَّن يَقُولُ ٱئۡذَن لِّي وَلَا تَفۡتِنِّيٓۚ أَلَا فِي ٱلۡفِتۡنَةِ سَقَطُواْۗ وَإِنَّ جَهَنَّمَ لَمُحِيطَةُۢ بِٱلۡكَٰفِرِينَ﴾
التوبة: 49]
অর্থ, আর তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলে, ‘আমাকে অনুমতি দিন এবং আমাকে
ফিতনায় ফেলবেন না’। শুনে রাখ, তারা ফিতনাতেই পড়ে আছে। আর নিশ্চয়
জাহান্নাম কাফিরদের বেষ্টনকারী। [সূরা তওবা: ৪৯]
আয়াতের ব্যাখ্যা: আর মুনাফিকদের মধ্যে থেকে কেউ কেউ তোমাকে
বলবে হে মুহাম্মদ!ٱئۡذَن لِّي ‘আমাকে ঘরে বসে থাকতে অনুমতি দিন আমি যুদ্ধে
তোমাদের সাথে শরিক হবো না। তুমি যদি আমাকে যুদ্ধে যেতে বাধ্য কর, আমি আমার
বিষয়ে আশংকা করছি যে, রুমের সুন্দর সুন্দর রমণীদের কারণে আমি ফিতনায়
আক্রান্ত হতে পারি। সুতরাং, وَلَا تَفۡتِنِّيٓۚ তুমি আমাকে ফিতনায় ফেলবে
না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, أَلَا فِي ٱلۡفِتۡنَةِ سَقَطُواْ শুনে
রাখ, তারা তাদের এ কথার কারণেই ফিতনাতেই পড়ে আছে।[35]
২৪. জিহাদে না গিয়ে বিভিন্ন ওজুহাত দাঁড় করানো:
রাসূল সা. যখন জিহাদ থেকে ফিরে আসতো, তখন মুনাফিকরা রাসূল সা. এর
দরবারে এসে বিভিন্ন ধরনের অজুহাত দাঁড় করান এবং নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ
করতে চেষ্টা করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَعۡتَذِرُونَ إِلَيۡكُمۡ إِذَا رَجَعۡتُمۡ إِلَيۡهِمۡۚ قُل لَّا تَعۡتَذِرُواْ لَن نُّؤۡمِنَ لَكُمۡ قَدۡ نَبَّأَنَا ٱللَّهُ مِنۡ أَخۡبَارِكُمۡۚ وَسَيَرَى ٱللَّهُ عَمَلَكُمۡ وَرَسُولُهُۥ ثُمَّ تُرَدُّونَ إِلَىٰ عَٰلِمِ ٱلۡغَيۡبِ وَٱلشَّهَٰدَةِ فَيُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمۡ تَعۡمَلُونَ﴾
[التوبة: 94]
অর্থ, তারা তোমাদের নিকট ওজর পেশ করবে যখন তোমরা তাদের কাছে ফিরে
যাবে। বল, ‘তোমরা ওজর পেশ করো না, আমরা তোমাদেরকে কখনো বিশ্বাস করব
না। অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের খবর আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন। আর আল্লাহ
তোমাদের আমল দেখবেন এবং তাঁর রাসূলও। তারপর তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে
গায়েব ও প্রকাশ্যের পরিজ্ঞাতার নিকট। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে জানিয়ে দেবেন
যা তোমরা আমল করতে সে সম্পর্কে’। [সূরা তওবা: ৯৪]
আয়াতের ব্যাখ্যা: আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের বিষয়ে সংবাদ দেন
যে, তারা যখন মদিনা ফিরে আসবে তখন তারা তোমাদের নিকট ওজর পেশ করবে। আল্লাহ
বলেন, قُل لَّا تَعۡتَذِرُواْ لَن نُّؤۡمِنَ لَكُمۡ বল, ‘তোমরা ওজর পেশ
করো না, আমরা তোমাদেরকে কখনো বিশ্বাস করব
না। قَدۡ نَبَّأَنَا ٱللَّهُ مِنۡ أَخۡبَارِكُمۡۚ অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের
খবর ও অবস্থা সম্পর্কে আমাদেরকে জানিয়ে
দিয়েছেন। وَسَيَرَى ٱللَّهُ عَمَلَكُمۡ وَرَسُولُهُۥ অর্থাৎ, আল্লাহ
তোমাদের আমলসমূহ দেখবেন এবং তাঁর রাসূলও। অর্থাৎ, তোমাদের আমলসমূহ আল্লাহ
তা‘আলা দুনিয়াতে মানুষের সম্মুখে প্রকাশ করে
দেবেন। ثُمَّ تُرَدُّونَ إِلَىٰ عَٰلِمِ ٱلۡغَيۡبِ وَٱلشَّهَٰدَةِ তারপর
তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে গায়েব ও প্রকাশ্যের পরিজ্ঞাতার
নিকট। فَيُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمۡ تَعۡمَلُونَ অতঃপর তিনি তোমাদেরকে
জানিয়ে দেবেন যা তোমরা আমল করতে সে সম্পর্কে’। অর্থাৎ তোমাদের খারাপ আমল ও
ভালো আমল সম্পর্কে অবগত করবে আর তোমাদের তার উপর বিনিময় দিবেন।[36]
২৫. মানুষের থেকে আত্ম-গোপন করা:
মুনাফিকরা মাথা লুকাত এবং নিজেদের সব সময় আড়াল করে রাখতো। কারণ, তাদের মনে সব সময় আতংক থাকতো। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَسۡتَخۡفُونَ مِنَ ٱلنَّاسِ وَلَا يَسۡتَخۡفُونَ مِنَ ٱللَّهِ وَهُوَ مَعَهُمۡ إِذۡ يُبَيِّتُونَ مَا لَا يَرۡضَىٰ مِنَ ٱلۡقَوۡلِۚ وَكَانَ ٱللَّهُ بِمَا يَعۡمَلُونَ مُحِيطًا﴾
[النساء: 108]
অর্থ, তারা মানুষের কাছ থেকে লুকাতে চায়, আর আল্লাহর কাছ থেকে লুকাতে
চায় না। অথচ তিনি তাদের সাথেই থাকেন যখন তারা রাতে এমন কথার পরিকল্পনা
করে যা তিনি পছন্দ করেন না। আর আল্লাহ তারা যা করে তা পরিবেষ্টন করে আছেন।
[সূরা নিসা: ১০৮]
আয়াতের ব্যাখ্যা: আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের আমলের নিন্দা করে
বলেন, তারা তাদের খারাপীগুলো মানুষের থেকে গোপন করে, যাতে তারা তাদের খারাপ
না বলে, অথচ, আল্লাহ তা‘আলা তাদের চরিত্রগুলো প্রকাশ করে দেন। কারণ,
আল্লাহ তা‘আলা তাদের গোপন বিষয় ও তাদের অন্তরের অন্তঃস্থলে কি আছে, সে
সম্পর্কে জানেন। এ কারণেই তিনি বলেন, ﴿وَهُوَ
َ مَعَهُمۡ إِذۡ يُبَيِّتُونَ مَا لَا يَرۡضَىٰ مِنَ ٱلۡقَوۡلِۚ وَكَانَ ٱللَّهُ بِمَا يَعۡمَلُونَ مُحِيطًا﴾ অথচ
তিনি তাদের সাথেই থাকেন যখন তারা রাতে এমন কথার পরিকল্পনা করে যা তিনি
পছন্দ করেন না। আর আল্লাহ তারা যা করে তা পরিবেষ্টন করে আছেন। এটি তাদের
হুমকি ও ধমক আল্লাহর পক্ষ হতে।[37]
২৬. মুমিনদের মুসিবতে খুশি হওয়া:
মুমিনরা যখন কোন মুসিবতে পতিত হয়, তখন মুনাফিকরা খুব খুশি হয়। তারা
সব সময় মুমিনদের ক্ষতি কামনা করে এবং তাদের মুসিবতের অপেক্ষায় থাকে।
কারণ, তারা তাদের অন্তরে মুমিনদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। আল্লাহ তা‘আলা
বলেন,
অর্থ, হে মুমিনগণ, তোমরা তোমাদের ছাড়া অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে
গ্রহণ করো না। তারা তোমাদের সর্বনাশ করতে ত্রুটি করবে না। তারা তোমাদের
মারাত্মক ক্ষতি কামনা করে। তাদের মুখ থেকে তো শত্রুতা প্রকাশ পেয়ে
গিয়েছে। আর তাদের অন্তরসমূহ যা গোপন করে তা মারাত্মক। অবশ্যই আমি তোমাদের
জন্য আয়াতসমূহ স্পষ্ট বর্ণনা করেছি। যদি তোমরা উপলব্ধি করতে। শোন, তোমরাই
তো তাদেরকে ভালবাস এবং তারা তোমাদেরকে ভালবাসে না। অথচ তোমরা সব কিতাবের
প্রতি ঈমান রাখ। আর যখন তারা তোমাদের সাথে সাক্ষাৎ করে, তখন বলে, ‘আমরা
ঈমান এনেছি’। আর যখন তারা একান্তে মিলিত হয়, তোমাদের উপর রাগে আঙ্গুল
কামড়ায়। বল, ‘তোমরা তোমাদের রাগ নিয়ে মর’! নিশ্চয় আল্লাহ অন্তরের গোপন
বিষয় সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞাত। যদি তোমাদেরকে কোন কল্যাণ স্পর্শ করে, তখন
তাদের কষ্ট হয়। আর যদি তোমাদেরকে মন্দ স্পর্শ করে, তখন তারা তাতে খুশি
হয়। আর যদি তোমরা ধৈর্য ধর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, তাহলে তাদের ষড়যন্ত্র
তোমাদের কিছু ক্ষতি করবে না। নিশ্চয় আল্লাহ তারা যা করে, তা
