মাসবুকের বিধান
১-মাসবূক কাকে বলে?
আলোচ্য বিষয়ে মাসবূক বলতে আমারা সেই
নামাযী ব্যক্তিকে বুঝাতে চাচ্ছি, যার ইমাম তার পূর্বে এক
বা একাধিক রাকাআত কিংবা নামাযের কিছু অংশ সমাপ্ত
করেছে আর সে নামায শুরু হওয়ার পর জামাআতে প্রবেশ করেছে।
২-মাসবূক কিভাবে নামাযে আসবে?
নামায পড়ার উদ্দেশ্যে মসজিদে বা অন্য কোনো স্থানে আগমন
করার সময় যদি নামাযীর যথাস্থানে পৌঁছানোর পূর্বে জামাআত
দাঁড়িয়ে যায় কিংবা জামাআত দাঁড়ানোর পর সে যদি সেই
জামাআতে শরীক হতে চায়, তাহলে সে যেন ধীর-স্থীর অবলম্বন
করতঃ জামাআতে যায়, দৌড়া-দৌড়ি বা তাড়াহুড়া না করে।
নবী (সাঃ) বলেনঃ
” ﺇﺫﺍ ﺳﻤﻌﺘﻢ ﺍﻹﻗﺎﻣﺔَ ﻓﺎﻣﺸﻮﺍ ﺇﻟﻰ ﺍﻟﺼﻼﺓِ ﻭ ﻋﻠﻴﻜﻢ ﺑﺎﻟﺴﻜﻴﻨﺔِ ﻭﺍﻟﻮﻗﺎﺭِ، ﻭﻻ ﺗُﺴﺮﻋﻮﺍ، ﻓﻤﺎ ﺃﺩﺭﻛﺘﻢ ﻓﺼﻠّﻮﺍ،
ﻭﻣﺎ ﻓﺎﺗﻜﻢ ﻓﺄﺗِﻤّﻮﺍ ” ﻣﺘﻔﻖ ﻋﻠﻴﻪ
“যখন তোমরা ইকামত শুনবে, তখন তোমরা শান্ত ও স্থৈর্য
সহকারে নামাযে চলো, দ্রুত চলো না।
যা পাবে তা পড়ে নিবে আর যা ছুটে যাবে তা পূরণ করে নিবে”।
[বুখারী, আযান অধ্যায়, নং ৬৩৬/মুসলিম, মাসাজিদ, নং ১৩৫৯]
মুসলিমের এক বর্ণনায় এসেছে, “কারণ তোমাদের কেউ যখন
নামাযের ইচ্ছা করে, তখন সে নামাযেই থাকে”।
তাই নামাযে যে ভাবে ধীর-স্থীর অবলম্বন করতে হয়,
সে অবস্থা যেন নামাযে আসার সময়ও থাকে।
তাছাড়া দৌড়ে বা দ্রুত আসলে মানুষ হাঁপায় এবং তার অঙ্গ-
প্রত্যঙ্গ স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে না, যার ফলে তার
নামাযের খুশু-খুযুতে ব্যাঘাত ঘটে।
৩-মাসবূক যে কোনো নফল না পড়ে অতি সত্তর জামাআতে শরীক
হবেঃ
নামাযী যদি এমন সময় মসজিদে প্রবেশ করে যে, জামাআত
দাঁড়িয়ে গেছে,
তাহলে সে সুন্নতে মুআক্কাদা বা তাহিয়্যাতুল মসজিদ
কিংবা অন্য কোন নামায শুরু করবে না; বরং সরাসরি ফরয
জামাআতে শরীক হবে। নবী (সাঃ) বলেনঃ “যখন নামাযের ইকামত
দেওয়া হবে, তখন ফরয নামায ব্যতীত অন্য কোন নামায নেই”।
[মুসলিম, সালাতুল মুসাফেরীন, নং ১৬৪৪]
৪-মাসবূক ব্যক্তির সামনের কাতারে স্থান
না পেলে পিছনে একাই দাঁড়ানো:
মাসবূক মসজিদে প্রবেশ করার পর যদি দেখে যে, সামনের
কাতারে খালি স্থান নেই, তাহলে সে কি সামনের কাতার
থেকে কাউকে টেনে নিয়ে কাতার তৈরি করবে, না ইমামের
পাশে গিয়ে দাঁড়াবে, না অন্য কারো আসার অপেক্ষা করবে, যেন
তার সাথে মিলে দু জনে কাতার তৈরি করে,
না একা একা পিছনে দাঁড়াবে?
এ বিষয়ে উলামায়ে কিরামের মতভেদ বিদ্যমান। এক দল
ইসলামী পণ্ডিত মনে করেন, লাইনের পিছনে একা একা এক
লাইনে নামায পড়লে নামায হবে না। কারণ নবী (সাঃ)
বলেনঃ “লাইনের পিছনে একা নামায আদায়কারীর নামায হয় না”।
[আহমদ, ৪/২৩ ইবনু মাজাহ, অধ্যায় ইকামাতুস স্বালাত, নং ১০০৩] অন্য
হাদীসে এসেছে, একদা নবী (সাঃ) এক ব্যক্তিকে লাইনের
পিছনে একা নামায পড়তে দেখলে তাকে পুনরায় নামায আদায় করার
আদেশ দেন”। [আহমদ, তিরিমিযী, আবওয়াবুস্ স্বালাত, নং ২৩০, আবু
দাঊদ, স্বালাত অধ্যায়, নং ৬৮২, সহীহ সুনান আবু দাঊদ, আলবানী,
নং৬৩৩]
যদি লাইনের পিছনে একা নামায পড়া শুদ্ধ হত, তো নবী (সাঃ)
তাকে পুনরায় আদায় করার আদেশ করতেন না। তাছাড়া উপরোক্ত
দলীলকে শিথিলকারী কোন অন্য দলীলও পাওয়া যায় না। এসব
কারণে উলামাগণের একটি দল লাইনের পিছনে একা নামায
আদায়কারীর নামায বাতিল মনে করেন।
ইসলামী পণ্ডিতগণের অপর দলটি ওজর বশতঃ লাইনের
পিছনে একা নামায পাঠকারীর নামায শুদ্ধ মনে করেন,
বিনা ওজরে নয়। ওজরের ব্যাখ্যা এইরূপ যে,
নামাযী মসজিদে প্রবেশ করার পর যখন দেখে যে, সামনের
লাইনে তার জন্য কোন স্থান নেই, তখন পিছনে একা নামায
পড়া ছাড়া আর তার কোন উপায় থাকে না। তাই এই অবস্থায় তার
পিছনে একা নামায পাঠ করাটা একটি ওজর। তারা মনে করেন, লাইনের
পিছনে একা ব্যক্তির নামায শুদ্ধ না হওয়াটা নামাযীর লাইনবদ্ধ
হওয়া জরূরীর প্রমাণ। কিন্তু সে কাতারবদ্ধ হতে অপারগ কারণ;
সামনের কাতারে জায়গা নেই। তাই এমতাবস্থায় তার জন্য এই
শারয়ী মূলণীতি প্রযোজ্য যে, [লা-ওয়াজিবা মাআ’ল ইজ্ য]
অপারগ হলে ওয়াজিবের বিধান প্রযোজ্য নয়। অর্থাৎ কেউ কোন
কিছু করতে অক্ষম হলে, তা করাটা তার উপর জরূরী থাকে না।
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (কাজেই তোমরা আল্লাহকে তোমাদের
সাধ্যমত ভয় কর।) [আত্ তাগাবুন/১৬] তিনি আরো বলেনঃ (আল্লাহ
কোন ব্যক্তির উপর তার সাধ্যের অতিরিক্ত কিছু আরোপ করেন
না।) [বাকারাহ/২৮৬] এই মতটি মধ্যম মত হিসাবে শাইখুল ইসলাম ইবনু
তায়মিয়া, শাইখ সা’দী, শাইখ আলবানী, শাইখ ইবনে উসায়মীন প্রমুখ
গ্রহণ করেছেন।
এই বিষয়ের সারাংশ স্বরূপ উল্লেখ্য যে,
ক-মাসবূক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করার পর নিজে একা কাতার
তৈরি না করে সামনের লাইনে ঢুকার চেষ্টা করবে। এই সময়
মুসল্লীদের তার জন্য স্থান করে দেওয়া উচিৎ। নবী (সাঃ)
বলেনঃ “তোমরা কাতার সোজা করে নাও, কাঁধ বরারবর করে নাও,
খালি স্থানগুলি পূরণ করে নাও এবং নিজ ভায়ের হাত ধরার
ক্ষেত্রে নম্র হও..”। [আহমদ, আবু দাঊদ, নাসাঈ, সহীহুত্ তারগীব
ওয়াত্ তারহীব]
আবু দাঊদ (রহঃ) নিজ ভাইর হাত ধরার ক্ষেত্রে নম্র হও এর
অর্থে বলেনঃ “যখন কেউ লাইনে প্রবেশ করতে আসে, তখন
প্রত্যেক ব্যক্তির উচিৎ যে, তারা যেন তার জন্য নিজ কাঁধ
নম্র করে যেন সে লাইনে প্রবেশ করতে পারে।
খ- এই সময় কাউকে সামনের কাতার থেকে টেনে নিয়ে কাতার
তৈরি করা যাবে না। কারণ এমন করার কোন সহীহ দলীল নেই।
বরং এতে কিছু শারঈ বিধান লঙ্ঘিত হয় যেমনঃ
১-যাকে টানা হয়, তাকে সমস্যায় ফেলা হয় এবং তার খুশু-
খুযুতে ব্যাঘাত ঘটে।
২-পূর্ণ লাইনে খালি স্থান তৈরি করা হয়; অথচ লাইন পূরণ ও
মিলনের আদেশ করা হয়েছে।
৩-যাকে টানা হচ্ছে তাকে উত্তম ফযীলতের স্থান থেকে কম
মানের স্থানে স্থানান্তর করা হয়।
৪-পুরা লাইনে ব্যাঘাত ঘটে কারণ; এক জনের স্থান খালি হওয়ার
কারণে লাইনের সবাইকে তা পূরণের জন্য নড়া-চড়া করতে হয়।
[শারহুল মুমতি, ইবনে উসায়মীন,৪/২৭২-২৭৩]
গ-সে ইমামের পাশে গিয়ে তার বরাবর দাঁড়িয়ে নামায
পড়বে না কারণঃ
১-এতে মানুষের কাঁধ ডিঙ্গানোর প্রয়োজন রয়েছে; অথচ
নামাযীর কাঁধ ডিঙ্গানো নিষেধ।
২-ইমামের সাথে তাঁর বরাবর নামায পড়লে সুন্নতের বরখেলাফ
করা হয় কারণ; সুন্নত হচ্ছে ইমামের স্থান মুক্তাদীর স্থান
থেকে পৃথক ও স্বতন্ত্র। [প্রাগুক্ত ৪/২৭৩]
ঘ-মাসবূক সামনের লাইনে ফাঁকা স্থান
না পেলে এবং তাতে প্রবেশ না করতে পারলে, সে আর অন্য
মাসবূকের অপেক্ষা করবে না; বরং একাই পিছনের লাইনে নামায
পড়বে কারণঃ
১-অপেক্ষা করতে করতে রাকাআত ছুটে যেতে পারে আর অনেক
সময় সেটি শেষ রাকাআত হলে জামাআতই ছুটে যেতে পারে। আর
এমন হলে জামাআতের ফযীলত থেকে সে মাহরূম হয়ে যাবে আর
নামাযও ছুটে যাবে। [প্রাগুক্ত,৪/২৭৪]
৫-মাসবূক কি ভাবে এবং কি বলে জামাআতে প্রবেশ করবে?
মাসবূক ব্যক্তি প্রথমে দণ্ডয়মান অবস্থায়
তকবীরে তাহরীমা দিবে অতঃপর ইমামকে যেই অবস্থায় পাবে, সেও
সেই অবস্থায় চলে যাবে কারণ; তকবীরে তাহরীমা নামাযের রুকন
তাই তা ব্যতীত নামায হয় না। অনেক সময় এই অবস্থায় মাসবূকের উপর
দুটি তাকবীর একত্রিত হয়ে যায়। যেমন ধরুন মাসবূক এমতাবস্থায়
জামাআতে প্রবেশ করছে, যখন ইমাম রুকূ বা সাজদার জন্য তাকবীর
দিচ্ছেন। এই সময় মাসবূকের
প্রতি প্রথমে তাকবীরে তাহরীমা দেওয়া জরূরী অতঃপর রুকূর
বা সাজদার তাকবীর দেওয়া। এটি উত্তম নিয়ম তবে যদি কেউ রুকূ
বা সাজদার তকবীর, যাকে তাকবীরাতুল ইন্তিকাল বলা হয়
তা না দিয়ে শুধু তাকবীরে তাহরীমা দেয়, তাহলে তার জন্য এটিই
যথেষ্ট হবে। [আল্ মুলাখ্খাস আল্ ফিকহী, ড.সালেহ ফাউযান,
পৃঃ ৯৮]
অতঃপর ইমাম যেই অবস্থায় থাকবে সেও সেই অবস্থায় শরীক হবে।
ইমাম সাজদায় আছে বলে তাঁর সাজদা থেকে দাঁড়ানোর
অপেক্ষা করা বা আরো এইরূপ অন্য কিছুর অপেক্ষা করা ভুল।
নবী (সাঃ) বলেনঃ “যখন তোমাদের কেউ
নামাযে আসবে এমতাবস্থায় যে ইমাম কোন এক অবস্থায় আছেন,
তাহলে সে যেন তেমন করে যেমন ইমাম করেন”। [তিরমিযী,
অনুচ্ছেদ নং ৬২ হাদীস নং ৫৯১, শাইখ আলবানী সহীহ বলেছেন]
তিনি (সাঃ) আরো বলেনঃ “যখন তোমরা ইমামকে সাজদারত অবস্থায়
পাবে, তখন তোমরাও সাজদা করবে কিংবা রুকূ অবস্থায় পাবে, তখন
তোমরাও রুকূ করবে কিংবা কিয়াম অবস্থায় পাবে, তখন তোমরাও
দাঁড়াবে”। [সিলসিলা সহীহা নং ১১৮৮]
৬-মাসবূক দুআই ইস্তিফ্তাহ (সানা) পড়বে কি?
দুআয়ে ইস্তিফ্তাহ বা সানা পড়ার সময় হচ্ছে,
তাকবীরে তাহরীমার পর এবং সূরা ফাতিহা পড়ার পূর্বে। তাই
মাসবূক যদি ইমামের রুকূ, সিজদা বা তাশাহ্ হুদের সময়
জামাআতে শরীক হয়, তাহলে তাকে সানা পড়তে হবে না। কারণ
এগুলো সানা পড়ার স্থান নয় এবং এসব স্থানের দুআ ও যিকির
নির্দিষ্ট। কিন্তু মাসবূক যদি কিয়াম অবস্থায় ইমামকে পায় আর
তার অধিক ধারণা হয় যে, সে ইমামের রুকূ করার
পূর্বে সানা পড়ে সূরা ফাতিহা পড়তে পারবে,
তাহলে সে সানা পড়বে; নচেৎ শুধু সূরা ফাতিহা পড়বে। কারণ
সূরা ফাতিহা পড়া ওয়াজিব আর সানা পড়া মুস্তাহাব। এটাই
প্রাধান্যযোগ্য মত। ইমাম নবভী (রহঃ) বলেনঃ “মাসবূক
ইমামকে যদি কিয়াম ছাড়া অন্য অবস্থায় পায়,
তাহলে দুআ’য়ে ইস্তিফতাহ (সানা) পড়বে না,… আর যদি কিয়াম
অবস্থায় পায় এবং অনুমান করতে পারে যে, সে সানা, তাআ’উয
(আউযুবিল্লাহ) ও ফাতিহা পড়তে পারবে, তাহলে সানা পড়বে…আর
যদি বুঝতে পারে যে, এসব পড়া সম্ভব নয় কিংবা সন্দেহ হয়,
তাহলে সানা পড়বে না”। [মাজমূ ৩/৩১৮-৩১৯]
এ সম্পর্কে কিছু উলামা মনে করেন, সির্রী (নিরব)
নামাযে মাসবূক সানা পড়বে কিন্তু জাহরী (সশব্দিক)
নামাযে যদি ইমামকে সূরা ফাতিহা পড়ার পূর্বে নিরব অবস্থায়
পায়, তাহলে পড়বে নচেৎ পড়বে না।
৭-মাসবূক ইমামের সাথে যেই রাকাআতে প্রবেশ করে, তা কি তার
জন্য প্রথম রাকাআত?
