ইমাম ও ইমামতি
আল্ হাল হামদুলিল্লাহ, ওয়াস্ সালাতু ওয়াস্ সালামু
আলা রাসূলিল্লাহ্, আম্মা বাদ:
ইমাম ও ইমামতি ইসলাম ধর্মের এবং মুসলিম সমাজের
একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং বহুল প্রয়োজনীয় বিষয়। একটি দেশ
থেকে নিয়ে একটি গ্রাম পর্যন্ত এমনকি একটি পরিবারেও এই পদের
প্রয়োজনীয়তা লক্ষণীয়। তাই এই বিষয়টির সম্পর্কে আমাদের
সমাজের প্রত্যেক ইমামকে বিশেষ ভাবে এবং অন্যান্য
মুসলিমদের সাধারণ ভাবে জ্ঞান রাখা আবশ্যক। উক্ত
কারণে বিষয়টির অবতারণা। আল্লাহ যেন সঠিক লেখার এবং তার
প্রতি আমল করার তাওফীক দেন। আমীন।
ইমাম শব্দের আভিধানিক অর্থ:
আরবী ভাষার বিশিষ্ট অভিধান ‘লিসানুল আরবে’ উল্লেখ হয়েছে,
‘মানুষ যার অনুসরণ করে, তাকে ইমাম বলে’।
ইবনু সীদাহ বলেন: ‘প্রধান ব্যক্তি কিংবা মানুষের অনুকরণীয়
ব্যক্তিকেই ইমাম বলা হয়। এর বহুবচন হচ্ছে, ‘আইম্মাহ’-ইমামগণ।
[লিসানুল আরব, ইবনে মনজুর,১২/২৪]
ফিকাহ বিশ্বকোষে বলা হয়েছে, ইমাম তাকেই বলা হয় কোন
সম্প্রদায় যার অনুসরণ করে। সেই সম্প্রদায় সঠিক পথের
অধিকারী হোক অথবা পথ ভ্রষ্ট হোক হোক।
সঠিক পথের অধিকারী অর্থে আল্লাহ বলেছেন: “আর তাদের
বানিয়েছিলাম ইমাম (নেতা) তারা আমার
নির্দেশে মানুষকে সঠিক পথ দেখাত।” [আম্বিয়া/৭৩]
পথ ভ্রষ্ট অর্থে: আল্লাহ বলেন: “আমি তাদের ইমাম (নেতা)
করেছিলাম। তারা জাহান্নামের দিকে আহ্বান করত, কিয়ামতের
দিন তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না।” [কাসাস/৪১] [ ফিকহ্
বিশ্বকোষ,৬/২১৬-২১৭]
আর ইমামাহ্-প্রচলিত ভাষায় যাকে আমরা ইমামতি বলি-
তা আরবী আম্মা-ইয়াউম্মু শব্দের মাসদার বা উৎস, যার আভিধানিক
অর্থ ইচ্ছা করা। শব্দটি অগ্রবর্তী হওয়ার অর্থে ব্যবহৃত হয়।
আরবী ভাষায় বলা হয়, আম্মাহুম এবং আম্মা বিহিমঃ অর্থাৎ যখন
সে অগ্রবর্তী হয়। [ঐ, ৬/২০১]
ইমামতির পারিভাষিক অর্থ:
ফকীহ তথা ইসলামী বিদ্বানগণের পরিভাষায় ইমামত দুই
অর্থে ব্যবহৃত হয়। যথা:
ইমামা কুবরা (বড় ইমামত)
ইমামা সুগরা (ছোট ইমামত)।
ইসলামী পরিভাষায় বড় ইমামত হচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতিনিধি হিসাবে দ্বীন ও দুনিয়ার
সাধারণ নেতৃত্ব প্রদানকরা। [প্রাগুক্ত,৬/২১৬] যাকে খলীফা,
রাষ্ট্রপ্রধান বা দেশের প্রধান নেতা বলা যেতে পারে।
আর ছোট ইমামত হচ্ছে নামাযের ইমামত। যে ব্যক্তি নামাযের
ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেয় আর নামাযীরা তাঁর অনুকরণ
করে থাকে। যেহেতু তিনি অনুকরণীয়
এবং অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী সেহেতু তাঁকে ইমাম বলা হয়।
অবশ্য ইমাম শব্দটি আরও ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।
শব্দটির আভিধানিক অর্থকে কেন্দ্র করে এমন ব্যক্তিকেও
ইমাম বলা হয়, যে বিশেষ জ্ঞানে পারদর্শী এবং সেই
জ্ঞানে সে অনুকরণীয় । তাই হাদীস শাস্ত্রে বুখারী (রহ)
কে ইমাম বুখারী বলা হয়। ফিকাহ শাস্ত্রে আবু হানীফা, মালেক,
শাফেয়ী ইত্যাদি উলামাগণের নামের শুরুতে ইমাম লেখা হয়। এ
সবই এই শব্দের ব্যাপক ব্যবহারের উদাহরণ। তবে আলোচ্য
বিষয়ে আমরা ছোট ইমামত তথা নামাযের ইমামতের আলোচনা করব।
ইনশাআল্লাহ।
নামাযের ইমামতের গুরুত্ব ও ফযীলতঃ
১- ইমামতি করা দ্বীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ
যা স্বয়ং নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
সারা জীবন করে গেছেন। অতঃপর তাঁর মৃত্যুর পর চার
খলীফা তা সম্পাদন করেছেন এবং এখনও মুসলিম সমাজের উত্তম
ব্যক্তিরাই সাধারণত: সেই উত্তম কাজটি পালন করে থাকেন।
২- পাঁচ ওয়াক্ত নামায সম্পাদন করা ইসলামের দ্বিতীয় রোকন
এবং ইসলামের স্পষ্ট প্রতীক যা মহান আল্লাহ জামাআতবদ্ধ
ভাবে আদায় করার আদেশ করেছেন। আর সেই আদেশ ইমাম ব্যতীত
বাস্তবায়িত হয় না।
৩- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইমাম ও মুয়াযযিনের
জন্য এই বলে দুয়া করেন:
“ ﺍﻹﻣﺎﻡ ﺿﺎﻣﻦ ﻭﺍﻟﻤﺆﺫﻥ ﻣﺆﺗﻤﻦ، ﺍﻟﻠﻬﻢ ﺃﺭﺷﺪ ﺍﻷﺋﻤﺔ ﻭﺍﻏﻔﺮ ﻟﻠﻤﺆﺫﻧﻴﻦ” ﺃﺧﺮﺟﻪ ﺃﺑﻮﺩﺍﻭﺩ ﻭﺍﻟﺘﺮﻣﺬﻱ
“ইমাম হচ্ছে জিম্মাদার আর মুয়াজ্জিন আমানতদার, হে আল্লাহ!
তুমি ইমামদের সঠিক পথ দেখাও কর
এবং মুয়াজ্জিনদেরকে ক্ষমা কর”। [আবু দাউদ, নং৫১৭ / তিরিমিযী,
নং ২০৭/ সহীহ সুনান আবুদাঊদ, ১/১০৫]
ইমামতীর অধিক হকদার কে?
এ প্রসঙ্গে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
বলেন:
ﻳَﺆﻡُّ ﺍﻟﻘﻮﻡَ ﺃﻗﺮﺋﻬﻢ ﻟﻜﺘﺎﺏِ ﺍﻟﻠﻪِ، ﻓﺈﻥ ﻛﺎﻧﻮﺍ ﻓﻲ ﺍﻟﻘﺮﺍﺀﺓِ ﺳﻮﺍﺀ ﻓﺄﻋﻠﻤﻬﻢ ﺑﺎﻟﺴﻨﺔ ﻓﺈﻥ ﻛﺎﻧﻮ ﻓﻲ ﺍﻟﺴﻨﺔ
ﺳﻮﺍﺀ ﻓﺄﻗﺪﻣﻬﻢ ﻫﺠﺮﺓ، ﻓﺈﻥ ﻛﺎﻧﻮﺍ ﻓﻲ ﺍﻟﻬﺠﺮﺓ ﺳﻮﺍﺀ ﻓﺄﻗﺪﻣﻬﻢ ﺳﻠﻤﺎ، ﻭﻻ ﻳﺆَﻣَّﻦَّ ﺍﻟﺮﺟﻞُ ﺍﻟﺮﺟﻞَ ﻓﻲ
ﺳﻠﻄﺎﻧﻪ، ﻭ ﻻ ﻳﻘﻌﺪ ﻓﻲ ﺑﻴﺘﻪ ﻋﻠﻰ ﺗﻜﺮﻣﺘﻪ ﺇﻻ ﺑﺈﺫﻧﻪ ” [ﺭﻭﺍﻩ ﻣﺴﻠﻢ ]
“লোকদের ইমামতি করবে ঐ ব্যক্তি যে তাদের মধ্যে আল্লাহর
কিতাব সব চেয়ে বেশী পাঠ করতে পারে। যদি তারা পাঠ করার
ক্ষেত্রে সমমানের হয়, তাহলে তাদের মধ্যে যে সুন্নতের
অধিক জ্ঞানী হবে সে ইমামতি করবে। যদি সুন্নতের
জ্ঞানে সকলে বরাবর হয়, তাহলে তাদের মধ্যে যে সর্বপ্রথম
হিজরতকারী সে ইমামতি করবে। যদি তারা সকলে হিজরতের
ক্ষেত্রেও বরাবর হয় তবে তাদের মধ্যে আগে ইসলাম গ্রহণ
করেছে সে তাদের ইমাতি করবে। কোন ব্যক্তি যেন কোন
ব্যক্তির অধীনস্থ স্থানে তার অনুমতি ব্যতীত
ইমামতী না করে এবং কোন ব্যক্তির জন্য নির্ধারিত আসনে যেন
তার অনুমতি ব্যতীত না বসে”। [মুসলিম, অধ্যায়, মাসাজিদ
এবং নামাযের স্থান সমূহ, হাদীস নং ৬৭৩]
সহীহ মুসলিমে এই বর্ণনার ঠিক পরের বর্ণনায় আগে ’ইসলাম
গ্রহণের স্থানে বয়সে বড় শব্দটি এসেছে।
উপরের বর্ণনানুযায়ী ইমামতির বেশী হকদার ব্যক্তিবর্গের
ধারাবাহিকতা এইরূপ:
১- কুরআন সব চেয়ে বেশী পাঠকারী। এখানে সব
চেয়ে বেশী পাঠকারী বলতে যার কুরআন সব চাইতে বেশী মুখস্থ
আছে তাকে বুঝানো হয়েছে। কারণ আমর বিন সালমার
হাদীসে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর আদেশ
এই ভাবে উল্লেখ হয়েছে, “যখন নামাযের সময় হবে, তখন তোমাদের
মধ্যে কেউ আযান দিবে এবং তোমাদের মধ্যে যার অধিক কুরআন
মুখস্থ আছে সে ইমামতি করবে’’। [বুখারী, অধ্যায়, মাগাযী,
হাদীস নং ৪৩০২]
২- সকলে কুরআন মুখস্থের ক্ষেত্রে সমান হলে সুন্নতের
ব্যাপারে অধিক জ্ঞানী।
৩- সুন্নতের জ্ঞানেও সকলে বরাবর হলে যে ব্যক্তি কুফরের
দেশ হতে ইসলামের দেশে আগে হিজরতকারী।
৪- হিজরতের ক্ষেত্রে সকলে বরাবর হলে, যে ইসলাম
গ্রহণে অগ্রবর্তী।
৫- আর ইসলাম গ্রহণে সবাই বরাবর হলে, যে বয়সে বড়। যেমন সহীহ
মুসলিমের পরের হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।
উপরে বর্ণিত পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের তরতীব নির্ণয়ে বিভিন্ন
উলামা ও মাজহাবের কিছু মতভেদ থাকলেও হাদীসে বর্ণিত
ধারাবাহিকতা প্রাধান্য পাবে। তবে চতুর্থের স্থানে পঞ্চম
হওয়ার সম্ভাবনা হাদীস দ্বারা স্বীকৃত। অর্থাৎ হিজরতের দিক
দিয়ে সকলে বরাবর হলে বয়সে বড় বেশী হকদার না ইসলাম
গ্রহণে অগ্রগামী হকদার? এ বিষয়ে হাদীসের শব্দের
ধারাবাহিকতায় পার্থক্য দেখা যায়। তাই কেউ
বয়সে বড়কে প্রাধান্য দিয়েছে আর কেউ ইসলাম
আগে গ্রহণকে প্রাধান্য দিয়েছে। [শারহু মুসলিম,৫ম খণ্ড,
১৭৫-১৭৭/ আর রাওযা আন নাদিয়্যাহ, মুহাম্মদ সিদ্দীক হাসান খান,
১/৩২০/ মুগনী, ইবনু কুদামাহ, ৩/১১১৬]
উপরোক্ত বিষয়ে আরো কিছু তথ্য:
ক- উপরোক্ত ধারাবাহিকতা বজায় রাখার আদেশ মোস্তাহাব আদেশ,
শর্ত নয় আর না ওয়াজিব। তাই অগ্রাধিকার প্রাপ্তের
উপস্থিতিতে অনগ্রাধিকার প্রাপ্তের ইমমতি ফুকাহাদের
সর্বসম্মতিক্রমে বৈধ। [আল্ মাওসূআহ আল ফিকহিয়্যাহ, ৬/২০৯]
খ- এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা তখন প্রযোজ্য হবে, যখন
মসজিদে নির্ধারিত ইমাম থাকবে না। আর যদি মসজিদে ইমাম
নির্ধারিত থাকে তাহলে সেই ইমামতি করার বেশী অধিকার রাখে;
যদিও তার থেকে বেশী কুরআন পাঠকারী ও সুন্নত তথা অন্যান্য
গুণের লোক উপস্থিত থাকে। কারণ নবী (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: ‘‘কোন ব্যক্তি যেন কোন ব্যক্তির
অধীনস্থ স্থানে কখনো ইমামতি না করে।” [শারহু মুসলিম,৫/১৭৭]
গ- হ্যাঁ, তবে সেই স্থানে যদি বড় ইমাম (রাষ্ট্রপ্রধান)
উপস্থিত হন, তাহলে নির্ধারিত ইমামও আর ইমামতি করার
বেশী হোকদার হবে না; বরং সেই বড় ইমাম তখন ইমামতি করার
বেশী হকদার হবেন। কারণ তাঁর কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা ব্যাপক।
[নায়লুল আউতার,৩/২০২/ শারহু মুসলিম,৫/১৭৭]
ঘ- হাদীসে বর্ণিত উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যে যদি সকলে সমান হয়,
তাহলে কী করতে হবে? এ বিষয়ে সেই হাদীসে আরো কিছু বলা হয়
নি। তবে অন্যান্য দলীলের আলোকে ইসলামী পণ্ডিতদের
অনেকে মনে করেন, তাহলে তাদের মধ্যে অধিক পরহেজগার
ব্যক্তি অগ্রাধিকার পাবে। কারণ আল্লাহ বলেন: “অবশ্যই
আল্লাহ নিকট তোমাদের মধ্যে অধিক আল্লাহ ভীরুই
বেশী সম্মানীয়।” [আল হুজুরাত/১৩] এর পরেও সকলে বরাবর
হলে তাদের মাঝে লটারি করতে হবে। সাহাবী সাআ’দ বিন অক্কাস
(রাযিঃ) একদা আযানের ব্যাপারে লটারি করেন। তাই আযানের
ক্ষেত্রে এমন করা বৈধ হলে ইমামতির ক্ষেত্রে বেশী বৈধ
হবে। [মুগনী,৩/১৬]
উল্লেখ্য যে, হানাফী মাজহাবের বিভিন্ন ফিকহের
বইতে উপরে বর্ণিত হাদীসের ৪-৫ টি পদ্ধতির শুধু ধারাবাহিকতাই
রক্ষা করা হয় নি; বরং তারা রায় ও কিয়াসের আশ্রয় নিয়ে ২০টিরও
অধিক পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন, যাতে এমন কিছু বিষয় লিখেছেন
যা রহস্যময়, লজ্জা জনক এবং অযৌক্তিক। যেমন দররে মুখতারের
লেখক সেই সকল বৈশিষ্ট্যের মধ্যে চেহারা-ছবি সুন্দর হওয়া,
স্ত্রী সুন্দরী হওয়া এমন কি মাথা বড় হওয়া এবং যৌনাঙ্গ ছোট
হওয়ার মত অযৌক্তিক ও লজ্জা জনক গুণাগুণকেও ইমামতির
অগ্রাধিকারের কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছেন।
[দুররে মুখতার,২য় খণ্ড, পৃঃ ৯৫, যাকারিয়া বুক
ডিপো দেওবন্দের ছাপা/ ত্বরীকে মুহাম্মদী, মুহাম্মদ
জুনাগড়ী,১৬২-১৬৮/ সালাফিয়্যাত কা তাআ’রুফ,
ড.রোযাউল্লাহ,২৭২-২৭৭]