পরিবেষ্টনকারী। [সূরা আলে-ইমরান ১১৮-১২০]
আয়াতের সারমর্ম: আল্লাহ তা‘আলা তার মুমিন বান্দাদেরকে
মুনাফিকদের অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করতে নিষেধ করেন। অর্থাৎ আল্লাহ
মুনাফিকদের অন্তরে কি আছে এবং তারা তাদের দুশমনদের জন্য কি গোপন করেন, তা
জানিয়ে দেন। মুনাফিকরা তাদের সাধ্য অনুযায়ী কখনোই মুমিনদের বন্ধু বানাবে
না। তারা সব সময় তাদের বিরোধিতা ও ক্ষতি করতে চেষ্টা করবে। মুমিনদের
বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে থাকবে। আর তারা মুমিনদের কষ্টের কারণ হয় বা তাদের
কোন মুসিবত হয় এমন কাজই করতে থাকবে।[38]
২৭. যখন আমানত রাখা হয় খিয়ানত করে যখন কথা বলে, মিথ্যা বলে, আর যখন
প্রতিশ্রুতি দেয়, তা ভঙ্গ করে আর যখন ঝগড়া করে অকাট্য ভাষায় গাল-মন্দ
করে।
মুনাফিকদের কিছু মৌলিক গুণ আছে, যেগুলো একটি সমাজ, দেশ ও জাতিকে ধ্বংস
করার জন্য যথেষ্ট। এ সব গুণগুলো থেকে বেঁচে থাকা আমাদের সকলের জন্য একান্ত
অপরিহার্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمِنۡهُم مَّنۡ عَٰهَدَ ٱللَّهَ لَئِنۡ ءَاتَىٰنَا مِن فَضۡلِهِۦ لَنَصَّدَّقَنَّ وَلَنَكُونَنَّ مِنَ ٱلصَّٰلِحِينَ ٧٥ فَلَمَّآ ءَاتَىٰهُم مِّن فَضۡلِهِۦ بَخِلُواْ بِهِۦ وَتَوَلَّواْ وَّهُم مُّعۡرِضُونَ ٧٦ فَأَعۡقَبَهُمۡ نِفَاقٗا فِي قُلُوبِهِمۡ إِلَىٰ يَوۡمِ يَلۡقَوۡنَهُۥ بِمَآ أَخۡلَفُواْ ٱللَّهَ مَا وَعَدُوهُ وَبِمَا كَانُواْ يَكۡذِبُونَ﴾
[التوبة: 75-77]
অর্থ, আর তাদের মধ্যে কতক আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার করে যে, যদি আল্লাহ
তার স্বীয় অনুগ্রহে আমাদের দান করেন, আমরা অবশ্যই দান-খয়রাত করব এবং
অবশ্যই আমরা নেককারদের অন্তর্ভুক্ত হব । অতঃপর যখন তিনি তাদেরকে তাঁর
অনুগ্রহ দান করলেন, তারা তাতে কার্পণ্য করল এবং বিমুখ হয়ে ফিরে
গেল। সুতরাং, পরিণামে তিনি তাদের অন্তরে নিফাক রেখে দিলেন সেদিন
পর্যন্ত, যেদিন তারা তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করবে, তারা আল্লাহকে যে ওয়াদা
দিয়েছে তা ভঙ্গ করার কারণে এবং তারা যে মিথ্যা বলেছিল তার কারণে। [সূরা
তওবা: ৭৫-৭৭]
আয়াতের সারমর্ম: আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, মুনাফিকরা আল্লাহ
তা‘আলাকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, যদি আল্লাহ তা‘আলা তার করুণা দ্বারা তাদের
ধন-সম্পদ ও অর্থ বিত্ত দান করেন, তবে সে আল্লাহর রাহে খরচ করবে। আর সে
নেককার লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু তাদের যখন ধন-সম্পদ দেয়া হল,
তারা তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। তারা যে সদকা করার দাবি করছিল তা
পূরণ করেনি। আল্লাহ তা‘আলা তাদের এ অপকর্মের শাস্তি স্বরূপ তাদের অন্তরে
নিফাক ঢেলে দেন। যেদিন তারা আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে অর্থাৎ কিয়ামত দিবস
পর্যন্ত তা তাদের অন্তরে স্থায়ী হবে। আমরা আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা
করি এ ধরনের নিফাক হতে।[39]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
অর্থ, আর মানুষের মধ্যে কিছু এমন আছে, যারা বলে, ‘আমরা ঈমান এনেছি
আল্লাহর প্রতি এবং শেষ দিনের প্রতি’, অথচ তারা মুমিন নয়। তারা আল্লাহকে
এবং যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে ধোঁকা দিচ্ছে [বলে মনে করে] অথচ তারা
নিজেদেরকেই ধোঁকা দিচ্ছে এবং তারা তা অনুধাবন করে না। [সূরা বাকারাহ: ৮]
আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রহ. বলেন, মুনাফিকদের বড় পুঁজি হল, ধোঁকা
দেয়া ও প্রতারণা করা। তাদের সম্পদ হল, মিথ্যা ও খিয়ানত। তাদের মধ্যে
দুনিয়ার জীবনের উপর যথেষ্ট জ্ঞান রয়েছে। উভয় দল, তাদের প্রতি সন্তুষ্ট
এবং তারা
নিরাপদ। ﴿يُخَٰدِعُونَ ٱللَّهَ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَمَا يَخۡدَعُونَ إِلَّآ أَنفُسَهُمۡ وَمَا يَشۡعُرُونَ﴾
তারা আল্লাহ তা‘আলাকে ধোঁকা দেয় এবং যারা আল্লাহর উপর ঈমান আনছে
তাদের ধোঁকা দেয়, মূলত: তারা তাদের নিজেদেরকেই ধোঁকা দেয় কিন্তু তারা তা
অনুধাবন করে না।[40]
অর্থ, আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. হতে বর্ণিত, রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম] বলেন, চারটি গুণ যার মধ্যে একত্র হবে, সে সত্যিকার
মুনাফেক। আর যার মধ্যে এ তিনটি গুনের যে কোন একটি থাকবে সে যতদিন পর্যন্ত
তা পরিহার না করবে তার মধ্যে নেফাকের একটি গুণ অবশিষ্ট থাকল। যখন কথা বলে
মিথ্যা বলে। আর যখন কোন বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেয়, তখন তা লঙ্ঘন করে, আর যখন
ওয়াদা করে তা খিলাফ করে, যখন ঝগড়া-বিবাদ করে, সে অকথ্য ভাষায়
গালি-গালাজ করে।[41]
ইমাম নববী রহ. বলেন, এক দল আলেম এ হাদিসটিকে জটিল বলে আখ্যায়িত করেন।
কারণ, এখানে যে কটি গুণের কথা বলা হয়েছে, তা একজন সত্যিকার মুসলিম যার
মধ্যে কোন সন্দেহ বা সংশয় নাই তার মধ্যেও পাওয়া যেতে পারে। যেমন, ইউসুফ
আ. এর ভাইদের মধ্যেও এ ধরনের গুণ পাওয়া গিয়েছিল। অনুরূপভাবে আমাদের আলেম,
ওলামা, পূর্বসূরি ও মনীষীদের মধ্য হতে অনেকের মধ্যে এসব গুণ বা এর কোন
একটি পাওয়া যাওয়া অস্বাভাবিক ছিল না। তাই বলে তারাতো মুনাফেক নয়। এর
সমাধানে ইমাম নববী বলেন, আলহামদু লিল্লাহ এ হাদিসে তেমন কোন অসুবিধা নাই।
তবে আলেমগণ হাদিসের বিভিন্ন অর্থ বর্ণনা করেন, অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ আলেমগণ যা
বলেছেন, তা হল, মূলত: এ চরিত্রগুলো হল, নেফাকের চরিত্র। যাদের মধ্যে এ সব
চরিত্র থাকবে সে মুনাফিকদের সাদৃশ্য হবে, তাদের চরিত্রে চরিত্রবান
হবে। কারণ, নিফাক হল, তার ভিতরে যা আছে, তার বিপরীতটিকে প্রকাশ করা। যার
মধ্যে উল্লেখিত চরিত্র গুলো পাওয়া যাবে, তার ক্ষেত্রে নেফাকের অর্থটিও
প্রযোজ্য। সে যাকে ওয়াদা দিয়েছে, যার সাথে মিথ্যা কথা বলছে, যার আমানতের
খিয়ানত করছে এবং যার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করছে, তার ব্যাপারে সে অবশ্যই
মুনাফেকি করছে। তার সাথে সে অবশ্যই বাস্তবতাকে গোপন করছে। এ অর্থে লোকটি
অবশ্যই মুনাফেক। কিন্তু সে ইসলামের ক্ষেত্রে মুনাফেক নয় যে, মুখে ইসলাম
প্রকাশ করল আর অন্তরে কুফরকে লালন করল। আর রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম] তার বাণী দ্বারা এ কথা বলেননি যে, সে খাঁটি মুনাফেক ও চির
জাহান্নামী হবে এবং জাহান্নামের নিম্নস্তরে তার অবস্থান হবে। এ অর্থটিই
বিশুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য। আল্লাহ আমাদের বোঝার তাওফীক দান করুন। আমীন!