অধিকাংশ ফুকাহায়ে কিরাম মনে করেন, মাসবূক যখন
জামাআতে শরীক হয়, তখন তার সেটা নামাযের শেষাংশ হয়। আর যখন
সে বাকিটা পূরণ করে সেটা তার প্রথমাংশ হয়। [ফিকহ বিশ্বকোষ
৩৭/১৬৪] উদাহারণ স্বরূপ যদি কোনো ব্যক্তি এমন সময়
জামাআতে শরীক হয়, যখন ইমাম এক রাকাআত শেষ করে দ্বিতীয়
রাকাআত পড়ছেন, তখন মাসবূকের এই রাকাআতটি তার জন্য প্রথম
না দ্বিতীয়? হানাফী, মালেকী ও হাম্বালী ফুকাহাগণ
এটাকে তার জন্য দ্বিতীয় রাকাআত মনে করেন, যেমন
সেটা ইমামের জন্যও দ্বিতীয়। আর ইমামের সালাম ফিরানোর পর
সে যা পড়বে তা তার প্রথম রাকাআত বা নামাযের শেষাংশ
ধরা হবে। তাদের দলীল নবী (সাঃ) এর এই হাদীস “…
যা পাবে তা পড়ে নিবে আর যা ছুটে যাবে তা কাযা করে নিবে”।
[নাসাঈ, ইমামাহ অধ্যায়, নং৮৬০]
তারা এখানে কাযা শব্দটিকে ফেকহী পারিভাষিক অর্থে গ্রহণ
করেন। অর্থাৎ কোন আমল তার নির্ধারিত
সময়ে না করা হলে পরে তা করে দেওয়া। তাই ইমামের
সাথে যেটা মাসবূক পায় নি সেটা তার প্রথম নামায ছিল
যা নির্ধারিত সময়ে আদায় না হওয়ার
কারণে পরে সে তা কাযা হিসাবে সম্পাদন করবে।
তবে শাফেয়ী মাযহাবের ফকীহগণ মনে করেন, মাসবূক
জামাআতে শরীক হয়ে ইমামের সাথে নামাযের যে প্রথম
অংশটি পায় সেটা তার জন্য প্রথম রাকাআত এবং পরে সে যা পূরণ
করে সেটি তার শেষ নামায বা নামাযের শেষাংশ। কারণ নবী (সাঃ)
বলেনঃ “যখন নামাযে আসবে, তখন শান্ত ভাবে আসবে,
যা পাবে তা পড়ে নিবে আর যা ছুটে যাবে, তা পূরণ করে নিবে”।
[বুখারী, অধ্যায়, আযান নং৬৩৫, ৬৩৬, মুসলিম, মাসাজিদ অধ্যায়,
নং ১৩৬২]
এটিই অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মত কারণঃ
ক- নবী (সাঃ) এর বাণী ‘পূরণ করে নিবে’ থেকে বুঝা যায় যে,
মুক্তাদী ইমামের সাথে যা পায় তা তার প্রথম রাকাআত। কারণ
কোনো কিছু তখনই পূরণ হয়, যখন তা শুরু করা হয়। তাই নবী (সাঃ) যখন
ছুটে যাওয়া নামায পূরণ করতে বলছেন, তখন এর অর্থ দাঁড়ায় যে,
সে ইমামের সাথে যা পেয়েছে, তা তার প্রথম নামায।
খ- ইবনু মুনযির বলেনঃ তারা এ ব্যাপারে ঐক্যমত যে,
তাকবীরে তাহরীমা প্রথম রাকাআত ছাড়া অন্য রাকাতে হয় না।
[নায়লুল্ আউত্বার,৩/১৭১] তাঁর মন্তব্যের ব্যাখ্যা এইরূপ যে,
মাসবূক যখন তাকবীরে তাহরীমা দিয়ে নামাযে প্রবেশ করে, তখন
তার সেটা প্রথম রাকাআত হওয়াই সঙ্গত কারণ;
তাকবীরে তাহরীমা প্রথম রাকাআতেই হয়। এমন নয় যে, মাসবূক যখন
দ্বিতীয় বা তৃতীয় রাকাআতে প্রবেশ করে, তখন
সে তাকবীরে তাহরীমা দিবে না বরং যখন পূরণ করতে উঠবে তখন
তাকবীরে তাহরীমা দিবে।
গ- বাকি থাকলো সেই বর্ণনা, যাতে কাযা করার শব্দ
এসেছে তো তার উত্তর এই ভাবে দেওয়া হয়েছে।
১- কাযা করার বর্ণনা অপেক্ষা পূরণ করার বর্ণনা বেশী সংখ্যায়
এসেছে এবং তা বেশী শুদ্ধ কারণ; এই বর্ণনা সহীহাইনে এসেছে।
২- হাদীসে কাযা শব্দটি ফুকাহাগণের পরিভাষায় ব্যবহার
হয়নি কারণ তা পরে আবিষ্কৃত পরিভাষা; বরং তা কোনো কাজ পূরণ
করা বা সমাপ্ত করার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন আল্লাহ
তাআলা বলেনঃ (ফা-ইযা কুযিয়াতিস্ স্বালাতু) [জুমুআহ/১০]
অর্থঃ ( যখন নামায সমাপ্ত হবে) তিনি অন্যত্রে বলেনঃ (ফা-
ইযা কাযাইতুম মানাসিকাকুম) [বাকারাহ/২০০] অর্থঃ (অতঃপর
হজ্জের কার্যাবলী যখন সমাপ্ত করবে)
এই মতভেদের ফলাফলঃ ধরুন যদি কেউ ইমামের সাথে মাগরিবের
তৃতীয় রাকাআতে শরীক হয়, তাহলে প্রথম মতানুযায়ী সে শুধু
সূরা ফাতিহা পাঠ করবে কারণ; এটা তার তৃতীয় রাকাআত যেমন
ইমামের ক্ষেত্রেও তৃতীয় রাকাআত। কিন্তু দ্বিতীয়
মতানুযায়ী সে সূরা ফাতিহা সহ অন্য একটি সূরাও পাঠ
করবে কারণ; এটি তার প্রথম রাকাআত। এই
ভাবে বাকি বিষয়গুলি অনুমান করতে পারেন।
৮-রুকূ পেলে রাকাআত গণ্য করাঃ
মাসবূক ইমামের সাথে রুকূ পেলে সে সেই রাকাআতটি গণ্য
করবে কি করবে না? অর্থাৎ তার
সে রাকাআতটি হয়ে যাবে না হবে না? এ
বিষয়ে ইসলামী বিদ্ব্যানদের দুটি মত দেখা যায়।
প্রথম মতঃ তার রাকাআত হয়ে যাবে এবং সে এটি রাকাআত
ধরে নিবে। এই মতে সমস্ত ফুকাহদের ঐক্যমত রয়েছে। [ফিকহ
বিশ্বকোষ ৩৭/১৬৩]
তাদের দলীলাদি নিম্নরূপঃ
১- আবু বাকরা থেকে বর্ণিত, তিনি একদা লাইনে পৌঁছানোর
পূর্বে রুকু করেন এবং ঝুকেই লাইনে প্রবেশ করেন।
বিষয়টি নবী (সাঃ) কে বলা হলে তিনি (সাঃ) বলেনঃ “ আল্লাহ
তোমার আগ্রহকে বাড়িয়ে দিক আর পূনরায় এমন করো না”। [বুখারী,
আযান অধ্যায়, নং৭৮৩] তারা বলেনঃ নবী (সাঃ) তাকে সেই
রাকাআতটি পুনরায় পড়ার আদেশ দেন নি, যা দ্বারা বুঝা যায় রুকূ
পেলে রাকাআত হয়ে যায়।
‘পুনরায় করো না’ এর অর্থে ইবনে হাজার আসক্বালানী (রহ)
বলেনঃ দৌড়ে চলা এবং লাইনে প্রবেশের পূর্বে রুকূ
করা অতঃপর সেই অবস্থায় ঝুকে হেঁটে লাইনে প্রবেশ করা, এমন
কাজ আর করো না। তিনি ত্বাবারানীর বরাতে একথাও উল্লেখ
করেন যে, নবী (সাঃ) জিজ্ঞাসা করেনঃ এই
নিঃশ্বাসী ব্যক্তি কে? (দৌড়ে দূর থেকে রুকূ করার
কারণে তাঁর নিঃশ্বাস স্ফীত হয়ে গেছিল) তখন
তিনি বলেনঃ আমার ভয় হচ্ছিল যে, আপনার সাথে রাকাআতটি পাব
না”। [ফাতহুল বারী ২/৩৪৭] অর্থাৎ রাকাআতটি যেন ছুটে না যায়
তাই তিনি এমন করেছিলে, যা থেকেও ইঙ্গিত মিলে যে, রুকূ
পেলে রাকাআত হয়ে যায়। অনেকে বলেনঃ পুনরায় করো না,
মানে লাইনের বাইরে তাকবীরে তাহরীমা দেওয়ার কাজটি আর
করো না। কেউ বলেনঃ নামাযে আসতে ঢিলেমি করো না। রুকু
অবস্থায় হেঁটে লাইনে প্রবেশ করো না কারণ; এটি চতুষ্পদ
জন্তুর চলন। [নায়লুল আউত্বার, শাওকানী, ৩/২৩৬] রুকূ
পেলে রাকাআত হয়ে যায়, মত পোষণকারীগণ উপরোক্ত
অর্থগুলি থেকেও দলীল পেশ করে বলেনঃ কোনো অর্থের
মাধ্যমে এটা বুঝা যায় না যে, নবী (সাঃ) তাকে পুনরায় সেই
রাকাআতটি পড়তে বলেছেন, যা দ্বারা বুঝা যায় যে, রুকূ
পেলে রাকাআত হয়ে যায়।
২- নবী (সাঃ) বলেনঃ “যে নামাযের এক রাকাআত পেল, সে নামায
পেয়ে গেল”। [বুখারী, মাওয়াক্বীতুস স্বালাত, নং ৫৮০] অন্য
বর্ণনায় এসেছে, যখন তোমরা নামাযে আসবে আর আমরা সাজদায়
থকবো তখন তোমরাও সাজদা করো এবং তা গণ্য করো না। আর
যে ব্যক্তি রাকাআত পেলো সে নামায পেয়ে গেল”। [আবু দাঊদ,
বায়হাক্বী, আলবানী (রহ) যয়ীফ বলেছেন, ইরওয়া ২/২৬০]
আপত্তিঃ হাদীস থেকে রুকূ পেলে নামায পেলো, বা নামাযের
ফযীলত পেলো, এটা বুঝা যায় কিন্তু রাকাআত
পেলো তা বুঝা যায় না কারণ; তা উল্লেখ হয় নি।
উল্লেখ্য, (যে রুকূ পেল সে রাকাআত পেয়ে গেল) বলে আবু
দাঊদের বরাতে যেই হাদীসটি বর্ণনা করা হয়, তা বর্তমান অনেক
গবেষকের নিকট সাব্যস্ত নয়; যদিও বহু ফিকহ তথা অন্যান্য
গ্রন্থে এমনই উল্লেখ হয়েছে।[দেখুন, সালেহ বিন মুহাম্মদ
আল্ আমূদী কর্তৃক লিখিত প্রবন্ধ ‘তাহকীকুল খিলাফ
ফী হাদীসে মান আদ্ রাকার রুকূ ফাক্বাদ আদ রাকার রাকাআহ’।
http://www.majles.alukah.net এ প্রকাশিত]
৩- তাঁরা এছাড়া আরো কিছু সাহাবার আমল দ্বারা দলীল দিয়েছেন
কিন্তু এসব বর্ণনা দোষ মুক্ত নয়।
দ্বিতীয় মতঃ রুকূ পেলে রাকাআত হবে না; বরং তাকে রুকূর
পূর্বে কিয়াম অবস্থায় সূরা ফাতিহা পড়ার সুযোগ থাকতে হবে।
এটি ইবনু হাযম সহ অনেকেরে মত।[আল্ মুহাল্লা, ইবনু হাযম ৩/২৪৪]
এই মতের দলীলাদিঃ
১- নবী (সাঃ) বলেনঃ “… যা পাবে তা পড়ে নিবে আর
যা ছুটে যাবে তা পূরণ করে নিবে”।[বুখারী, অধ্যায়, আযান
নং ৬৩৫, ৬৩৬, মুসলিম, মাসাজিদ অধ্যায়, নং ১৩৬২]
যে ইমামকে রুকূ অবস্থায় পায়, তার কিয়াম ছুটে যায়। তাই
তাকে সালামের পর সেটা পূরণ করতে হবে।
২- কিয়াম নামাযের রুকন, যা ব্যতীত নামায হয় না। নবী (সাঃ)
বলেনঃ “দাঁড়িয়ে নামায পড়, যদি না পারো তো বসে পড়, তাও
না পারলে কাঁত হয়ে পড়”। [বুখারী, তাকস্বীরুস স্বালাত,
নং ১১১৭]
বুঝা গেল,
নামাযে দাঁড়ানো জরূরী তা বিনা ওজরে ছাড়া যাবে না। তাই
রুকূ পাওয়া ব্যক্তির কিয়াম ছুটে যায় বলে তাকে সেই রাকাআত
আবারো পড়তে হবে।
৩- নবী (সাঃ) বলেনঃ “ সূরা ফাতিহা পড়া ব্যতীত নামায হয় না”।
[বুখারী, আযান অধ্যায়, নং৭৫৬]
বুঝা গেল, সূরা ফাতিহা ছাড়া নামায হয় না। তাই রুকূ
পাওয়া ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পড়েনি বলে তাকে পরে তা কাযা
করতে হবে।
অগ্রাধিকার প্রাপ্ত মত নির্ণয়ঃ প্রথম মতের দিকে লক্ষ্য
করলে দেখা যাচ্ছে, ইমাম চতুষ্টয় সহ জমহূর উলামা আবু
বাকরা (রাযিঃ) এর হাদীস থেকে রুকূ পেলে রাকাআত হয়ে যায়
বুঝেছেন এবং এটি সঊদী স্থায়ী উলামা পরিষদও সমর্থন করেছেন।
তাই তাঁদের বুঝের বিপরীতে কোন রায় দেওয়া আমার
পক্ষে কষ্টকর। অন্য দিকে নামাযে সূরা ফাতিহা পাঠ
এবং কিয়ামের গুরুত্বের দিকে লক্ষ্য করলে রুকু
পাওয়া ব্যক্তির রাকাআত হওয়া মেনে নেওয়াতে একটু কিন্তু
থেকেই যায়। তবে উভয় মত দলীল দ্বারা সমাদৃত হওয়ায় দুটির
প্রতি আমল করা সঙ্গত হবে ইনশা আল্লাহ।
৯-জুমআর এক রাকাআত নামায ছুটে গেলেঃ
যে ব্যক্তি জুমআর এক রাকাআত নামায পেয়েছে, সে জুমআ
পেয়েছে। এই সময় সে ইমামের সালামের পর বাকি এক রাকাআত পূরণ
করে নিবে। নবী (সাঃ) বলেনঃ “ যে ব্যক্তি জুমআর এক রাকাআত
পেল, সে যেন আর এক রাকাআত মিলিয়ে নেয় এবং তার সালাত
পূর্ণ”। [নাসাঈ নং ৫৫৭, ইবনু মাজাহ নং ১১২১, সূত্র সহীহ,
ফাতাওয়া লাজনা দাইমাহ ৮/২২৪]
আর যে ব্যক্তি এক রাকাআতের কম পেয়েছে, যেমন দ্বিতীয়
রাকাআতের সাজদা বা তাশাহ্হুদ পেয়েছে, তাহলে সে জুমআর
সালাত পায় নি। এমতাবস্থায় সে ইমামের সালাম শেষে উঠে চার
রাকাআত যহরের নামায আদায় করবে।
[সউদী স্থায়ী ফাতাওয়া বোর্ড ৮/২২৭]
১০-ঈদের নামাযের মাসবূকঃ
ঈদের নামাযে প্রথম রাকাআতে ইমামের অতিরিক্ত তকবীর দেওয়ার
সময় কেউ জামাআতে প্রবেশ করলে,
প্রথমে সে তাকবীরে তাহরীমা দিয়ে নামাযে প্রবেশ করবে। এই
সময় যদি সে কিছু তকবীর ইমামের সাথে পায় তো দিবে নচেৎ
বাকি কাজে ইমামের অনুসরণ করবে। নামায শেষে এই অতিরিক্ত
তাকবীর (তাকবীরে যাওয়াঈদ) তাকে পূরণ করতে হবে না। [মাজমূউ
ফাতাওয়া ইবনু উসায়মীন,১৬/২৪৫]
আর কেউ যদি দুই ঈদের দ্বিতীয় রাকাআতের তাশাহ্হূদে শরীক
হয়, তাহলে সে ইমামের সালাম ফিরানোর পর ইমামের মতই তকবীর,
কিরাআত, রুকূ ও সাজদা করে দুই রাকাআত নামায আদায় করবে।
[সঊদী স্থায়ী ফতোয়া বোর্ড ৮/৩০৭] এই ভাবে এক রাকাআত
ছুটে গেলেও অনুরূপ পদ্ধতিতে আদায় করবে।
১১-জানাযার নামাযের মাসবূকঃ
যদি কেউ এমন অবস্থায় জানাযার নামাযে শরীক হয় যখন ইমাম
একটি তাকবীর শেষ করে দ্বিতীয় তাকবীরে আছেন বা দ্বিতীয়
শেষ করে তৃতীয়তে অবস্থান করছেন বা তৃতীয় শেষ
করে চতুর্থের স্থানে রয়েছেন। তাহলে সে ইমামের সাথে যত
তাকবীর পাবে তার অনুসরণ করতঃ আদায় করবে এবং ইমামের সালাম
ফিরানোর পর এবং জানাযা উঠানোর
পূর্বে সে বাকি তাকবীরগুলি দিয়ে সালাম ফিরাবে।
কাযা তকবীরগুলি
আদায় করার সময় তার উপর সর্বনিম্ন যা জরুরী তা করলেই যথেষ্ট
হবে। যেমন দ্বিতীয় তাকবীরে যদি বলে,
আল্লাহুম্মা সাল্লি আ’লা মুহাম্মদ (হে আল্লাহ! নবীর
প্রতি রহমত প্রেরণ করো) এবং তৃতীয়ের পর
যদি বলেঃ ‘আল্লাহুম্মাগ্ ফির লাহু’ (হে আল্লাহ!
তুমি তাকে ক্ষমা করো), তাহলে তা যথেষ্ট হবে।
[সঊদী স্থায়ী ফতোয়া বোর্ড,৮/৩৯৯]
ইমামের ভুল-ত্রুটি (সাজদায়ে সাহুর বিধান)
‘সাহু’ ও সাজদায়ে সাহুঃ
সাহুর আভিধানিক অর্থ, ভুল, অমনোযোগ এবং বেখেয়াল। তাই
নামাযে সাহু হওয়া মানে নামায সম্পাদনের সময়
ভুলে তথা বেখায়ালে কিছু
ছেড়ে দেওয়া বা বেশী করে দেওয়া বা সন্দেহে পড়া। আর
সাজদায়ে সাহু হচ্ছে, সেই ভুল সংশোধনের উদ্দেশ্যে সালাম
ফিরানোর পূর্বে বা পরে দুটি সাজদা করা।
১-সাজদায়ে সাহুর মাধ্যমে কি ধরণের ভুল সংশোধিত হয়?