ইমামের বেতন-ভাতা:
ইমামের অবস্থা হিসাবে এ বিষয়ের বিধান প্রযোজ্য হবে। একজন
ইমামের সাথে মোটামুটি নিন্মের অবস্থাগুলি সংশ্লিষ্ট
থাকতে পারে।
১- যদি ইমাম কেবল পার্থিব উদ্দেশ্যেই ইমামতি করে,
তাহলে তা হারাম ও বড় গুনাহ। মনে রাখা উচিৎ যে,
ইমামতি করা এবং আযান দেওয়া, উভয় শারয়ী কাজ
এবং তা নিঃসন্দেহে ইবাদত। আর ইবাদত কবুলের প্রথম শর্তই
হচ্ছে, ইখলাস। অর্থাৎ যে কোন ইবাদত তা যেন কেবল আল্লাহর
উদ্দেশ্যে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হয়, অর্থ পাবার
উদ্দেশ্যে কিংবা পদ লাভের উদ্দেশ্যে কিংবা নিজের
সুন্দর কণ্ঠের মাধ্যমে লোকের প্রশংসা পাওয়ার উদ্দেশ্য
থাকলে, তাতে আর ইখলাস থাকে না। যার ফলে ইবাদতটি কবুল হয়
না এবং তা ছোট শিরকে পরিণত হয় । কারণ ইবাদত, যা কেবল আল্লাহর
জন্যই খাঁটি ভাবে হওয়া কাম্য, তাতে সে পার্থিব উদ্দেশ্য
অংশী করেছে। তাই আক্বীদার পণ্ডিতগণ বলেন: মূল ইবাদতের
মাধ্যমে কেবল দুনিয়া অর্জনের উদ্দেশ্য, যেমন হজ্জ
করা পয়সার জন্য, জিহাদ করা গনিমতের সম্পদ পাওয়ার জন্য, অনুরূপ
[ইমামতি করা বেতনের জন্য], যাতে আল্লাহর কোন সন্তুষ্টির
উদ্দেশ্য থাকে না। এই প্রকারের আমল বাতিল, হারাম, বড় গুনাহ
এবং ছোট শিরক। [দেখুন, তাসহীলুল আক্বীদা,ড.জিবরীন, পৃঃ৩৭৬]
আল্লাহ বলেন:
“যারা এ দুনিয়ার জীবন আর তার শোভা সৌন্দর্য কামনা করে,
তাদেরকে এখানে তাদের কর্মের পুরোপুরি ফল আমি দিয়ে দেই,
আর তাতে তাদের প্রতি কোন কমতি করা হয় না। কিন্তু
আখেরাতে তাদের জন্য আগুন ছাড়া কিছুই নাই। এখানে যা কিছু
তারা করেছে তা নিষ্ফল হয়ে গেছে, আর তাদের যাবতীয় কাজ-
কর্ম ব্যর্থ হয়ে গেছে।) [হূদ,১৫-১৬]
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: “অবশ্যই আমল
সমূহ নির্ভর করে নিয়তের উপরে এবং প্রত্যেক ব্যক্তি তাই
পায়, যার সে নিয়ত করে থাকে।”। [বুখারী, নং১, মুসলিম, নং১৯০৭]
তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরও বলেন: “
যে ইলম আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে অর্জন করা হয় কেউ
যদি তা কেবল পার্থিব উদ্দেশ্যে তা করে তবে সে জান্নাতের
সুগন্ধও পাবে না”। [আহমদ,২/৩৩৮, আবু দাঊদ, নং (৩৬৬৪) ইবনু হিব্বান
নং (৭৮)]
উপরোক্ত দলীল-প্রমাণের আলোকে একথা সুস্পষ্ট যে,
ইমামতির উদ্দেশ্য যদি শুধু বেতন হয় কিংবা শুধু কোন পার্থিব
লাভ হয়, তাহলে সেই ইমামতি বাতিল ও হারাম। তাই আমাদের ঐসকল
ইমামদের চিন্তা করা প্রয়োজন যারা বেতন ছাড়া ইমামতি করেন
না বা বেতনের চুক্তি করেই ইমামতি করেন; নচেৎ করেন না।
২- মূলত: ইমাম যদি সওয়াবের আশায় ইমামতি করে অতঃপর সরকার
তাকে বায়তুল মাল থেকে ভাতা প্রদান করে, কিংবা কোন
সংস্থা তাকে ভাতা দেয় কিংবা কোন ব্যক্তি তাকে এ
কারণে সাহায্য দেয়, তাহলে তা গ্রহণে কোন অসুবিধা নেই
বরং তা জায়েজ। [ইসলামের শুরু যুগে যাকে বায়তুল মাল বলা হত,
বর্তমান যুগে তা অর্থ মন্ত্রণালয় বলা যেতে পারে।]
সউদী ইফতা বোর্ডকে ঐ ইমামের পিছনে নামায
পড়া বৈধতা বা অবৈধতার বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়, যে এর
ফলে সরকারী মজুরি নেয়। উত্তরে বোর্ড তাদের পিছনে নামায
পড়া বৈধ বলে ফাতওয়া দেন এবং সেই ইমামের বেতন গ্রহণকেও বৈধ
বলেন। বোর্ডের উত্তরটি নিন্মে উল্লেখ করা হল:
ফাতওয়া নং (৩৫০২) সরকারি মজুরি পায় এমন ইমামের পিছনে নামায
আদায় বৈধ কি?
উত্তর: ‘হ্যাঁ। এমন ব্যক্তির পিছনে নামায পড়া বৈধ। কারণ
সে মুসলিমদের সাধারণ দায়িত্ব পালন করে থাকে। তাই
মুসলিমদের বায়তুল মালে তার অধিকার রয়েছে, যা থেকে তার
মজুরি প্রদান করা হবে। যেমন খুলাফা, আমীর, কাজী , শিক্ষক
এবং এই রকম অন্যান্যদের তাদের দায়িত্ব পালন করার জন্য
দেওয়া হয়। এই নিয়ম নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
এর যুগ থেকে এখন পর্যন্ত চলে আসছে। অনুরূপ ইমাম ও
মুয়াজ্জিনদের তাদের দায়িত্ব পালনের কারণে আওকাফের পক্ষ
থেকে দেওয়া শস্য গ্রহণও
বৈধ।’ [সউদী স্থায়ী ফতোয়া কমিটি,৭/৪১৭]
ফিকাহ বিশ্বকোষে বর্ণিত হয়েছে, ‘এমন কাজে বায়তুল মাল
থেকে অনুদান নেওয়া বৈধ, যার মাধ্যমে সকল মুসলিম উপকৃত হয়,
যেমন বিচার বিভাগ, ফাতওয়া বিভাগ, আযান, ইমামত, কুরআন
শিক্ষা এবং হাদীস ফিকাহ এর মত
উপকারী বিদ্যা শিক্ষা ইত্যাদি। কারণ এ গুলো সাধারণ
জনকল্যাণের অন্তর্ভুক্ত’। [মাওসূআ ফিকহিয়্যাহ,২২/২০২]
পূর্বসূরি উলামাগণ বায়তুল মালের অনুদানকে ‘বিনিময়’ (ইওয়ায)
কিংবা ‘মজুরী’ (উজরাহ) বলেন নি বরং তাঁরা এটাকে ‘রায্ক’
অর্থাৎ জীবিকা বা দান বলেছেন।
ইবনে তায়মিয়্যাহ (রহঃ) বলেন: ‘আর যা বায়তুল মাল
থেকে নেওয়া হয়, তা বিনিময় ও মজুরি নয়; বরং তা আনুগত্যের
কাজে সহযোগিতার উদ্দেশ্যে অনুদান। আর সৎ কাজে অনুদান
গ্রহণ কাজটিকে নৈকট্য থেকে বের করে না আর
না ইখলাসে ব্যাঘাত ঘটায়; ব্যাঘাত ঘটলে গনিমতের হকদার হত না’।
[প্রাগুক্ত,২২/২০২]
৩- বায়তুল মাল বা সরকারি ব্যবস্থাপনার অবর্তমানে যদি কোন
সংস্থা বা মসজিদ কমিটি ইমামদের মাসিক সাহায্য বা অনুদান দেয়,
তাহলে তা বায়তুল মালেরই স্থলাভিষিক্ত হিসাবে গণ্য হবে।
৪- ইমাম যদি অর্থশালী হয় তবে ইমামতির জন্য বেতন-
ভাতা না নেওয়াই উত্তম। কিন্তু ইমাম যদি অভাবী হয় এবং ইমামতীর
দায়িত্ব পালনের কারণে নিজস্ব প্রয়োজন ও তার সংসারের
প্রয়োজনীয় অর্থ যোগান দিতে অক্ষ হয় তবে তার জন্য
এতখানি মাসিক বেতন বা সাহায্য নেওয়া বৈধ, যার মাধ্যমে তার ও
তার সাংসারিক অভাব পূরণ হয়। আল্লাহ তাআ’লা ইয়াতীমের
অভিভাবকদের আদেশ করেন:
“আর যে অভাব মুক্ত সে যেন বিরত থাকে আর যে অভাবগ্রস্ত
সে যেন ন্যায়সঙ্গত ভাবে ভোগ করে।” [আন্ নিসা/৬]
তাই অনেকে অভাবী ইমামদের সাহায্য নেওয়াকে এই আদেশের উপর
কেয়াস করত: বৈধ বলেছেন। তাছাড়া অভাবীর অভাব দূরীকরণ
ইসলামের একটি সুন্দর মৌলিক বিধান।
উল্লেখ থাকে যে, ইমাম, মুয়াজ্জিন, দ্বীনের দাঈ
এবং মক্তবের শিক্ষক যারা তাদের সময়ের অধিকাংশ এই রকম দ্বীনই
কাজে ব্যায় করে থাকেন তাদের বেতন-ভাতার
ব্যবস্থা সরকারকে বায়তুল মাল থেকে করা উচিৎ।
সরকারি ব্যবস্থা না থাকলে ইসলামী সংস্থাগুলো করা
প্রয়োজন। যদি এমন সংস্থাও না থাকে তাহলে এসব কাজের
কমিটি এমনকি ব্যক্তি বিশেষকেও করা দরকার। কারণ উপরোক্ত সৎ
কাজ সমূহ দ্বীনের ও মুসলিম সমাজের মৌলিক ও সাধারণ
জনকল্যাণের কাজ, যা শূণ্য হয়ে গেলে বা হ্রাস পেলে ইসলাম ও
মুসলিম সমাজের অপুরণীয় ক্ষতি সাধিত হবে।
৫- কোন অমুসলিম সরকার যদি ইমাম ভাতার ব্যবস্থা করে এবং এর
বিনিময়ে সরকার যদি তাদের উপর কোন অবৈধ কাজের শর্তারোপ
না করে, তাহলে সাধারণত: সেই ভাতা গ্রহণ বৈধ হবে। কারণ
লেনদেনের মূলনীতি হচ্ছে, বৈধতা। তাছাড়া মজুরি গ্রহণের
ক্ষেত্রে মজুরিদাতার মুসলিম হওয়া শর্ত নয়। [ওয়াল্লাহু
আ’লাই]
ইমামতি ছাড়া ইমামের কিছু পছন্দনীয় কাজ:
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, একজন ইমামের মূল দায়িত্ব
হচ্ছে ইমামতি করা। সে একজন আমানতদার হিসাবে নিষ্ঠার
সাথে তার দায়িত্ব পালন করবে। কিন্তু যেহেতু
সে মুসাল্লীদের দৃষ্টিতে আদর্শ, সেহেতু তাকে এই
দায়িত্বকে গনিমত ভেবে সুযোগের সদ্ব্যবহার করা দরকার
এবং তাকে এমন কিছু দ্বীনী ও সামাজিক কাজ আঞ্জাম
দেওয়া প্রয়োজন, যার মাধ্যমে সেই মসজিদের মুসল্লীবর্গ সহ
সেই গ্রাম ও মহল্লার লোকেরা যেন সঠিক দ্বীন জানতে পারে,
ইসলামি আদর্শে আদর্শবান হতে পারে এবং সুন্দর সমাজ
গড়ে তুলতে পারে।
সম্মানিত ইমাগণের উদ্দেশ্যে নিন্মে কিছু ভাল কাজের
সূচী প্রদত্ত হল:
১- মুসাল্লীদের সংখ্যা ও উপযুক্ত সময়ের দিকে খেয়াল
রেখে দৈনন্দিন কোন নামায শেষে সংক্ষিপ্ত ৮-১০ মিনিট
বিভিন্ন আলোচনার ব্যবস্থা করা। এই ক্ষেত্রে সুন্দর নিয়ম হল,
কোন যোগ্য আলেমের বই ধারাবাহিক ভাবে পাঠ করা। আক্বীদা,
পাক-পবিত্রতা, নামাযের নিয়ম-পদ্ধতি, ইসলামি শিষ্টাচার, হালাল-
হারাম ও এই ধরনের বিষয়াদিকে প্রাধান্য দেওয়া দরকার।
২- মৌসুম অনুযায়ী বিষয় পরিবর্তন
করা এবং সে হিসাবে আলোচনা করা। যেমন রামাযান মাসে রোযার
বিভিন্ন মাসায়েল, কুরবানী ও হজ্জের সময় সে সব মাসায়েল,
ফসলাদি কাটার সময় উশর-যাকাতের মাসায়েল। বর্তমান সউদী আরবের
বেশীর ভাগ মসজিদে এই নিয়ম লক্ষ্য করা যায়।
৩- মক্তব-মাদ্রাসার ব্যবস্থা থাক কিংবা না থাক, কুরআন
শিক্ষার ব্যবস্থা করা। এ ক্ষেত্রে শিশুদের
সাথে সাথে বড়দের জন্যও আলাদা ভাবে ব্যবস্থা করা।
৪- মসজিদে মহিলাদের নামায পড়ার ব্যবস্থা না থাকলে,
ব্যবস্থা করতে মুসাল্লীদের উদ্বুদ্ধ করা।
৪- পর্দার ব্যবস্থা করে মহিলাদের জন্য মাসিক বা পাক্ষিক
দ্বীন শিক্ষা ও দাওয়াতের ব্যবস্থা করা।
৫- মাঝে মাঝে মসজিদে সকাল সন্ধ্যা ও নামায শেষে পঠনীয়
দুয়া ও যিকির শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
৬- নিজের সম্মান বজায় রেখে অন্যের পারিবারিক ঝগড়া-বিবাদ
মীমাংসায় অংশ নেওয়া।
৭- ধীরে ধীরে মসজিদ লাইব্রেরী গঠন করা। মসজিদ
লাইব্রেরী বলতে সেই গ্রন্থ সমাহারকে বুঝায় যা ইসলামের
মৌলিক গ্রন্থ হিসাবে পরিচিত এবং যা মসজিদে পঠন-পাঠনের
জন্যই নির্দিষ্ট। যেমন কুরআন, কুরআনের তাফসীর,
বুখারী মুসলিম সহ অন্যান্য হাদীস গ্রন্থ এবং কুরআন-সুন্নাহ
ভিত্তিক ফিকাহ গ্রন্থ। এর মাধ্যমে যেমন ইমাম স্বয়ং উপকৃত হয়,
তেমন মুসাল্লীরাও বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বচক্ষে দলীল-
প্রমাণ দেখতে পায়।
৮- আগ্রহ ও ইখলাসের সহিত অসুস্থ মুসল্লীদের যিয়ারত
করা এবং তাদের জানাযায় শরীক হওয়া; কারণ এটা যেমন নেকীর কাজ,
তেমন এক মুসলিম ভাইর প্রতি অপর মুসলিম ভায়ের অধিকার ও
ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধির বিরাট বড় উপায়।
৯- মাঝে মাঝে ভাল আলেমকে নিয়ে এসে বিশেষ আলোচনার
ব্যবস্থা করা।
১০- মাঝে মাঝে মসজিদের আয়োজনে ও
তত্ত্বাবধানে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা।
যে সব কাজ থেকে ইমামকে বিরত থাকা উচিৎ:
যেহেতু ইমামতি একটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বীনই পদ, সেহেতু