আর রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর বাণী:
«كان منافقا خالصا»
[সে খালেস মুনাফেক] এ কথার অর্থ হল, এ চরিত্রগুলোর কারণে লোকটি
মুনাফিকদের সাথে অধিক সাদৃশ্য রাখে। আবার আরো কতক আলেম বলেন, রাসূল
[সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর এ বাণী ঐ লোকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য
যার মধ্যে এ চরিত্রগুলো প্রাধান্য বিস্তার করছে। আর যার মধ্যে প্রাধান্য
বিস্তার করেনি তবে মাঝে মধ্যে পাওয়া যায়, সে এ হাদিসের অন্তর্ভুক্ত নয়।
মুহাদ্দিসগণ হাদিসের এ অর্থটিকেই গ্রহণ করেছেন।[42]
২৮. সময় মত সালাত আদায় না করা:
মুনাফিকরা সময় মত সালাত আদায় করে না। জামাতে ঠিক মত হাজির হয় না।
তারা সালাতের জামাত কায়েম হওয়ার শেষ সময় আসে আবার সর্বাগ্রে চলে যায়।
অর্থ, আলা ইবনে আব্দুর রহমান রা. হতে বর্ণিত, একদিন তিনি বছরায় আনাস
ইবনে মালেকের বাড়ীতে প্রবেশ করেন। আর আনাস ইবনে মালেক তখন যোহরের সালাত
আদায় করে বাড়ীতে ফিরেন। তার ঘর ছিল মসজিদের একেবারে পাশেই। আলা ইবনে
আব্দুর রহমান বলেন, আমরা তার নিকট প্রবেশ করলে, তিনি আমাদের বলেন, তোমরা কি
আসরের সালাত আদায় করছ? আমরা তাকে বললাম, আমরাতো কেবল যোহরের সালাত আদায়
করে ফিরলাম। তখন তিনি বললেন, তাহলে তোমরা আসরের সালাত আদায় কর। তারপর আমরা
দাঁড়ালাম এবং আসরের সালাত আদায় করলাম। আমরা সালাতের সালাম ফিরাইলে তিনি
বলেন, আমি রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] কে বলতে শুনেছি
মুনাফিকদের সালাত হল, তারা বসে বসে সূর্যের অপেক্ষা করতে থাকে। তারপর সূর্য
যখন শয়তানের দুটি শিংয়ের মাঝে অবস্থান করে, তখন তারা তাড়াহুড়া করে
সালাতে দাঁড়ায়, কাকের ঠোকরের মত চার রাকাত সালাত আদায় করে, তাতে আল্লাহর
যিকির বা স্মরণ খুব কমই করা হয়ে থাকে।[43]
আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রহ. বলেন, তারা সালাতকে প্রথম ওয়াক্তে আদায়
করে না। সালাতকে একদম শেষ ওয়াক্তে নিয়ে যায়, যখন সালাতের সময় শেষ হয়ে
যাওয়ার উপক্রম হয়। তারা ফজর আদায় করে সূর্য উদয়ের সময়, আসর আদায় করে
সূর্যাস্তের সময়। আর তারা সালাত আদায় করে কাকের ঠোকরের মত করে। তাদের
সালাত হল, দেহের সালাত, তাদের সালাত অন্তরের সালাত নয়। তারা সালাতের মধ্যে
শিয়ালের মত এদিক সেদিক তাকায়।[44]
২৯. জামাতে সালাত আদায় করা হতে বিরত থাকা:
মুনাফিকরা জামাতে সালাত আদায় হতে বিরত থাকে। তাদের নিকট জামাতে সালাত
আদায় করা অতীব কঠিন কাজ। তাই মুমীনদের উচিত, তারা যেন জামাতে সালাত আদায়
করবে।
অর্থ, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, যে ব্যক্তি
পছন্দ করে যে, কিয়ামতের দিন সে একজন মুসলিম হিসেবে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত
করবে, সে যেন পাঁচ ওয়াক্ত সালাতসমূহের জন্য আহ্বান করা হলে, তা যথাযথ
সংরক্ষণ করে। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের নবীর জন্য হেদায়েতের বিধান চালু
করেন। আর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত হল, হিদায়েতেরই বিধান। তোমরা যদি তোমাদের
সালাতসমূহকে ঘরে আদায় কর, যেমনটি এ পশ্চাৎপদ লোকটি করে থাকে, তবে তোমরা
তোমাদের নবীর সুন্নতকে ছেড়ে দিলে। আর যখন তোমরা তোমাদের নবীর সুন্নাতকে
ছেড়ে দেবে তখন তোমরা গোমরাহ ও ভ্রষ্ট হয়ে যাবে। যে কোন ব্যক্তিই হোক না
কেন, সে যখন ভালোভাবে ওজু করবে, তারপর মসজিদসমূহ হতে কোন একটি মসজিদের দিকে
যাওয়ার জন্য রওয়ানা করে, আল্লাহ তা‘আলা তার প্রতিটি কদমে কদমে নেকি
লিপিবদ্ধ করেন, তার মর্যাদাকে এক ধাপ করে বৃদ্ধি করেন এবং একটি করে গুনাহ
ক্ষমা করেন। আমরা রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর যুগে দেখেছি
একমাত্র প্রসিদ্ধ মুনাফিক ছাড়া আর কেউ সালাত হতে বিরত থাকতো না। রাসূল
[সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর যুগে আমরা আরো দেখেছি, এক লোককে
দুইজন মানুষের কাঁধে ভর করে সালাতের কাতারে উপস্থিত করা হত।[45]
আল্লামা সুমনি রহ. বলেন, এখানে মুনাফিক দ্বারা উদ্দেশ্য ঐ মুনাফিক নয়
যারা কুফরকে গোপন করে এবং ইসলাম প্রকাশ করে। যদি তাই হয়, তাহলে জামাতে
সালাত আদায় করা ফরয হয়ে যাবে। কারণ, যে কুফরকে গোপন করে সে অবশ্যই
কাফের।[46]
৩০. অশ্লীল কথা বলা ও বেশি কথা বলা:
মুনাফিকদের স্বভাব হল, তারা কথায় কথায় মানুষকে গালি দেয়, লজ্জা
দেয়। যে কথা লোক সমাজে বলা উচিত নয়, ঐ ধরনের অশ্লীল ফাহেশা কথা বলাবলি
করত এবং তারা তাদের মজলিশে হাসাহাসি করত।
অর্থ, আবু উমামাহ রা. হতে বর্ণিত রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম] বলেন, লজ্জা ও কথা কম বলা, ঈমানের দুটি শাখা আর অশ্লীলতা ও
অতিকথন নেফাকের দুটি শাখা।[47]
ইমাম তিরমিযি রহ. বলেন, হাদিসে الْعِىُّ শব্দটির অর্থ হল, কম কথা বলা
আর الَبذَاءُ শব্দের অর্থ হল, অশ্লীল কথা বলা আর البيان অর্থ হল অধিক কথা
বলা। যেমন বক্তা বা ওয়ায়েজরা মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য ও তাদের প্রশংসা
কুড়ানোর উদ্দেশ্যে এমন এমন কথা বলে যা আল্লাহ তা‘আলা পছন্দ করে না।
আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রহ. বলেন, মুনাফিকদের অবস্থা মুসলিমদের মধ্যে
অচল মুদ্রার মত। যা অনেক মানুষই তাদের অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে গ্রহণ করে
থাকে। আর যারা অভিজ্ঞ ও যোগ্যতা সম্পন্ন তারা অবশ্যই বুঝতে পারে এটি কি আসল
মুদ্রা না নকল মুদ্রা। আর এ ধরনের অভিজ্ঞ লোকের সংখ্যা সমাজে কমই হয়ে
থাকে। দ্বীনের জন্য এ ধরনের লোকের চাইতে ক্ষতি আর কিছুই হতে পারে না। এ সব
লোকেরা দ্বীন ও ধর্মকে স্ব-মুলে উৎখাত করে ফেলে। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা
কুরআনে করীমে তাদের অবস্থাকে পরিষ্কার করেন ও চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলেন।
একাধিক বার তাদের অবস্থান, বৈশিষ্ট্য ও আলোচনা তুলে ধরেন এবং তাদের ক্ষতি
উম্মতকে থেকে সতর্ক করেন। এ উম্মতকে বার বার তাদের কারণে মাশুল দেয়া, এবং
তাদের কারণেই এ উম্মতের উপর বড় বড় মুসিবত নেমে আসায়, তাদের সম্পর্কে
ভালোভাবে জানার প্রয়োজন তীব্রভাবে দেখা দেয়। তাদের কথা শোনা হতে বেঁচে
থাকা, তাদের এবং সাথে সম্পর্ক রাখা হতে দুরে থাকা উম্মতের উপর ফরয হয়ে
গেছে। তারা কত পথিককেই না তাদের গন্তব্যের পথ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে!