নামাযে সংঘটিত ভুলগুলি সমমানের নয়। কিছু ভুল বড় পর্যায়ের,
যা সাজদায়ে সাহুর মাধ্যমে সংশোধন হয় না; বরং তা হলে অনেক
সময় নামায বাতিল হয়ে যায়, আর অনেক সময় ছুটে যাওয়া সেই
কাজটি পুনরায় করা ব্যতীত নামায শুদ্ধ হয় না। এই সব বড় ভুলের
উদাহরণ হচ্ছে, নামাযের রুকন ছুটে যাওয়া। সেই রুকন গুলির
মধ্যে যদি কেউ তাকবীরে তাহরীমা ভুলে ছেড়ে দেয়,
তাহলে তার নামায বাতিল হয়ে যাবে এবং সাজদায়ে সাহুর
মাধ্যমে তা পূরণ হবে না। এ ছাড়া অন্য কোনো রুকন
ছুটে গেলে, যেমন রুকু কিংবা সাজদা ছুটে গেলে অতঃপর তার
পরের রাকাআতের কিরাআত শুরু করার পূর্বে স্মরণ
হলে তৎক্ষণাৎ তা করতে হবে এবং তার পরের বাকি কাজও
করতে হবে। আর যদি পরের রাকাআত শুরু করার পর স্মরণ হয়,
তাহলে যেই রাকাআতে সেই রুকন ছুটে গেছে তা বাতিল
হয়ে যাবে এবং তার পূর্বে সংঘটিত রাকাআতটি সেই
স্থানে স্থলাভিষিক্ত হবে। [দেখুন, শারহুল মুমতি,৩/৩৭১-৩৭২/
আল্ মুলাখ্খাস আল্ ফিকহী, ড. ফাউযান/৭৫]
এতদ্ব্যতীত নামাযের কোনো ওয়াজিব ভুলে ছুটে গেলে,
তা সাজদায়ে সাহুর মাধ্যমে পূরণ তথা সংশোধন হয়ে যায়। যেমন
প্রথম তাশাহ্হুদ ছুটে যাওয়া, তকবীরে তাহরীমা ব্যতীত
বাকি তাকবীর সমূহের কোনো একটি ছুটে যাওয়া,
সামিআল্লাহুলিমান হামিদাহ ভুলে না বলা ইত্যাদি। নবী (সাঃ)
একদা প্রথম তাশাহ্হুদ ভুলে ছেড়ে দিলে সাহুর
দুটি সাজদা করেন। [আহমদ, ৪/২৫৩, তিরমিযী, আবু দাঊদ ও বায়হাক্বী]
নামাযের সুন্নাহ কিছু ছুটে গেলে সাজদায়ে সাহু
দেয়া জরুরী নয়; বরং অনেক উলামার নিকট তা না দেয়াই ভাল। কারণ
নামাযের সুন্নাহ ছুটে যাওয়ার ফলে নবী (সাঃ) সাজদায়ে সাহু
করেছেন মর্মে কোনো দলীল পাওয়া যায় না। তবে একটি আম
(ব্যাপক অর্থবোধক) হাদীস তা বৈধতার ইঙ্গীত করে। নবী (সাঃ)
বলেনঃ “প্রত্যেক সাহুর বদলে রয়েছে দু’টি সাজদা”। [ইবনু
মাজাহ নং ১২১৯, আবু দাঊদ নং১০৩৮, সূত্র হাসান দেখুন ইরওয়াউল
গালীল ২/৪৭]
উল্লেখ থাকে যে, নামাযের রুকন ইচ্ছা বা অনিচ্ছায়
ছুটে গেলে নামায হয় না যতক্ষণে তা না করা হয়। ওয়াজিব
ইচ্ছাকৃত ছাড়লে নামায বাতিল হয়ে যায় কিন্তু অনিচ্ছায়
ছাড়লে সাজদায়ে সাহুর মাধ্যমে তা সংশোধন হয়ে যায়। আর
নামাযের সুন্নাহ ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় ছুটে গেলে নামায বাতিল
হয় না, তবে পূর্ণ সওয়াব হতে বঞ্ছিত হয়। [মুলাখ্খাস আল
ফিকহী/৬৩]
২-যে সব কারণে সাজদায়ে সাহু বৈধ হয়ঃ
সাধারণতঃ যে সব কারণে সাজদায়ে সাহু করা বৈধ সেগুলো হল
তিনটি। যথা:
ক-নামাযের কিছু বেশী হওয়া।
খ- নামাযের কিছু কম হওয়া।
গ- নামাযে সন্দেহ হওয়া। [শারহুল্ মুমতি,৩/৩৩৮]
৩-সাজদায়ে সাহু সালামের পূর্বে না পরে?
অধিকাংশ উলামার মতে সাজদায়ে সাহু সালামের
পরে বা পূর্বে দিলে, তা যথেষ্ট হবে এবং নামায শুদ্ধ হবে।
কারণ নবী (সাঃ) সাজদায়ে সাহু সালামের পূর্বেও করেছেন
এবং পরেও করেছেন। শাওক্বানী বলেনঃ ‘ক্বাযী ইয়ায
এবং শাফেয়ীর অনুসারী এক দল বলেনঃ এই সকল
মতভেদকারী উলামা এবং অন্যান্য উলামাদের
মধ্যে এতে কোনো মতবিরোধ নেই যে, যদি কেউ নামাযের কম
বা বেশীর কারণে সালামের পূর্বে বা পরে সাজদায়ে সাহু দেয়,
তাহলে তা যথেষ্ট হবে এবং নামায বিনষ্ট হবে না। মূলতঃ তাদের
মতভেদ হচ্ছে, উত্তম কি? [সালামের আগে না পরে?] [নায়লুল্
আউত্বার, শাওক্বানী,৩/১৪২/ আর রাউযাতুন্নাদিয়্যাহ, মুহাম্মদ
সিদ্দীক হাসান খাঁ,১/৩২৭/শারহুল মুমতি,৩/৩৯৪]
অতঃপর আমাদের জানা ভাল যে, সাজদায়ে সাহু সালামের
পূর্বে না পরে, কখন হওয়া উত্তম? এ বিষয়ে ইসলামী পণ্ডিতদের
মধ্যে বড় মতভেদ রয়েছে। কম-বেশী আট টি মত পাওয়া যায়।
ইমাম আবু হানীফা (রহ) এর মতে সর্বাবস্থায় সাজদায়ে সাহু
সালামের পরে হবে। কিন্তু এই মত গ্রহণ করলে সেই সব হাদীস
প্রত্যাখ্যান করা হয়, যাতে নবী (সাঃ) সালামের পূর্বে সাহুর
সাজদা করেছেন বলে প্রমাণিত।
ইমাম শাফেয়ী (রহ) এর মতে সর্বাবস্থায় সাজদায়ে সাহু সালামের
পূর্বে হবে। আর এই মত গ্রহণ করলে সেই সব হাদীসের প্রতি আমল
হয় না, যেই সব হাদীসে নবী (সাঃ) সালামের পরে সাজদায়ে সাহু
করেছেন বলে প্রমাণিত।
তাই এমন একটি সমাধানের পথ হওয়া উচিৎ, যা গ্রহণ করা হলে উভয়
প্রকার হাদীসের প্রতি আমল করা সম্ভব হয়। এমন
মতকে সমন্বয়সাধনকারী মত বলে। উলামায়ে কেরাম হতে এই রকম
দুটি সুন্দর সমন্বয়কারী মত পাওয়া যায়।
প্রথম মতটি ইমাম শাওক্বানীর। তিনি বলেনঃ সে সব
স্থানে সালামের পূর্বে সাজদায়ে সাহু করা উত্তম যে সব
স্থানে নবী (সাঃ) সালামের পূর্বে করেছেন। অনুরূপ ঐসব
স্থানে সালামের পর সাজদায়ে সাহু করা উত্তম যে সব
স্থানে নবী (সাঃ) সালামের পর সাজদায়ে সাহু করেছেন।
এছাড়া অন্য স্থানে ভুল হলে নামাযী সালামের
পূর্বে কিংবা পরে সাজদায়ে সাহু করতে স্বাধীন; কারণ এসব
স্থানে কোথায় করতে হবে, তা তিনি (সাঃ) থেকে প্রমাণিত নয়।
[নায়লুল আউত্বার,৩/১৪৩]
দ্বিতীয় মতটি ইবনু তায়মিয়াহ এবং ইমাম আহমদের
একটি বর্ণনানুযায়ী মত। এই মতানুযায়ী যদি সাজদায়ে সাহু
নামাযের কোনো কিছু কমের কারণে হয়, তাহলে সালামের
পূর্বে হবে আর যদি কোনো কিছু বেশীর কারণে হয়,
তাহলে সালামের পরে হবে। আর সন্দেহের
কারণে হলে দুটি অবস্থা হবে। প্রথমতঃ সন্দেহের সময় সঠিক
নির্ণয়ে প্রয়াস করতঃ তা নির্ণয় সম্ভব হবে। এমন হলে সালামের
পর সাজদায়ে সাহু করতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ তিন রাকাআত হল
কি চার? এমন হলে তৎক্ষণাৎ সে চেষ্টা চালাবে যে, আসলে কত
রাকাআত হল। যদি অনুমানের পাল্লা এক দিকে বেশী হয়,
তাহলে সেটিই গণনা করবে। তিনের দিকে মনটা বেশী হলে তিন
ধরবে আর চারের দিকে বেশী হলে চার ধরবে। এই
নিয়মকে ‘তাহার্রী’ বলে। দ্বিতীয়তঃ সন্দেহের পর
কোনো দিকেই অনুমানের পাল্লা বেশী হবে না। যেমন তিন হল
কি চার? দুই দিকেই বরাবর সন্দেহ। এমন হলে কম সংখ্যা গণনা করবে।
অর্থাৎ তিন রাকাআত ধরবে। এটাকে (আল বিনাউ আলাল্ ইয়াক্বীন)
ইয়াক্বীনে প্রতি ভিত্তি করা বলে। এমন হলে সাজদায়ে সাহু
সালামের পূর্বে করবে। এই মতানুসারে প্রায় সকল দলীলের
প্রতি আমল সম্ভব। এই মতটি আগের মতের তুলনায় বেশী ভাল ও
আমলের দিক দিয়ে ব্যাপক কারণ প্রথম মতানুযায়ী যে সব
স্থানে সাজদায়ে সাহু প্রমাণিত নেই সেই সব স্থানে ভুল
হলে নামাযী আগে বা পরে সাজদায়ে সাহু
করতে পারে মর্মে যা বলা হয়েছে তা কোনো দলীলের উপর
ভিত্তিশীল নয় কিন্তু দ্বিতীয় মতটি তিন ক্ষেত্রে, কম,
বেশী ও সন্দেহের সময় যে সমাধান দেওয়া হয়েছে তাতে যেমন
প্রমাণিত স্থানে সাজদায়ে সাহুর প্রতি আমল হয়, তেমন
অপ্রমাণিত স্থানে এই সব দলীলের আধারে সমাধান দেওয়া হয়।
[আল্লাহই ভাল জানেন]
৪-যে সব কারণে এবং স্থানে নবী (সাঃ) সাজদায়ে সাহু করেছেন,
তার বর্ণনাঃ
১- চার রাকাআতের স্থানে পাঁচ রাকাআত পড়া হলে তিনি (সাঃ)
সাজদায়ে সাহু সালামের পর করেছেন। আর
এটা হচ্ছে নামাযে বেশী হওয়ার উদাহারণ।
ﻋﻦ ﻋﺒﺪ ﺍﻟﻠﻪ ﺑﻦ ﻣﺴﻌﻮﺩ: ﺃﻥ ﺍﻟﻨﺒﻲ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭ ﺳﻠﻢ ﺻﻠّﻰ ﺍﻟﻈﻬﺮَ ﺧﻤﺴﺎ ﻓﻘﻴﻞ ﻟﻪ : ﺃﺯِﻳﺪَ ﻓﻲ
ﺍﻟﺼﻼﺓِ؟ ﻓﻘﺎﻝ : ﻭ ﻣﺎ ﺫﺍﻙ؟ ﻗﺎﻟﻮﺍ: ﺻﻠّﻴﺖَ ﺧﻤﺴﺎ، ﻓﺴﺠﺪ ﺳﺠﺪﺗﻴﻦ ﺑﻌﺪﻣﺎ ﺳﻠّﻢ. ﺭﻭﺍﻩ ﺍﻟﺠﻤﺎﻋﺔ .
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ হতে বর্ণিত, একদা নবী (সাঃ) যহরের
নামায পাঁচ রাকাআত পড়ালেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, নামায
কি বেশী করে দেওয়া হয়েছে? তিনি বললেনঃ এ প্রশ্নের কারণ?
সাহাবাগণ বললেনঃ আপনি পাঁচ রাকাআত পড়ালেন। তখন
তিনি দুটি সাজদা করলেন সালাম ফিরানোর পর”। [বুখারী, স্বালাত
অধ্যায়, অনুচ্ছেদ নং ৩২, হাদীস নং (৪০৪)/ মুসলিম, মাসাজিদ
অধ্যায়, নং (১২৮১)]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, এটা শুনার পর তিনি (সাঃ) তাঁর দুই
পায়ে বসলেন এবং কিবলামুখী হলেন। অতঃপর দুটি সাজদা করলেন
তারপর সালাম ফিলালেন”। [বুখারী, স্বালাত অধ্যায়, নং (৪০১)]
২- চার রাকাআতের স্থানে দুই রাকাআত পড়ে সালাম
ফিরালে কিংবা চার রাকাআতের স্থানে তিন রাকাত পড়ে সালাম
ফিরালে, নবী (সাঃ) বাকি রাকাআত সালামের পর পূর্ণ করেন
এবং সালাম ফিরান তারপর সাজদায়ে সাহু করেন। বাহ্যত
এটা নামাযে কম হওয়ার উদাহারণ মনে হলেও ঐ সকল
উলামা এটাকে নামাযে বেশী করার উদাহারণ মনে করেছেন,
যারা নামাযের কোনো কিছু বেশী হলে সালাম ফিরানোর পর
সাজদায়ে সাহু হবে বলে মত ব্যক্ত করেছেন। তাদের
মতে বর্তমান অবস্থায় সে নামায পূর্ণ করার পূর্বে সালাম
ফিরিয়েছে যা, মূলতঃ নামাযে বেশী করা। [শারহুল মুমতী,৩/৩৪১]
ক- আবু হুরাইরা (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, একদা আল্লাহর রাসূল
(সাঃ) আমাদের যহর কিংবা আসরের নামায পড়ালেন। তিনি দুই
রাকাআত পড়িয়ে সালাম ফিরালেন। [কিছু লোক
বলাবলি করতে লাগলো, নামায মনে হয় কম করে দেওয়া হয়েছে!]
লোকদের মধ্যে এক ব্যক্তি ছিল, যাকে যুল ইয়াদাঈন বলা হত।
সে নবী (সাঃ) কে বললঃ আপনি কি ভুলে গেলেন না নামায কম
হয়ে গেছে? তিনি (সাঃ) বললেনঃ না আমি ভুলেছি আর না কম
করা হয়েছে। অতঃপর তিনি (সাঃ) বাকি লোকদের বললেনঃ যুল্
ইয়াদাঈন কি ঠিক বলছে? তারা বললঃ হাঁ। অতঃপর তিনি (সাঃ)
বাকি নামায আদায় করলেন। তারপর সালাম ফিরালেন। তারপর তকবীর
দিলেন এবং তাঁর সাজদার মত সাজদা করলেন বা তার চেয়েও একটু
দীর্ঘ সাজদা। তারপর তাঁর মাথা উঠালেন এবং তকবীর দিলেন।
অতঃপর তকবীর দিয়ে সাজদা করলেন তাঁর সাজদার মত কিংবা তার
থেকেও একটু দীর্ঘ সাজদা। তারপর তাঁর মাথা উপরে উঠালেন
এবং তকবীর দিলেন। অতঃপর সালাম ফিরালেন”। [বুখারী, সাহু
অধ্যায়, নং১২২৯/মুসলিম, মাসাজিদ অধ্যায়, সাহু অনুচ্ছেদ,
নং ১২৮৮]
খ- ইমরান বিন হুসাঈন হতে বর্ণিত, একদা নবী (সাঃ) আসরের নামায
তিন রাকাআত পড়িয়ে সালাম ফিরান এবং নিজ বাসস্থানে প্রবেশ
করেন। অতঃপর খিরবাক নামক ব্যক্তি তাঁকে এটা অবগত
করালে তিনি (সাঃ) রাগান্বিত অবস্থায় বাসা থেকে বের
হয়ে লোকদের মাঝে উপস্থিত হলেন
এবং জিজ্ঞাসা করলেনঃ একি সত্য বলছে? তারা বললঃ হাঁ!
অতঃপর তিনি (সাঃ) এক রাকাআত নামায পড়লেন এবং সালাম
ফিরালেন। তারপর দুটি সাজদা করলেন এবং সালাম ফিরালেন”।
[মুসলিম, মাসাজিদ অধ্যায়, সাহু অনুচ্ছেদ, নং (১২৯৩)/আবু দাঊদ
নং (১০১৮) নাসাঈ নং (১২৩৬) ইবনু মাজাহ নং (১২১৫)]
৩- প্রথম তাশাহ্হুদ [চার রাকাআত বা তিন রাকাআত বিশিষ্ট
নামাযের দুই রাকাআত শেষে তাশাহ্হুদ] ছুটে গেলে,
নবী (সাঃ) সালামের পূর্বে সাজদায়ে সাহু করেন অতঃপর সালাম
ফিরান। এখানে নামাযের অংশ কম হওয়ায় সাজদায়ে সাহু সালামের
পূর্বে হবে।
আব্দুল্লাহ বিন বুহাইনা (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, একদা নবী (সাঃ)
তাদের যহরের নামায পড়ান। প্রথম দুই রাকাআত শেষে না বসেই
উঠে যান। লোকেরাও তাঁর সাথে উঠে পড়েন। যখন নামায শেষ হয়
এবং লোকেরা তাঁর সালাম ফিরানোর অপেক্ষা করতে লাগে,
তিনি (সাঃ) বসা অবস্থায় তকবীর দেন, সালামের
পূর্বে দুটি সাজদা করেন অতঃপর সালাম ফিরান”। [বুখারী, সাহু
অধ্যায়, নং (১২২৪-১২২৫)/নাসাঈ, নং (১১৭৬)]
উপরোক্ত অবস্থায় ইমাম যদি পুরোপুরি দাঁড়ানোর পূর্বে তাঁর
এই ভুল জানতে পারে, তাহলে বসে পড়বে। আর
পুরো দাঁড়িয়ে যাওয়ার পর জানতে পারলে বসবে না।
বরং সাজদায়ে সাহু করবে। [আবু দাঊদ, স্বালাত অধ্যায়, নং (১০৩৬)
ইবনু মাজাহ, নং (১২০৮)]
৪- নামাযের রাকাআত সংখ্যায় সন্দেহ হওয়ার পর কোনো এক
দিকে ধারনা প্রবল হলে, নবী (সাঃ) সাজদায়ে সাহু সালামের পর
করতে বলেছেন। যেমন কারো সন্দেহ হল, তিন রাকাআত হল কি চার?