ইমামকে যেমন এই কাজের যোগ্য হতে হবে, তেমন
তাকে আরো কিছু মহৎ গুণের অধিকারী হওয়া উচিৎ যেমন, সততা,
সত্যবাদিতা, চরিত্রবান এবং এই ধরনের অন্যান্য ভাল গুণ। এই সব
আনুষঙ্গিক গুণ থাকলে তার কথার ও আদেশ-উপদেশের
সমাজে সহজে প্রভাব পড়বে এবং তা গ্রহণীয় হবে। কিন্তু
কারো মধ্যে উপরে বর্ণিত ইমামতির হকদারের গুণগুলি থাকলেও
যদি এই আনুষঙ্গিক গুণগুলি না থাকে, তাহলে সেই ইমাম সাধারণত:
তার সমাজে কামিয়াব ইমাম বিবেচিত হয় না। তাই প্রত্যেক
ইমামকে তার সমাজে প্রচলিত কিছু এমন কাজ-কর্ম ও অভ্যাস
থেকে বিরত থাকা উচিৎ, যা করলে স্বয়ং সে দ্বীনের দিক
থেকে লাভবান হতে পারবে, তার কথা ও কাজ অধিক গৃহীত হবে এবং]
সে আত্মমর্যাদার জীবন-যাপন করবে। ইনশাআল্লাহ।
১- গণতান্ত্রিক দেশে সাধারণত: কোন রাজনৈতিক দলের
সাথে জড়িত না থাকা। কারণ তিক্ত হলেও সত্য যে, আমাদের
সমাজের অধিকাংশ লোক কোন না কোন ভাবে রাজনীতির
সাথে জড়িত কিংবা প্রভাবিত। যার ফলে তারা ইসলামের
দৃষ্টিতে নয়; বরং রাজনীতির নীতিতে একে অপরকে ভাল-মন্দ
বিবেচনা করে থাকে। তাই ইমাম কোন দলের সাথে সম্পৃক্ত
হলে প্রথমেই সে মুসাল্লীদের একটি বড় অংশের অন্তর
থেকে বাদ পড়ে যাবে এবং তার মূল উদ্দেশ্য বিফল হয়ে যাবে।
অতঃপর তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হবে। পরিশেষে হয়ত:
ইমামতি হারাতে হবে, বেইজ্জত হতে হবে, সমাজ
ভেঙ্গে যাবে আর অনেক সময় মসজিদ ভেঙ্গে আরো একটি মসজিদ
নির্মাণ হবে, যা খুবই দুঃখজনক ও নিন্দনীয়।
২- আত্মমর্যাদার সবসময় খেয়াল রাখা। নিজের অভাব-অনটন ও
মুখাপেক্ষিতা সবার কাছে পেশ না করা তার হাবভাবে প্রকাশ
না করা। কারণ এর ফলে ইমাম তার মুসাল্লীদের ও গ্রামবাসীদের
নজরে ছোট হয়ে যায়, মর্যাদা হারিয়ে ফেলে। ফলস্বরূপ তার
আদেশ-উপদেশও তাদের কাছে হাল্কা হয়ে যায়। অনেক সময় লোক
তাকে মর্যাদা দেয়া তো দূরের কথা তাকে দেখলেই উপহাসের
ছলে কথা বলে।
৩- কুরআন ও দ্বীনই শিক্ষার দায়িত্ব থাকলে ছেলে ও মেয়েদের
জন্য ভিন্ন ভিন্ন পড়ার ব্যবস্থা করা। সম্ভব না হলে ছেলেদের
সাথে শুধু নাবালিকা মেয়েদের পড়ার দায়িত্ব ভার নেওয়া। কারণ
এটা যেমন দ্বীনই বিধান তেমন অনেক শয়তানী চক্রান্ত ও বদনাম
থেকে বাঁচার উপায়।
৪- কেবল প্রয়োজনে বৈধ ঝাড়-ফুঁক করা। কিন্তু এটাকে নিজের
পেশা বা স্বভাবে পরিণত না করা। কারণ একাজ সাধারণত: বৈধ
দিয়ে শুরু হয় এবং পরে বিভিন্ন কারণে হারামে পরিণত হয়। (যেমন,
তাবিজ ব্যবসা)
৫- মহল্লা বা গ্রামের বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে দাওয়াত
পাওয়া ছাড়া অংশ না নেওয়া এবং এ বিষয়ে ধনী ও দরিদ্রের
পার্থক্য না করা। এসব অনুষ্ঠানের ফলে কিছু পাওয়ার লোভ
না করা আর না কিছু চুক্তি করা। তবে না চাইতে কেউ কিছু দান
করলে তা গ্রহণ করা অবৈধ নয়।
৬- বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্বন্ধে শারিয়ার বিধান স্পষ্ট
করে বলে দেওয়া এবং নিজের জন্য এ সম্পর্কে সেই বিধান
অনুযায়ী একটি সঠিক অবস্থান নির্ণয় করা, যেন আপনার কোথাও
অংশ নেওয়া বা না নেওয়া সেই শারঈ কারণে হয়। যার
ফলে আপনি বলতে সক্ষম হবেন যে, আপনি কোন অনুষ্ঠানে কেন
যান আর অন্য অনুষ্ঠানে কেন উপস্থিত হন না।
১-যার অবস্থা অজ্ঞাত, এমন ইমামের পিছনে নামাযঃ
কোথাও অপরিচিত ইমামের পিছনে নামায আদায় করার সময়
মুসাল্লীকে ইমামের
দ্বীনী অবস্থা সম্পর্কে জানা বা খোঁজ নেওয়া জরূরী নয়;
বরং তার বাহ্যিক অবস্থাই গ্রহণীয়। আবুল্ ইয্ শারহু
আক্বীদাতিত্ ত্বাহাবিয়ায় বলেনঃ ‘মুক্তাদীর জন্য ইমামের
আক্বীদা জানা শর্ত নয় আর না তাকে পরীক্ষা করবে এই বলে যে,
তোমার আক্বীদা কি? বরং সে অবস্থা অজ্ঞাত এমন ইমামের
পিছনে নামায আদায় করবে’। [শারহুল্ আক্বীদা আত্
ত্বাহাবিয়্যাহ,২/৫৬৮]
সউদী স্থায়ী উলামা পরিষদকে জিজ্ঞাসা করা হয়,
যে ব্যক্তি কোন শহরে বা গ্রামে অবস্থান করে, তার উপর
জরূরী কি যে, সে নামায আদায়ের পূর্বে তার ইমামের
অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে?
উত্তরে পরিষদ বলেনঃ ‘তার উপর এটা জরূরী নয় এবং অজ্ঞাত
ইমামের পিছনে তার নামায পড়া বৈধ কিন্তু যদি তার মধ্যে এমন
কিছু দেখে যা দ্বীনে মন্দ। কারণ মুসলিমের
অবস্থা সম্পর্কে নীতি হল, তাদের সম্পর্কে সুধারণা রাখা,
যতক্ষণে এর বিপরীত প্রকাশ না পায়’। [ফাতাওয়াল্ লাজনা,৭/৩৬৩]
২-শির্ককারী ইমামের পিছনে নামাযঃ
মুসলিম হিসাবে পরিচিত কিন্তু সে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের
নিকট দুআ-প্রার্থনা করে, নবী, অলী ও সৎ লোকদের আল্লাহর
নৈকট্যকারী মনে করে, মৃত কথিত অলীদের
উদ্দেশ্যে কুরবানী করে, মানত করে, কবরস্থ সৎ দরগাহ
বাসীকে কল্যাণকারী বা ক্ষতি সাধনকারী বিশ্বাস করে, এমন
ইমামের পিছনে নামায বৈধ কি? এ বিষয়ে উপরোক্ত
সউদী ফাতাওয়া বোর্ডকে জিজ্ঞাসা করা হলে, তারা তার
পিছনে নামায অবৈধ বলেছেন। কারণ এসব ইবাদত বা এর কোন অংশ
আল্লাহ ব্যতীত অন্যের জন্য করা শির্ক, যা মানুষকে ইসলামের
গোণ্ডী থেকে বের করে দেয়। [দেখুন, ফাতাওয়াল্
লাজনা আদ্দায়িমাহ,৭/৩৫৩-৩৫৯, বিষয়ঃ মুশরিকের পিছনে নামায]
৩-ফাসেক এবং বিদআতী ইমামের পিছনে নামাযঃ
[ফাসেক, বড় গুনাহকারী বা বারংবার ছোট গুনাহকারী ব্যক্তি।
আর এখানে বিদআতী বলতে ঐ বিদআতকে বুঝানো হয়েছে যা, কুফর
নয়।]
ক- উপরোক্ত মন্দ গুণের অধিকারী ইমামের পিছনে নামায সহীহ।
বিশেষ করে সেই ইমাম যদি রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক নির্ধারিত হয়
এবং তাকে অপসারণ করার
ক্ষমতা না থাকে কিংবা তাকে সরাতে গিয়ে যদি ফেতনা-
ফাসাদের আশংকা থাকে, তাহলে তার পিছনে নামায শুদ্ধ।
এটা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের একটি আক্বীদাও। ইমাম
ত্বাহাবী বলেনঃ ‘আমরা আহলে কিবলার প্রত্যেক পরহেযগার
এবং গুনাহগার ব্যক্তির পিছনে নামায জায়েয মনে করি’। [শারহুল
আক্বীদা আত্ ত্বাহাবিয়া,২/৫৬৬]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “লোকদের
ইমামতি করবে, তাদের মধ্যে আল্লাহর কিতাব অধিক পাঠকারী” ।
[মুসলিম, নং (৬৭৩)] এখানে নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আদেশ আম/ব্যাপক।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক প্রকার ইমামের
সম্পর্কে বলেনঃ “তারা (ইমামেরা) তোমাদের নামায পড়াবে,
যদি তারা সঠিক করে, তাহলে তোমাদের নামাযের সওয়াব তোমাদের
জন্যে আর যদি সে ভুল করে তাহলে তোমাদের সওয়াব তোমাদের
জন্যে এবং তাদের ভুল তাদের জন্যে”। [বুখারী, আযান অধ্যায়,
নং ৬৯৪]
সাহাবাগণের মধ্যে ইবনে উমার যিনি সুন্নতের
প্রতি সদা আগ্রহী হিসাবে পরিচিত, তিনি অত্যাচারী গভর্নর
হাজ্জাজ বিন ইউসেূফের পিছনে নামায সম্পাদন করতেন। [বুখারী,
হজ্জ অধ্যায়, নং ১৬৬০]
ইমাম আহমদ সহ তাঁর যুগের উলামাগণ মুতাযেলীর পিছনে জুমআ ও
ঈদের নামাযে হাজির হতেন। [মুগনী, ইবনু কুদামাহ,৩/২২]
সউদী স্থায়ী উলামা পরীষদের ফাতওয়ায় বিদআতী ইমামের
পিছনে নামায সম্পর্কে বলা হয়, যদি বিদআত কুফর ও শির্ক
পর্যায়ের হয়, তাহলে তার পিছনে নামায অশুদ্ধ আর বিদআতকারীর
বিদআত যদি কুফরী পর্যায়ের না হয়, যেমন মুখে উচ্চারণ
করে নিয়ত পড়া, তাহলে তার নিজের নামায শুদ্ধ এবং তার
পিছনে নামায আদায়কারীর নামাযও শুদ্ধ।
[ফাতওয়া নং (১২০৮৭),৭/৩৬৪-৩৬৫]
এ বিষয়ে একটি মূলনীতি হচ্ছে, ‘যার নিজের নামায শুদ্ধ তার
ইমামতীও শুদ্ধ’। [আশ্ শারহুল্ মুমতি, ইবনে উসাইমীন, ৪/২১৭]
এসব বিধান ও নিয়মের মূল কারণ হচ্ছে, ইসলামী ঐক্য ও
সংহতি রক্ষা। ইসলাম সদা ঐক্যের আদেশ দেয় এবং মতভেদ
থেকে সতর্ক করে। তাই দেখা যায়, যেখানে মানুষ ইমামদের
সাধারণ ভুল-ত্রুটি নিয়ে মতভেদ করে,
সেখানে লোকেরা দলে দলে বিভক্ত হয়, এক পর্যায় একাধিক
মসজিদ তৈরি হয়, এমনকি গ্রাম ও মহল্লা ভেঙ্গে আপসে ঘোর
শত্রুতায় লিপ্ত হয়।
কিন্তু বিদআতী ও ফাসেক ইমামের বর্তমানে যদি মুআহ্হিদ ও
মুত্তাকী ইমামের পিছনে নামায পড়া সম্ভব হয়, তাহলে পরহেযগার
ও সহীহ আক্বীদা পোষণকারী ইমামের পিছনে নামায পড়া উত্তম।
কারণ, অবশ্যই ফাসেক থেকে মুত্তাক্বী উত্তম এবং বিদআত
থেকে সুন্নত উত্তম। আল্লাহ বলেনঃ “তোমাদের
মধ্যে আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তিই বেশী সম্মানীয়
যে ব্যক্তি বেশী মুত্তাক্বী।” [সূরা হুজুরাত/১৩]
উদাহারণ স্বরূপ যদি কারো বাড়ির পার্শে দুটি মসজিদ থাকে,
একটির ইমাম সুন্নাহ ও তাক্বওয়ার অধিকারী আর অপরটির ইমাম
বিদআত ও ফিসকে লিপ্ত, তাহলে সে প্রথমটির পিছনে নামায আদায়
করবে; যদিও সেই মসজিদটি দূরে অবস্থিত হয়।
৪-নাবালেগের ইমামতীঃ
বালেগ এর বিপরীত নাবালেগ। শরীয়ার দৃষ্টিতে নিম্নের
তিনটি বিষয়ের যে কোন একটির প্রকাশ পাওয়া বালেগ হওয়া বুঝায়।
১-পনের বছর বয়স পূরণ হওয়া।
২-গুপ্তাঙ্গের চতুর্পার্শে লোম উদগত হওয়া।
৩-যৌন চেতনার সাথে জাগ্রত বা নিদ্রাবস্থায় বীর্যপাত হওয়া।
আর মহিলাদের ক্ষেত্রে আর একটি বিষয় যোগ হবে,
তা হচ্ছে মাসিক স্রাব আসা। মাসিক স্রাব প্রকাশ মহিলাদের
বালেগা হওয়ার আলামত। [শারহুল্ মুমতি, ইবনে উসায়মীন,৪/২২৪]
ছয়-সাত বছরের নাবালেগ ছেলে যদি নামাযীদের মধ্যে অধিক
কুরআন মুখস্থকারী হয়, তাহলে তার ইমামতি সিদ্ধ। আমর বিন
সালামাহ বলেনঃ আমাকে তারা (গোত্রের সাহাবারা) ইমাম
বানিয়ে দেয়। সেই সময় আমার বয়স ছয় কিংবা সাত বছর ছিল। কারণ
তারা নিজেদের মাঝে খোঁজে দেখে যে, আমারই সর্বাধিক
কুরআন মুখস্থ রয়েছে। [বুখারী, অধ্যায়, মাগাযী, অনুচ্ছেদ
নং ৫৩, হাদীস নং ৪৩০২]
৫-অন্ধ ব্যক্তি ও দাসের ইমামতিঃ
অন্ধ ব্যক্তির ইমামতি নিঃসন্দেহে বৈধ। আনাস (রাযিঃ)
থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
উম্মে মাকতূমের পূত্রকে মদীনায় দুইবার স্থলাভিষিক্ত
করেছিলেন। তিনি তাদের ইমামতি করতেন এবং তিনি অন্ধ ছিলেন।
[আবু দাঊদ, সালাত অধ্যায়, নং৫৯৫/আহমাদ,৩/১৯২]
ইবনে উমার থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পূর্বে মদীনার কুবার নিকট