তাদেরকে সঠিক পথ থেকে সরিয়ে গোমরাহি ও ভ্রষ্ট পথে নিয়ে গেছে। তারা কত
মানুষকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা ভঙ্গ করছে! আর কত মানুষকে তারা আশাহত
করছে। তারা মানুষকে ওয়াদা দিয়ে প্রতারণা করছে এবং মানুষকে ধ্বংস ও
হালাকের দিকে ঠেলে দিয়েছে।[48]
৩১. গান শ্রবণ করা:
গান-বাজনা হল মুনাফিকদের একটি অন্যতম কু অভ্যাস, যা একজন মানুষকে
আল্লাহর স্মরণ থেকে সম্পূর্ণ গাফেল করে দেয়। আর এ গান বাজনাই ছিল
মুনাফিকদের নিত্য দিনের সাথী। তারা সব সময় গান বাজনা শ্রবণ করে সময় নষ্ট
করত। বর্তমান সময়ে এ ব্যধিটি মুসলিম যুবকদের মধ্যেও প্রকট হয়ে
দাঁড়িয়েছে। মুনাফিকদের এ ঘৃণিত স্বভাব থেকে আমাদের সবাইকে বেঁচে থাকতে
হবে।
«قال عبد الله بن مسعود الغناء ينبت النفاق في القلب»
অর্থ, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ রা. বলেন, গান মানুষের অন্তরে নিফাক সৃষ্টি করে।[49]
আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রহ. বলেন, মনে রাখতে হবে, নেফাকের মুল ভিত্তি
হল, একজন মানুষের বাহ্যিক দিকটি তার অন্তরের অবস্থার বিপরীত হওয়া। একজন
গায়ক তার দুই অবস্থা হতে পারে, সে তার গানে কারো চরিত্রকে হনন করে, ফলে সে
ফাজের। অথবা সে মিথ্যা গুণগান করে তাহলে সে মুনাফেক। একজন গায়ক সে
দেখায় যে, তার মধ্যে আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি আগ্রহ আছে কিন্তু তার অন্তর
নফসের খায়েশাতে ভরপুর। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল যে সব গান বাজনা বাদ্য
যন্ত্র ও অনর্থক গলাবাজিকে অপছন্দ করে, তার প্রতি তার ভালোবাসা অটুট। তার
অন্তর এসব দ্বারাই সব সময় ভর্তি। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল যা পছন্দ করে এবং
যা অপছন্দ করে তা থেকে তার অন্তর একে বারেই খালি ও বিরান। তাদের এ চরিত্র
নিফাক বৈ আর কিছুই না।… এ ছাড়াও নেফাকের আলামত হল, আল্লাহর যিকির কম করা,
সালাত আদায়ে অলসতা করা এবং সালাতে কাকের ঠোকরের মত ঠোকর দেয়া। আর
অভিজ্ঞতা হল, যারা গান করে তাদের খুব কম লোকই আছে যাদের মধ্যে এ চরিত্রগুলো
পাওয়া যাবে না। গায়করা সাধারণত সালাতে অমনোযোগী ও আল্লাহর যিকির হতে
গাফেল হয়ে থাকে। এ ছাড়াও নেফাকের ভিত্তিই হল, মিথ্যার উপর আর গান হল
সবচেয়ে অধিক মিথ্যাচার। গানে অসুন্দরকে সুন্দর ও খারাপকে ভালো করে দেখায়
আর সুন্দরকে বিশ্রী আর ভালোকে মন্দ করে দেখায়। আর এই হল, আসল নিফাক বা
কপটতা। আরো বলা যায়, নিফাক হল, ধোঁকা, ষড়যন্ত্র ও মিথ্যাচার আর গানের
ভিত্তিই হল এ সবের উপর প্রতিষ্ঠিত।[50]
নিফাক থেকে বাঁচার উপায়।
প্রতিটি মুসলিমের উপর কর্তব্য হল, সে নিজেকে নিফাক থেকে হেফাযত করবে।
আর নেফাকের থেকে বাঁচার জন্য তাকে অবশ্যই নেক আমল সমূহের পাবন্দী করতে হবে
এবং ভালো গুণে গুণান্বিত হতে হবে। নিফাক একটি মারাত্মক সমস্যা। মুমিনের
জন্য নিফাক থেকে বাঁচার কোন বিকল্প নাই। একজন মুমিন নিফাক থেকে নিজেকে না
বাঁচাতে পারলে, সে অবশ্যই ধীরে ধীরে অধঃ:পতনের দিকে যাবে। ফলে সে এক সময়
ঈমান হারা হয়ে মারা যাবে। সুতরাং নিফাক থেকে বাঁচার কোন বিকল্প নাই।
যে সব নেক আমল সমূহের পাবন্দি করতে হবে তা নিম্নরূপ:
এক. প্রথম ওয়াক্তের মধ্যে সালাত আদায় করা এবং ইমামের সাথে তাকবীরে তাহরীমায় শরীক হওয়া।
মুনাফিকদের স্বভাব হল, তারা সালাতে দেরি করা এবং শেষ ওয়াক্তের মধ্যে গিয়ে কোন রকম সালাত আদায় করা।»
অর্থ, আনাস ইবনে মালেক হতে বর্ণিত, রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম] বলেন, যে ব্যক্তি প্রথম তাকবীরের সাথে চল্লিশ দিন জামাতে
সালাত আদায় করে, তার জন্য দুটি পুরস্কার লিপিবদ্ধ হয়, এক- তাকে জাহান্নাম
হতে মুক্তি দেয়া হবে। দুই- নিফাক থেকে তাকে মুক্তি দেয়া হবে।
অর্থাৎ, লোকটি জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও নাজাত পাবে। আর নিফাক থেকে
মুক্তি পাওয়ার অর্থ হল, সে লোকটি দুনিয়াতে মুনাফিকরা যে সব আমল করে তা
হতে মুক্ত থাকবে। মুখলিস লোকেরা যে সব আমল করে আল্লাহ তা‘আলা তাকে তা করার
তাওফীক দিবেন। আর আখেরাতে লোকটি মুনাফিকদের যে শাস্তি দেয়া হবে তা থেকে
মুক্ত থাকবে। এবং তার সম্পর্কে সাক্ষ্য দেয়া হবে যে লোকটি মুনাফেক নয়।
মোট কথা মুনাফিকরা সালাতে দাঁড়ালে অলসতা করে আর এ লোকটি তার বিপরীত
হবে।[51]
দুই. উত্তম চরিত্র ও দ্বীনের জ্ঞান:
উত্তম চরিত্র অবলম্বন ও দ্বীন সম্পর্কে জান অর্জন করার মাধ্যমে একজন
মুসলিমকে অবশ্যই নিফাক থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে হবে। কারণ, কখনোই
দ্বীনি শিক্ষাকে ভালো চোখে দেখে না, তারা সব সময় ইসলামী শিক্ষাকে পরিত্যাগ
করে এবং বিজাতীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পছন্দ করে।
অর্থ, আবু হুরাইরা হতে বর্ণিত, রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম] বলেন, একজন মুনাফেকের মধ্যে দুটি চরিত্র কখনোই একত্র হয়না,
সুন্দর চরিত্র ও দ্বীনের জ্ঞান।[52]
সুন্দর চরিত্র বলতে এখানে বুঝানো হয়েছে, সালে-হীনদের গুণে গুণান্বিত
হওয়া এবং কল্যাণকর কাজগুলো অনুসন্ধান করে তার উপর জীবন যাপন করা। আর খারাপ
ও মন্দ কাজ হতে নিজেকে নিরাপদ রাখা।
তিন. সদকা করা:
সদকা হল, নিফাক থেকে বাঁচার গুরুত্বপূর্ণ উপায়। কারণ, মানুষের অন্তরে
টাকা, পয়সা ও ধন সম্পদের লোভ অত্যধিক হয়ে থাকে। তাই সে যখন সদকা করবে
তখন তার অন্তর থেকে পার্থিব জগতের মুহাব্বাত কমবে এবং সে আখেরাতমুখী হবে।
ৱঅর্থ, আবু মালেক আল-আশয়ারী হতে বর্ণিত, রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম] বলেন, পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গ, আলহামদু লিল্লাহ মীযানকে ভরে
দেয়, আর সুবহানাল্লাহ ও আলহামদু লিল্লাহ উভয়টিকে ভরপুর করে দেয় অথবা
আসমান ও যমিনে মধ্যবর্তী সব কিছুকে ভরপুর করে দেয়। সালাত হল, নুর। সদকা হল
প্রমাণ, ধৈর্য হল আলো আর কুরআন হয় তোমার পক্ষে দলীল অথবা তোমার বিপক্ষে
প্রমাণ। প্রতিটি আত্মাই ব্যবসায়ী। কেউ হয়ত, লাভবান হয় আর কেউ হয়তো
ক্ষতিগ্রস্ত হয়।[53]
সদকা করা একজন মানুষের ঈমানদার হওয়ার উপর বিশেষ প্রমাণ। কারণ, একজন