অতঃপর অনুমান তিনের দিকে বেশী হল, তখন তা তিনই
ধরতে হবে এবং এই সন্দেহের কারণে সালামের পর সাজদায়ে সাহু
করতে হবে।
নবী (সাঃ) বলেনঃ “তোমাদের কেউ
নামাযে সন্দেহে পড়লে সে যেন সঠিক
নির্ণয়ে চেষ্টা করে এবং তা করে। অতঃপর সে যেন সালাম
ফিরায় এবং তার পর দুটি সাজদা করে”। [বুখারী, স্বালাত অধ্যায়,
নং (৪০১) মুসলিম, নং (১২৭৪)]
৫- নামাযের রাকাআত সংখ্যায় সন্দেহ হওয়ার পর কোনো এক
দিকে ধারনা প্রবল না হলে, কম সংখ্যা ধরতে হবে এবং এই রকম
ক্ষেত্রে সাজদায়ে সাহু সালামের পূর্বে হবে। যেমন
কারো সন্দেহ হল যে, দুই রাকাআত পড়েছে কি তিন? আর
কোনো দিকেই অনুমান বেশী হয় না। এমন ক্ষেত্রে কম
সংখ্যা গণনা করতে হবে অর্থাৎ দুই রাকাআত
ধরতে হবে এবং সালামের পূর্বে সাজদায়ে সাহু করতে হবে।
আবু সাঈদ খুদরী (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেছেনঃ “যখন
তোমাদের মধ্যে কেউ নামাযে সন্দেহে পড়বে আর
জানতে পারবে না যে, সে তিন রাকাআত পড়লো না চার রাকাআত,
তাহলে সে যেন সন্দেহকে প্রত্যাখ্যান করে আর
যাতে সন্দেহ নেই তার উপর ভিত্তি করে। অতঃপর সালামের
পূর্বে সে যেন দুটি সাজদা দেয়। যদি তার অবস্থা এমন হয় যে,
সে পাঁচ রাকাআত পড়েছে, তাহলে (সেই দুটি সাজদা) তার
নামাযকে জোড়া করে দিবে। আর যদি সে চার রাকাআত
পূরণার্থে পড়েছে, তাহলে সেই দুটি সাজদা শয়তানকে লাঞ্ছিত
করা স্বরূপ হবে”। [মুসলিম, মাসাজিদ অধ্যায়, নামাযে সাহু
অধ্যায়, নং ১২৭২/মুসনাদ আহমদ,৩/৭২]
উপরের বর্ণনাসমূহের সারাংশঃ
উপরে বর্ণিত হাদীস সমূহ থেকে নবী (সাঃ) এর যে সব
স্থানে সাহু হয়েছে, তার বিবরণ নিম্নরূপঃ
১- চার রাকাআতের স্থানে পাঁচ পড়েছেন এবং এমন সময়
তিনি (সাঃ) সাজদায়ে সাহু সালামের পর করেছেন।
২- চার রাকাআতের স্থানে দুই রাকাআত পড়ে সালাম ফিরিয়েছেন
অনুরূপ চার রাকাআতের স্থানে তিন রাকাআত পড়িয়ে সালাম
ফিরিয়েছেন এবং এই সময়ে তিনি (সাঃ) সালাম ফিরানোর পর
সাজদায়ে সাহু করেছেন।
৩- প্রথম তাশাহ্হুদ না পড়েই তৃতীয় রাকাআতের জন্য
উঠে পড়েছেন। এমতবস্থায় তিনি (সাঃ) সাজদায়ে সাহু সালামের
পূর্বে করেছেন।
৪ এবং ৫-নামাযের রাকাআত সংখ্যায় সন্দেহ হওয়া অতঃপর
কোনো এক সংখ্যার দিকে একীন হওয়া কিংবা না হওয়া। এই দুই
স্থানে তাঁর সাহু হয়েছে বলে প্রমাণ নেই কিন্তু তাঁর হাদীস
রয়েছে। সন্দেহের পর কোনো এক সংখ্যার দিকে অনুমান
বেশী হলে তিনি (সাঃ) সাজদায়ে সাহু সালামের পর
করতে বলেছেন। আর সন্দেহের পর দুই সংখ্যার কোনো দিকেই
একীন না হলে কম সংখ্যা ধরতে বলেছেন এবং এই সময় তিনি (সাঃ)
সাজদায়ে সাহু সালামের পূর্বে করতে বলেছেন।
তাই উপরোক্ত স্থানে সাহু হলে বর্ণনানুযায়ী সালামের
আগে বা পরে সাজদায়ে সাহু করা উত্তম। আর অন্য স্থানে সাহু
হলে দেখতে হবে সেই সাহু উপরোক্ত কোন্ সাহুর সাথে মিল
রাখে? অতঃপর সেই অনুযায়ী আগে বা পরে সাজদায়ে সাহু
করতে হবে। আর কেউ যদি তা নির্ণয় করতে সক্ষম না হয়,
তাহলে আগে বা পরে যে কোনো সময় সাজদায়ে সাহু করা বৈধ
হবে ইন্ শাআল্লাহু তাআ’লা।
৫-সাজদায়ে সাহু করার নিয়মঃ
সাজদায়ে সাহুর পূর্বে তকবীর দিয়ে ঐ
ভাবে দুটি সাজদা করতে হবে যেভাবে নামাযে সাজদা করা হয়। এই
সময় নামাযের সাজদার যা বিধান, তা এই সাজদায়েও প্রযোজ্য।
[উপরোক্ত দলীলগুলির আলোকে]
৬-ইমাম সাজদায়ে সাহু করলে মুক্তাদীদেরও সাজদায়ে সাহু
করতে হবে:
কারণ মুক্তাদীগণ ইমামের অনুসরণ করতে আদিষ্ট। কিন্তু ইমামের
পিছনে মুক্তাদীর সাহু হলে, মুক্তাদী পৃথক
ভাবে সাজদায়ে সাহু করবে না। এ বিষয়ে ইবনুল মুনযির ঐক্যমত
বর্ণনা করেছেন। [আল্ ইজমা, ইবনুল মুনযির, পৃ ৮]
৭-সাজদায়ে সাহুর জন্য ভিন্ন তাশাহ্হুদঃ
সাজদায়ে সাহুর পরে আবার আলাদা কোনো তাশাহ্হুদ নেই। এ
বিষয়ে ইমরান বিন হুসাইন থেকে যেই হাদীস আবু দাঊদ ও
তিরমিযীতে বর্ণিত হয়েছে যে, “একদা নবী (সাঃ) নামাযে সাহু
করেন এবং দুটি সাজদা করেন। অতঃপর তাশাহ্হুদ করেন তারপর
সালাম ফিরান”, তা অসংরক্ষিত বর্ণনা; বরং সংরক্ষিত সহীহ
বর্ণনায় (অতঃপর তাশাহহুদ করেন) শব্দটি নেই। উক্ত
শব্দটিকে বায়হাকী, ইবনু আব্দুল বার্র, ইবনু হাজার
এবং আলবানী (রাহেমাহুমুল্লাহ) ‘শায’ বলেছেন। অর্থাৎ সৎ
রাভির এমন বর্ণনা যা, তিনি তার থেকে অধিক সৎ বর্ণনাকারীর
বিপরীত বর্ণনা করেছেন।[ইরওয়াউল গালীল,২/১২৮]
প্রকাশ থাকে যে, তাহিয়্যা পড়ার পর এক দিকে এক সালাম
ফিরানোর পর সাজদায়ে সাহু করার কোনো সহীহ হাদীস পাওয়া যায়
না।
৮-একই নামাযে একাধিক সাহু হলে:
একাধিক সাজদায়ে সাহু নয়; বরং এক বার সাজদায়ে সাহু যথেষ্ট
হবে। নবী (সাঃ) এর সাহুতে একাধিক সাহু ঘটেছিল, যেমন রাকাআত
কম হওয়া, নামাযের পূর্বে সালাম ফিরিয়ে দেওয়া অতঃপর অন্যের
সাথে বাক্যালাপ করা, তার পরেও তিনি এক বারই সাজদায়ে সাহু
দেন।[বুখারী, সাহু অধ্যায়, নং১২২৯/মুসলিম, মাসাজিদ অধ্যায়,
সাহু অনুচ্ছেদ, নং ১২৮৮]
ইমাম ও মুক্তাদীর বিবিধ ভুল-ত্রুটি
আমরা এ পর্বে ইমাম ও মুক্তাদীর কিছু ভুল-
ত্রুটি সংক্ষিপ্তাকারে আলোচনা করবো ইন্ শাআল্লাহু
তা’আলা। এসব ভুলের মধ্যে অনেক ভুল এমন রয়েছে যা ছোট
প্রকারের কিন্তু তা থেকেও আমাদের সতর্ক থাকা উচিৎ যেন
আমরা পূর্ণ সওয়াবের অধিকারী হতে পারি এবং এ সব ভুল যেন
একটি স্বভাবে পরিণত না হয়।
১-ইমামের সুতরা ব্যবহার না করা।
ইমাম মসজিদে ইমামতি করুক বা মসজিদের বাইরে, যদি তার
সামনে দেয়াল, পিলার, লাঠি বা এই জাতীয় কোনো আড়
না থাকে তাহলে তাকে সুতরা করা প্রয়োজন। এ
সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আদেশ
ব্যাপক অর্থবোধক। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
বলেনঃ
“যখন তোমাদের কেউ নামায আদায় করবে, তখন সে যেন
সুতরা সামনে করে নামায আদায় করে এবং সুতরার নিকটবর্তী হয়,
তার ও সুতরার মাঝে কাউকে অতিক্রম করতে না দেয়।” [আবু দাঊদ,
ইবনু খুযায়মাহ (৮১৮) বায়হাক্বী ২/২৬৭]
২-চাঁদ-তারার নকশা আছে এমন জায়নামাযে নামায অবৈধ মনে করাঃ
কিছু লোক এই কারণে সেই সব জায়নামাযে নামায আদায় অবৈধ
মনে করে যে, মহান আল্লাহ চন্দ্র-সূর্যকে সাজদা করতে নিষেধ
করেছেন। কিন্তু এটা তাদের বুঝার ভুল। কারণ এসব
জায়নামাযে নামাযী চন্দ্র-
সূর্যকে সাজদা করে না বরং আল্লাহকে সাজদা করে। চন্দ্র-
সূর্যকে সাজদা করা আলাদা বিষয় আর চাঁদ-তারার উপর
সাজদা করা আলাদা বিষয়। যেমন মাটিকে সাজদা করা ভিন্ন বিষয় আর
মাটির উপর সাজদা করা ভিন্ন বিষয়। আমাদের ভাল করে জানা দরকার
যে, মহান আল্লাহ শুধু চাঁদ ও সূর্যকে সাজদা করতে নিষেধ
করেন নি বরং সকল সৃষ্টিকে সাজদা করতে নিষেধ করেছেন
এবং কেবল তাঁকে সাজদা করতে বলেছেন যিনি এসবের
সৃষ্টিকর্তা। হ্যাঁ, তবে এমন জায়নামাযে বা বিছানায় নামায
না পড়াই ভাল, যাতে নকশা ও কারুকার্য থাকে, যার ফলে নামাযীর
মনযোগে ব্যাঘাত ঘটে।
৩-কিবলামুখী হওয়ার গুরুত্ব না দিয়ে মাইক্রোফোনমুখী হওয়ার
গুরুত্ব বেশী দেওয়া।
লাউড স্পীকারে নামায পড়ান এমন অনেক ইমামকে দেখা যায়,
তারা ইমামতির সময় লাউড স্পীকার ও স্টান্ডকে সম্মুখে ও
নিকটে রাখার চেষ্টা করেন। আর এমন করতে গিয়ে অনেক সময়
তারা কিবলা থেকে বেঁকে যান, যা ভুল। কারণ
আমরা কিবলামুখী হয়ে দাঁড়াতে আদিষ্ট। স্বেচ্ছায় জেনে-
বুঝে কিবলা থেকে বেঁকে দাঁড়ানো অবশ্যই আদেশ উল্লংঘন।
আমাদের সোজা কিবলার দিকে দাঁড়ানো প্রয়োজন
তাতে মাইক্রোফোন সম্মুখে আসুক বা দূরে থাক। এ
ক্ষেত্রে ওয়্যারলেস বিশিষ্ট পকেট মাইক্রফোন ব্যবহার
করা হলে সমস্যার সমাধান হতে পারে।
৪-ইমাম ও মুক্তাদীর লাইন সোজা ও বরাবর না করা:
অনেক ইমামকে দেখা যায়, মুয়াজ্জিনের ইক্বামত শেষ
হওয়া মাত্রই তকবীরে তাহরীমা দিয়ে নামায শুরু করে দেন। আর
অনেকে সেই সময় লাইন সোজা করার কথা বললেও সোজা হল কি না,
তা ভ্রুক্ষেপ না করেই নামায আরম্ভ করে দেন।
অন্যদিকে অনেক মুক্তাদী এমনও আছে যারা এটাকে ইমামের
রুটিন মনে করে তাঁর কথার তোয়াক্কাই করে না;
বরং অনেককে দেখা যায়, তার সামনের লাইনে স্থান
খালি আছে তা সত্ত্বেও সেই স্থান পূরণ করে না।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেমন লাইন বরাবর করা,
পূর্ণ করা, মাঝে ফাঁক না রাখা এবং কাঁধে কাঁধ
মিলিয়ে দাঁড়ানোর আদেশ করতেন, তেমন তিনি ইক্বামতের পর
স্বয়ং লাইনের দিকে মুখ করে বরাবর হওয়ার আদেশ করতেন, অনেক
সময় লাইনের শেষে গিয়ে তাদের বরাবর করতেন। [বুখারী, আযান
অধ্যায়, নং ৭১৯, সহীহ ইবনু খুযায়মা নং ১৫৫১-১৫৫২]
৫-বিশেষ শব্দের মাধ্যমে বিভিন্ন নামাযের নিয়ত পড়াঃ
আরবী নিয়ত শব্দটির অর্থ, ইচ্ছা করা, মনস্থ করা। নিয়তের স্থান
অন্তর। মনে মনে মানুষ যা ইচ্ছা করে তাই তার নিয়ত।
তা সশব্দে নামায শুরু করার পূর্বে পড়া বা নিরবে বলা উভয়ই
একটি ভুল এবং তা দ্বীনের বিধান মনে করে করা বিদআত। এমন নিয়ত
করতে গিয়ে অনেকে ইমামের
পরে পরে তাকবীরে তাহরীমা না দিয়ে অনেকটা দেরীতে দেয়,
যা সুন্নার পরিপন্থী। আর অনেকে বিড় বিড় করে পড়ার
কারণে তার পাশের নামাযীকে কষ্ট দেয়। নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকবীরে তাহরীমার মাধ্যমে নামায শুরু
করতেন এবং অন্যকে তা দ্বারা শুরু করার আদেশ করতেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
নামাযে ভুলকারীকে শিক্ষা দেনঃ “যখন নামাযে দাঁড়াবে,
পূর্ণরূপে অযু করে নিবে, অতঃপর কিবলামুখী হবে, তারপর
তাকবীর দিবে, অতঃপর কুরআনের সহজতর যা তোমার মুখস্ত
আছে তা পড়বে”।[বুখারী, নং৭৯৩]
৬-তাকবীর বলার সময় আল্লাহু আকবার এর (বা–) টেনে পড়াঃ
আযান হোক বা নামায, এই সময় আল্লাহু আক্ বার বলার সময় (বা) টান
দিয়ে বলা নিষেধ। কারণ (বা) এ মাদ্দ দিলে অর্থ পাল্টে যায়।
বিনা মাদ্দে (আকবার) অর্থ সবচেয়ে বড় আর মাদ্দ সহকারে আকবা—
র অর্থ, তবলা। ইমাম আল্লাহু আক্ বা—র দীর্ঘ
করে বললে আরো একটি সমস্যা হয়ে থাকে, তা হলঃ ইমামের
তাকবীর শেষ হওয়ার পূর্বে অনেক মুক্তাদীর তাকবীর শেষ
হয়ে যাওয়া; কারণ মুক্তাদী তত দীর্ঘ করে বলে না। আর ইমামের
পূর্বে তাকবীর দেওয়া নিষেধ। বিষয়টি যদি তাকবীরে তাহরীমার
ক্ষেত্রে হয়, তাহলে নামায বাতিল হওয়ারও আশংকা থাকে।
[ইরশাদাত আন বা’যিল মুখালাফাত, সাদহান,পৃঃ ৯৬]
আবার কিছু ইমামকে দেখা যায় তারা বিশেষ বিশেষ স্থানের
তাকবীর টেনে বলেন আর বাকিগুলো সাধারণ ভাবে। যেমন
তাশাহ্হুদে বসার সময় কিংবা রুকূ থেকে উঠার সময়
কিংবা রুকূতে যাওয়ার সময়ের তাকবীর দীর্ঘ করেন আর
বাকিগুলো স্বাভাবিক; অথচ এমন পার্থক্য করার কোনো দলীল
নেই। তাই সব তাকবীর সাধারণতঃ বরাবর হবে এটাই সঠিক নিয়ম।
৭-তাকবীরে তাহরীমার সময় কান স্পর্শ করা এবং হাতের তালু
চিপের দিকে রাখাঃ
অনেক মুসাল্লীকে দেখা যায়, তারা নামায শুরু করার সময়
কানের লতি স্পর্শ করে; অথচ নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম কান স্পর্শ করতেন না বরং তাঁর হাতের
আঙ্গুল অনেক সময় বাহু বরার উঠাতেন আর অনেক সময় কান বরাবর।
যারা কানের লতি স্পর্শ করে, তারা আরো একটি ভুল করে তা হল,
কানের লতি ছোয়াঁর কারণে তাদের হাতের তালু কানের
দিকে থাকে; অথচ এই সময় নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাতের তালু কিবলামুখী থাকতো। [আবু
দাঊদ (৭৭৫) তিরমিযী (২৪২) মুসলিম (৩৯৮)]
৮-এমন বিশ্বাস রাখা যে, মুয়াজ্জিন ব্যতীত অন্য কেউ ইকামত
দিতে পারে না:
এ সম্পর্কে বর্ণিত হাদীস “যে আযান দিবে সেই ইক্বামত দিবে”
খুবই যয়ীফ। [সিলসিলা যয়ীফা নং (৩৫)] নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মুয়াজ্জিনকে ইক্বামত দেয়ার আদেশ
করলে সে ইক্বামত দিত। তাই ইমাম মুয়াজ্জিনকে যখন ইক্বামত
দেওয়ার আদেশ করবেন, তখন সে ইক্বামত দিবে। আর মুয়াজ্জিনের
অনুপস্থিতিতে ইমাম যাকে ইক্বামত দিতে বলবেন, সেই ইক্বামত
দিতে পারে।
৯-নামাযে কিরাআত, দুআ ও যিকর পড়ার সময়
জিহব্বা না নাড়িয়ে মনে মনে পড়াঃ
অনেকে একাকি কিংবা ইমামের পিছনে নামায পড়ার সময়, কিরাআত,
তাকবীর, রুকু-সাজদা সহ অন্যান্য স্থানের দুআ সমূহ
মনে মনে পড়ে, যেন নামায কিছু কাজের নাম মুখে কিছু পড়ার নয়।
জিহব্বা ও ঠোঁট না নাড়িয়ে মনে মনে কিছু বলা বা করার
ইচ্ছা করা, সেটা অবৈধ কিছু হলেও আল্লাহ তাআলা তা পাকড়াও
করবেন না। নবী (সাঃ) বলেনঃ “আল্লাহ তাআ’লা আমার
উম্মতকে ক্ষমা করেছেন, যা তাদের অন্তর বলে”। [হাদীস সহীহ,
দেখুন ইরওয়াউল গালীল নং ২০৬২] তাই মনের কথা শরীয়ার
দৃষ্টিতে অবিবেচ্য। আর এমন হলে নামাযে মনে মনে সূরা, দুআ ও
যিকর পাঠকারীর আমলও অধর্তব্য।
১০-ইমামের পিছনে মুক্তাদীদের তাকবীর, রাব্বানা ওয়ালাকাল্