হিজরতকারীদের আবু হুযায়ফার (রাযিঃ) দাস সালেম
ইমামতি করতেন কারণ তিনি বেশী কুরআন মুখস্থকারী ছিলেন।
[বুখারী, অধ্যায়ঃ আযান, নং৬৯২]
ইমাম বুখারী উক্ত হাদীসের অনুচ্ছেদ যেই
শিরোনামে রচনা করেন, তা হলঃ ‘দাস ও স্বাধীনকৃত দাসের
ইমামতি’।
আয়েশা (রাযিঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে, তারঁ জনৈক দাস তাঁর
ইমামতি করতো। [মুগনী,৩/২৬]
৬-বোবা ও বধির ব্যক্তির ইমামতিঃ
বোবা ব্যক্তি, সে জন্মগত বোবা হোক কিংবা পরে কোন
কারণে বোবা হোক, তার ইমামতি জায়েয নয়; কারণ সে নামাযের
রুকন ও ওয়াজিব উচ্চারণ করতে অক্ষম। যেমন
তকবীরে তাহরীমা বলা, সূরা ফাতিহা পাঠ করা, তাশাহ্হুদ পাঠ
করা ইত্যাদি। তবে তার নিজের নামায সহীহ। [মুগনী,৩/২৯,শারহুল
মুমতি,৪/২২৬-২২৭]
বধির ব্যক্তির ইমামতির সম্পর্কে কিছু উলামা বলেনঃ যেহেতু
তার মাধ্যমে নামাযের কাজ ও শর্ত সমূহের ব্যাঘাত ঘটে না, তাই
তার অবস্থা অন্ধ ব্যক্তির ন্যায়। আর যেমন অন্ধের
ইমামতি জায়েয তেমন তারও জায়েয। কিন্তু কিছু উলামা এই
বলে বধির ব্যক্তির ইমামতি অশুদ্ধ বলেছেন যে, যেহেতু
সে ভুল করলে তাকে সুবহানাল্লাহ বলে ভুলের সংকেত
দেওয়া অনর্থক, তাই তার ইমামতি সিদ্ধ নয়। [মুগনী,৩/২৯]
মূলতঃ বোবা ও বধির ব্যক্তির ইমামতি সম্পর্কে স্পষ্ট কোন
দলীল বর্ণিত হয় নি, তাই উলামাগণের মধ্যে এই মতভেদ।
৭-মহিলার ইমামতিঃ
মহিলার জন্য মহিলার ইমামতি বৈধ। নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মু অরাকা (রাযিঃ) কে আদেশ করেন,
তিনি যেন তার বাড়ির সদস্যদের ইমামতি করেন। [আবু দাঊদ, সালাত
অধ্যায়, অনুচ্ছেদঃ মহিলার ইমামতি,নং ৫৯১, ইবনু
খুযায়মা বর্ণনাটিকে সহীহ বলেছেন]
আয়েশা (রাযিঃ) হতে প্রমাণিত, তিনি মহিলাদের ইমামতি করতেন
এবং লাইনের মাঝে দাঁড়াতেন। [মুসান্নাফ আব্দুর
রাজ্জাক,নং৫০৭৬, দারাকুত্বনী/বায়হাক্বী]
তবে তারা ইমামতির সময় পুরুষের মত লাইন
থেকে আগে বেড়ে পৃথক স্থানে দাঁড়াবে না; বরং লাইনের
মাঝেই অবস্থান করতঃ ইমামতি করবে। এটা কিছু সাহাবিয়ার আমল
দ্বারা প্রমাণিত। [আর রাওদা আন নাদিয়্যাহ, সিদ্দীক হাসান
খাঁন,১/৩২২]
কিন্তু মহিলার জন্য বৈধ নয় যে, তারা পুরুষের ইমামতি করবে।
[প্রাগুক্ত,৩১২-৩১৩] এ বিষয়ে নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আমল, খুলাফায়ে রাশেদীনের আমল
এবং ধারাবাহিক মুসলিম উম্মার আমলই বড় প্রমাণ, যে তাঁরা কেউ
মহিলাকে পুরুষের ইমাম নিযুক্ত করেন নি আর না তাদের
যুগে এমন কোন নজীর ছিল।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘‘ঐ সম্প্রদায়
কখনো সফলকাম হতে পারে না, যারা কোন মহিলাকে তাদের
বিষয়াদির নেতা নিযুক্ত করে”। [বুখারী, অধ্যায়ঃ মাগাযী,
নং৪৪২৫] যেহেতু ইমামতি এক প্রকারের নেতৃত্ব, তাই তাদের এ
পদে নিযুক্ত করা অবৈধ। [দেখুন শারহুল মুমতি,৪/২২২]
৮-রুকু, সাজদা, কিয়াম, কুঊদ করতে অপারগ ব্যক্তির ইমামতিঃ
সাধারণতঃ রুকু, সাজদা, কিয়াম, কুঊদ সহ নামাযের অন্যান্য রুকন
পালন করতে অক্ষম ব্যক্তি এ সব পালনে সক্ষম ব্যক্তির
ইমামতি করতে পারে না। কারণ এ ক্ষেত্রে ইমামের
অবস্থা মুক্তাদী অপেক্ষা দুর্বল, যা ইমামের জন্য
বাঞ্ছনীয় নয়। তবে মসজিদের নির্ধারিত সবল ইমাম যদি কোন
কারণে নামায পড়ানোর সময় কিয়াম করতে (দাঁড়াতে) অক্ষম
হয়ে পড়ে কিংবা অসুস্থতার কারণে শুরু থেকেই
দাঁড়িয়ে নামায আদায় করতে অক্ষম হয়, তাহলে সেই ইমাম
বসে নামায পড়াতে পারেন। কিন্তু এই সময় দাঁড়াতে সক্ষম
মুক্তাদীগণ বসে নামায পড়বে না দাঁড়িয়ে? এ বিষয়ে উত্তম মত
হল, ইমাম যদি প্রথমে দাঁড়ানো অবস্থায় নামায শুরু করে থাকেন
আর মাঝে বসে পড়ান, তাহলে মুক্তাদীগণ দাঁড়িয়ে নামায
সম্পাদন করবেন। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
এর মৃত্যুর পূর্বে অসুস্থকালে আবু বকর (রাযিঃ)
দাঁড়িয়ে নামায শুরু করলে নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বাম পার্শে বসে ইমামতি করেন আর
আবু বকর সহ অন্যান্য সাহাবাগণ দাঁড়িয়ে নামায আদায়
করতে থাকেন। কারণ এখানে প্রথমে আবু বকর (রাযিঃ)
দাঁড়িয়ে ইমামতি শুরু করেছিলেন। আর যদি ইমাম শুরু থেকেই
বসে নামায পড়ান, তাহলে মুক্তাদীরাও বসে নামায পড়বেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “যখন ইমাম
বসে নামায পড়াবে তখন তোমরাও বসে নামায পড়বে”। [বুখারী, আযান
অধ্যায়ঃ নং৬৮৯/ মুসলিম, সালাত অধ্যায়, নং৪১১/ বিস্তারিত
দেখুন, শারহুল্ মুমতি,৪/২২৮-২৩৬]
৯-উম্মী তথা অজ্ঞ ব্যক্তির পিছনে নামাযঃ
এখানে উম্মী বা অজ্ঞ বলতে ঐ ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে,
যে সূরা ফাতেহা ভাল করে পড়তে পারে না; যদিও সে অন্য
সূরা ভাল করে পড়তে সক্ষম হয়। যেমন ‘রা’ কে ‘লা’
পড়ে কিংবা হরকত ভুল পড়ে যেমন, যেরের স্থানে যবার
পড়ে বা যবারের স্থানে যের বা পেশ পড়ে, যার ফলে শব্দের
অর্থ পরিবর্তন হয়ে যায়। উদাহরণ স্বরূপ (ইহ্ দিনা) অর্থ আমাদের
সঠিক পথ দেখাও এর স্থানে পড়ে (আহ্ দিনা) অর্থ আমাদের
হাদিয়া-উপহার দাও কিংবা (আন্ আম্ তা) অর্থ তুমি অনুগ্রহ
করেছো এর স্থানে পড়ে (আন্ আম্ তু) অর্থ আমি অনুগ্রহ
করেছি। তাহলে এমন উম্মী ইমামের পিছনে শুদ্ধ
সূরা ফাতিহা পাঠকারীর নামায বৈধ নয়। তবে উপস্থিত সকল লোক
যদি সূরা ফাতিহা অশুদ্ধ পাঠকারী হয়, তাহলে তাদের একে অপরের
ইমামতি বৈধ। কারণ আল্লাহ তাআ’লা সাধ্যের অতিরিক্ত
জরূরী করেন না। কিছু উলামার মতে সূরা ফাতিহা অশুদ্ধ
পাঠকারীর পিছনে শুদ্ধ সূরা পাঠকারীর নামায বৈধ কিন্তু
এটা উচিৎ নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
বলেনঃ “লোকদের ইমামতি করবে তাদের মধ্যে আল্লাহর কিতাব
অধিক পাঠকারী”। [মুসলিম, অধ্যায়ঃ মাসাজিদ, নং ৬৭৩ এবং ২৯০,
আরো দেখুন, আল্ মুগনী,৩/২৯-৩০, শারহুর্ মুমতি,৪/২৪৫-২৪৯,
ফতাওয়াল লাজনা,৭/৩৪৮]
১০-কিছু আনুসাঙ্গিক বিষয়ঃ
ক-ইমামতির জন্য বিবাহিত হওয়া শর্ত নয়।
[সউদী স্থায়ী ফাতাওয়া পরিষদ,৭/৩৮২]
খ-ব্যভিচারীর সন্তানের ইমামতি অন্য মানুষের ন্যায়। তার
মায়ের পাপের কারণে তার ইমামতি প্রভাবিত হবে না। [প্রাগুক্ত
ফাতাওয়া পরিষদ,৭/৩৮৮]
গ-ইমামতির সময় অযু নষ্ট হলে অন্য কোন মুক্তাদীকে ইমাম
নিযুক্ত করা বৈধ। [প্রাগুক্ত,৭/৩৯৫]
নামাযের পূর্বে ইমামের করণীয়
১-আযানের পর কিছুক্ষণ বিরতি প্রদানঃ
আযানের পর এবং নামায শুরু করার পূর্বে ইমাম কতক্ষণ
বিরতি দিবেন বা অপেক্ষা করবেন, তার কোন নির্দিষ্ট
সময়সীমা সহী হাদীস দ্বারা বর্ণিত নয়। তবে বিভিন্ন হাদীসের
আলোকে কিছুক্ষণ বিরতি দেওয়া প্রমাণিত। কারণ
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ ‘‘প্রত্যেক
দুই আযানের মাঝে নামায রয়েছে’’। [বুখারী,নং ৫৮৮] অর্থাৎ
আযান ও ইকামতের মাঝে নফল নামায আছে।
এমনকি তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাগরিবের
ফরয নামাযের পূর্বেও নামায পড়ার আদেশ দেন।
তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
বলেনঃ ‘‘তোমরা মাগরিবের পূর্বে নামায পড়, তোমরা মাগরিবের
পূর্বে নামায পড়, তৃতীয়বারে বলেনঃ যার
ইচ্ছা।” [বুখারী নং ১১৮৩]
তাছাড়া আযানের উদ্দেশ্যই হল, লোকদের সংবাদ
দেওয়া যে নামাযের সময় হয়ে গেছে, যাতে করে তারা অযু
করে নামাযের প্রস্তুতি নিয়ে মসজিদে উপস্থিত হয়। তাই
আযানের পর সময় না দিলে এই মূল উদ্দেশ্যই নষ্ট নয়।
ইশার নামায সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, নবী (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যদি মসজিদে লোকদের অধিক
হারে উপস্থিতি দেখতেন, তাহলে তিনি (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটু আগেই নামায শুরু করতেন আর
যদি সংখ্যা কম দেখতেন তো একটু বিলম্ব করতেন। [বুখারী,
নং ৫৬৫]
উপরোক্ত তথ্যানুসারে এটা স্পষ্ট যে, আযান ও ইকামতের
মাঝে কিছুক্ষণ সময় অপেক্ষা করা প্রমাণিত ও মুস্তাহাব।
তবে নির্দিষ্টরূপে এর সময়সীমা কতখানি হবে তা বর্ণিত নয়। তাই
বিভিন্ন নামাযের পূর্বে সুন্নতে রাতেবার দিকে লক্ষ্য
রেখে, নামাযীদের দুর কিংবা নিকটে অবস্থানের দিকে লক্ষ্য
রেখে এবং আরো অন্যান্য বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রেখে ইমাম
সময়সীমা নির্ধারণ করতে পারেন। অনুরূপ ইমাম ও
মুক্তাদী উভয়ের সম্মতিতে যদি কোন সময় সুচী নির্ধারণ
করা হয়, কিংবা সরকার বা মসজিদ কমিটির পক্ষ্য
থেকে সময়সূচী নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, যা সকলকে এক
সাথে জামাআতের সাথে নামায আদায় করতে সহায়ক, তাহলে এই রকম
করা অনুচিৎ নয়। তবে তাদের অবশ্যই খেয়াল রাখা দরকার যে,
বিরতি যেন এত দীর্ঘ না হয় যাতে আউয়াল ওয়াক্ত শেষ হওয়ার
আশংকা থাকে কিংবা এত কম না হয় যাতে লোকদের মসজিদে আসা ও
সুন্নত পড়া বাধাগ্রস্থ হয়।
২-সুতরা না থাকলে সুতরা করে নেওয়াঃ
সুতরা উঁচু বিশিষ্ট এমন বস্তুকে বলে যা নামাযী তার সাজদার
স্থানের সম্মুখে রাখে, যেন কেউ তার ভিতর দিয়ে অতিক্রম
না করে এবং এর বাইরে যা কিছু ঘটে সেই দিকে নামাযীর ধ্যান
না যায়।
দেয়াল, প্রাচির, বেড়া, খুঁটি, লাঠি, বর্শা, বল্লম, গাছ, পাথর,
বাহন (গাড়ি-ঘোড়া) ইত্যাদি লম্বা কিংবা চওড়া বিশিষ্ট বস্তু
সুতরার জন্য প্রযোজ্য। [মুগনী,৩/৮০, আল্ মুলাখ্খাস আল্
ফিকহী,৭২-৭৩]
ইমাম যখন তাঁর মিহরাবে (ইমাম দাঁড়ানোর স্থান) দেয়ালের
নিকটে নামায পড়াবে তখন সেই দেয়াল তার
সুতরা হিসেবে বিবেচিত হবে। তখন আর অন্য ভিন্ন
সুতরা মেহরাবে রাখার প্রয়োজন নেই। তাই নবী (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মিহরাবে সুতরা থাকার প্রমাণ
পাওয়া যায় না। তবে ইমাম যদি মসজিদের মাঝে নামায পড়ায়
কিংবা ফাঁকা স্থানে নামায পড়ায় অর্থাৎ সামনের স্থান
খালি থাকে, কারো অতিক্রম করার আশংকা থাক কিংবা না থাক,
তাহলে সামনে সুতরা রাখা মুস্তাহাব। নবী (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
” ﺇﺫﺍ ﺻﻠّﻰ ﺃﺣﺪﻛﻢ، ﻓﻠﻴُﺼﻞّ ﺇﻟﻰ ﺳُﺘﺮﺓ، ﻭﻟﻴﺪْﻥُ ﻣﻨﻬﺎ ”
“তোমাদের কেউ যখন নামায পড়বে, তখন যেন