মুনাফেক তার মধ্যে আল্লাহর উপর বিশ্বাস না থাকাতে সে কখনোই সদকা করবে না।
সুতরাং, যে সদকা করল, তা তার ঈমানের সত্যতার উপর প্রমাণ স্বরূপ।[54]
চার. কিয়ামুল্লাইল করা।
কাতাদাহ রহ. বলেন, একজন মুনাফেক কখনোই রাত জেগে ইবাদত করতে পারে না।[55]
কারণ হল, একজন মুনাফেক তখন নেক আমল করে, যখন লোকেরা তাকে দেখে আর যখন
লোকজন ঘুমিয়ে থাকে বা না দেখে, তখন তার নেক আমল করার কোন কারণ থাকে না।
সুতরাং যখন একজন লোক রাতে উঠে সালাত আদায় করে, তাহলে বুঝতে হবে লোকটি
মুনাফেক নয় বরং ঈমানদার। আমাদের সকলেরই উচিত রাতে কিয়ামুল্লাইল করা। এতে
আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ ও নিফাক থেকে বাঁচা সহজ হয়।
পাঁচ. আল্লাহর রাহে জিহাদ করা:
জিহাদ হল, ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ সোপান ও শৌর্যবীর্য। ইসলামকে দুনিয়ার
বুকে প্রতিষ্ঠা করা এবং টিকিয়ে রাখার জন্য জিহাদের কোন বিকল্প
নাই। সুতরাং, একজন ঈমানদারের জন্য যখনই সুযোগ আসবে, তাকে অবশ্যই জিহাদে
শরিক হতে হবে। অন্যথায় তার অন্তরে শহিদ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকতে হবে। যদি
কারো অন্তরে এ ধরনের আকাঙ্ক্ষা না থাকে তাকে বুঝতে হবে, তার অন্তরে নিফাকের
ব্যাধি রয়েছে।
অর্থ, আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম] বলেন, যে ব্যক্তি মারা গেল, জীবনে কখনো জিহাদ করেনি এবং
অন্তরে জিহাদের আকাঙ্ক্ষাও জাগেনি সে নিফাকের একটি অধ্যায়ের উপর মৃত্যু
বরণ করল।[56]
ইমাম নববী রহ. বলেন, এখানে অর্থ হল, যার অবস্থা এমন হবে সে যে সব
মুনাফিকরা জিহাদ করা হতে বিরত থাকে তাদের মতই হবে। কারণ, জিহাদ ছেড়ে দেয়া
নিফাকের একটি অন্যতম শাখা। হাদিস দ্বারা একটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে, যদি
কোন ব্যক্তি কোন ইবাদত করার নিয়ত করে এবং সে কাজটি করার আগেই মারা যায়
তাহলে তাকে নিন্দা করা হবে না। যেমনটি নিন্দা করা হবে ঐ ব্যক্তির যে নিয়তই
করল না।[57]
ছয়. আল্লাহর যিকির বেশি করা:
আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রহ. বলেন, আল্লাহর জিকির বেশি করে করা দ্বারা
নিফাক থেকে নিরাপদ থাকা যায়। কারণ, মুনাফিকরা আল্লাহর যিকির করেই না।
আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের সম্পর্কে বলেন,
﴿ إِنَّ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ يُخَٰدِعُونَ ٱللَّهَ وَهُوَ
خَٰدِعُهُمۡ وَإِذَا قَامُوٓاْ إِلَى ٱلصَّلَوٰةِ قَامُواْ كُسَالَىٰ
يُرَآءُونَ ٱلنَّاسَ وَلَا يَذۡكُرُونَ ٱللَّهَ إِلَّا قَلِيلٗا ١٤٢ ﴾
[النساء: ١٤٢]
“নিশ্চয় মুনাফিকরা আল্লাহর সাথে ধোঁকাবাজি করে, বস্তুত: তিনি তাদেরকে
ধোঁকায় ফেলেন, আর যখন তারা সালাতে দাঁড়ায় তখন শৈথিল্যের সাথে দাঁড়ায়;
শুধুমাত্র লোকদেখানোর জন্য এবং আল্লাহকে তারা অল্পই স্মরণ করে”। [নিসা:
১৪২]
আর কা‘ব রহ. বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর যিকির বেশি করে সে নিফাক হতে
মুক্ত থাকবে। এ কারণেই হতে পারে আল্লাহ তা‘আলা সূরা মুনাফিককে শেষ করেছেন-
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تُلۡهِكُمۡ
أَمۡوَٰلُكُمۡ وَلَآ أَوۡلَٰدُكُمۡ عَن ذِكۡرِ ٱللَّهِۚ وَمَن يَفۡعَلۡ
ذَٰلِكَ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡخَٰسِرُونَ ٩ ﴾ [المنافقون: ٩]
“হে মুমিনগণ, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর
স্মরণ হতে উদাসীন না করে। আর যারা এরূপ উদাসীন হবে, তারাই তো
ক্ষতিগ্রস্ত।” [সূরা মুনাফিকুন: ০৯] এ কথা দ্বারা। কারণ, এ আয়াতে আল্লাহ
তা‘আলা মুনাফিকদের ফিতনা থেকে সতর্ক করেন। যারা আল্লাহর যিকির থেকে গাফেল
হওয়ার কারণে নিফাকে নিপতিত হয়। কোন কোন সাহাবীকে খারেজীদের বিষয়ে
জিজ্ঞাসা করা হল, তারা কি মুনাফিক? উত্তরে তারা বলল, না। কারণ, মুনাফিকরা
আল্লাহর যিকির করে না। আল্লাহর যিকির না করা নিফাকের আলামত। আল্লাহর যিকির
করা নিফাক থেকে বাঁচার অন্যতম উপায়। যে অন্তর আল্লাহর যিকিরে মশগুল ঐ
অন্তরকে নিফাকে লিপ্ত করা কোন ক্রমেই সমীচীন নয়। নিফাক হল ঐ অন্তরের জন্য
যে অন্তর আল্লাহর যিকির হতে গাফেল ও বেখবর।[58]
সাত. দোয়া করা:
অর্থ, যুবাইর ইবনে নুফাইর হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি আবু দারদার ঘরে
প্রবেশ করে দেখি সে সালাত আদায় করছে, তারপর যখন সে তাশাহুদের জন্য বসল,
তখন তাশাহুদ পড়ে আল্লাহর নিকট নিফাক হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছে, যখন সালাম
ফিরাল আমি তাকে বললাম আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে ক্ষমা করুক হে আবু দারদা! তুমি
নিফাককে এত ভয় করছ কেন? তোমার সাথে নিফাকের সাথে সম্পর্ক কি? এ কথার
জবাবে সে তিনবার হে আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন এ কথা বলল এবং আরো বললেন, এ
মহা প্রলয় হতে কে নিরাপদে থাকবে? এ মহা প্রলয় থেকে কে নিরাপদ? আমি
আল্লাহর শপথ করে বলছি একজন লোক মুহূর্তের মধ্যে ফিতনার সম্মুখীন হয় তারপর
সে তার দ্বীন থেকে ফিরে যায়।[59]
আট. আনছারীদের মহব্বত করা:
عن أنس عن النبي صلى الله عليه وسلم قال: «آيَةُ الِإيمَان حُّب الأنَصَارِ، وَآَيُة النفاقِ بُغْضُ الأنصَارِ»
অর্থ, আনাস রা. হতে বর্ণিত, রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম]
বলেন, ঈমানের আলামত হল, আনছারদের মহব্বত করা আর নিফাকের আলামত হল, আনছারদের
ঘৃণা করা।[60]
নয়. আলী ইবনে আবী তালেব রা. কে মহব্বত করা:
عن زر قال قال علي بن أبي طالب «وَالَّذِي فَلَقَ الَحبَّةَ، وَبَرَأَ النَّسَمَةَ إِنَّهُ لَعهْدُ النَّبيِِّ الأُِّميِّ إلَي أَنَّهُ لا يُحبِّنيِ إلِا مُؤمِنٌ ولا يُبْغِضُنيِ إلِا مُنَافقِ»
অর্থ, যুর রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আলী ইবনে আবী তালেব রা. বলেন,
আমি ঐ সত্তার শপথ করে বলছি যিনি বীজ থেকে অঙ্কুর উৎপন্ন করেন এবং
মানবাত্মাকে সৃষ্টি করেন, রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] অবশ্যই
আমাকে জানান যে, আমাকে শুধু মুমিনরাই মহব্বত করবে আর যারা আমাকে ঘৃণা করবে
তারা হল মুনাফিক।[61]
মুনাফিকদের বিষয়ে একজন ঈমানদারের অবস্থান কি হওয়া উচিত?