হাম্দ সহ ইত্যাদি দুআ-যিকর সশব্দে পড়াঃ
ইমামের পিছনে মুক্তাদীদের অবস্থা হচ্ছে সিররী অবস্থা।
অর্থাৎ সূরা ফাতিহা সহ ইত্যাদি দুআ-যিকর নিরবে পাঠ করা। এসব
সশব্দে পাঠ করা যেমন ভুল তেমন এমন করলে ইমাম সহ অন্যান্য
মুক্তাদীদের খুশু-খুযুতে ব্যাঘাত ঘটে ও
জটিলতা সৃষ্টি হয়। এ ক্ষেত্রে কোনো সাহাবীর নির্দিষ্ট
স্থানে সরবে কিছু পড়া একটি খাস বা নির্দিষ্ট ঘটনা, তা সাধারণ
ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
১১-নামাযে চোখ বন্ধ রাখা কিংবা আকাশের দিকে দেখাঃ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাযের সময় তাঁর
চক্ষু বন্ধ রাখতেন না; বরং তাশাহ্হুদের সময় তাঁর
দৃষ্টি শাহাদাত (তর্জনী) অঙ্গুলির
দিকে থাকতো এবং দন্ডায়মান অবস্থায় সাজদার স্থানে থাকতো।
অনুরূপ তিনি নামাযের সময় আকাশের দিকে তাকাতে কঠোর
ভাবে নিষেধ করতেন। অনেকে নামাযে একাগ্রতা সৃষ্টির জন্য
এমন করে থাকে, যা সুন্নত বিরোধী। [আল্ কাউলুল মুবীন
ফী আখত্বাইল মুসাল্লীন, পৃঃ ১১০-১১২]
১২-ঝটকা দিয়ে রুকূতে যাওয়া এবং ঝটকা দিয়ে রুকূ
থেকে উঠাঃ
অনেকে রুকূ করার সময় শরীরে একটা ঝটকা দিয়ে দ্রুত
গতিতে রুকূতে যায় এবং এই সময় রুকূ অবস্থায় তার শরীরে কম্পন
থাকে। দুই তিনবার কম্পনের পর তার শরীর স্বাভাবিক অবস্থায়
ফিরে আসে। অনুরূপ সাজদা ও সাজদা থেকে উঠার সময় এবং সালাম
ফিরানোর সময় অনেককে এমন করতে দেখা যায়,
যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামাযের
পদ্ধতির বিপরীত। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
রুকূ সাজদায় যাওয়ার সময় স্বাভাবিক ভাবে যেতেন, না দ্রুত
যেতেন আর না অতি ধীর গতিতে।
১৩-সূরা ফাতিহা কিংবা সূরা ফাতিহার পর অন্য সূরা পাঠ শেষ
করার পূর্বেই হাত ছেড়ে দেওয়া। এসময় সূরা-কিরাআত শেষ হওয়ার
পর হাত ছাড়া উচিৎ।
১৪-ইমাম যখন ‘সামিআল্লাহুলিমান হামিদাহ’ বলেন, তখন
মুক্তাদীদের অনেকে শুধু ‘রব্বানা ওয়ালাকাল্ হামদ’
বলে থাকে; অথচ ইমাম ও মুক্তাদী উভয়কে সামিআল্লাহু…
এবং রাব্বানা ওয়া… বলা দরকার। [তামামুল্ মিন্নাহ, পৃঃ ১৯০-১৯১]
১৫-রুকূ-সাজদায় স্থীর না হওয়া অনুরূপ রুকূ-
সাজদা থেকে উঠে বরাবর হয়ে স্থীরতা অবলম্বন না করা:
মনে রাখা দরকার এদুটি নামাযের রুকন তা না করলে নামায বাতিল
হওয়ার সম্ভাবনা আছে। নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামায ভুলকারীকে রুকু-সাজদায় স্থীর
হতে বলেন এবং উভয় স্থান থেকে উঠেও স্থীর হতে বলেন
এবং তার পরে নামাযের পরের কাজটি করতে আদেশ করেন। [বুখারী,
নং৭৫৭ মুসলিম নং ৩৯৭]
১৬-সাজদার সময় সাতটি অঙ্গ মাটিতে না রাখাঃ
সাজদার সাতটি অঙ্গ হচ্ছে যথাক্রমে কপাল সহ নাক, দুই হাত, দুই
হাঁটু এবং দুই পার সামনের পাতা। অনেকে কপাল
মাটিতে রাখে কিন্তু নাক রাখে না। আর অনেকে সাজদার সময় দুই
পা মাটি থেকে উপরে রাখে কিংবা এক পা আর এক পার উপর রাখে,
যা বড় ভুল। এই সময় উপরোক্ত সাতটি অঙ্গের মাধ্যমে সাজদা হবে।
নবী (সাঃ) বলেনঃ “আমাকে আদেশ করা হয়েছে, যেন
আমি সাতটি অঙ্গের উপর সাজদা করি”। [মুসলিম নং ৪৯১,
তিরমিযী নং ২৭২] অন্য বর্ণনায় সাতটি হাড়ের কথা এসেছে।
১৭-সাজদার পদ্ধতিতে ভুল করাঃ
সাজদা যেমন সাতটি অঙ্গের উপর হবে, তেমন সাজদার সময় দুই ঊরু
থেকে পেট পৃথক থাকবে, দুই বাহু পার্শ্বদেশ থেকে যথাসম্ভব
দূরে থাকবে, হাতের জঙ্ঘা (হাতের কুনুই
থেকে কব্জি পর্যন্ত অংশ)
মাটি থেকে উপরে থাকবে মাটিতে বিছানো থাকবে না এবং দুই
হাতের তালু দুই কাঁধ বা দুই কান বরাবর থাকবে। দুই পায়ের পাতার
সামনের ভিতরের অংশ মাটিতে ঠেকে থাকবে,
গোড়ালি সম্মিলিত ভাবে উপরে থাকবে এবং আঙ্গুলসমূহ
কিবলামুখী থাকবে। [বিস্তারিত দেখুন,আল্ কাউলুল মুবীন,
ফী আখত্বাইল মুস্বাল্লীন, মাশহূর হাসান, নং১৩৭-১৩৮]
১৮-অসুস্থতা কিংবা অন্য
কারণে নামাযী মাটিতে সাজদা করতে অক্ষম হলে, বালিশ, টেবিল
বা উঁচু কিছুতে সাজদা করাঃ
নামাযী কোনো কারণে যদি সরাসরি মাটিতে কপাল
ঠেকিয়ে সাজদা করতে না পারে, তাহলে সে কোনো উঁচু যিনিস
যেমন বালিশ, কাঠ, টেবিল কিংবা অন্য কিছুতে সাজদা করবে না;
বরং যতটা পারবে সাজদার জন্য ঝুকবে এবং ইশারায় সাজদা করবে।
আর রুকূ অপেক্ষা সাজদায় বেশী ঝুকবে। [ত্বাবারানী, সূত্র
সহীহ, দেখুন সিলসিলা সহীহা নং (৩২৩)]
১৯-তাওয়াররুক ও ইফতিরাশে ভুল করা:
ইফতিরাশ হল, দুই রাকাআত বিশিষ্ট নামাযে তাশাহ্হুদে বসার সময়
ডান পা খাড়া রাখা এবং বাম পায়ের উপর বসা। আর তাওয়াররুক
হচ্ছে তিন বা চার রাকাআত বিশিষ্ট নামাযের শেষ বৈঠকে ডান
পা খাড়া রেখে বাম পা ডান পায়ের জঙ্ঘার মাঝ দিয়ে বের
করে দিয়ে নিতম্বের ভরে বসা। এই আমল অনেকে করেই না। আর
অনেকে প্রথম তাশাহ্হুদে কিংবা দুই রাকাআত বিশিষ্ট
নামাযের শেষ তাশাহ্হুদে তাওয়াররুক করে; অথচ এটা তিন বা চার
রাকাআত বিশিষ্ট নামাযের শেষ বৈঠকে হবে। [হাদীস আবু হুমাইদ,
বুখারী, নং (৮২৮)]
২০-লম্বা স্বরে সালাম ফিরানোঃ
সালাম ফিরানোর সময় স্বাভাবিক নিয়মে সালাম
ফিরানো সুন্নাত। এই সময় অনেকে সালামের কোনো শব্দ যেমন
(আস্ সালা–মু) বা (বারাকা–তুহূ) দীর্ঘ স্বরে টেনে পড়ে। এই
রকম টেনে বলার কারণে অনেক সময় মুক্তাদী ইমামের
পূর্বে সালাম ফিরিয়ে দেয় নচেৎ ইমামের পূর্বে তার সালাম
উচ্চারণ সমাপ্ত হয়ে যায়, যা অবশ্যই সুন্নাহ বিরোধী কাজ,
যেটা ইমামের দীর্ঘ স্বরে সালাম ফিরানোর কারণে হয়ে থাকে।
২১-সালামের পর মুসাফাহা করাঃ
অনেকে ফরয নামাযের সালামের পর তার ডান-বাম পাশের মুসল্লীর
সাথে মুসাফাহ করে, যা একটি নতুন আমল। নবী করীম
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর সাহাবাগণ
থেকে নামাযের সালাম শেষে মুসাফাহা করা প্রমাণিত নয়।
অনেকে আবার বিশেষ করে ফজর ও আসর নামাযান্তে এমন
করে থাকে। উল্লেখ্য যে, দূর থেকে আগত ব্যক্তির জন্য
এটা সুন্নাহ যে, সে মুসলিম ভাইর সাথে সালামের পর
মুসাফাহা করবে। তাই এমন ব্যক্তি হলে সে পাশের নামাযীর
সাথে মুসাফাহা করতে পারে; নচেৎ না।[আল্ ইরশাদাত আন্ বা’যিল
মুখালাফাত/১২০] এই মুসাফাহা করতে গিয়ে অনেকে নামাযীর
যিকর ও তাসবীহ কাজে ব্যাঘাত ঘটায়।
২২-আঙ্গুলের গিরা ছেড়ে তসবীহ দানায় তাসবীহ পাঠঃ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ডান হাতে তাসবীহ
পাঠ করতেন। [আবু দাঊদ নং (১৫০২) তিরমিযী নং (৩৪৮৪)]
এবং তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আঙ্গুলের
গিরায় তাসবীহ পাঠ করার আদেশ দেন
এবং বলেনঃ সেগুলোকে কথা বলানো হবে।”। [আবু দাঊদ
নং (১৫০১) হাদীসটিকে হাকেম ও যাহাবী সহীহ বলেছেন, নভবী ও
আসক্বালানী হাসান বলেছেন এবং আলবানী যয়ীফ বলেছেন] শাইখ
আলবানী (রহ) বলেনঃ“ তসবীহ দানায় তাসবীহ পড়ার মন্দসমূহের
মধ্যে একটিই যথেষ্ট যে, এই নিয়ম
আঙ্গুলে গুণে গুণে তাসবীহ পড়ার সুন্নতকে শেষ
করে দিয়েছে কিংবা প্রায় শেষ করে দিয়েছে”।
[সিলসিলা যয়ীফা,১/১১৭]
২৩-ইমামের সাথে একজন মুক্তাদী থাকলে ইমামের একটু
আগে অবস্থান করাঃ
এ সম্পর্কে সহীহ নিয়ম হচ্ছে, ইমাম ও মুক্তাদী উভয়ে এক অপরের
বরাবর দাঁড়াবে। ইমাম একটু আগে অবস্থান করবে না আর
না মুক্তাদী ইমামের একটু পিছনে দাঁড়াবে। ইমাম বুখারী এ
সম্পর্কে এক অনুচ্ছেদ রচনা করেনঃ (অনুচ্ছেদ, দুই জন
হলে মুক্তাদী ইমামের ডান পাশে তার বরাবর দাঁড়াবে) [বুখারী,
আযান অধ্যায়, অনুচ্ছেদ নং ৫৭, হাদীস নং ৬৯৭] অতঃপর
ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) এর ঐ ঘটনা উল্লেখ করেন, যাতে তিনি তার
খালা উম্মুল মুমেনীন মায়মূনা (রাযিঃ) এর নিকট রাত অতিবাহিত
করেন এবং রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর
সাথে কিয়মুল লাইল আদায় করেন। মুসনাদ আহমদে বিষয়টি আরোও
স্পষ্ট এসেছে। [দেখুন, সিলসিলা সহীহা, নং (৬০৬)]
২৪-নফল স্বালাত আদায়কারীর সাথে কেউ ফরয আদায় করার ইচ্ছায়
তার সাথে শরীক হলে, নফল আদায়কারীর তাকে হাত
দ্বারা বা ইশারা-ইঙ্গিতে সরিয়ে দেওয়া। এটি ভুল।
২৫-নামায অবস্থায় হাই আসলে তা অপসারণের চেষ্টা না করাঃ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
“যদি তোমাদের কেউ নামাযে হাই তোলে, তাহলে সে যেন
যথা সম্ভব তা চেপে রাখে; কারণ শয়তান প্রবেশ করে”। [আহমদ,
মুসলিম নং২৯৯৫]
চেপে রাখার নিয়ম হবে, সে যেন তার হাত মুখে রাখে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
“যদি তোমাদের কেউ হাই তোলে, তাহলে সে যেন তার হাত
মুখে দেয়”। [মুসলিম, নং২৯৯৫]
২৬-ফরয নামাযান্তে ইমাম ও মুক্তাদীদের সম্মিলিতভাবে দুআ
করা।
এছাড়াও ইমাম ও মুক্তাদীদের অনেক ভুল-
ত্রুটি নামাযে ঘটে থাকে। কিন্তু এ স্থানে সব ভুলের
আলোচনা সম্ভব নয়। তাই এই বিষয়ের এখানেই সমাপ্তি ঘটানো হল।
তাছাড়া আমাদের ধারাবাহিক পর্বে বিভিন্ন
স্থানে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরো অনেক ভুল-ভ্রান্তির
আলোচনা হয়েছে। আল্লাহর কাছে দুআ করি তিনি যেন আমাদের
সঠিক সুন্নাহ অনুযায়ী নামায আদায় করার তাওফীক দেন
এবং তা কবূল করেন। আমীন।
ফরয নামাযান্তে ইমাম ও মুক্তাদীদের হাত তুলে সম্মিলিত
ভাবে দুয়া করা
আল্ হামদু লিল্লাহি রাব্বিল্ আলামীন, ওয়াস্ স্বালাতু
ওয়াস্ সালামু আলা রাসূলিহিল কারীম। আম্মা বাদঃ
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিষয়টি বহু প্রাচীন এবং এ
সম্পর্কে বিগত উলামাগণ যথেষ্ট লেখা-লেখি ও করেছেন।
কিন্তু যেহেতু বিষয়টির সম্পর্ক আমাদের আলোচ্য বিষয় ইমাম ও
ইমামতির সাথে রয়েছে তাই কিছু আলোচনা করা সঙ্গত মনে করছি।
ওয়া মা তাওফীকী ইল্লা বিল্লাহ।
১-সমাজের সাধারণ লোকদের এই দুয়া সম্পর্কে ধারণাঃ
যেই সমাজে এই দুয়ার প্রথা রয়েছে সেখানকার লোকেরা এই
দুয়া সম্পর্কে যে ধারণা ও বিশ্বাস রাখে তার সামান্য
বর্ণনা নিম্নে তুলে ধরলাম।
যেখানে এই দুয়ার প্রথা চালু
আসে সেখানে কোনো কারণে কাউকে যদি ইমামতি করতে হয়
এবং ইমাম সালাম শেষে দুয়া না শুরু করে, তাহলে পিছনের
মুসল্লারা দুয়ার অপেক্ষায় থাকে। অনেক সময় মুক্তাদীদের
কেউ আদেশ কিংবা আবেদনের সুরে বলেই দেয়, দুয়া করে দিন।
ভাবটা এমন যে, এই দুয়া তারা নিজে করতে পারে না ইমামের
নেতৃত্বেই করতে হবে এবং এই কাজ ব্যতীত যেন তাদের নামায
শেষ হয় নি, তাই তারা সমাপ্ত করার উদ্দেশ্যে অপেক্ষায়
রয়েছে।
অনেক স্থানে কোনো ইমাম নিয়মিত দুয়া না করার
কারণে ইমামতি হারায়। অর্থাৎ আপনি এই সম্মিলিত
দুয়াকারী হলেই তাদের ইমাম হতে পারেন; নচেৎ নয়। তাদের এই
আচরণে এটাই প্রকাশ পায় যে, তারা এই কাজকে খুবই গুরুত্ব দেয়
এবং তা না করলে তার পিছনে নামায আদায় করে না।
অতঃপর দুয়া না করে কোনো ইমাম যদি সুন্নত নামায শুরু
করে দেয় কিংবা মসজিদ থেকে বেরিয়ে যায় তাহলে শুরু হয়
মন্তব্যের পর মন্তব্য। এটা কেমন ইমাম নামাযের পর মুনাজাতই
করলো না! একে কে ইমাম বানালো? দুয়া করা কি অপরাধ?
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি দুয়া করতেন না?
আল্লাহ তাআলা কি কুরআনে দুয়া করতে বলেন নি?
দুয়া করলে ক্ষতিটা কি? কেউ আবার উপমা পেশ করে বলেঃ এই
ইমাম ভাত খাওয়ালো কিন্তু পানি খাওয়ালো না।
ইত্যাদি মন্তব্য যার অনেকেটা অবান্তর ও বিরক্তকরও বটে।
কোথাও আবার বাহ্যত সম্মিলিত দুয়ার প্রথা নেই কিন্তু
কৌশলে সেই প্রথা জিইয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। তাই কেউ
ফরমাইশ করে বলেঃ অমুক সমস্যা রয়েছে, তমুক অসুস্থ, কিছু
না পেলে সবসময়ের সমস্যা উল্লেখ করে বলেঃ বর্তমান
বিশ্বে মুসলিমদের অবস্থা শোচনীয় তাই দুয়া করে দিন। কেউ
যেন তাদের শিক্ষা দিয়েছে যে এমনি এমনি এই রকম দুয়া ঠিক নয়
কিন্তু ফরমাইশী দুয়া (আবেদনের দুয়া) ঠিক আছে।
যাই হোক উপরোক্ত সকলের কথা ও ভাবে এটা স্পষ্ট হয় যে,
তারা এই দুয়ার একটি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
অনেকে এটাকে নামাযের একটি অংশও মনে করে থাকে,
তা না করলে নামাযের ঘাটতি মনে করে। কম পক্ষে বলতে পারেন,
তারা এমন করাকে ভাল মনে করে।
এখন প্রশ্ন হল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি এমন
করতেন; অথচ তিনি নামায ফরয হওয়ার পর সারা জীবন ইমামতি করেছেন?
এমন করার প্রথা কোনো সাহাবী কি বর্ণনা করেছেন; অথচ
তারা বহু সংখ্যায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর
অনুকরণে তাঁর পিছনে নামায আদায় করেছেন? এমন একটি ইবাদত
যা দিন-রাতে পাঁচবার আদায় করা হয়, তাতে এমন দুয়ার নিয়ম
থাকলে তাঁরা কি বর্ণনা করতেন না? আর যদি এই নিয়মেই না থাকে,
তাহলে আমাদের এমন করা দ্বীনে নতুল আমল সৃষ্টি করা নয় কি?