সে সুতরা সামনে করে নামায পড়ে এবং তার নিকটবর্তী হয়”। [আবু
দাঊদ, নং ৬৯৮, ইবনু মাজাহ নং ৯৫৪, ইবনু খুযায়মাহ নং ৮৪১, সূত্র
হাসান]
উপরোক্ত বিধানটি ইমাম ও একাকী নামাযী উভয়ের জন্য
প্রযোজ্য তবে ইমাম সুতরা করলে আর মুক্তাদীদের সুতরা করার
প্রয়োজন নেই, এটাই অধিকাংশ বিদ্বানের মত। [মুগনী,৩/৮১]
সুতরার দৈর্ঘতা এক বিঘত কিংবা এক গজ হওয়া এবং নামাযীর
সাজদা ও সুতরার মাঝে একটি ছাগল পার হওয়ার মত
ফাঁকা থাকা প্রমাণিত। [মুসলিম, অধ্যায়, সালাত,অনুচ্ছেদ,
মুসল্লীর সুতরা,নং ১১১২, ১১১৪,১১৩৪/বুখারী নং ৪৯৪]
প্রকাশ থাকে যে, কিছু উলামা সুতরা করাকে ওয়াজিব বলেছেন,
অনেকে সুন্নতে মুআক্কাদাও বলেছেন,
তবে জমহূরে উলামা সুতরা করাকে মুস্তাহাব বলেছেন। পারত
পক্ষে এই বিধান পরিত্যাগ করা উচিৎ নয়।
৩-লাইন সোজা করার আদেশ প্রদানঃ
নামাযে দাঁড়ানোর সময় লাইন সোজা করা, বরাবর হওয়া, লাইনের
মাঝে জায়গা ফাঁকা না রাখা এবং প্রথম লাইন পূর্ণ করার
পূর্বে দ্বিতীয় লাইন তৈরি না করা ওয়াজিব আমলের
অন্তর্ভুক্ত। এটি যেমন মুক্তাদীদের কর্তব্য তেমন ইমামেরও
দায়িত্ব যে, সে নামায শুরু করার পূর্বে এর আদেশ
করবে এবং যথাসম্ভব নিজে তা পর্যবেক্ষণ করবে।
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামায শুরু করার
পূর্বে বলতেনঃ
ﺳﻮّﻭﺍ ﺻﻔُﻮﻓﻜﻢ ﻓﺈﻥ ﺗﺴﻮﻳﺔ ﺍﻟﺼﻒ ﻣﻦ ﺗﻤﺎﻡ ﺍﻟﺼﻼﺓ ” ﺭﻭﺍﻩ ﺍﻟﺒﺨﺎﺭﻱ ﻭ ﻣﺴﻠﻢ ”
“তোমরা তোমাদের লাইন সোজা করে নাও কারণ লাইন
সোজা করা নামাযের পরিপূর্ণতার অন্তর্ভুক্ত” [বুখারী,
অধ্যায়ঃ আযান, নং ৭২৩/ মুসলিম, অধ্যায়ঃ স্বালাত, নং ৯৭৪]
আনাস (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ নবী (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তকবীরে তাহরীমা দেয়ার
পূর্বে আমাদের দিকে মুখ করে দাঁড়াতেন এবং বলতেন
তোমরা একে অপরের সাথে ঘেষে দাঁড়াও
এবং সোজা হয়ে দাঁড়াও” [বুখারী, অধ্যায়ঃ আযান, নং ৭১৯/মুসলিম
অধ্যায়ঃ নামায নং ৯৭৫]
৪-ইমামতির সময় ইমামের অবস্থানঃ
ক-ইমামতির সময় ইমাম মুক্তাদীদের তুলনায় উঁচু
স্থানে অবস্থান করবে না। ইবনে মাসঊদ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত,
তিনি বলেন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইমামের
কোন কিছুর উপরে অবস্থান করা আর মুক্তাদীদের তার
থেকে নিম্ন স্থানে অবস্থান করা থেকে নিষেধ করেছেন।”।
[দারা কুত্বনী, জানাযা অধ্যায়] তবে নামাযের নিয়ম-
পদ্ধতি শিক্ষা দানের উদ্দেশ্যে ইমামের উঁচু
স্থানে ইমামতি করা বৈধ। [বুখারী, মাসাজিদ অধ্যায়ঃ নং৯১৭]
খ-ইমামের সাথে যদি এক পুরুষ ব্যক্তি নামায
পড়ে তাহলে সে ইমামের ডান দিকে দাঁড়াবে। যদি ভুল
করে সে তার বাম পার্শে দাঁড়ায়, তাহলে ইমাম তাকে তার ডান
পার্শে করে নিবে। আর ইমামের সাথে যদি দুই কিংবা দুইয়ের
অধিক পুরুষ ব্যক্তি শুরু থেকে নামায পড়ার জন্য উপস্থিত
থাকে, তাহলে ইমাম আগে বেড়ে নামায পড়াবে আর
তারা পিছনে এক লাইনে দাঁড়াবে। যদি ইমামের সাথে এক
ব্যক্তি নামায পড়তেছে এমতাবস্থায় দ্বিতীয় ব্যক্তি শরীক
হতে চায়, তাহলে মুক্তাদী দুজন পিছনে চলে আসবে আর ইমাম নিজ
স্থানে থেকে ইমামতি করবে। কিন্তু দ্বিতীয়
ব্যক্তি যদি ইমামের বাম পার্শে গিয়ে দাঁড়ায়, তাহলে ইমাম
তাদের দুই জনকে পিছনে করে দিবে। যদি ইমামের সাথে পুরুষ,
মহিলা ও নাবালেগ বাচ্চা নামায পড়ে, তাহলে পুরুষেরা ইমামের
পিছনে লাইন করবে অতঃপর পুরুষ বাচ্চারা লাইন করবে অতঃপর
মহিলারা। যদি ইমামের সাথে একজন পুরুষ ও এক বা একাধিক
মহিলা নামায পড়তে চায়, তাহলে পুরুষ ব্যক্তি ইমামেন ডান
পার্শে দাঁড়াবে আর এক বা একাধিক
মহিলা পিছনে আলাদা লাইনে দাঁড়াবে। [দেখুন নায়লুল আউত্বার,
শাওকানী, অধ্যায়ঃ ইমাম ও মুক্তাদীদের অবস্থান..অনুচ্ছেদ
নং ২১০, ৩/২২৬-২২৯]
গ-সকল নাবালেগ বাচ্চাদের এক লাইনে দাঁড় করালে যদি তাদের
গোলমাল করার এবং বড়দের নামাযে বিঘ্ন ঘটার আশংকা থাকে,
তাহলে বড়রা বাচ্চাদের মাঝে মাঝে নিয়ে নামায পড়তে পারে।
[শারহুল্ মুমতি, ইবনু উসাইমীন,৪/২৭৮]
৫-ইমাম মুসাফির হলে নামাযীদের বলে দেওয়া, যেন তারা নামায
পূরণ করে নেনঃ
মুসাফির ইমামের পিছনে মুকীম নামায পড়লে, ইমামের সালামের পর
নামায পূরণ করতে হবে। এই সময় মুসাফির ইমাম সালাম ফিরানোর পর
বলবেঃ আপনারা নামায পূরণ করে নিন কারণ আমি মুসাফির।
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কা বিজয়ের সময়
মক্কাবাসীদের ইমামতিকালে এইরূপ বলতেন। [আবু দাঊদ, সফর
অধ্যায়, নং (১২২৯) মুআত্বা,২/২০৬] এই কথাটি নামাযের পূর্বেও
বলা যেতে পারে। [মাজমুঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাঈল,
ইবনে উসাইমীন/১৫/১৫৩]
নামাযরত অবস্থায় ইমামের করণীয়
১-নামাযের রুকন ও ওয়াজিব কাজসমূহ পূর্ণরূপে সম্পাদন করাঃ
নামায পড়ানোর সময় ইমামের সবচেয়ে বড় করণীয় হচ্ছে, নামাযের
রূকনগুলি ও ওয়াজিবগুলি পূর্ণরূপে ধীর-স্থিরতার
সাথে সম্পাদন করা।কিয়াম, কুঊদ, রুকূ, সাজদা, রুকূ থেকে উঠা,
দুই সাজদার মাঝে বসা ইত্যাদি কাজগুলি এমন ভাবে সম্পাদন
করা যেন একটি কাজ শেষ হওয়ার আগে অপরটি শুরু না করা হয়। যেমন
রূকূ থেকে উঠে ভালভাবে সোজা না হয়েই সাজদা করা। অনুরূপ
এক সাজদা থেকে উঠে ভাল করে না বসেই দ্বিতীয় সাজদা করা।
ফুকাহাগণ স্থিরতার সংজ্ঞায় বলেছেনঃ একটি কাজ করার সময়
মানুষের অঙ্গের যেই নড়া-চড়ার প্রয়োজন হয় তা স্থির হওয়ার পর
এতখানি স্থির থাকা যাতে ভালবাবে একবার তাসবীহ
[সুবহানাল্লাহ] বলা সম্ভব হয়। উলামাগণের নিকট এই
বিষয়টি ‘তা’দীলুল আরকান’ নামে পরিচিত, যা করা ওয়াজিব।
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
তাড়াহুড়া করে নামায পাঠকারীকে পুনরায় নামায পড়ার আদেশ
দেন। [বুখারী,নং ৭৯৩/ মুসলিম]
২-মুক্তাদীদের অবস্থার খেয়াল রাখাঃ
ইমামতির সময় ইমামকে খেয়াল রাখা উচিৎ যে, তার
পিছনে মুক্তাদীদের অবস্থা একরকম নয়; বরং কেউ দুর্বল, কেউ
অসুস্থ, কেউ বয়স্ক, কেউ প্রয়োজনীয় কাজের সাথে জড়িত
এমনকি অনেক মায়ের সাথে তাদের ছোট সন্তানও থাকে। তাই
লম্বা সূরা দ্বারা এবং যতটুকু যথেষ্ট তার অতিরিক্ত দুআ ও
যিকির দ্বারা নামায দীর্ঘ না করা। একদা এক
সাহাবী লম্বা সূরা দ্বারা নামায পড়ালে নবী (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে ‘সাব্বিহিস্মা রাব্বিকাল্ আ’লা,
ওয়াশ্ শাম্ সি ওয়া যুহাহা’ দ্বারা নামায পড়াতে আদেশ করেন।
[বুখারী, আযান অধ্যায়, নং ৭০৫] নবী (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
” ﺇﺫﺍ ﺻﻠّﻰ ﺃﺣﺪﻛﻢ ﻟﻠﻨﺎﺱ ﻓﻠﻴُﺨﻔﻒ، ﻓﺈﻥ ﻣﻨﻬﻢ ﺍﻟﻀﻌﻴﻒ ﻭﺍﻟﺴﻘﻴﻢ ﻭﺍﻟﻜﺒﻴﺮ. ﻭ ﺇﺫﺍ ﺻﻠّﻰ ﺃﺣﺪﻛﻢ ﻟﻨﻔﺴﻪ
ﻓﻠﻴﻄﻮﻝ ﻣﺎ ﺷﺎﺀ ” -ﺭﻭﺍﻩ ﺍﻟﺒﺨﺎﺭﻱ
“যখন তোমাদের কেউ লোকদের ইমামতি করবে, তখন যেন সে নামায
হালকা করে, কারণ তাদের মধ্যে দুর্বল, অসুস্থ ও বয়স্ক লোক
থাকে। আর যখন সে একা নামায পড়বে, তখন যত ইচ্ছা দীর্ঘ করবে”।
[বুখারী, অধ্যায়ঃ আযান নং ৭০৩]
৩-প্রয়োজনে ইমামতির সময় অন্যকে স্থলাভিষিক্ত করাঃ
ইমামতিকালে যদি ইমামের অযু নষ্ট হয়ে যায় কিংবা আরো অন্য
কারণে তাকে মাঝখানে নামায ছাড়তে হয়, তাহলে তার
পিছনে উপস্থিত মুক্তাদীদের কাউকে তার স্থানে করে দিবে।
ইমাম কাউকে নির্ধারণ না করলে স্বইচ্ছায় মুক্তাদীদের কেউ
ইমাম হয়ে যাবে এবং বাকি নামায পূরণ করবে। এমতাবস্থায়
সে ইমামের নায়েব/স্থলাভিষিক্ত ইমাম। সে নতুন করে নামায
শুরু থেকে পড়াবে না; বরং যেখান থেকে পূর্বের ইমাম নামায
ছেড়েছে সেখান থেকে বাকি নামায পূর্ণ করবে। উমর (রাযিঃ)
কে ইমামতি কালে শত্রু ছুরি দ্বারা আঘাত
করলে তিনি সাহাবী আব্দুর রহমান বিন আউফ (রাযিঃ)
কে স্থলাভিষিক্ত করেন।
[ফাতাওয়া সউদী স্থায়ী উলামা পরিষদ,৭/৩৯৩-৩৯৫]
উল্লেখ্য, ইমাম যদি অযু ছাড়াই নামায পড়ায়, তাহলে তার নামায
বাতিল কিন্তু মুক্তাদীদের নামায সহীহ। [ফাতহুল বারী,২/২৪৩]
আর যদি কোন নির্দিষ্ট মুক্তাদী তার ইমামের বেঅযু
সম্পর্কে জানতে পারে, কিন্তু অন্যরা তা না জানতে পারে,
তাহলে যে জানে তার নামায বাতিল কিন্তু
যারা জানে না তাদের নামায শুদ্ধ। এমতাবস্থায় ইমাম যদি নামাযরত
অবস্থায় নিজের অযু নেই তা জানতে পারে, তাহলে সে ততক্ষণাৎ
অন্যকে তার স্থানে স্থলাভিষিক্ত করে অযু করবে, আর নামায
শেষ করার পর জানতে পারলে সে অযু করে নিজের নামায পুনরায়
আদায় করবে।
অনুরূপ কোন ইমাম যদি জেনে-বুঝে নাপাকী নিয়ে নামায আদায়
করে, তাহলে তার নামায বাতিল। কিন্তু
সে যদি অজান্তে নাপাকী নিয়ে নামায পড়ে অতঃপর নামাযরত
অবস্থায় তা জানতে পারে, তাহলে নামাযরত অবস্থায় তা দূর
করা সম্ভব হলে দূর করবে যেমন জুতা, মোজা,
টুপি বা পাগড়িতে নোংরা লেগে থাকলে তা খুলে ফেলে দিবে
এবং নামায পূরণ করবে।[আবু দাঊদ নং (৬৫০/ইবনু খুযায়মা নং (১০১৭]
আর নামাযরত অবস্থায় তা দূর করা সম্ভব না হলে নামায
ছেড়ে অন্যকে ইমাম করে দিয়ে পাক হবে। তবে নামায শেষ করার পর
তা জানতে পারলে সহীহ মতানুসারে তাদের পুনরায় নামায আদায়
করতে হবে না। [ মাজমুউল ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়া,২২/১৮৪-১৮৫]
৪-নামাযে ছোট-বড় সূরা পাঠ ও
বিশেষসূরা চয়নে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর
তরীকা অবলম্বনঃ
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সূরা ফাতিহার পর সব
নামাযে এক ধরনের সূরা পড়তেন না আর না সব নামাযের সময়সীমা এক
হত; বরং তিনি কোন ওয়াক্তে দীর্ঘ সূরা পড়তেন আবার কোন
সময়ে ছোট। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
বেশীরভাগ ক্ষেত্রে শেষের রাকাআতগুলির তুলনায় প্রথম
রাকাআতের কিরাআত দীর্ঘ করতেন। তাই ইমামকে মুক্তাদীদের
অবস্থা বুঝে এসব মুস্তাহাব বিষয়গুলিরও খেয়াল রাখা উচিৎ।
আবু ক্বাতাদাহ তার
পিতা থেকে বর্ণনা করেনঃ“নবী (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যহরের প্রথম দুই
রাকাআতে সূরা ফাতিহা এবং আরো দুটি সূরা পড়তেন,
প্রথমটি লম্বা করতেন এবং দ্বিতীয়টি সংক্ষিপ্ত আর অনেক সময়