মুনাফিকদের সাথে কোন প্রকার নমনীয়তা প্রদর্শন সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।
তাদের ক্ষতিকে কোন ক্রমেই ছোট মনে করা যাবে না। রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম] এর যুগের মুনাফিকদের তুলনায় বর্তমান যুগের মুনাফিকরা আরো
অধিক ভয়ঙ্কর।
عن حذيفة بن اليمان قال: «إن المنافقين اليوم شر منهم على عهد النبي صلى الله عليه وسلم كانوا يومئذ يسرون واليوم يجهرون»
হুজাইফা ইবনুল ইয়ামন রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, বর্তমান যুগের
মুনাফিকরা রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর যুগের মুনাফিকদের
তুলনায় আরো বেশি ভয়ঙ্কর। রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর
যুগে তারা গোপনে কাজ করত, আর বর্তমানে তারা প্রকাশ্যে মুনাফেকি করে।[62]
তাদের বিষয়ে একজন মুসলিমের অবস্থান:
১. মুনাফিকদের আনুগত্য করা হতে বিরত থাকা:
কখনোই মুনাফিকদের আনুগত্য করা যাবে না। কারণ, তারা কখনোই মুসলিমদের কল্যাণ চায় না তারা চায় ক্ষতি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ ٱتَّقِ ٱللَّهَ وَلَا تُطِعِ ٱلۡكَٰفِرِينَ وَٱلۡمُنَٰفِقِينَۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ عَلِيمًا حَكِيمٗا﴾
[الأحزاب: 1]
অর্থ, হে নবী, আল্লাহকে ভয় কর এবং কাফির ও মুনাফিকদের আনুগত্য করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সম্যক জ্ঞানী, মহাপ্রজ্ঞাময়। [আহযাব:১]
আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা তাবারী রহ. আল্লাহ তা‘আলা তার স্বীয় নবী
মুহাম্মদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] কে
বলেন, ﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ ٱتَّقِ ٱللَّهَ﴾ [হে নবী, আল্লাহকে ভয়
কর] অর্থাৎ হে নবী! তুমি আল্লাহকে তার আনুগত্যের মাধ্যমে ভয় কর। তোমার
জন্য যা করা কর্তব্য ও তোমার উপর যা ফরয করা হয়েছে, তা আদায় কর এবং যে সব
নিষিদ্ধ কাজ হতে তোমাদের নিষেধ করা হয়েছে, তা করা হতে বিরত
থাক। ﴿لَا تُطِعِ ٱلۡكَٰفِرِينَ ﴾ [আর তুমি কাফেরদের আনুগত্য করো না।]
যারা তোমাকে বলে, তুমি তোমার আশপাশ থেকে দুর্বল, গরীব, মিসকিন ও অসহায়
ঈমানদারদের সরিয়ে দাও। তাদের তুমি আনুগত্য করো না। وَٱلۡمُنَٰفِقِينَۚ আর
তুমি মুনাফিকদের আনুগত্য করো না যারা তোমার নিকট এসে প্রকাশ করে যে, তারা
ঈমানদার ও তোমার সহযোগী। বাস্তবে তারা ঈমানদার নয়, তারা কখনোই তোমাকে ও
তোমার সাথীদেরকে বন্ধু বানাবে না। তুমি তাদের থেকে কোন মতামত নিয়ো না এবং
তাদের কোন পরামর্শ গ্রহণ করো না। কারণ, তারা তোমার দুশমন ও আল্লাহর দ্বীনের
দুশমন।إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ عَلِيمًا حَكِيمٗا নিশ্চয় আল্লাহ
তা‘আলা সম্যক জ্ঞানী, মহাপ্রজ্ঞাময়। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা তারা তাদের
অন্তরে যা কিছু গোপন করে তা জানেন। আর তারা প্রকাশ্যে তোমার কল্যাণকামী
হওয়ার দ্বারা তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ও জানেন। আল্লাহ তা‘আলা তোমার ও
তোমার সাহাবীদের এবং দ্বীনের যাবতীয় কর্মের আঞ্জাম দেয়ার ক্ষেত্রে এবং
সমগ্র মাখলুকের যাবতীয় পরিচালনায় তিনি সম্যক জ্ঞানী।[63]
২. মুনাফিকদের সাথে বিতর্ক করা থেকে বিরত থাকা, তাদের ধমক দেয়া ও ভালো হওয়ার জন্য উপদেশ দেয়া:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿بَشِّرِ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ بِأَنَّ لَهُمۡ عَذَابًا أَلِيمًا﴾ [النساء : 137]
অর্থ, তুমি মুনাফিকদের সুসংবাদ দাও যে, তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। [সূরা নিসা: ১৩৭]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ يَعۡلَمُ ٱللَّهُ مَا فِي قُلُوبِهِمۡ فَأَعۡرِضۡ عَنۡهُمۡ وَعِظۡهُمۡ وَقُل لَّهُمۡ فِيٓ أَنفُسِهِمۡ قَوۡلَۢا بَلِيغٗا﴾
[النساء: 63]
অর্থ, ওরা হল সেসব লোক, যাদের অন্তরে কি আছে আল্লাহ তা জানেন। সুতরাং
তুমি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও এবং তাদেরকে সদুপদেশ দাও। আর তাদেরকে
তাদের নিজদের ব্যাপারে মর্মস্পর্শী কথা বল। [সূরা নিসা: ৬৩]
আয়াতের ব্যাখ্যা: হে মুহাম্মাদ! ঐ সব মুনাফেক যাদের বর্ণনা আমি
তোমাকে দিয়েছি, তারা তোমার নিকট বিচার ফায়সালা নিয়ে আসা বাদ দিয়ে
তাগুতের নিকট বিচার ফায়সালা নিয়ে যাওয়াতে তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে
আল্লাহ তা‘আলা জানেন। আল্লাহ তা‘আলা
বলেন, يَعۡلَمُ ٱللَّهُ مَا فِي قُلُوبِهِمۡ [তাদের অন্তরে কি আছে আল্লাহ
তা জানেন] যদিও তারা শপথ করে বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য ভালোই ছিল। আমরা কখনোই
খারাপ চাইনি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَأَعۡرِضۡ عَنۡهُمۡ وَعِظۡهُمۡ তুমি
তাদের থেকে বিরত থাক। তাদের দৈহিক ও শারীরিক কোন প্রকার শাস্তি দিও না। তবে
তাদের উপর নাযিল হওয়া আল্লাহর শাস্তি সম্পর্কে তাদের ভয় দেখিয়ে তাদের
উপদেশ দাও। আর তাদের শাস্তি হল, তারা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল সম্পর্কে যে
সন্দেহ পোষণ করে তার কারণে তাদের ঘরে বাড়ীতে আযাব নাযিল হওয়া। আল্লাহ তার
রাসূলকে নির্দেশ দিয়ে
বলেন, وَقُل لَّهُمۡ فِيٓ أَنفُسِهِمۡ قَوۡلَۢا بَلِيغٗا আর তুমি আল্লাহকে
ভয় করতে এবং তার রাসূল তাদের আযাবের যে ওয়াদা ও হুমকি দিয়েছো তার প্রতি
বিশ্বাস করতে বল।[64]
৩. তাদের সাথে বিতর্ক না করা এবং তাদের থেকে আত্মরক্ষা করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَا تُجَٰدِلۡ عَنِ ٱلَّذِينَ يَخۡتَانُونَ أَنفُسَهُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُحِبُّ مَن كَانَ خَوَّانًا أَثِيما﴾ [النساء: 107]
অর্থ, আর যারা নিজেদের খিয়ানত করে তুমি তাদের পক্ষে বিতর্ক করো না।
নিশ্চয় আল্লাহ ভালবাসেন না তাকে, যে খিয়ানত-কারী, পাপী। [নিসা: ১০৭]
অর্থ, হে মুহাম্মাদ! তুমি বিতর্ক করো না তাদের পক্ষে যারা নিজেদের
খিয়ানত করে। নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা ঐ সব লোকদের পছন্দ করেন না যাদের
গুণ হল, মানুষের সম্পদে খিয়ানত করা এবং আল্লাহ তা‘আলা যে সব কাজ করতে
নিষেধ করছে তা করা।[65]
৪. তাদের সাথে বন্ধুত্ব করা থেকে বিরত থাকা:
মুনাফিকদের কখনোই অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَتَّخِذُواْ بِطَانَةٗ مِّن دُونِكُمۡ لَا يَأۡلُونَكُمۡ خَبَالٗا وَدُّواْ مَا عَنِتُّمۡ قَدۡ بَدَتِ ٱلۡبَغۡضَآءُ مِنۡ أَفۡوَٰهِهِمۡ وَمَا تُخۡفِي صُدُورُهُمۡ أَكۡبَرُۚ قَدۡ بَيَّنَّا لَكُمُ ٱلۡأٓيَٰتِۖ إِن كُنتُمۡ تَعۡقِلُونَ﴾
[آل عمران: 118]
অর্থ, হে মুমিনগণ, তোমরা তোমাদের ছাড়া অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে
গ্রহণ করো না। তারা তোমাদের সর্বনাশ করতে ত্রুটি করবে না। তারা তোমাদের
মারাত্মক ক্ষতি কামনা করে। তাদের মুখ থেকে তো শত্রুতা প্রকাশ পেয়ে
গিয়েছে। আর তাদের অন্তরসমূহ যা গোপন করে তা মারাত্মক। অবশ্যই আমি তোমাদের
জন্য আয়াতসমূহ স্পষ্ট বর্ণনা করেছি। যদি তোমরা উপলব্ধি করতে। [সূরা