২-সালাম শেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
যা করতেনঃ
মহান আল্লাহ বলেনঃ (যখন তোমরা নামায আদায় করে নিবে, তখন
দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে আল্লাহর যিকর করবে) [সূরা নিসা/১০৩]
অনুরূপ মহান আল্লাহ গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত শেষে তাঁর যিকর
করার আদেশ করেন। যেমন রামাযানের সিয়াম
শেষে [সূরা বাকারাহ/১৮৫] এবং হজ্জ সম্পাদন শেষে।
[বাকারাহ/২০০]
তাই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামায
শেষে বেশী বেশী যিকর-আযকার করতেন, যার বিস্তারিত
বর্ণনা হাদীসের গ্রন্থসমূহে এবং সীরাতে বর্ণিত হয়েছে।
দ্বীনের সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম বিষয়ের বিশিষ্ট গবেষক বাকর আবু
যাইদ (রাহেঃ) বলেনঃ ‘ফরয নামাযের সালামের পর সুন্নত হচ্ছে,
কতিপয় যিকর সামান্য সশব্দে করা সমূহ যিকর সশব্দে নয়, দুয়া করা,
কুরআনুল কারীম থেকে যা বর্ণিত তা পাঠ করা… এবং সুন্নত
হচ্ছে প্রত্যেক মুসল্লীর নিজে নিজে এসব করা’।
[তাস্বহীহুদ্দুআ/৪৩৮] অতঃপর তিনি সহীহ বর্ণনার
আলোকে সেগুলি তুলে ধরেন।
উল্লেখ্য যে, যিকর এমন শব্দ ও
বাক্যকে বলে যা দ্বারা আল্লাহর মহত্ব, বড়ত্ব এবং তাঁর
গুণগান করা হয়। আর দুয়া এমন শব্দ বা বাক্যকে বলা হয়, যার
মাধ্যমে আল্লাহকে ডাকা হয়, তাঁর নিকট প্রার্থনা করা হয়, তাঁর
কাছে আবেদন করা হয়। কোনো কোনো সময় দুটি এক অপরের অর্থেও
ব্যবহৃত হয়।
ক-নামায শেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
থেকে প্রমাণিত যিকরের বর্ণনাঃ (সংক্ষিপ্তাকারে)
তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সালাম ফিরানোর পর
তিন বার ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ বলতেন। অতঃপর বলতেনঃ “
আল্লাহুম্মা আনতাস্ সালাম ওয়া মিনকাস্ সালাম,
তাবারাকতা ইয়া যাল্ জালালি ওয়াল্ ইকরাম”। [সহীহ মুসলিম,
মাসাজিদ অধ্যায় নং ৫৯১] তিনি সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই সময় কিবলামুখী হয়ে প্রায় ততক্ষণ
থাকতেন যতক্ষণ উপরোক্ত যিকর বলতে সময় লাগে। তার পর
মুসাল্লীদের দিকে মুখ করে ফিরে বসতেন। [যাদুল্
মাআ’দ,১/২৯৫]
সহীহাইনের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামায শেষ করার পর
বলতেনঃ “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্ দাহু লা শারীকা লাহু,
লাহুল্ মুলকু ওয়ালাহুল্ হামদু ওহুআ আলা কুল্লি শায়ইন্
ক্বাদীর। আল্লাহুম্মা লা মানিআ লিমা আ’ত্বায়তা ওয়া লা-
মুত্বিয়া লিমা মানা’তা, ওয়ালা ইয়ানফাউ যাল্ জাদ্দি মিনকাল্
জাদ্দু”। [বুখারী, নামাযের নিয়ম অধ্যায়, নং ৮৪৪/মুসলিম, নং ৫৯৩]
আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর (রাযিঃ) বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক নামাযের শেষে যখন সালাম
ফিরাতেন, তখন এই বাক্যগুলি বলতেনঃ “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু
ওয়াহ্দাহু লা শারীকা লাহু, লাহুল্ মুলকু, ওয়া লাহুল্ হামদু
ওয়া হুআ আলা কুল্লি শায়ইন ক্বাদীর।
লা হাওলা ওয়ালা কুওআতা ইল্লা বিল্লাহ।
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ … ওয়া লাও কারিহাল কাফিরূন” পর্যন্ত।
[সহী মুসলিম, মাসাজিদ অধ্যায়, নং ৫৯৪]
অতঃপর তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৩৩ বার
সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আল্ হামদুলিল্লাহ, ৩৩ বার আল্লাহু
আকবার এবং ১০০ পূরণে বলতেনঃ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু
ওয়াহ্দাহূ, লা শারীকা লাহু, লাহুল মুলকু, ওয়ালাহুল্ হামদু,
ওয়া হুআ আলা কুল্লি শায়ইন ক্বাদীর। [মুসলিম, মাসাজিদ অধ্যায়,
নং ৫৯৭] এই তাসবীহ পাঠের আরো ৫টি পদ্ধতি প্রমাণিত। [দেখুন,
তাস্বহীহুদ দুয়া পৃঃ ৪৩২ এবং যাদুল মাআদ, ১/২৯৮-২৯৯]
খ-নামায শেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
কর্তৃক কুরআনের কিছু অংশ ও সূরা পড়ার বর্ণনাঃ
আয়াতুল্ কুরসী পাঠ করাঃ নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “যে ব্যক্তি প্রত্যেক নামাযের
পশ্চাদে আয়াতুল্ কুরসী পাঠ করবে, তার জান্নাতে প্রবেশ
করা থেকে মৃত্যু ব্যতীত কোনো কিছু বাধা হবে না” [নাসাঈ,
নং ৯৯২৮, তারগীব ও তারহীব, ২/২৬১, ইবনু হিব্বান]
সূরা ইখলাস, সুরা ফালাক্ব এবং সূরা নাস পাঠ করাঃ উক্ববা বিন
আমের থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমাকে রাসুল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশ করেছেন যেন
আমি প্রত্যেক নামাযের পশ্চাদে মুআব্বিযাত (আশ্রয় চাওয়ার
সূরাসমুহ যথাক্রমে ইখলাস, ফালাক্ব ও নাস) পাঠ করি। [মুসনাদ
আহমদ ৪/২১১, আবু দাঊদ নং (১৫২৩), ইবনু হিব্বান (২৩৪৭),
তিরমিযী (২৯০৫) তবে তাতে কেবল সূরা নাস ও ফালাক উল্লেখ
হয়েছে]
গ-নামাযান্তে সালামের পর নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে দুয়ার প্রমাণঃ
আবু উমামাহ থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে জিজ্ঞাসা করা হয়ঃ কোন্
দুয়া বেশী কবূল হয়? তিনি সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “রাতের শেষাংশে এবং ফরয
নামাযের পশ্চাদে।”। [তিরমিযী, অধ্যায় দাআওয়াত, অনুচ্ছেদ
নং ৭৯, হাদীস নং (৩৪৯৯] হাদীসটিকে স্বয়ং ইমাম তিরমিযী হাসান
বলেছেন এবং শাইখ আলবানীও হাসান বলেছেন]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুয়ায (রাযিঃ)
কে অসিয়ত করেন, সে যেন প্রত্যেক নামাযের
পশ্চাদে বলেঃ “আল্লাহুম্মা আইন্নী আলা যিকরিকা ওয়া
শুকরিকা ওয়া হুসনি ইবাদাতিকা”। অর্থঃ হে আল্লাহ! আপনার
যিকর, আপনার কৃতজ্ঞতা এবং আপনার উত্তম ইবাদত
করতে আমাকে সাহায্য করুন। [আবু দাঊদ, স্বালাত অধ্যায়,
ইস্তিগফার অনুচ্ছেদ নং (১৫২২), নাসাঈ, সূত্র সহীহ, ইবনু
হিব্বান (২৩৪৫)] উল্লেখ্য যে, মুআয (রাযিঃ) কে অসিয়তকৃত
বাক্যগুলি দুয়া’র বাক্য।
আবু দাঊদ সহীহ সূত্রে আলী বিন আবী ত্বালিব (রাযিঃ)
হতে বর্ণনা করেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
যখন নামাযে সালাম ফিরাতেন, তখন বলতেনঃ “আল্লাহুম্মাগ্
ফির্ লী মা কাদ্দাম্তু ওয়া মা আখ্খারতু, ওয়া মা আসরারতু,
ওয়া মা আ’লানতু, ওয়া মা আসরাফতু, ওয়া মা আন্তা আ’লামু
বিহী মিন্নী, আন্তাল্ মুকাদ্দিমু ওয়া আন্তাল্ মুআখ্
খিরু, লা ইলাহা ইল্লা আন্তা”। [আবু দাঊদ, স্বালাত অধ্যায়,
অনুচ্ছেদঃ সালাম ফিরানোর পর মানুষ যা বলবে, সূত্র সহীহ,
তিরমিযী দাআওয়াত নং (৩৪১৯)] অর্থঃ “হে আল্লাহ! আমি যে সব
গুনাহ অতীতে করেছি, পরে করেছি, গোপনে করেছি,
প্রকাশ্যে করেছি, সীমালঙ্ঘনে করেছি, তা তুমি মাফ করে দাও।
মাফ করে দাও আমার সেই সব গুনাহ যা তুমি আমার
অপেক্ষা বেশী জানো, তুমি যা চাও আগে কর এবং যা চাও
পিছে কর, তুমি ছাড়া উপসনাযোগ্য কোনো সত্য মা’বূদ নেই”।
ইবনুল ক্বায়্যিম (রাহেঃ) উপরোক্ত দুয়াটির সম্পর্কে সহীহ
মুসলিমের বরাতে বলেনঃ মুসলিমের বর্ণনানুযায়ী দুটি শব্দ
এসেছে। এক, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
এটা তাশাহ্হূদ ও সালামের মাঝে বলতেন। দুই, সালামের পর
বলতেন। অতঃপর তিনি উভয়ের সমন্বয় করতঃ বলেনঃ মনে হয়,
তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উভয় স্থানে বলতেন।
[যাদুল মাআদ,১/২৯৭]
ইমাম বুখারী কিতাবুত্ দাআওয়াতে, নামাযের
পরে দুয়া করা শিরোনামে অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন
এবং বুখারীর ভাষ্যকার ইবনু হাজার এই অনুচ্ছেদ
সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেছেনঃ এই অনুচ্ছেদ তাদের খণ্ডন
করে, যারা মনে করে যে, নামাযের পর দুয়া করা বৈধ নয়। [ফাতহুল
বারী,১১/১৫৯]
উপরোক্ত দলীল-প্রমাণের আলোকে আমরা এ
সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, ফরয নামাযে সালামের পর
দুয়া করা বৈধ। কিন্তু তা হাত তুলে করতে হবে না সম্মিলিত
ভাবে করতে হবে, এর প্রমাণ উপরোক্ত দলীল সমূহে উল্লেখ হয়
নি।
উল্লেখ্য যে, ইমাম ইবনু তাইমিয়া হাদীসে উল্লেখিত শব্দ
(দুবুরুস্ স্বালাত) নামাযের
পশ্চাদে দুয়া করা বলতে নামাযের শেষাংশে সালামের
পূর্বে তাশাহ্হুদে দুয়া করা মনে করেছেন। অর্থাৎ ঐসকল
দুয়া নামাযের ভিতরে হবে নামাযের পরে নয়। তাঁর মন্তব্য হল,
দুবুর (পশ্চাদ) শব্দটি কবুল (সম্মুখ) এর বিপরীত। আর
কোনো কিছুর দুবুর বলতে সেই বস্তুর পশ্চাদ বুঝায়, যা তার
সাথে মিলিত থাকে তা থেকে পৃথক থাকে না। যেমন মানুষের
পশ্চাদ বা পাছা, যা মানুষের সাথেই মিলিত, মানুষ থেকে পৃথক
নয়। তাই নামাযের পশ্চাদে দুয়া করা অর্থ হবে নামাযের
শেষাংশে দুয়া করা, নামায শেষ করার পর নয়। কারণ সালামের পর
দুয়া করলে দুয়া নামাযের বাইরে হয়, নামাযের পশ্চাদে হয় না।
কিন্তু তাঁর এই মত সরাসরি গ্রহণীয় নয় কারণ; দুবুর (পশ্চাদ)
শব্দটির অর্থ যেমন সেই বিষয়ের পাছা বুঝায়, যা তার সাথে মিলিত
থাকে, তেমন কোনো কিছুর পশ্চাদ বুঝায়, যা তা থেকে পৃথক
থাকে।
ইবনু হাজার (রহ) বলেনঃ ‘আমরা বলেছি প্রত্যেক নামাযের
(দুবুরে) পশ্চাদে যিকরের আদেশ এসেছে। আর এর অর্থ
সর্বসম্মতিক্রমে সালামের পর’। [ফাতহুল বারী,১১/১৬০] অর্থাৎ
তিনি বলতে চাচ্ছেন, নামাযের পর যে যিকর সমূহ
করতে বলা হয়েছে, তাতেও দুবুরুস্ স্বালাত (নামাযের
পশ্চাদে) শব্দটি এসেছে এবং উলামাদের
ঐক্যমতানুযায়ী এখানে দুবুর অর্থ নামাযের পর। তাই দুয়া যেমন
নামাযের শেষাংশে সালামের পূর্বে করা বৈধ তেমন নামায
শেষে সালামের পরেও করা বৈধ।
৩-কোনো সময়ে বা স্থানে দুয়ার প্রমাণ থাকলেই কি হাত
তুলে দুয়া করা বৈধ হয়?
আমরা অনেকে মনে করি যে, কোথাও দুয়ার প্রমাণ থাকলেই
মনে হয়, হাত তুলে দুয়া করতে হয় বা তুলা বৈধ হয়। দুয়ার প্রমাণ
যেহেতু আছে, তাই হাত তুলে দুয়া করলে অসুবিধা কি?
তাছাড়া সমাজে অনেকের নিকট দুয়া মানে হাত তুলে চাওয়া। হাত
না তুলেই আল্লাহর নিকট চাওয়া যায়, এটা তাদের ধারণাই নেই।
অতঃপর দুয়ার প্রমাণ পেলেই হাত তুলার পক্ষে সেই আম হাদীসও
দলীল হিসাবে পেশ করা হয় যাতে নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “ অবশ্যই তোমাদের রব্ব
লজ্জাশীল, ত্রুটি গোপনকারী, বান্দা যখন দুই হাত তুলে তার
নিকট চায়, তখন তিনি তাদের শূন্য
হাতে ফিরিয়ে দিতে লজ্জা করেন”।[তিরমিযী নং ৩৫৫৬]
আমাদের মনে রাখা উচিৎ যে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বহু স্থানে ও বিভিন্ন সময়ে দুয়ার
প্রমাণ এসেছে কিন্তু তিনি এসব ক্ষেত্রে অনেক
স্থানে হাত তুলেছেন আর অনেক স্থানে তুলেন নি। তাই তাঁর
সুন্নতের প্রতি আমল করতে হলে, আমাদের সেই সব স্থানে হাত
তুলা উচিৎ যেখানে তিনি তুলেছেন আর
যেখানে তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তুলেন
নি সেখানে না তুলাই সুন্নাহ। নিম্নে কিছু এমন সময় ও
স্থানে দুয়ার বর্ণনা দেওয়া হল, যেখানে দুয়া প্রমাণিত
কিন্তু হাত তুলা প্রমাণিত নয়ঃ
অযু শেষে দুয়া করা প্রমাণিত। নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাহাদাতাইন পাঠ করতেন
এবং বলতেনঃ “হে আল্লাহ! আমাকে তাওবা কবূলকারীদের
অন্তর্ভুক্ত করো এবং পবিত্রতা অর্জনকারীদের দলভুক্ত
করো”। [মুসলিম (২৩৪) তিরমিযী (৫৫)] কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ স্থানে দুই হাত তুলে সেই দুয়া করতেন
না।
তাওয়াফ করার সময় দুয়া করা প্রমাণিত, বিশেষ
করে রুকনে ইয়ামানী ও হাজরে আসওয়াদের
মাঝে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
বলতেনঃ (হে আমাদের রব্ব! আমাদের দুনিয়াতে কল্যাণ দাও ,
আখেরাতে কল্যাণ দাও এবং জাহান্নামের আযাব
থেকে পরিত্রান দাও)। [বাক্বারা/২০১] কিন্তু তিনি এখানে হাত
না তুলেই এই দুয়া করতেন।
জুমআর খুতবায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
থেকে দুয়া করা প্রমাণিত, কিন্তু তিনি সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাতে হাত তুলে দুয়া করতেন না।[মুসলিম,
নং ৮৭৪] তবে এই সময় ইস্তিসকার (বৃষ্টির জন্য দুয়া-প্রার্থনা)
করলে তিনি দুই হাত তুলে দুয়া করতেন। [বুখারী,
ইস্তিসক্বা অধ্যায়, নং ৯৩৩]
সফর শুরু করার সময় এবং বাহনে আরোহণকালে দুয়া করা প্রমাণিত
কিন্তু হাত তুলা প্রমাণিত নয়। তিনি সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বাহনে পা রাখতেন তখন বিসমিল্লাহ
বলতেন। আর আরোহণ করলে বলতেনঃ আল্ হামদু
লিল্লাহিল্লাযী সাখ্খারা লানা.. [তিরিমিযী নং৩৪৪৩)
আরো বলতেনঃ আল্লাহুম্মা ইন্না নাসআলুকা ফী সাফারিনা
হাযা… [মুসলিম হাজ্জ অধ্যায় নং ১৩৪২]
নামাযের মধ্যেই রুকু, সাজদা এবং তাশাহ্হুদে দুয়া প্রমাণিত
কিন্তু হাত তুলা প্রমাণিত নয়। আরো ও বহু
স্থানে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
হতে দুয়া প্রমাণিত কিন্তু হাত তুলা অপ্রমাণিত যেমন,
মসজিদে প্রবেশের সময় এবং বের হওয়ার সময় দুয়া, বাড়িতে প্রবেশ
কালে এবং বের হওয়ার সময় দুয়া, শৌচালয়ে প্রবেশ ও বের হওয়ার
সময় দুয়া, বিছানায় ঘুমাবার পূর্বে দুয়া এমন
কি স্ত্রী সহবাসের সময় দুয়া। এসব স্থানে দুয়া প্রমাণিত
কিন্তু হাত তুলা প্রমাণিত নয়।
তাই এমন মত পোষণ করা ভুল যে, ফরয সালামান্তে যেহেতু দুয়ার
প্রমাণ রয়েছে তাই হাত তুলে দুয়া করা যায় বা করা ভাল। কারণ
এটি একটি দুয়ার এমন স্থান যাতে দুয়ার প্রমাণ
তো রয়েছে কিন্তু হাত তুলার প্রমাণ নেই। যেমন উপরোক্ত
একাধিক প্রমাণে একাধিক স্থানে দুয়া করা সাব্যস্ত কিন্তু
হাত তুলা সাব্যস্ত নয়।
শাইখ সালিহ ফাউযান (হাফেঃ) বলেনঃ “অতঃপর এই যিকর সমূহ শেষ
করার পর চুপি চুপি যা ইচ্ছা দুয়া করবে। কারণ এমন ইবাদতের পর
এবং এসব মহান যিকরের পর দুয়া বেশী কবূল হওয়ার সম্ভাব্য স্থান।
অতঃপর ফরয নামায শেষে দুয়ার সময় দুই হাত তুলবে না, যেমন
অনেকে করে; কারণ এটি বিদআত। এটা কখনো কখনো নফলের পর
করা যায়”। [আল্ মুলাখ্খাস আল্ ফিক্বহী/৭৯]
৪-কোনো সময়ে বা স্থানে দুয়ার প্রমাণ থাকলেই কি সম্মিলিত
ভাবে দুয়া করা বৈধ হয়?