তাঁর আয়াত পড়া শোনা যেত। তিনি (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
আসরে সূরা ফাতিহা এবং আরো দুটি সূরা পাঠ করতেন।
তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফজরের নামাযের
প্রথম রাকাআত দীর্ঘ করতেন আর দ্বিতীয়টি সংক্ষিপ্ত”।
[বুখারী, অধ্যায়ঃ আযান, হাদীস নং ৭৫৯]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, “তিনি (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রথম রাকাআত যতখানি দীর্ঘ করতেন
ততখানি দ্বিতীয় রাকাআতে করতেন না। এই ভাবে তিনি আসর ও
সাকালেও করতেন”। [বুখারী, নং ৭৭৬]
অনুরূপ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জুমআর
ফজরে, জুমআর নামাযে, দুই ঈদের নামাযে এবং বিতরের
নামাযে বিশেষ সূরা বেশীরভাগ সময়ে পড়তেন, তাই ইমামকেও
তা করা মুস্তাহাব। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
জুমআর দিনে ফজরের প্রথম রাকাআতে আলিফ্ লাম্ মীম
তানজীল্ আস্ সাজদাহ (সূরা সাজদাহ) এবং দ্বিতীয়
রাকাআতে সূরা দাহ্ র পাঠ করতেন। [বুখারী, জুমআ অধ্যায়,
নং৮৯১] আর জুমআর নামাযের প্রথম রাকাআতে সূরা ফাতিহার পর
সূরা ‘আ’লা’ (সাব্বিহিসমা রাব্বিকাল্ আ’লা) এবং দ্বিতীয়
রাকাআতে ‘গাশিয়াহ্’ (হাল্ আতাকা হাদীসুল্ গাশিয়াহ) পাঠ
করতেন। এমনকি জুমআর দিনে যদি ঈদ একত্রিত হত, তাহলে জুমআহ ও
ঈদ উভয় নামাযে এই দুটি সূরা পাঠ করতেন। [মুসলিম, জুমআহ
অধ্যায়ঃ নং ২০২৫/আবু দাঊদ/তিরমিযী]
তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জুমআর নামাযের
প্রথম রাকাআতে সূরা ‘জুমুআহ্’ এবং দ্বিতীয়
রাকাআতে সূরা ‘মুনাফেকূন’ ও পাঠ করতেন। [মুসলিম, অধ্যায়
জুমুআহ, নং২০২৩/আবু দাঊদ নং১১২৪/তিরমিযী নং৫১৯]
তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক সাথে তিন
রাকাআত বিতর পড়লে প্রথম রাকাআতে সূরা ফাতিহার পর
সূরা আ’লা, দ্বিতীয় রাকাতে ‘কাফেরূন’ এবং তৃতীয়
রাকাআতে সূরা ‘ইখলাস’ পাঠ করতেন। [সহীহ সুনান নাসাঈ নং১৬০৬]
৫-সালাম ফিরানোর পর মুক্তাদীদের দিকে মুখ করে ফিরে বসাঃ
ইমাম সালাম ফিরানোর পর কিবলামুখী হয়ে বেশীক্ষণ থাকবেন
না বরং; তিনিবার আস্তাগ্ ফিরুল্লাহ এবং একবার
আল্লাহুম্মা আনতাস্ সালাম ও মিনকাস্ সালাম
তাবারাকতা ইয়া যাল্ জালালি ওয়াল্ ইকরাম বলতে যতক্ষণ সময়
লাগে ততক্ষণ শেষে মুক্তাদীদের দিকে মুখ করে বসবেন, এটাই
সুন্নত। মুক্তাদীদের দিকে ফিরার সময় ডান দিক কিংবা বাম
দিকে ঘুরে অতঃপর মুসল্লীদের দিকে মুখ করে বসা, উভয় নিয়ম
প্রমাণিত। [বুখারী, আযান অধ্যায়ঃ নং ৮৫২, মুসলিম,
অধ্যায়ঃ মুসাফেরীনদের নামায, নং৭০৮/শারহুল মুমতি,৪/৩০৫-৩০৬]
ইমামতির বিবিধ মাসাইল
১-যে ইমামকে মুসল্লীগণ অপছন্দ করে তার ইমামতি:
এমন ইমাম যাকে মুসাল্লীরা অপছন্দ করে সেই ইমামের
ইমামতি করা মাকরূহ। তবে বিদ্বানগণ মনে করেন, অপছন্দের কারণ
যেন দ্বীনী কারণ হয়; কোন দুনিয়াবী কারণ না হয়। অনুরূপ
অপছন্দকারীর সংখ্যা যেন বেশী হয়, দু-চার জনের অপছন্দ
করা যথেষ্ট নয়। [নায়লুল আউত্বার, শাওকানী,৩/২২৫]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “তিন শ্রেণীর
লোকের নামায তাদের মাথার উপর থেকে এক বিঘতও উঠানো হয়
না (অর্থাৎ তাদের নামায আল্লাহর নিকট কবূল হয় না)।
১-যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের ইমামত করে অথচ
তাকে তারা অপছন্দ করে।
২-সেই মহিলা যে রাত্রি যাপন করে অথচ তার স্বামী তার উপর
অসন্তুষ্ট।
৩-পলাতক দাস”। [সহীহ সুনান ইবনু মাজাহ, হাদীস নং-৭৯২]
ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) বিষয়টিকে (ছোট ইমামতি) নামাযের ইমামতির
সাথে সম্পর্কিত মনে করেন, বড় ইমাম তথা রাষ্ট্রপ্রধানের
ক্ষেত্রে মনে করেন না। কারণ রাষ্ট্রপরিচালকের
ইমামতি বেশীরভাগ লোকেই অপছন্দ করে। [নায়লুল আউত্বার,৩/২২৫]
(বড় ইমামত ও ছোট ইমামত বিষয়টি ১ম পর্বে দেখুন)
২-নফল নামায পাঠকারীর পিছনে ফরয সালাত আদায় করাঃ
কোন ব্যক্তি কোথাও ফরয নামায পড়েছে অতঃপর এমন লোকদের
ইমামতি করতে চায়, যারা এখনো সেই ফরয পড়েনি, তাহলে এমন
করা বৈধ। এটা ইমামের জন্য নফল হবে এবং লোকদের জন্য ফরয।
উলামাগণ এই বিষয়টিকে নফল নামায পাঠকারীর পিছনে ফরয নামায
আদায় করা হিসাবে জানেন। সাহাবী মুয়ায নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে ইশার নামায আদায় করতেন এবং নিজ
গোত্রে ফিরে গিয়ে পুনরায় সেই নামায ইমাম হয়ে আদায় করতেন।
[মুসলিম, অধ্যায়ঃ সালাত, নং৪৬৫] অন্য বর্ণনায় উল্লেখ হয়েছে,
সেটা তার জন্য (মুআযের জন্য) নফল হবে এবং অন্যদের জন্য ফরয।
[শাফেয়ী ও দ্বারা কুত্বনী বর্ণনা করেন। দেখুন নায়লুল
আউত্বার,৩/২১৩ এবং সঊদী স্থায়ী ফতোয়া বোর্ড,
ফতোয়া নং ৪৭০৬, লাজনা দায়িমাহ,৭/৪০১]
উক্ত দলীলের আধারে বুঝা যায় যে, রামাযান মাসে যদি কোন
ব্যক্তি ইশার নামায আদায় করার উদ্দেশ্যে মসজিদে প্রবেশ
করে দেখে যে, লোকেরা ইশার নামায শেষ করে তারাবীহ পড়ছে,
তাহলে সে ইশার ফরয নামাযের নিয়তে তাদের সাথে নামায পাঠ
করবে এবং ইমামের সালাম ফিরানোর পর বাকি রাকায়াত পূর্ণ
করবে। [সউদী ফতোয়া বোর্ড, নং৬৪৯৬]
৩-ফরয সালাত আদায়কারীর পিছনে নফল সালাত আদায় করাঃ
ফরয নামায আদায়কারী ইমামের পিছনে নফল নামায আদায় করা বৈধ।
ইবনু কুদামাহ (রহঃ) বলেনঃ ‘আহলে ইলমদের এ বিষয়ে কোন মতভেদ
আমাদের জানা নেই’। [মুগনী,৩/৬৮]
আবু যার গেফারী (রাযিঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে,
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ তোমার
অবস্থা কেমন হবে, যখন শাষকগণ নামায সঠিক
সময়ে না পড়ে বিলম্বে পড়বে? আমি বললামঃ এমন সময় আমার করণীয়
কি? তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
‘‘তুমি সঠিক সময়ে নামায পড়ে নিবে অতঃপর তাদের সাথে সেই
নামায পেলে তাও পড়ে নিবে; কারণ সেটা তোমার জন্য নফল হবে’’।
[মুসলিম]
ইয়াজীদ বিন আসওয়াদ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত,
একদা তিনি নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর
সাথে ফজরের নামায আদায় করেন। নামায
শেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুই
ব্যক্তিকে দেখেন, যারা তাঁর সাথে নামায পড়ে নি। তখন
তিনি তাদের দু জনকে ডাকেন।
তারা ভয়ে ভয়ে কাছে আসলে নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের বলেনঃ ‘‘তোমরা দুই জনে আমাদের
সাথে নামায পড়লে না কেন”? তারা বললঃ আমরা নিজ
বাড়িতে নামায পড়েছি। নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ “এমন করো না, যখন তোমরা আপন
বাড়িতে নামায পড়বে এবং ইমামকে এমতাবস্থায় পাবে যে,
সে এখনো নামায পড়ে নি, তাহলে তার সাথে নামায পড়ে নিবে।
কারণ; এটা তোমাদের জন্য নফল হয়ে যাবে”। [আবু দাঊদ, তিরমিযী,
নাসাঈ, দ্বারা কুত্বনী, ইবনুস সাকান এবং ইবনু হিব্বান
হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন, সহীহ আবু দাঊদ, আলবানী, নং৫৯০]
৪-নির্দিষ্ট ফরয সালাত আদায়কারীর পিছনে অন্য ফরয আদায় করাঃ
ফরয সালাত আদায়কারী ইমামের পিছনে মুক্তাদী অন্য ফরয নামায
আদায় করতে পারে। উদাহারণ স্বরূপ ইমাম আসরের নামায
পড়াচ্ছে আর তার সাথে কেউ যহরের নিয়তে যহর আদায় করছে। চাই
ইমাম ও মুক্তাদীর নামাযের রাকাআত সংখ্যা এক হোক যেমন আসর
আদায়কারীর পিছনে যহর পড়া কিংবা উভয়ের নামাযের রাকাআত
সংখ্যা ভিন্ন ভিন্ন হোক। যেমন ইশার ফরয নামায
আদায়কারী ইমামের পিছনে মগরিব পড়া, কারণঃ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “ মানুষের
আমলসমূহ নির্ভর করে তার নিয়তের উপরে এবং প্রত্যেক
ব্যক্তি তাই পায়, যার সে নিয়ত করে থাকে”। [বুখারী, ১ম হাদীস]
তাই এখানে মুক্তাদী ও ইমাম যে যেই নিয়তে নামায পাঠ করবে,
সে সেই অনুযায়ী প্রতিফল পাবে।
এ বিষয়ের বৈধতায় উলামাগণ ঐসব দলীল উল্লেখ করেছেন যা,
ইতিপূর্বে ফরয আদায়কারীর পিছনে নফল আদায় করা এবং নফল
আদায়কারীর পিছনে ফরয আদায় করার দলীল হিসাবে উল্লেখ
হয়েছে। কেননা যদি ইমাম ও মুক্তাদীর নিয়ত একই হওয়া শর্ত হতো,
তাহলে উপরোক্ত বিষয়দুটি বৈধ হত না।
ইবনু হাযম (রহঃ) বলেনঃ ‘না কুরআনে, না সুন্নতে, না ইজমায়,
না কিয়াসে এমন কিছু এসেছে যা, ইমাম ও মা’মূমের (মুক্তাদীর)
নিয়ত এক হওয়া জরূরী করে। তাই প্রত্যেক এমন বিধান যা কুরআন,
সুন্নত এবং ইজমা জরুরী করে না, তা জরুরী নয়’।
[মুহাল্লা,৪/৩১৬-৩১৭]
একই ফরয নামাযে ইমাম ও মুক্তাদীর নিয়ত ভিন্ন হওয়ার সময়
যদি তাদের নামাযের রাকাআত সংখ্যা এক হয়, তাহলে ইমামের
পিছনে নামায পাঠকারীর কোন বাড়তি বা ঘাটতি কিছু করতে হয় না,
যেমন যহর আদায়কারীর পেছনে আসর পড়া। কিন্তু মাগরিব
আদায়কারীর পিছনে যদি কেউ ইশা পড়ে, তাহলে সে কী করবে? কারণ
এখানে মুক্তাদীর রাকাআত সংখ্যা বেশী। শাইখ ইবনে উসায়মীন
(রহঃ) বলেনঃ সে ইমামের সালাম ফিরানোর পর উঠে এক রাকাআত
পড়ে নিবে। এই ভাবে যদি কেউ ইশার নামায সম্পাদনকারীর
পিছনে মাগরিব পড়ে, তাহলে সে কী করবে? কারণ
এক্ষেত্রে ইমামের থেকে তার রাকাআত সংখ্যা কম।
তিনি বলেনঃ সে দুই নিয়মের যে কোন একটি করতে পারে। তৃতীয়
রাকাআতের পর যখন ইমাম চতুর্থ রাকাআতের জন্য দাঁড়াবে তখন
সে বসে তাশাহ্হুদের দুআ পড়ে ইমামের সালাম ফিরানোর
অপেক্ষা করবে, যখন ইমাম চতুর্থ রাকাআত পড়ে সালাম
ফিরাবে তখন সেও ইমামের সাথে সালাম ফিরাবে কিংবা তৃতীয়
রাকাআত শেষে যখন ইমাম চতুর্থ রাকাআতের জন্য দাঁড়াবে, তখন
সে নিজে তাশাহ্হুদ দিয়ে সালাম ফিরাবে’। এমন দৃষ্টান্ত
সালাতুল খাওফের পদ্ধতিতে রয়েছে।[দেখুন,শারহুল
মুমতি,৪/২৬১]
৫-নামাযরত অবস্থায় একাকী নামাযের নিয়ত পরিবর্তন করে ইমামতির
নিয়ত করা কিংবা ইমামতির নিয়ত পরিবর্তন করে মুক্তাদীর নিয়ত
করাঃ
প্রত্যেক নামাযীকে নামাযের সময় ফরয, নফল,
ইমামতি বা মুক্তাদী ইত্যদির নিয়ত অন্তরে করতে হবে। এখন
প্রশ্ন হচ্ছে, এক ব্যক্তি একাকী নামায পড়ার
নিয়তে দাঁড়িয়েছে ইতিমধ্যে কেউ তার সাথে শরীক হল, এখন
কি সে একাকীর নিয়ত থেকে ইমামতির নিয়ত করতে পারে?