আলে-ইমরান: ১১৮]
মুসলিমদের এক দল সম্পর্কে নাযিল হয়, যাদের সহযোগী ছিল ইয়াহুদী ও
মুনাফিক। ইসলামের পূর্বে জাহিলিয়াতের যুগে তাদের সাথে যে সব কারণে
বন্ধুত্ব ছিল, সে সব কারণে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে আল্লাহ তা‘আলা তাদের
নিষেধ করেন এবং তাদের কোন বিষয়ে উপদেশ দিতে নিষেধ করেন।[66]
৫. তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা এবং তাদের বিষয়ে কঠোর হওয়া।
মুনাফিকদের বিষয়ে কোন প্রকার নমনীয়তা প্রদর্শন করা যাবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ جَٰهِدِ ٱلۡكُفَّارَ وَٱلۡمُنَٰفِقِينَ وَٱغۡلُظۡ عَلَيۡهِمۡۚ وَمَأۡوَىٰهُمۡ جَهَنَّمُۖ وَبِئۡسَ ٱلۡمَصِيرُ﴾
অর্থ, হে নবী! কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর এবং তাদের উপর কঠোর হও, আর তাদের ঠিকানা হল জাহান্নাম; [সূরা তওবা: ৭৩]
ব্যাখ্যা, আল্লাহ তা‘আলা তার স্বীয় রাসূলকে নির্দেশ দেন
যে,﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ جَٰهِدِ ٱلۡكُفَّارَ﴾ হে নবী আপনি কাফেরদের
সাথে যুদ্ধ করেন তলোয়ার ও অস্ত্র নিয়ে।وَٱلۡمُنَٰفِقِينَ আর মুনাফিকদের
সাথেও জিহাদ করুন। মুনাফিকদের সাথে জিহাদ করা অর্থ কি এ বিষয়ে,
মুফাসসিরদের মধ্যে একাধিক মত আছে, তাদের সাথে জিহাদ হল হাত ও মুখ দ্বারা।
আর যা কিছু দ্বারা তাদের সাথে জিহাদ করা সম্ভব হয়। এটিই হল, আব্দুল্লাহ
ইবনে মাসউদের মতামত।[67]
৬. মুনাফিকদের নিকৃষ্ট বলে জানা এবং কখনো তাদের কাউকে নেতা না বানানো:
عن بريدة قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: «لا تَقُولُوا للِمُناَفقِِ سَّيدٌ، فَإنِّهُ إنِْ يَكُ سَّيدًا فَقَدْ أَسْخْطُتمْ ربَّكُمْ عَزَّ وَجَلَّ»
অর্থ, বুরাইদা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম] বলেন, তোমরা মুনাফিকদের কখনোই নেতা বলে সম্বোধন করো না। কারণ,
যদি তোমরা তাদেরকে সরদার বল, তাহলে তোমরা তোমাদের রবকে অসন্তুষ্ট করলে ও
কষ্ট দিলে।
৬. তারা মারা গেলে তাদের জানাজায় অংশ গ্রহণ করা হতে বিরত থাকা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَا تُصَلِّ عَلَىٰٓ أَحَدٖ مِّنۡهُم مَّاتَ أَبَدٗا وَلَا تَقُمۡ عَلَىٰ قَبۡرِهِۦٓۖ إِنَّهُمۡ كَفَرُواْ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ وَمَاتُواْ وَهُمۡ فَٰسِقُونَ﴾
[التوبة: 84]
অর্থ, আর তাদের মধ্যে যে মারা গিয়েছে, তার উপর তুমি জানাজা পড়বে না
এবং তার কবরের উপর দাঁড়াবে না। নিশ্চয় তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে
অস্বীকার করেছে এবং তারা ফাসিক অবস্থায় মারা গিয়েছে। [সূরা তওবা: ৮৪]
«عن عبد الله قال لما توفي عبد الله بن أُبيّ جاء ابنه إلى رسول الله
صلى الله عليه
وسلم: فقال يا رسول الله، أعطني قميصَك أكفنه فيه وصلِّ عليه واستغفِر له، فأعطاه قميصه وقال إذَا فَرَغْتَ مِنْهُ فَآذِنَّا فلمّا فرغ آذنه به، فجاء ليصلّي عليه، فجذبه عمر، فقال أليس قد نهاك الله أن تصلّي على المنافقين ؟! فقال… »
অর্থ, আব্দুল্লাহ রা. হতে বর্ণিত, তিন বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই
ইবনে সুলুল মারা গেলে তার ছেলে, রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম]
এর নিকট এসে বলে, হে আল্লাহর রাসূল! তুমি তোমার পরিধেয় কাপড়টি আমার নিকট
দাও! তাতে আমি আমার পিতাকে কাফন দেবো। আর তুমি তার উপর সালাতে জানাজা পড়
এবং তার জন্য আল্লাহর দরবারে ক্ষমা চাও। তার প্রস্তাবে রাসূল [সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম] সম্মত হয়ে তাকে তার জামাটি দিয়ে দেয় এবং তাকে বলে,
তুমি যখন কাফন থেকে ফারেগ হবে, তখন আমাকে খবর দেবে। তারপর যখন তারা কাফন
থেকে ফারেগ হল, রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] কে খবর দিল। খবর
পেয়ে রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] তার উপর সালাতে জানাজা
আদায়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলে, ওমর রা. তাকে টেনে ধরে বলেন, আপনি কোথায়
যাচ্ছেন? আল্লাহ তা‘আলা কি আপনাকে মুনাফিকদের উপর সালাতে জানাজা পড়তে
নিষেধ করেনি? তখন তিনি বলেন, আমি তাদের জন্য ক্ষমা চাই বা না চাই উভয়টি
সমান। আর আমি যদি তাদের জন্য সত্তর বারও ক্ষমা চাই আল্লাহ তা‘আলা তাদের
কখনোই ক্ষমা করবে না। তখন আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল
করেন,﴿وَلَا تُصَلِّ عَلَىٰٓ أَحَدٖ مِّنۡهُم مَّاتَ أَبَدٗا وَلَا تَقُمۡ عَلَىٰ قَبۡرِهِۦٓۖ إِنَّهُمۡ كَفَرُواْ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ وَمَاتُواْ وَهُمۡ فَٰسِقُونَ﴾ আর
তাদের মধ্যে যে মারা গিয়েছে, তার উপর তুমি জানাযা পড়বে না এবং তার কবরের
উপর দাঁড়াবে না। নিশ্চয় তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করেছে এবং
তারা ফাসিক অবস্থায় মারা গিয়েছে। তারপর রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম] তাদের উপর সালাত আদায় করা ছেড়ে দেন।[68]
পরিশিষ্ট
উল্লেখিত আলোচনা দ্বারা মুনাফিকদের তৎপরতা ও নিফাকের ভয়াবহ পরিণতি
সম্পর্কে আমরা কিছুটা হলেও জানতে পারছি। নিফাক এমন একটি মারাত্মক ব্যাধি ও
নিন্দনীয় চরিত্র, যা মানুষের জন্য খুবই ক্ষতি ও মারাত্মক। রাসূল
[সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] যারা নিফাকের গুণে গুণান্বিত তাদের
গাদ্দার, খিয়ানত কারী, মিথ্যুক ও ফাজের বলে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ, একজন
মুনাফিক তার ভিতরে যা আছে, সে তার বিপরীত জিনিষটিকে প্রকাশ করে। সে নিজেকে
সত্যবাদী দাবী করলেও সে নিজেই জানে নিশ্চয় সে একজন মিথ্যুক। সে নিজেকে
আমানতদার দাবী করে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে একজন খিয়ানত কারী। অনুরূপভাবে সে
দাবি করে যে, সে প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী কিন্তু সত্যি হল, সে একজন গাদ্দার।
একজন মুনাফিক তার প্রতিপক্ষের লোকদের নানান ধরনের মিথ্যা অপবাদ দিয়ে
থাকে, অথচ সে নিজেই ফাজের অশ্লীল ও অন্যায় কাজে লিপ্ত। মুনাফিকদের চরিত্রই
হল, ধোঁকা দেয়া, প্রতারণা করা ও মিথ্যাচার করা। যদি কোন মুসলিমের মধ্যে এ
ধরনের কোন চরিত্র পাওয়া যায়, তাহলে আশংকা হয় যে, তাকে বড় নিফাক- ঈমান
হারা- আক্রান্ত করতে পারে। কারণ, নিফাকে আমলী যদিও এমন এক অপরাধ বা কবিরা
গুনাহ যা বান্দাকে ইসলাম থেকে বের করে দেয় না, কিন্তু যখন একজন বান্দার
মধ্যে তা প্রগাঢ় হয়ে যায় বা গেঁথে বসে, তখন তার চরিত্র ধীরে ধীরে
মিথ্যাচার, প্রতারণা ও ধোঁকা দেয়ায় অভ্যস্ত হয়ে থাকে। তারপর যখন তার
চরিত্রের আরো অবনতি ঘটে তখন সে আল্লাহর মাখলুকের সাথে যে ধরনের আচরণ করে,
তার প্রভুর সাথেও ঠিক একই ধরনের আচরণ করে। অত:পর তার অন্তর থেকে ঈমান হরণ
করা হয়, তার পরিবর্তে তাকে দেয়া হয়ে নিফাক, আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি ও
হুমকি।
আল্লাহর নিকট আমাদের প্রার্থনা হল, আল্লাহ তা‘আলা যেন আমাদের
অন্তরসমূহকে সংশোধন করে দেন। আমাদেরকে প্রকাশ্য ও গোপনীয় যাবতীয় ফিতনা
হতে দূরে রাখেন। আমীন!