আমরা যখন উপরোক্ত আলোচনায় বুঝাতে সক্ষম হয়েছি যে, দুয়ার
প্রমাণ থাকলেই হাত তুলা বৈধ হয় না, তখন বর্তমান প্রসঙ্গ
বুঝতে আশা করি সহজ হবে যে, কোথাও দুয়ার প্রমাণ থাকলেই
তা সম্মিলিত ভাবে করা বৈধ হবে না; যতক্ষণে সম্মিলিত
আকারে করার প্রমাণ না পাওয়া যায়। উদাহারণ স্বরূপ জুমআর
খুত্ববায় দুয়া করা। এই সময় নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রায় সব খুত্ববাতে দুয়া করতেন কিন্তু
তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাত তুলতেন না আর
না নামাযীগণ তুলতেন। কিন্তু এই স্থানেই যখন
ইস্তিসকা তথা বৃষ্টি চাওয়ার দুয়া করলেন, তখন তিনি ও উপস্থিত
সাহাবীগণ সকলে হাত তুলে দুয়া করলেন। তাই যেখানে ও যেই
সময়ে তিনি সম্মিলিত ভাবে দুয়া করলেন, আমাদের
সেখানে সম্মিলিত আকারে করা সুন্নত আর
যেখানে তিনি একা একা করলেন সেখানে একা একাই করা সুন্নত।
একটি আরোও সুস্পষ্ট উদাহারণ উল্লেখ করা ভাল মনে করছি।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
হাজারো সাহাবীকে সাথে নিয়ে হজ্জ পালন করছেন এবং বলছেন
“তোমরা আমার কাছ থেকে হজ্জের নিয়ম জেনে নাও” [মুসলিম১২৯৭]
এই হজ্জ পালনের সময় তিনি বহু স্থানে দুয়া করেছেন।
তন্মধ্যে ৬য় স্থানে তাঁর হাত তুলার প্রমাণ এসেছে। ১-
সাফাতে ২-মারওয়াতে ৩-আরাফার দিনে সন্ধায় ৪-মুযদালিফায়
ফজরের পর ৫- তাশরীকের দিনগুলিতে ছোট জামরায় পাথর মারার পর
৬- মধ্যম জামরায় পাথর মারার পর। [তাস্বহীহুদ দুয়া/৪৩৭]
লক্ষণীয় হচ্ছে, উক্ত স্থান সমূহে দুয়ার প্রমাণ
রয়েছে এবং হাত তুলারও প্রমাণ রয়েছে কিন্তু সম্মিলিত
ভাবে দুয়ার প্রমাণ মিলে না; অথচ সাহাবাদের একটি বড়
সংখ্যা তাঁর সাথে রয়েছেন। না নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সাথে নিয়ে দুয়া করছেন আর
না সাহাবাগণ তাঁর সাথে দুয়ায় শরীক হয়ে আমীন আমীন বলছেন।
যা দ্বারা বুঝা যায় যে, দুয়া করার সময় ও স্থান এবং তাতে হাত
তুলার প্রমাণ থাকলেও সম্মিলিত রূপ দেওয়া বৈধ নয়। যেমন
আমাদের অনেক অজ্ঞ ভাই বিশেষ বিশেষ সমাবেশের সময়
বলে থাকেঃ বহু লোকের সমাগম হয়েছে আল্লাহ
কারো না কারো দুয়া কবূল করবে তাই দুয়া করে দিন বা এই ধরণের
অন্য যুক্তি। অথচ এসব বৈঠক ও সমাবেশ দুয়া কবূলের স্থান
হিসাবে প্রমাণিত নয়। আর তা না হলে হাত তুলে দুয়া করা ও
সম্মিলিত ভাবে করা দূরের প্রশ্ন।
যারা এসব ক্ষেত্রে সাধারণ সমস্যার দিকে ইঙ্গিত
করে ফরমায়েশী দুয়ার আবেদন করে হাত তুলে সম্মিলিত
দুয়া করেন, তাদের জন্যও একটি নববী সুন্নত পেশ করতে চাই। এসব
সাধারণ অবস্থা নয় বরং জিহাদ-কিতালের সময়
হয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রায় ৩১৪ জন
সাহাবীকে সাথে নিয়ে বদর প্রাঙ্গনে হাজির হয়েছেন।
শত্রুদের সংখ্যা হাজারেরও অধিক। তাদের যুদ্ধ সরঞ্জামও
অনেক বেশী। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
রাতে মহান আল্লাহর নিকট অতি কাকুতি-
মিনতি সহকারে দুয়া করেন। তিনি তার দুয়ায় বলেনঃ হে আল্লাহ!
ইসলামের এই গোষ্ঠী যদি আজ ধ্বংশ হয়ে যায়, তাহলে তোমার
জমিনে ইবাদত করার আর কেউ থাকবে না। এই দুয়ার এমনই অবস্থা ছিল
যে, তাঁর কাঁধ থেকে চাদর পড়ে যায়। এই সময় আবু বাকর (রাযিঃ)
চাদর তুলে আল্লাহর রাসূলের কাঁধ ঢেকে দেন
এবং বলেনঃ হে আল্লাহর নবী! যথেষ্ট হয়েছে, নিশ্চয় আল্লাহ
আপনার সাথে কৃত অঙ্গীকার পূরণ করবেন। [বুখারী ও মুসলিম]
বলুন তো এমন অবস্থাতেও কি নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের সাথে নিয়ে দুয়া করলেন? আর
না সাহাবাগণ পিছন থেকে এসে তাঁর সাথে দুয়ায় শরীক হলেন? এমন
কি আবু বাকর পাশে থাকা সত্ত্বেও কি তাঁর সাথে দুয়ায় শরীক
হলেন? আর না কেউ ফরমাইশ করল যে, কাল যুদ্ধ তাই একটু
দুয়া করে দিন। তাই বলছিলাম ছোট-খাট অজুহাতকে কেন্দ্র
করে সম্মিলিত দুয়ার অভ্যাসও পরোক্ষভাবে বিদআতী দুয়ারই
অন্তর্ভুক্ত।
৫-ফরয নামায শেষে দুয়ার দলীলগুলির অবস্থাঃ
যারা ফরয নামায শেষে সম্মিলিত দুয়ার পক্ষে মত ব্যক্ত করেন,
তারা কিছু দলীল পেশ করে থাকেন। কিন্তু সত্যিকারে সে সব
দলীল মূলতঃ দলীল নয়; কারণ হয় সেগুলো জাল, যয়ীফ
কিংবা সে সবের অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। নিম্নে ঐসব
প্রমাণের কয়েকটির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলঃ
ক- আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর হতে বর্ণিত, তিনি এক
ব্যক্তিকে নামায শেষ করার পূর্বে দুই হাত
তুলে দুয়া করতে দেখেন। যখন সে নামায শেষ করে, তখন
তিনি তাকে বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর দুই হাত নামায শেষ করার
পূর্বে তুলতেন না। [ত্বাবারী, মুজাম আল কাবীর, ১৩/১২৯]
কিন্তু হাদীসটি যয়ীফ কারণ; বর্ণনাকারীদের মধ্যে মুহাম্মদ
বিন আবী ইয়াহইয়া ও আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর (রাযিঃ) এর
মধ্যে সূত্র বিচ্ছিন্ন (মুনকাত্বা)। তাছাড়া ইবনু
আবী ইয়াহইয়াকে ঐক্যমতানুযায়ী প্রত্যাখ্যাত (মাতরূক)
রাবী বলা হয়েছে এবং তার থেকে বর্ণনাকারী ফুযাইল বিন
সুলাইমান নামক অপর রাবীর স্মরণশক্তি ও দুর্বল প্রকৃতির। তাই
হাদীসটি সূত্র বিচ্ছিন্নতা এবং দুর্বলতার দোষে দুষণীয়।
তাছাড়া সেই হাত তুলা নফল না ফরযান্তে হবে তাও বর্ণিত হয় নি।
আর না তাতে সম্মিলিত দুয়ার কথা আছে।
খ- ইয়াযীদ বিন আসওয়াদ আল্ আমেরী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত,
তিনি বলেনঃ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
এর সাথে ফজরের নামায আদায় করলাম। যখন তিনি সালাম ফিরালেন,
মুখ ফিরে বসলেন এবং দুই হাত তুললেন এবং দুয়া করলেন ।” [ইলাউস
সুনান, ৩/২০৭]
পর্যালোচনাঃ উপরোক্ত হাদীসের শেষাংশ আন্ডার লাইন
করা হয়েছে, “এবং দুই হাত তুললেন এবং দুয়া করলেন।” এই
বাক্যটি হাদীসের মূল গ্রন্থে নেই। হানাফী মাযহাবের
প্রসিদ্ধ বই ইলাউস্ সুনান সহ অন্য মুতাআখ্খির
বইতে বাক্যটি আছে। কিন্তু হাদীসের মূল গ্রন্থ
যা থেকে হাদীসটি সংকলন করা হয়েছে, তাতে এই বর্ধিত বাক্য
নেই। আর এই বর্ধিত বাক্য না থাকলে হাদীসটি নামাযের পর
একা বা সম্মিলিত ভাবে হাত তুলে দুয়া করার প্রমাণই
হতে পারে না। হাদীসটির মূল গ্রন্থ হচ্ছে মুসান্নাফ ইবনু
আবী শাইবা। আর তাতে দুই হাত তুললেন এবং দুয়া করলেন
বাক্যটি নেই। [বর্ধিত অংশ ছাড়াই হাদীসটি দেখুন, আবু দাঊদ,
স্বালাত অধ্যায়, অনুচ্ছেদঃ সালামের পর ইমাম ঘুরে বসবে,
নং ৬১০/মুসনাদ আহমদ ৪/১৬০-১৬১, ইবনু আবী শায়বা, ১/৩০২ ও ১৪/১৮৬]
অনেকে এটা সালাম শেষে দুয়ার গোঁড়া সমর্থকদের
কারচুপি মনে করেন, যারা নিজ মতের
সমর্থনে হাদীসে কারচুপি পর্যন্ত করেন। উপরোক্ত বর্ণনাটির
সম্পর্কে বিস্তারিত দেখুন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম কা স্বাহীহ ত্বারীকায়ে নামায, রাইস
নাদভী, পৃঃ ৫৪৩-৫৪৭ এবং তাস্বহীহুদ দুয়া পৃঃ ৪৪১।
গ- ফযল বিন আব্বাস থেকে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “ নামায দুই দুই রাকাআত,
প্রত্যেক দুই রাকাআতে তাশাহ্হূদ হবে। বিনয়, বিনম্রতা, অসহায়
প্রকাশ পাবে এবং দুই হাত তুলতে হবে। অতঃপর
বর্ণনাকারী বলেনঃ তুমি উভয় হাতকে মহান রব্বের দিকে এমন
ভাবে তুলবে যেন, হাতের অভ্যন্তরীন ভাগ চেহারার
দিকে থাকে এবং বলবেঃ হে আমার রব্ব! হে আমার রব্ব! আর
যে এমন করবে না, তার নামায এমন হবে এবং এমন হবে।” [তিরমিযী,
স্বালাত অধ্যায়, অনুচ্ছেদ নং ২৭৯, হাদীস নং ৩৮৩]
পর্যালোচনাঃ তুহফাতুল্ আহওয়াযীর লেখক
মুবারকপূরী বলেনঃ এই হাদীসটি আব্দুল্লাহ বিন নাফি বিন
ইবনুল উমইয়ার উপর ভিত্তিশীল। আর সে অজ্ঞাত রাভী যেমন
হাফেয বলেছেন। ইমাম বুখারী বলেনঃ তার হাদীস স্বহীহ নয়।
ইবনে হিব্বান তাকে আস্ সিক্বাত গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন”।
[তুহফাতুল আহওয়াযী, ২/৩২৮] তাছাড়া হাদীসটি সহীহ হলেও তা নফল
তথা রাতের নামাযকে বুঝায়; কেন না তাতে দুই দুই রাকাআতের
বর্ণনা এসেছে অন্যদিকে ফজর নামায ছাড়া সব ফরয নামায দুইয়ের
বেশী।
ফরয নামাযান্তে হাত তুলে সম্মিলিত আকারে দুয়ার
সমর্থনে উপরোক্ত দলীলগুলি ছাড়া আরো কিছু দলীল ও সাহাবার
আসার দ্বারা দলীল দেওয়ার চেষ্টা করা হয় কিন্তু সবগুলির
অবস্থা এমন যা হাদীসবিষারদদের নিকট অগ্রহণীয়।
৫-উপরোক্ত আলোচনার সারাংশঃ
উপরোক্ত দলীল-প্রমাণের আলোকে আমরা বলতে পারি যে, ফরয
নামাযে সালাম ফিরানোর পরের সময়টি যেমন যিকর-আযকার করার সময়
তেমন এই সময় দুয়ারও সময় কিন্তু এই দুয়া একা-
একা চুপি চুপি হবে এবং তাতে হাত তুলা প্রমাণিত নয় আর
না সম্মিলিত ভাবে করা প্রমাণিত। তাই যে বা যারা এই সময় হাত
তুলে ইমামের নেতৃত্বে সম্মিলিত ভাবে দুয়া করে তারা এই
দুয়া করার নিয়ম-পদ্ধতি আবিষ্কারক, যা দ্বীনে নবাবিষ্কার। তাই
তা বিদআহ ও প্রত্যাখ্যাত।
৬- সউদী স্থায়ী ফতোয়া বোর্ড কি বলে?
সউদী স্থায়ী উলামা পরিষদকে প্রশ্ন করা হয়, ফরয নামায বাদ
দুয়া করা কি সুন্নত, এই দুয়া কি দুই হাত তুলে হবে…?
তাঁরা উত্তরে বলেনঃ ফরয নামায বাদ দুয়া সুন্নত নয়, যদি তা হাত
তুলে হয়। চাই এটা একা ইমামের পক্ষ থেকে হোক,
কিংবা একা মুস্বল্লীর পক্ষ থেকে হোক কিংবা উভয় কর্তৃক
হোক; বরং এটা বিদআত। কারণ এমন করা নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত নয়, আর না তাঁর
সাহাবা (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। এ ছাড়া দুয়াতে সমস্যা নেই এ
সম্পর্কে কতিপয় হাদীস উল্লেখ থাকার কারণে। [ফাতাওয়াল
লাজনা আদ্ দায়িমাহ,৭/১০৩]
সমাপ্ত
১-মাসবূক কাকে বলে?
আলোচ্য বিষয়ে মাসবূক বলতে আমারা সেই
নামাযী ব্যক্তিকে বুঝাতে চাচ্ছি, যার ইমাম তার পূর্বে এক
বা একাধিক রাকাআত কিংবা নামাযের কিছু অংশ সমাপ্ত
করেছে আর সে নামায শুরু হওয়ার পর জামাআতে প্রবেশ করেছে।
২-মাসবূক কিভাবে নামাযে আসবে?
নামায পড়ার উদ্দেশ্যে মসজিদে বা অন্য কোনো স্থানে আগমন
করার সময় যদি নামাযীর যথাস্থানে পৌঁছানোর পূর্বে জামাআত
দাঁড়িয়ে যায় কিংবা জামাআত দাঁড়ানোর পর সে যদি সেই
জামাআতে শরীক হতে চায়, তাহলে সে যেন ধীর-স্থীর অবলম্বন
করতঃ জামাআতে যায়, দৌড়া-দৌড়ি বা তাড়াহুড়া না করে।
নবী (সাঃ) বলেনঃ
” ﺇﺫﺍ ﺳﻤﻌﺘﻢ ﺍﻹﻗﺎﻣﺔَ ﻓﺎﻣﺸﻮﺍ ﺇﻟﻰ ﺍﻟﺼﻼﺓِ ﻭ ﻋﻠﻴﻜﻢ ﺑﺎﻟﺴﻜﻴﻨﺔِ ﻭﺍﻟﻮﻗﺎﺭِ، ﻭﻻ ﺗُﺴﺮﻋﻮﺍ، ﻓﻤﺎ ﺃﺩﺭﻛﺘﻢ ﻓﺼﻠّﻮﺍ،
ﻭﻣﺎ ﻓﺎﺗﻜﻢ ﻓﺄﺗِﻤّﻮﺍ ” ﻣﺘﻔﻖ ﻋﻠﻴﻪ
“যখন তোমরা ইকামত শুনবে, তখন তোমরা শান্ত ও স্থৈর্য
সহকারে নামাযে চলো, দ্রুত চলো না।
যা পাবে তা পড়ে নিবে আর যা ছুটে যাবে তা পূরণ করে নিবে”।
[বুখারী, আযান অধ্যায়, নং ৬৩৬/মুসলিম, মাসাজিদ, নং ১৩৫৯]
মুসলিমের এক বর্ণনায় এসেছে, “কারণ তোমাদের কেউ যখন
নামাযের ইচ্ছা করে, তখন সে নামাযেই থাকে”।
তাই নামাযে যে ভাবে ধীর-স্থীর অবলম্বন করতে হয়,
সে অবস্থা যেন নামাযে আসার সময়ও থাকে।
তাছাড়া দৌড়ে বা দ্রুত আসলে মানুষ হাঁপায় এবং তার অঙ্গ-
প্রত্যঙ্গ স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে না, যার ফলে তার
নামাযের খুশু-খুযুতে ব্যাঘাত ঘটে।
৩-মাসবূক যে কোনো নফল না পড়ে অতি সত্তর জামাআতে শরীক
হবেঃ
নামাযী যদি এমন সময় মসজিদে প্রবেশ করে যে, জামাআত
দাঁড়িয়ে গেছে,
তাহলে সে সুন্নতে মুআক্কাদা বা তাহিয়্যাতুল মসজিদ
কিংবা অন্য কোন নামায শুরু করবে না; বরং সরাসরি ফরয
জামাআতে শরীক হবে। নবী (সাঃ) বলেনঃ “যখন নামাযের ইকামত
দেওয়া হবে, তখন ফরয নামায ব্যতীত অন্য কোন নামায নেই”।
[মুসলিম, সালাতুল মুসাফেরীন, নং ১৬৪৪]
৪-মাসবূক ব্যক্তির সামনের কাতারে স্থান
না পেলে পিছনে একাই দাঁড়ানো:
মাসবূক মসজিদে প্রবেশ করার পর যদি দেখে যে, সামনের
কাতারে খালি স্থান নেই, তাহলে সে কি সামনের কাতার
থেকে কাউকে টেনে নিয়ে কাতার তৈরি করবে, না ইমামের
পাশে গিয়ে দাঁড়াবে, না অন্য কারো আসার অপেক্ষা করবে, যেন
তার সাথে মিলে দু জনে কাতার তৈরি করে,
না একা একা পিছনে দাঁড়াবে?