কিংবা ইমামের অনুপস্থিতে কেউ
ইমামতি করতে দাঁড়িয়েছে এমতাবস্থায় ইমাম উপস্থিত হয়েছে,
তাহলে সে কি ইমামকে আগে করে দিয়ে মুক্তাদীর নিয়ত
করতে পারে? বিষয়টিকে উলামাগণ নামাযরত অবস্থায় নিয়ত
পরিবর্তন করা শিরোনামে উল্লেখ করেছেন।
একাকী নামাযী প্রয়োজনে নামাযরত অবস্থায় তার নিয়ত পরিবর্তন
করে ইমামতির নিয়ত করতে পারে। ইবনে আব্বাস (রাযিঃ)
বলেনঃ একদা আমি আমার খালা মায়মূনা (রাযিঃ) এর নিকট রাত যাপন
করি, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
রাতে উঠে নামায (তাহাজ্জুদের নামায) শুরু করেন, তখন আমিও
তাঁর সাথে তাঁর বাম পাশে নামাযে দাঁড়ালাম। তিনি আমার
মাথা ধরে ডান দিকে করে দেন”। [বুখারী, আযান অধ্যায়, নং ৬৯৯]
বুঝা গেল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
একা নামাযের নিয়তে দাঁড়ান অতঃপর ইবনে আব্বাস (রাযিঃ)
মুক্তাদী হলে, তাঁকে ইমাম হতে হয়। অন্যদিকে একদা রামাযান
মাসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
রাতে একা নামায শুরু করলে ধীরে ধীরে অনেক
সাহাবী পিছনে তাঁর ইক্তিদা করে নামায আদায় করেন। [বুখারী,
আযান অধ্যায়, নং ৭৩০-৭৩১]
অনুরূপ ইমামতির নিয়ত থেকে মুক্তাদী হওয়াও প্রমাণিত,
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বানু আমর বিন আউফ
গোত্রে মীমাংসা করতে গেলে নামাযের সময় হয়। কোন
কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর
উপস্থিতিতে বিলম্ব হলে মুআয্ যিন আবু বকর (রাযিঃ)
কে ইমামতি করতে বলেন। তিনি ইমাম হয়ে নামায শুরু
করলে নবী উপস্থিত হন। লোকেরা ইশারা করলে আবু বকর (রাযিঃ)
পিছনে সরে আসেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইমামতি করেন। [বুখারী, আযান অধ্যায়,
নং ৬৮৪] বুঝা গেল, আবু বকর (রাযিঃ) ইমামতির নিয়ত পরিবর্তন
করে মুক্তাদী হলেন।
মুক্তাদী সংক্রান্ত মাস্আলা-মাসাইল
যদিও আমাদের আলোচনা ইমাম ও ইমামতিকে কেন্দ্র করে কিন্তু
যেহেতু মুক্তাদী ছাড়া ইমাম ধারণা করা যায় না অর্থাৎ ইমাম ও
মুক্তাদী একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত তাই এ
পর্যায়ে আমরা মুক্তাদীর মাস্আলা-মাসাইল
নিয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
১-মুক্তাদীগণ নামাযের উদ্দেশ্যে কখন কাতারবদ্ধ হবেন?
নামায শুরু হওয়ার সময় ইমাম যদি মসজিদের ভিতরে পূর্ব
থেকে অবস্থান না করেন; বরং তাঁর বাসস্থান
থেকে এসে ইমামতির স্থানে দাঁড়ায় তবে (নামাযের সময়
হয়ে গেলে) মুক্তাদীগণ ইমামকে মসজিদে আসতে দেখলেই
নামাযে দাঁড়াবেন এবং মুয়াযযিন ইকামত দিবেন, যদিও এখনও ইমাম
তাঁর ইমামতির স্থানে না পৌঁছে থাকেন।
আবু হুরাইরাহ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, ‘নামাযের জন্যে ইকামত
দেয়া হত, আর লোকেরা কাতারে অবস্থান নিত,
নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর
স্থানে অবস্থান নেয়ার পূর্বে’। [মুসলিম, মাসাজিদ অধ্যায়,
নং ১৩৬৮] অবশ্য ইমাম তাঁর স্থানে অবস্থান নেয়ার সময়ও মুয়াযযিন
ইকামত দিতে পারে, তাতে নিষেধের কিছু নেই।
উল্লেখ থাকে যে, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
ফরয নামায সমূহের আগে ও পরের সুন্নতগুলি তাঁর গৃহেই আদায়
করতেন। তাই তাঁর মসজিদে আসাটাই ফরয নামায শুরু করার সময় ও
অনুমতি ধরে নেওয়া হত।
আর যদি ইমাম মসজিদেই থাকেন, তাহলে তিনি যখন
মুয়াযযিনকে অনুমতি দিবেন বা নামায আরম্ভ করার নির্ধারিত সময়
হবে, তখন বাকি মুসাল্লীরা কাতারবদ্ধ হবেন। কিন্তু ঠিক
ইকামতের কোন্ শব্দের সময় উপস্থিত মুসাল্লীরা কাতারবদ্ধ
হওয়ার জন্য দাঁড়াবেন, তা নিয়ে কিছু মতামত পাওয়া যায়। কেউ
বলেনঃ ইকামত শেষ হওয়ার সময় মুসাল্লীরা দাঁড়াবেন। কেউ
বলেনঃ মুয়াযযিন যখন ‘‘ক্বাদ ক্বামাতিস্ স্বালাহ” বলবেন, তখন
দাঁড়াবেন। কেউ বলেনঃ আল্লাহু আকবার বলার সময় দাঁড়াবেন।
আসলে এ বিষয়ে বিভিন্ন দলীলের দিকে লক্ষ্য করলে বুঝা যায়
যে, মুসাল্লীগণ ইমামকে ইমামতির স্থানে আসতে দেখলে,
বা তাঁর স্থানে অবস্থান নিলে, মুয়াযযিন ইকামত দেওয়া শুরু
করবেন এবং মুক্তাদীরা তাদের সাধ্যমত কাতারবদ্ধ হতে শুরু
করবে, একটু আগে বা পরে হলে সমস্যার কিছু নেই, তবে নেকীর
কাজে দ্রুতগামী হওয়াই বেশী ভাল। ইমাম মালেক (রহঃ)
বলেনঃ ‘নামাযের ইকামতের সময় মুক্তাদীদের দাঁড়ানোর বিশেষ
সময়সীমা সম্পর্কে আমি কিছু শুনিনি। তাই আমি লোকদের
সাধ্যানুযায়ী এটা প্রজোয্য মনে করি; কারণ তাদের
মধ্যে অনেকে ভারী শরীর-স্বাস্থ্যের লোক থাকেন আর
অনেকে হাল্কা স্বাস্থ্যের’।[নায়লুল আউত্বার,৩/২৪৪]
২-ইমামের অনুসরণ করা মুক্তাদীদের অবশ্য কর্তব্য :
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
“ ﺇﻧﻤﺎ ﺟُﻌﻞ ﺍﻹﻣﺎﻡُ ﻟﻴﺆﺗَﻢَّ ﺑﻪ، ﻓﺈﺫﺍ ﺻﻠﻰّ ﻗﺎﺋﻤﺎ ﻓﺼﻠﻮﺍ ﻗﻴﺎﻣﺎ، ﻓﺈﺫﺍ ﺭﻛﻊَ ﻓﺎﺭﻛﻌﻮﺍ، ﻭ ﺇﺫﺍ ﺭﻓﻊ ﻓﺎﺭﻓﻌﻮﺍ ”
“ইমাম নির্ধারণ করা হয়, তার অনুসরণ করার জন্য, তাই যখন
সে দাঁড়িয়ে নামায পড়বে, তখন তোমরাও দাঁড়িয়ে নামায পড়, যখন
সে রুকূ করবে, তখন তোমরাও রুকূ করো আর যখন সে উঠবে, তখন
তোমরাও উঠো” [বুখারী, আযান অধ্যায়, নং৬৮৯]
ইমামের অনুসরণের ক্ষেত্রে মুক্তাদীদের অবস্থা চার
ভাগে বিভক্তঃ
১-মুত্বাবাআ’হ বা অনুসরণঃ
নামাযের কাজ সমূহ ইমামের পরে পরে করা; ইমামের সাথে সাথে নয়।
এটাই সুন্নাত এবং মুক্তাদীগণ এমন করতেই আদিষ্ট, যা উপরের
হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
২-মুআফাকা’হ বা ইমামের সাথে সাথে করাঃ
ইমামের সাথে সাথে করা আবার দুই ভাগে বিভক্ত। যথা:
(১) নামাযের কর্ম বিষয়ক অংশগুলি তার সাথে সাথে সম্পাদন
করা যেমন, ইমাম রুকূ করলে তার সাথে একই সময়ে রুকূ করা।
(২) নামাযের কাউল বা বচন বিষয়ক অংশগুলি তার
সাথে সাথে করা যেমন, ইমাম আল্লাহু আকবার বললে তার
সাথে সাথে বরাবর সময়ে আল্লাহু আকবার বলা।
বাচনিক বিষয়গুলিতে তাকবীরে তাহরীমা এবং সালাম ব্যতীত
বাকি বিষয়গুলি ইমামের সাথে সাথে বা পরে করলে কোন
সমস্যা নেই। উদাহরণ স্বরূপ, ইমামের
রুকুতে ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আ’যীম’ বলার সময় মুক্তাদীর
ইমামের আগে বা পরে কিংবা সাথে সাথে তা বললে কোন
অসুবিধা নেই। কিন্তু তকবীরে তাহরীমা ইমামের
আগে হলে কিংবা ইমামের ‘আল্লাহু আকবার’ বলা শেষ হওয়ার
পূর্বেই মুক্তাদীর তা বলা হলে নামায শুদ্ধ হবে না। এই
ভাবে ইমামের সালামের সাথে সাথে সালাম ফিরালে উলামাগণ
এমন করাকে মাকরূহ বলেছেন।
আর মুক্তাদীদের নামাযের কর্ম বিষয়ক অংশগুলিতে ইমামের
সাথে সাথে করা মাকরূহ। উদাহরণ স্বরূপ ইমাম যখন আল্লাহু
আকবার বলে রুকুতে যান, তখন ইমামের সাথে সাথে মুক্তাদীর
একই সময়ে ঝুকে রুকুতে যাওয়া। এটা ঠিক নয়। কারণ
হাদীসে ইমামের পরে তা করতে আদেশ করা হয়েছে;
সাথে সাথে নয়।
৩-তাখাল্লুফ্ বা ইমামের পরে দেরীতে করাঃ
এটা দুই ভাগে বিভক্ত। যথা:
(১) দেরীতে করায় ওজর থাকা, যেমন কোন মুক্তাদী কিয়াম
অবস্থায় আছে অন্য দিকে ইমাম রুকুতে গেছেন কিন্তু
সে ইমামের তাকবীর শুনতে পাই নি, যখন শুনতে পাচ্ছে তখন ইমাম
সামিয়াল্লাহুলিমান্ হামিদাহ বলছেন। এমতাবস্থায় সেই
মুক্তাদী তাৎক্ষণাত রুকু করবে এবং ইমামের
বাকি কাজে অনুসরণ করবে; কারণ এখানে তার ওজর রয়েছে।
(২) বিনা ওজরে দেরী করা, যেমন ইমাম রুকুতে গেছে আর
মুক্তাদী দাঁড়িয়েই আছে। যখন ইমাম রুকু থেকে উঠছে, তখন
সে রুকুতে যাচ্ছে। এই ভাবে অন্যান্য ক্ষেত্র। এমতাবস্থায়
মুক্তাদী যদি নামাযের কোন রুকনকে জেনে-বুঝে ইমামের সেই
রোকন শেষ হওয়ার পর করে, তাহলে তার নামায বাতিল হয়ে যাবে।
৪-মুসাবাক্বাহ বা ইমামের পূর্বে করাঃ
যেমন ইমামের পূর্বে রুকূ/সাজদা করা কিংবা ইমামের
পূর্বে রুকূ/সাজদা থেকে উঠা। যদি কেউ জেনে-
বুঝে স্বেচ্ছায় এমন করে তাহলে তার নামায বাতিল হয়ে যাবে।
আর যদি অজ্ঞতা বশতঃ কিংবা ভুলে করে, তাহলে তার নামায
শুদ্ধ।
এমন আচরণকারীর জন্য কঠোর শাস্তির উল্লেখ
করে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
বলেনঃ “সে ব্যক্তি কি ভয় করে না যে তার ইমামের
পূর্বে নিজের মাথা উত্তলন করে, আল্লাহ তায়ালা চাইলে তার
মাথাকে গাধার মাথায় পরিবর্তন করে দিবেন কিংবা তার
আকৃতিকে গাধার আকৃতির ন্যায় করে দিবেন”। [বুখারী, আযান
অধ্যায়, নং ৬৯১, মুসলিম, স্বালাত অধ্যায়ঃ নং ৪২৭] এ
বিষয়ে একটি ফেকহী মুলনীতিও রয়েছে, ‘ইবাদতে ইচ্ছাকৃত
নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করা, ইবাদতকে বাতিল করে দেয়’। [উপরোক্ত
প্রকারগুলি বিস্তারিত দেখুন, আশ্ শারহুল মুমতী, ইবনু
উসায়মীন, ৪/১৮০-১৯০]
৩- ইমামের পিছনে মুক্তাদীগণের সূরা ফাতিহা পাঠঃ
এটি একটি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যার সম্পর্কে আহলুস্
সুন্নাহ ওয়াল্ জামায়াতের উলামাগণ মতভেদ করেছেন।
আমরা খুবই সংক্ষিপ্তাকারে এ স্থানে দলীল সহ তাঁদের
মতামতের বর্ণনা দেয়ার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
ইমামের পিছনে মুক্তাদী হয়ে নামায
আদায়কারীকে সূরা ফাতিহা পাঠ করতে হবে কি না? এ
বিষয়ে প্রধান তিনটি মত বিদ্যমান। যথা:
১ম মতঃ ইমামের পিছনে মুক্তাদী হয়ে নামায আদায়কারীকেও
অবশ্যই সুরা ফাতেহা পাঠ করতে হবে। এই মতের প্রধান দলীলাদিঃ
ক- নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
[ ﻻ ﺻﻼﺓَ ﻟﻤﻦ ﻟﻢ ﻳﻘﺮﺃ ﺑﻔﺎﺗﺤﺔ ﺍﻟﻜﺘﺎﺏ ]
“তার নামায হয় না যে সূরা ফাতেহা পড়ে না”। [বুখারী, অধ্যায়,
আযান, অনুচ্ছেদঃ প্রত্যেক নামাযে ইমাম ও মুক্তাদী সকলের
প্রতি কিরাআত জরূরী, নং ৭৫৬]
প্রমাণিত হয় যে, সূরা ফাতেহা ব্যতীত কোন নামাযই হয় না, চাই
তা ফরয হোক বা নফল বা একা একা পড়া হোক বা ইমামের পিছনে; কারণ
এখানে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর
বাণী ব্যাপকার্থ বোধক।
খ- নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেনঃ
[ ﻣَﻦ ﺻﻠّﻰ ﺻﻼﺓً ﻟﻢ ﻳﻘﺮﺃ ﻓﻴﻬﺎ ﺑﺄﻡّ ﺍﻟﻘﺮﺁﻥ ﻓﻬﻲ ﺧِﺪﺍﺝٌ ﺛﻼﺛﺎ ﻏﻴﺮ ﺗﻤﺎﻡ .]
“যে ব্যক্তি এমন কোন নামায পড়ল,
যাতে সে সূরা ফাতিহা পড়লো না, তাহলে সেই নামায অসম্পূর্ণ
অসম্পূর্ণ অসম্পূর্ণ -অপূর্ণাঙ্গ”। [মুসলিম, অধ্যায়ঃ নামায,
অনুচ্ছেদঃ প্রত্যেক রাকাআতে সূরা ফাতিহা পড়া ওয়াজিব,
নং৮৭৬]
প্রমাণিত হল যে, সূরা ফাতেহা ছাড়া কোন নামাযই পূর্ণাঙ্গ নয়,
চাই সে নামায একা পড়া হোক বা ইমামের সাথে। উল্লেখ্য যে,
অসম্পূর্ণ শব্দটি নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
তাগীদের সাথে তিন বার বলেন।
গ- একদা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবাদের
নিয়ে ফজরের নামায পড়ালেন। নামায শেষে তিনি জিজ্ঞেস
করলেনঃ কে তার পিছনে কুরআন পড়ছে?