وصلى الله وسلم على نبينا محمد.
অনুশীলনী
তোমার সামনে দুই ধরনের প্রশ্ন আছে, এক ধরনের প্রশ্ন যা তুমি সাথে সাথে
উত্তর দিতে পারবে। আর এক ধরনের প্রশ্ন আছে যে গুলো গভীর চিন্তা ভাবনা ও
ফিকির করার প্রয়োজন আছে।
প্রথম প্রকার প্রশ্ন:
1. নিফাকের শাব্দিক ও আভিধানিক অর্থ কি?
2. নিফাকের প্রকার গুলো কি?
3. নিফাকে ইতিকাদী ও নিফাকে আমলীর মধ্যে পার্থক্য কি?
4. মুনাফিকদের কিছু আলামত ও গুণ রয়েছে, সে গুলোর থেকে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আলোচনা কর।
5. একজন মুসলিম কীভাবে নিজেকে নিফাক থেকে রক্ষা করবে?
3.মুনাফিকদের সাথে একজন মুসলিমের অবস্থান কি হওয়া উচিত?
দ্বিতীয় প্রকার প্রশ্ন:
১. নিফাকে আসলি আর নিফাকে আমলীর মধ্যে পার্থক্য কি?
২. মদিনায় কেন নিফাক প্রকাশ পেল কিন্তু মক্কায় নিফাক প্রকাশ পেল না?
৩. আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, «الغناء ينبت النفاق في القلب» এ কথাটির ব্যাখ্যা কর।
৪. ইমাম নববী রহ. উল্লেখ করেন, আলেমগণ নিম্ন বর্ণিত আব্দুল্লাহ ইবনে
আমর ইবনুল আসের হাদিসটিকে মুশকিল বলে উল্লেখ করেন হাদিসটির বিশুদ্ধ অর্থ
কি?
«أَرَْبعٌ مَن كُنَّ فِيهِ كَانَ مُناَفقًا خَالصِا، وَمَن كَانَتْ فيِهِ خَصْلَةٌ مِنهْنَّ كَاَنتْ فِيهِ خَصْلٌة مِنَ النفِّاقِ حَتَّى يَدَعَهَا: إذَِا حَدَّثَ كَذََب، وَإذَِا عَاَهَد غَدرَ، وَإذَِا وَعَدَ أَْخلَفَ، وَإذَِا خَاصَمَ فَجَرَ»
অর্থ, চারটি গুণ যার মধ্যে একত্র হবে, সে সত্যিকার মুনাফিক। আর যার
মধ্যে এ চারটি গুণের যে কোন একটি থাকবে সে যতদিন পর্যন্ত তা পরিহার না
করবে, তার মধ্যে নিফাকের একটি গুণ অবশিষ্ট থাকল। গুণগুলো হল, যখন কথা বলে
মিথ্যা বলে। আর যখন কোন বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেয়, তখন তা লঙ্ঘন করে, আর যখন
ওয়াদা করে তা খিলাফ করে, যখন ঝগড়া-বিবাদ করে, সে অকথ্য ভাষায়
গালি-গালাজ করে।
সমাপ্ত
[1] দেখুন লিসানুল আরব ১০/৩৫৭ আরো দেখুন, মুজামু মাকায়েসুললুগাহ ৫/৪৫৫
[2] তাফসীরুল কুরআনীল আযীম ১/১৭২
[3] মাজমু’উল ফতওয়া ৭/৫২৪
[4] জামে’উল উলুম ওয়াল হিকাম ১/৪৩১
[5] তরীকুল হিজরাতাইন পৃঃ৫৯৫
[6] জামে’উল উলুম ওয়াল হিকাম ১/৪৩১
[7] সীয়ারে আ-লামুন নুবালা ৬/৩৮২, আল্লামা যাহাবী বলেন হাদীসের সনদটি বিশুদ্ধ।
[8] মুসলিম (২৭৫০)
[9] শরহে নববী লি-মুসলিম ১৭/৬৬-৬৭
[10] ইবনে আবি শাইবা এটি বর্ণনা করেছেন, আল-মুসান্নাফ ৮/৬৩৭।
[11] বুখারি ১/২৬।
[12] মাদারেজুস সালেকীন ১/৩৫৮।
[13] এহইয়াউ ‘উলুমুদ্দিন ৪/১৭২।
[14] জামে’উল বয়ান ২০/২৫৮
[15] মাদারেজুস সালেহীন ১/৩৫০
[16] জামেউল বায়ান ৯/৩১৯
[17] জামেয়ুল বায়ান ৯/৩২৪
[18] জামে’উল বায়ান ৫/৩২৯
[19] জামে’উল বায়ান ৯/৩৩৩
[20] মুসলিম (২৭৮৪)
[21] শরহে নববী ১৭/১২৮
[22] জামে’উল বায়ান ১/২৭২
[23] মাদারেজুস সালেকীন ১/৩৫৩
[24] তাফসীরুল কুরআন আল আযীম ৪/১৬০
[25] তাফসীরুল কুরআন আল আজীম ৪/১৬৩
[26] মাদারেজুস সালেকীন ১/৩৫৪
[27] বুখারি (৪৫৬৭) ও মুসলিম (২৭৭৭)
[28] তাফসীরুল কুরআন আল-আজীম ১৮২/২
[29] বুখারি (৪৬৬৮) মুসলিম (১০১৮)
[30] তাফসীরুল কুরআন আল-আজীম ৪/১৮৪
[31] তাফসীরুল কুরআন আল-আজীম ৪/১৯২
[32] তাফসীরুল কুরআন আল আযীম ৪/১৭৩
[33] তাফসীরুল কুরআন আল আযীম ৪/১৭৯
[34] জামে’উল বায়ান ৮/৫৩৮
[35] তাফসীরুল কুরআন আল আযীম ৪/১৬১
[36] তাফসীরুল কুরআন আল আযীম ৪/২০১
[37] তাফসীরুল কুরআন আল আযীম ৪/৪০৭
[38] তাফসীরুল কুরআনীল আজিম ২/১০৬
[39] তাফসীরুল কুরআন আল আযীম ৪/৮৩
[40] মাদারেজুস সালেকীন ১/৩৪৯
[41] বুখারি (৩৪), মুসলিম (৫৮)।
[42] শরহে মুসলিম ২/৪৬-৪৭
[43] মুসলিম (৬২২)
[44] মাদারেজুস সালেকীন ১/৩৫৪
[45] মুসলিম: (৬৫৪)
[46] দেখুন ‘আওনুল মাবুদ ২/১৭৯
[47] তিরমিযি: ২০২৭ হাকিম হাদীটিকে সহীহ বলে আখ্যায়িত করেন।
[48] তরিকুল হিজরাতাইন ৬০৩
[49] শুয়াবুল ঈমান ১০/২২৩
[50] ইগাসাতুল নাহকান ১/২৫০
[51] তুহফাতুল আহওয়াযী ২/৪০
[52] তিরমিযি (২৬৮৪) আল্লামা আলবানী রহ . হাদীসটি সহীহ বলে আখ্যায়িত করেন।
[53] মুসলিম (২২৩)
[54] শরহে নববী ৩/১০১
[55] হুলয়াতুল আওলিয়া ২/৩৩৮
[56] মুসলিম (১৯১০)
[57] শরহে নববী ১৩/৫৬
[58] আল ওয়াবেলুস সাইয়েব পৃঃ ১১০
[59] সীয়ারু আলামিন নুবালা ৬/৩৮২ আল্লামা যাহাবী বলেন, সনদটি সহীহ।
[60] বুখারি (১৭) মুসলিম (৭৪)
[61] মুসলিম কিতাবুল ঈমান (৭৮)
[62] বুখারি (৭১১৩)
[63] জামে’উল বায়ান ২০/২০২
[64] জামে’উল বায়ান ৮/৫১৫
[65] জামে’উল বায়ান ৯/১৯০
[66] জামে’উল বায়ান ৭/১৪০
[67] জামে’উল বায়ান ১৪/৩৬০
সংকলন : শাইখ মুহাম্মাদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ
অনুবাদক : জাকের উল্লাহ আবুল খায়ের
সম্পাদনা : ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব
No comments:
Post a Comment