কিংবা বললেনঃ তোমরা কি তোমাদের ইমামের পিছনে কিছু
পড়ে থাক? তারা বললেনঃ হ্যাঁ, আল্লাহর রাসূল। অতঃপর
তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
বললেনঃ সূরা ফাতিহা ব্যতীত এমনটি করো না; কারণ
যে সূরা ফাহিতা পাঠ করে না তার নামাজ হয় না”। [আবু দাঊদ,
নং ৮২৩, তিরমিযী, নামায অধ্যায়ঃ অনুচ্ছেদঃ ইমামের
পিছনে কিরআত, নং ৩১০/আহমদ/হাকেম, সূত্র হাসান, দেখুন
তুহফাতুল আহওয়াযী,২/১৯৩-১৯৪]
প্রমাণিত হল যে, ইমামের পিছনে মুক্তাদীদের কেবল
সূরা ফাতিহা পড়তে হবে; অন্য কিছু নয়।
২য় মতঃ ইমামের পিছনে মুক্তাদীদের কখনও সূরা ফাতিহা বা অন্য
কোন সূরা পড়তে হবে না বরং চুপ থেকে ইমামের কিরাআত
শুনতে হবে। এই মতের দলীলাদিঃ
ক- আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ
( ﻭَ ﺇﺫﺍ ﻗُﺮِﺉَ ﺍﻟﻘﺮﺁﻥُ ﻓﺎﺳْﺘﻤِﻌﻮﺍ ﻟﻪ ﻭَ ﺃﻧﺼِﺘﻮﺍ ﻟﻌﻠﻜﻢ ﺗُﺮﺣﻤﻮﻥ ) ﺍﻷﻋﺮﺍﻑ 204/
“যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তোমরা তা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ কর ও
চুপ থাক।” [সূরা আরাফ/২০৪]
বুঝা গেল, কুরআন পড়া হলে চুপ থেকে ভালভাবে শুনতে হবে।
তাই ইমাম যেহেতু নামাযে কুরআন পড়েন, সেহেতু
মুক্তাদীদের চুপ থেকে শুনতে হবে। কোন সূরা পড়া যাবে না।
আপত্তিঃ (১) যদি এই আয়াতের মর্ম এই হয় যে, ইমামের
পিছনে সূরা ফাতিহাও পড়া যাবে না,
তাহলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কেন
বললেন যে, সূরা ফাতিহা ছাড়া কোন নামায হয়
না বা তোমরা সূরা ফাতিহা ব্যতীত অন্য কিছু পড়বে না?
তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
কি তাহলে কুরআনের বিপরীত আদেশ দিলেন? (নাউযু বিল্লাহ।)
আপত্তি (২) যদি এই আয়াতকে ইমামের
পিছনে সূরা ফাতিহা না পড়ার দলীল ধরেও নেওয়া হয়, তাহলে যুহর
ও আসর নামাযে যখন ইমাম চুপি চুপি কিরআত করেন, তখন
তো মুক্তাদীরা কুরআন পাঠ শোনে না, এমতাবস্থায়
তারা কী করবে? তাই এই আয়াত উপরোক্ত মতের পূর্ণাঙ্গ দলীল
হয় না।
খ- নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ “যার ইমাম
রয়েছে, তার ইমামের কিরাআত তার কিরাআত হিসাবে গণ্য হবে”।
[ইবনু মাজাহ, অধ্যায়, ইকামাতুস স্বালাহ, নং৮৪০]
বুঝা গেল, মুক্তাদীকে কোন কিছু পাঠের প্রয়োজন নেই। কারণ
ইমামের কিরাআত করাটা তারও কিরাআত ধরা হবে।
আপত্তিঃ (১) হাদীসটি অত্যন্ত দুর্বল-যয়ীফ। অবশ্য কেউ কেউ
হাসান বলার চেষ্টা করেছেন। ইবনে হাজার (রহঃ) বলেনঃ এই
হাদীসটি সকল হাদীস বিদ্বানদের নিকট যয়ীফ (দুর্বল)
বলে পরিচিত। [ফাতহুল বারী,২/৩১৪, তালখীসুল হাবীর,১/৫৬৯] (২) এই
রকম একটি দুর্বল হাদীসের মুকাবিলায় উপরোক্ত বুখারী,
মুসলিম সহ অন্যান্য সুনান গ্রন্থের সহীহ
হাদীসকে কিভাবে প্রত্যাখ্যান করা যায়?
৩য় মতঃ জেহরী অর্থাৎ যে সব নামাযে ইমাম সরবে সূরা পাঠ করেন
(যেমন ফজর, মাগরিব ও ইশা) এসব নামাযে পড়তে হবে না কিন্তু
যে সব নামাযে সূরা নিরবে পাঠ করা হয় (যেমন, যুহর ও আসর)
তাতে পাঠ করা আবশ্যিক। এই মতের দলীলঃ
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ “যখন
তোমরা নামায আদায় করবে, তখন কাতার সোজা করে নিবে,
তোমাদের মধ্যে কেউ ইমামতি করবে, যখন সে তকবীর দিবে তখন
তোমরাও দিবে ….. আর যখন সে পাঠ করবে, তখন তোমরা চুপ থাকবে”।
[মুসলিম, স্বালাত অধ্যায়, স্বালাতে তাশাহ্হূদের বর্ণনা,
নং ৪০৪/ নাসাঈ নং৯১২]
আপত্তিঃ হাদীসটির সনদ সহীহ হলেও হাদীসের যেই অংশ থেকে এই
মতের দলীল দেয়া হচ্ছে অর্থাৎ যখন সে পাঠ করবে, তখন
তোমরা চুপ থাকবে সেই অংশটিকে উঁচু পর্যায়ের
মুহাদ্দিসগণের অনেকেই গাইর মাহফূয (অসংরক্ষিত) বলেছেন।
যেমন ইমাম বুখারী, ইয়াহইয়া বিন মাঈন, আবু দাঊদ, আবু হাতিম,
হাকেম, দারা কুত্বনী, ইবনু খুযাইমাহ, হাফেয আবু
আলী নীসাপূরী, বায়হাক্বী, ইমাম নবভী প্রমুখ। [দেখুন,
তাহকীকুল কালাম, সাহেবে তুহফা, ২/৮৭] ইমাম নবভী বলেনঃ ‘এই
বাক্যটির দুর্বল হওয়ার ব্যাপারে হাদীসের পণ্ডিতদের একমত
হওয়া মুসলিমের সিহ্হাতের উপর প্রধান্য পাবে। বিশেষ করে যখন
তিনি তাঁর সহীহ মুসলিমে বর্ণনাটি মুসনাদাকারে বর্ণনা করেন
নি’। [শারহু মুসলিম, নভবী, ৪/১২৮, রিয়াদে ছাপা]
উল্লেখ্য, হাদীস বিশারদদের নিকট গাইর মাহফূয বাক্য যয়ীফ
হওয়ার কারণে অগ্রহণীয়। তাই এই অংশ দলীল যোগ্য নয়।
অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মতঃ প্রথম মত। অর্থাৎ
মুক্তাদীদেরকে ইমামের পিছনে অবশ্যই সূরা ফাতিহা পাঠ
করতে হবে। আর ফাতিহার পর ইমাম যা পাঠ করবেন তা শুনতে হবে।
কারণঃ
১- প্রথম মতের দলীলগুলো বেশী স্পষ্ট ও বেশী শুদ্ধ। তাই
দলীলের বিবেচনায় ১ম মত প্রাধান্যযোগ্য।
২- “যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তোমরা তা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ কর
ও চুপ থাক।” [সূরা আরাফ/২০৪] এবং ‘যখন ইমাম পাঠ করবে তখন
তোমরা চুপ থাক’ এদুটি সূরা ফাতিহা সহ বাকি কুরআনের
ক্ষেত্রে আম বা ব্যাপক আদেশ যা, ইমামের
পিছনে সূরা ফাতিহা পড়ার দলীল দ্বারা নির্দিষ্ট বা খাস
করা হবে। যেন উভয় মতের দলীলাদির প্রতি আমল করা সম্ভব হয়।
অর্থাৎ কুরআন পড়াকালে চুপ থেকে শোনা সাধারণ সময়ের জন্য
প্রযোজ্য হবে এমনকি নামাযের সময়ে সূরা ফাতিহার অতিরিক্ত
কিরাআতের জন্য প্রযোজ্য হবে কিন্তু
সূরা ফাতিহা পাঠকালে তা প্রযোজ্য
হবে না বরং মুক্তাদীরাও তা পাঠ করবে।
৩- যে সব দলীলে ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা না পড়ার
কথা এসেছে, সে সব দলীলের অর্থ হবে উচ্চ স্বরে পড়া নিষেধ।
কারণ উচ্চ স্বরে পড়লে ইমামের কিরাআতে বিঘ্ন ঘটে কিন্তু
নিরবে পড়লে তা হয় না। তাই যখন সাহাবী আবু হুরায়রা (রাযিঃ)
কে ইমামের পিছনে থাকলে কি করবো প্রশ্ন করা হয়, তখন
তিনি বলেনঃ “মনে মনে পড়ে নিবে।” [মুসলিম, নামায অধ্যায়,
অনুচ্ছেদঃ প্রত্যেক রাকাআতে কিরাআত জরূরী]
৪- ইমাম ও মুক্তাদী উভয়ের সশব্দে আমীন বলাঃ
জাহরী তথা সশব্দিক নামাযে ইমাম যখন আমীন বলবেন তার পর
মুক্তাদীদেরকেও জোর শব্দে আমীন বলতে হবে।
“নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ যখন ইমাম
আমীন বলবে তখন তোমরাও আমীন বলো; কেননা যার আমীন
ফেরেশতাদের আমীনের সাথে খাপ খেয়ে যাবে, তার বিগত পাপ
ক্ষমা করা হবে”। ইবনু শিহাব বলেনঃ রাসূল (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আ—মীন বলতেন। [আ টেনে বলতেন]
[বুখারী ও মুসলিম, বুখারী, আযান অধ্যায়ঃ নং ৭৮০]
উপরের হাদীসে যেমন ইমাম ও মুক্তাদী উভয়ের আমীন
বলা প্রমাণিত হয়, তেমন উভয়ের তা জোরে বলাও প্রমাণিত হয় কারণ
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর আদেশ যে, যখন
ইমাম আমীন বলবে, তখন তোমরাও বলবে। অর্থাৎ যখন তোমরা ইমামের
আমীন বলা শুনতে পাবে নচেৎ সির্রী বা নিরব নামাযে ইমাম কখন
আমীন বলে তা শোনা অসম্ভব। আর ইমাম জোরে আমীন
বললে মুক্তাদীকেও জোরে বলতে হবে। এমন নয় যে ইমাম
জোরে বলবে আর মুক্তাদীরা নিরবে।
ওয়ায়েল বিন হুজ্ র হতে বর্ণিত,
তিনি বলেনঃ “আমি নবীজীকে পড়তে শুনেছি,
তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পড়লেনঃ (গায়রিল
মাগ্ যূবি আলাইহিম্ ওয়া লায্ যা-ল্লীন) এবং বললেনঃ আমীন।
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর
শব্দকে টেনে পড়লেন”। [তিরমিযী, নামায অধ্যায়, অনুচ্ছেদ
আমীন প্রসঙ্গ/আবু দাঊদ, আহমদ, বায়হাক্বী]
৫- ইমামের ভুল হলে মুক্তাদীদের সংকেত দেওয়াঃ
ইমামের ভুল হওয়া মানবীয় স্বভাব। তাই তার ভুল হলে মুক্তাদীগণ
তার ভুলের সংকেত দিবে। যেন সে তার ভুল বুঝতে পারে ও
তা শুধরে নেয়। যেমন ইমাম তিন রাকাআত বিশিষ্ট নামাযে যদি চার
রাকাআতের জন্য উঠে কিংবা ৩ বা ৪ রাকাআত বিশিষ্ট
নামাযে প্রথম তাশাহহুদ শেষে বসে থাকে… ইত্যাদি। এ
সম্পর্কে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
বলেনঃ “নামাযে কারো কিছু ঘটলে সে যেন তাসবীহ
পড়ে (সুব্হানাল্লাহ বলে)। কেননা যখন সুবহানাল্লাহ বলা হবে,
তখন সে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ দিবে। আর তালি দেয়া কেবল
মহিলাদের জন্য”। [বুখারী, আযান অধ্যায়, নং৬৮৪]
তবে ইমাম যদি ভুলে চার রাকাআত বিশিষ্ট নামাযে পঞ্চম
রাকাআতের জন্য উঠে দাঁড়ান কিংবা দুই রাকাআত বিশিষ্ট
নামাযে তৃতীয় রাকাআতের জন্য কিংবা তিন রাকাআত বিশিষ্ট
নামাযে চতুর্থ রাকাআতের জন্য দাঁড়িয়ে যান আর
পিছনে তাসবীহ বলার পরেও তিনি না ফিরেন এমতবস্থায় সেই
মুক্তাদী কি করবে? কারণ, এটা নিশ্চিত যে তার ইমাম নির্ধারিত
রাকাআতের অতিরিক্ত পড়াচ্ছেন।
এমন সময় সেই মুক্তাদী ইমামের সাথে অতিরিক্ত রাকায়াত আদায়
না করে বসে তাশাহ্হুদের দুআ-যিকর পাঠ করবে এবং ইমাম যখন
অতিরিক্ত রাকাআত শেষে সালাম ফিরাবেন, তখন সেও তাদের
সাথে সালাম ফিরাবে। কারণ জেনে-বুঝে স্বেচ্ছায় অতিরিক্ত
রাকাআত পড়লে নামায বাতিল হয়ে যাবে।
[সউদী স্থায়ী ফতোয়া বোর্ড,৭/১৩৭, ফতোয়া নং ৯৫২৬] এই
ভাবে ইমাম যদি জানতে পারে যে, সে অতিরিক্ত রাকাআতের
জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে কিংবা তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়,
তাহলে তার জন্য জরুরি যে, তিনি সেই রাকাআত
না পড়ে বসে পড়বেন। [সউদী স্থায়ী ফতোয়া বোর্ড,
ফতোয়া নং১৭১৫৮]
৫- ইমামের ফাতিহা কিংবা অন্য কিরাআতে ভুল হলে স্মরণ
করিয়ে দেওয়াঃ
ইমাম যদি কোন আয়াত ভুল পড়ে, তাহলে তাকে স্মরণ
করিয়ে দেওয়া বৈধ। [সউদী স্থায়ী ফতোয়া বোর্ড,৬/৩৯৯]
তবে বহু ইসলামী বিদ্বানের মতে ফাতেহার
ক্ষেত্রে তা ওয়াজিব আর অন্য তেলাওয়াতের
ক্ষেত্রে তা মুস্তাহাব। [মাজমূ, নবভী, ৪/২৩৯]
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদা নামায পড়ান
এবং সেই নামাযে কিরাআতের সময় তাঁর জটিলতা সৃষ্টি হয়, নামায
শেষে তিনি উবাই বিন কাআব (রাযিঃ) কে বললেনঃ তুমি আমাদের
সাথে নামাযে ছিলে? সে বললঃ হ্যাঁ। নবী (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ তাহলে তোমাকে কি নিষেধ
করলো? (অর্থাৎ স্মরণ করিয়ে দিতে কিসে বাধা দিল?) [আবু দাঊদ,
নামায অধ্যায়, অনুচ্ছেদঃ ইমামকে লোকমা দেওয়া]
৬- মুক্তাদীদের ভুল-ত্রুটিঃ
• প্রথম কাতার কিংবা সামনের কাতার পূরোন না করেই
আলাদা কাতার বানানো । [সহীহ ইবনু মাজাহ, নং৮১৪]
• প্রথমকাতারে দাঁড়াতে অলসতা করা। অথচ প্রথম কাতারের ফযীলত
জানলে তারা পরষ্পরে লটারি করতে হলেও করতো। [বুখারী,
নং২৫৪৩]
• কাতার সোজা না করা বরং বাঁকা থাকা সত্ত্বেও নামায শুরু
করে দেওয়া। [মুসলিম নং৪৩২]
• বিনা ওজরে একাই এক কাতারে নামায আদায় করা। (এ
সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা আগামীতে আসবে, ইনশাআল্লাহ)
• (একান্ত প্রয়োজন ছাড়া) খুঁটি তথা পিলারের মাঝে কাতার
তৈরি করা; অথচ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
তা নিষেধ করেছেন। [সহীহ ইবনে মাজাহ, নং৮২১]
• নামাযের কাজগুলি ইমামের পূর্বে কিংবা তার
সাথে সাথে করা। [ইতিপূর্বে এ
সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে)
• ইমামের পিছনে জ্ঞানী ও বড়দের অবস্থান না করা; অথচ
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ “তোমাদের
জ্ঞানবান ও সাবালোকরা যেন আমার নিকটে থাকে, অতঃপর তার
পরের স্তরের লোকেরা, অতঃপর তার পরের স্তরের লোকেরা”।
[মুসলিম, নং ৯৭৩]
লেখক: শাইখ আব্দুর রাকীব মাদানী,
লিসান্স, মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়
দাঈ, খাফজী দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব।
Email: a.raquib1977@yahoo.com
সম্পাদক: শাইখ আবদুল্লাহিল-হাদী মু. ইউসুফ
লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব
No comments:
Post a Comment