এ বিষয়ে উলামায়ে কিরামের মতভেদ বিদ্যমান। এক দল
ইসলামী পণ্ডিত মনে করেন, লাইনের পিছনে একা একা এক
লাইনে নামায পড়লে নামায হবে না। কারণ নবী (সাঃ)
বলেনঃ “লাইনের পিছনে একা নামায আদায়কারীর নামায হয় না”।
[আহমদ, ৪/২৩ ইবনু মাজাহ, অধ্যায় ইকামাতুস স্বালাত, নং ১০০৩] অন্য
হাদীসে এসেছে, একদা নবী (সাঃ) এক ব্যক্তিকে লাইনের
পিছনে একা নামায পড়তে দেখলে তাকে পুনরায় নামায আদায় করার
আদেশ দেন”। [আহমদ, তিরিমিযী, আবওয়াবুস্ স্বালাত, নং ২৩০, আবু
দাঊদ, স্বালাত অধ্যায়, নং ৬৮২, সহীহ সুনান আবু দাঊদ, আলবানী,
নং৬৩৩]
যদি লাইনের পিছনে একা নামায পড়া শুদ্ধ হত, তো নবী (সাঃ)
তাকে পুনরায় আদায় করার আদেশ করতেন না। তাছাড়া উপরোক্ত
দলীলকে শিথিলকারী কোন অন্য দলীলও পাওয়া যায় না। এসব
কারণে উলামাগণের একটি দল লাইনের পিছনে একা নামায
আদায়কারীর নামায বাতিল মনে করেন।
ইসলামী পণ্ডিতগণের অপর দলটি ওজর বশতঃ লাইনের
পিছনে একা নামায পাঠকারীর নামায শুদ্ধ মনে করেন,
বিনা ওজরে নয়। ওজরের ব্যাখ্যা এইরূপ যে,
নামাযী মসজিদে প্রবেশ করার পর যখন দেখে যে, সামনের
লাইনে তার জন্য কোন স্থান নেই, তখন পিছনে একা নামায
পড়া ছাড়া আর তার কোন উপায় থাকে না। তাই এই অবস্থায় তার
পিছনে একা নামায পাঠ করাটা একটি ওজর। তারা মনে করেন, লাইনের
পিছনে একা ব্যক্তির নামায শুদ্ধ না হওয়াটা নামাযীর লাইনবদ্ধ
হওয়া জরূরীর প্রমাণ। কিন্তু সে কাতারবদ্ধ হতে অপারগ কারণ;
সামনের কাতারে জায়গা নেই। তাই এমতাবস্থায় তার জন্য এই
শারয়ী মূলণীতি প্রযোজ্য যে, [লা-ওয়াজিবা মাআ’ল ইজ্ য]
অপারগ হলে ওয়াজিবের বিধান প্রযোজ্য নয়। অর্থাৎ কেউ কোন
কিছু করতে অক্ষম হলে, তা করাটা তার উপর জরূরী থাকে না।
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (কাজেই তোমরা আল্লাহকে তোমাদের
সাধ্যমত ভয় কর।) [আত্ তাগাবুন/১৬] তিনি আরো বলেনঃ (আল্লাহ
কোন ব্যক্তির উপর তার সাধ্যের অতিরিক্ত কিছু আরোপ করেন
না।) [বাকারাহ/২৮৬] এই মতটি মধ্যম মত হিসাবে শাইখুল ইসলাম ইবনু
তায়মিয়া, শাইখ সা’দী, শাইখ আলবানী, শাইখ ইবনে উসায়মীন প্রমুখ
গ্রহণ করেছেন।
এই বিষয়ের সারাংশ স্বরূপ উল্লেখ্য যে,
ক-মাসবূক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করার পর নিজে একা কাতার
তৈরি না করে সামনের লাইনে ঢুকার চেষ্টা করবে। এই সময়
মুসল্লীদের তার জন্য স্থান করে দেওয়া উচিৎ। নবী (সাঃ)
বলেনঃ “তোমরা কাতার সোজা করে নাও, কাঁধ বরারবর করে নাও,
খালি স্থানগুলি পূরণ করে নাও এবং নিজ ভায়ের হাত ধরার
ক্ষেত্রে নম্র হও..”। [আহমদ, আবু দাঊদ, নাসাঈ, সহীহুত্ তারগীব
ওয়াত্ তারহীব]
আবু দাঊদ (রহঃ) নিজ ভাইর হাত ধরার ক্ষেত্রে নম্র হও এর
অর্থে বলেনঃ “যখন কেউ লাইনে প্রবেশ করতে আসে, তখন
প্রত্যেক ব্যক্তির উচিৎ যে, তারা যেন তার জন্য নিজ কাঁধ
নম্র করে যেন সে লাইনে প্রবেশ করতে পারে।
খ- এই সময় কাউকে সামনের কাতার থেকে টেনে নিয়ে কাতার
তৈরি করা যাবে না। কারণ এমন করার কোন সহীহ দলীল নেই।
বরং এতে কিছু শারঈ বিধান লঙ্ঘিত হয় যেমনঃ
১-যাকে টানা হয়, তাকে সমস্যায় ফেলা হয় এবং তার খুশু-
খুযুতে ব্যাঘাত ঘটে।
২-পূর্ণ লাইনে খালি স্থান তৈরি করা হয়; অথচ লাইন পূরণ ও
মিলনের আদেশ করা হয়েছে।
৩-যাকে টানা হচ্ছে তাকে উত্তম ফযীলতের স্থান থেকে কম
মানের স্থানে স্থানান্তর করা হয়।
৪-পুরা লাইনে ব্যাঘাত ঘটে কারণ; এক জনের স্থান খালি হওয়ার
কারণে লাইনের সবাইকে তা পূরণের জন্য নড়া-চড়া করতে হয়।
[শারহুল মুমতি, ইবনে উসায়মীন,৪/২৭২-২৭৩]
গ-সে ইমামের পাশে গিয়ে তার বরাবর দাঁড়িয়ে নামায
পড়বে না কারণঃ
১-এতে মানুষের কাঁধ ডিঙ্গানোর প্রয়োজন রয়েছে; অথচ
নামাযীর কাঁধ ডিঙ্গানো নিষেধ।
২-ইমামের সাথে তাঁর বরাবর নামায পড়লে সুন্নতের বরখেলাফ
করা হয় কারণ; সুন্নত হচ্ছে ইমামের স্থান মুক্তাদীর স্থান
থেকে পৃথক ও স্বতন্ত্র। [প্রাগুক্ত ৪/২৭৩]
ঘ-মাসবূক সামনের লাইনে ফাঁকা স্থান
না পেলে এবং তাতে প্রবেশ না করতে পারলে, সে আর অন্য
মাসবূকের অপেক্ষা করবে না; বরং একাই পিছনের লাইনে নামায
পড়বে কারণঃ
১-অপেক্ষা করতে করতে রাকাআত ছুটে যেতে পারে আর অনেক
সময় সেটি শেষ রাকাআত হলে জামাআতই ছুটে যেতে পারে। আর
এমন হলে জামাআতের ফযীলত থেকে সে মাহরূম হয়ে যাবে আর
নামাযও ছুটে যাবে। [প্রাগুক্ত,৪/২৭৪]
৫-মাসবূক কি ভাবে এবং কি বলে জামাআতে প্রবেশ করবে?
মাসবূক ব্যক্তি প্রথমে দণ্ডয়মান অবস্থায়
তকবীরে তাহরীমা দিবে অতঃপর ইমামকে যেই অবস্থায় পাবে, সেও
সেই অবস্থায় চলে যাবে কারণ; তকবীরে তাহরীমা নামাযের রুকন
তাই তা ব্যতীত নামায হয় না। অনেক সময় এই অবস্থায় মাসবূকের উপর
দুটি তাকবীর একত্রিত হয়ে যায়। যেমন ধরুন মাসবূক এমতাবস্থায়
জামাআতে প্রবেশ করছে, যখন ইমাম রুকূ বা সাজদার জন্য তাকবীর
দিচ্ছেন। এই সময় মাসবূকের
প্রতি প্রথমে তাকবীরে তাহরীমা দেওয়া জরূরী অতঃপর রুকূর
বা সাজদার তাকবীর দেওয়া। এটি উত্তম নিয়ম তবে যদি কেউ রুকূ
বা সাজদার তকবীর, যাকে তাকবীরাতুল ইন্তিকাল বলা হয়
তা না দিয়ে শুধু তাকবীরে তাহরীমা দেয়, তাহলে তার জন্য এটিই
যথেষ্ট হবে। [আল্ মুলাখ্খাস আল্ ফিকহী, ড.সালেহ ফাউযান,
পৃঃ ৯৮]
অতঃপর ইমাম যেই অবস্থায় থাকবে সেও সেই অবস্থায় শরীক হবে।
ইমাম সাজদায় আছে বলে তাঁর সাজদা থেকে দাঁড়ানোর
অপেক্ষা করা বা আরো এইরূপ অন্য কিছুর অপেক্ষা করা ভুল।
নবী (সাঃ) বলেনঃ “যখন তোমাদের কেউ
নামাযে আসবে এমতাবস্থায় যে ইমাম কোন এক অবস্থায় আছেন,
তাহলে সে যেন তেমন করে যেমন ইমাম করেন”। [তিরমিযী,
অনুচ্ছেদ নং ৬২ হাদীস নং ৫৯১, শাইখ আলবানী সহীহ বলেছেন]
তিনি (সাঃ) আরো বলেনঃ “যখন তোমরা ইমামকে সাজদারত অবস্থায়
পাবে, তখন তোমরাও সাজদা করবে কিংবা রুকূ অবস্থায় পাবে, তখন
তোমরাও রুকূ করবে কিংবা কিয়াম অবস্থায় পাবে, তখন তোমরাও
দাঁড়াবে”। [সিলসিলা সহীহা নং ১১৮৮]
৬-মাসবূক দুআই ইস্তিফ্তাহ (সানা) পড়বে কি?
দুআয়ে ইস্তিফ্তাহ বা সানা পড়ার সময় হচ্ছে,
তাকবীরে তাহরীমার পর এবং সূরা ফাতিহা পড়ার পূর্বে। তাই
মাসবূক যদি ইমামের রুকূ, সিজদা বা তাশাহ্ হুদের সময়
জামাআতে শরীক হয়, তাহলে তাকে সানা পড়তে হবে না। কারণ
এগুলো সানা পড়ার স্থান নয় এবং এসব স্থানের দুআ ও যিকির
নির্দিষ্ট। কিন্তু মাসবূক যদি কিয়াম অবস্থায় ইমামকে পায় আর
তার অধিক ধারণা হয় যে, সে ইমামের রুকূ করার
পূর্বে সানা পড়ে সূরা ফাতিহা পড়তে পারবে,
তাহলে সে সানা পড়বে; নচেৎ শুধু সূরা ফাতিহা পড়বে। কারণ
সূরা ফাতিহা পড়া ওয়াজিব আর সানা পড়া মুস্তাহাব। এটাই
প্রাধান্যযোগ্য মত। ইমাম নবভী (রহঃ) বলেনঃ “মাসবূক
ইমামকে যদি কিয়াম ছাড়া অন্য অবস্থায় পায়,
তাহলে দুআ’য়ে ইস্তিফতাহ (সানা) পড়বে না,… আর যদি কিয়াম
অবস্থায় পায় এবং অনুমান করতে পারে যে, সে সানা, তাআ’উয
(আউযুবিল্লাহ) ও ফাতিহা পড়তে পারবে, তাহলে সানা পড়বে…আর
যদি বুঝতে পারে যে, এসব পড়া সম্ভব নয় কিংবা সন্দেহ হয়,
তাহলে সানা পড়বে না”। [মাজমূ ৩/৩১৮-৩১৯]
এ সম্পর্কে কিছু উলামা মনে করেন, সির্রী (নিরব)
নামাযে মাসবূক সানা পড়বে কিন্তু জাহরী (সশব্দিক)
নামাযে যদি ইমামকে সূরা ফাতিহা পড়ার পূর্বে নিরব অবস্থায়
পায়, তাহলে পড়বে নচেৎ পড়বে না।
৭-মাসবূক ইমামের সাথে যেই রাকাআতে প্রবেশ করে, তা কি তার
জন্য প্রথম রাকাআত?
অধিকাংশ ফুকাহায়ে কিরাম মনে করেন, মাসবূক যখন
জামাআতে শরীক হয়, তখন তার সেটা নামাযের শেষাংশ হয়। আর যখন
সে বাকিটা পূরণ করে সেটা তার প্রথমাংশ হয়। [ফিকহ বিশ্বকোষ
৩৭/১৬৪] উদাহারণ স্বরূপ যদি কোনো ব্যক্তি এমন সময়
জামাআতে শরীক হয়, যখন ইমাম এক রাকাআত শেষ করে দ্বিতীয়
রাকাআত পড়ছেন, তখন মাসবূকের এই রাকাআতটি তার জন্য প্রথম
না দ্বিতীয়? হানাফী, মালেকী ও হাম্বালী ফুকাহাগণ
এটাকে তার জন্য দ্বিতীয় রাকাআত মনে করেন, যেমন
সেটা ইমামের জন্যও দ্বিতীয়। আর ইমামের সালাম ফিরানোর পর
সে যা পড়বে তা তার প্রথম রাকাআত বা নামাযের শেষাংশ
ধরা হবে। তাদের দলীল নবী (সাঃ) এর এই হাদীস “…
যা পাবে তা পড়ে নিবে আর যা ছুটে যাবে তা কাযা করে নিবে”।
[নাসাঈ, ইমামাহ অধ্যায়, নং৮৬০]
তারা এখানে কাযা শব্দটিকে ফেকহী পারিভাষিক অর্থে গ্রহণ
করেন। অর্থাৎ কোন আমল তার নির্ধারিত
সময়ে না করা হলে পরে তা করে দেওয়া। তাই ইমামের
সাথে যেটা মাসবূক পায় নি সেটা তার প্রথম নামায ছিল
যা নির্ধারিত সময়ে আদায় না হওয়ার
কারণে পরে সে তা কাযা হিসাবে সম্পাদন করবে।
তবে শাফেয়ী মাযহাবের ফকীহগণ মনে করেন, মাসবূক
জামাআতে শরীক হয়ে ইমামের সাথে নামাযের যে প্রথম
অংশটি পায় সেটা তার জন্য প্রথম রাকাআত এবং পরে সে যা পূরণ
করে সেটি তার শেষ নামায বা নামাযের শেষাংশ। কারণ নবী (সাঃ)
বলেনঃ “যখন নামাযে আসবে, তখন শান্ত ভাবে আসবে,
যা পাবে তা পড়ে নিবে আর যা ছুটে যাবে, তা পূরণ করে নিবে”।
[বুখারী, অধ্যায়, আযান নং৬৩৫, ৬৩৬, মুসলিম, মাসাজিদ অধ্যায়,
নং ১৩৬২]
এটিই অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মত কারণঃ
ক- নবী (সাঃ) এর বাণী ‘পূরণ করে নিবে’ থেকে বুঝা যায় যে,
মুক্তাদী ইমামের সাথে যা পায় তা তার প্রথম রাকাআত। কারণ
কোনো কিছু তখনই পূরণ হয়, যখন তা শুরু করা হয়। তাই নবী (সাঃ) যখন
ছুটে যাওয়া নামায পূরণ করতে বলছেন, তখন এর অর্থ দাঁড়ায় যে,
সে ইমামের সাথে যা পেয়েছে, তা তার প্রথম নামায।
খ- ইবনু মুনযির বলেনঃ তারা এ ব্যাপারে ঐক্যমত যে,
তাকবীরে তাহরীমা প্রথম রাকাআত ছাড়া অন্য রাকাতে হয় না।
[নায়লুল্ আউত্বার,৩/১৭১] তাঁর মন্তব্যের ব্যাখ্যা এইরূপ যে,
মাসবূক যখন তাকবীরে তাহরীমা দিয়ে নামাযে প্রবেশ করে, তখন
তার সেটা প্রথম রাকাআত হওয়াই সঙ্গত কারণ;
তাকবীরে তাহরীমা প্রথম রাকাআতেই হয়। এমন নয় যে, মাসবূক যখন
দ্বিতীয় বা তৃতীয় রাকাআতে প্রবেশ করে, তখন
সে তাকবীরে তাহরীমা দিবে না বরং যখন পূরণ করতে উঠবে তখন
তাকবীরে তাহরীমা দিবে।
গ- বাকি থাকলো সেই বর্ণনা, যাতে কাযা করার শব্দ
এসেছে তো তার উত্তর এই ভাবে দেওয়া হয়েছে।
১- কাযা করার বর্ণনা অপেক্ষা পূরণ করার বর্ণনা বেশী সংখ্যায়
এসেছে এবং তা বেশী শুদ্ধ কারণ; এই বর্ণনা সহীহাইনে এসেছে।
২- হাদীসে কাযা শব্দটি ফুকাহাগণের পরিভাষায় ব্যবহার
হয়নি কারণ তা পরে আবিষ্কৃত পরিভাষা; বরং তা কোনো কাজ পূরণ
করা বা সমাপ্ত করার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন আল্লাহ
তাআলা বলেনঃ (ফা-ইযা কুযিয়াতিস্ স্বালাতু) [জুমুআহ/১০]
অর্থঃ ( যখন নামায সমাপ্ত হবে) তিনি অন্যত্রে বলেনঃ (ফা-
ইযা কাযাইতুম মানাসিকাকুম) [বাকারাহ/২০০] অর্থঃ (অতঃপর
হজ্জের কার্যাবলী যখন সমাপ্ত করবে)
এই মতভেদের ফলাফলঃ ধরুন যদি কেউ ইমামের সাথে মাগরিবের
তৃতীয় রাকাআতে শরীক হয়, তাহলে প্রথম মতানুযায়ী সে শুধু
সূরা ফাতিহা পাঠ করবে কারণ; এটা তার তৃতীয় রাকাআত যেমন
ইমামের ক্ষেত্রেও তৃতীয় রাকাআত। কিন্তু দ্বিতীয়
মতানুযায়ী সে সূরা ফাতিহা সহ অন্য একটি সূরাও পাঠ
করবে কারণ; এটি তার প্রথম রাকাআত। এই
ভাবে বাকি বিষয়গুলি অনুমান করতে পারেন।
৮-রুকূ পেলে রাকাআত গণ্য করাঃ
মাসবূক ইমামের সাথে রুকূ পেলে সে সেই রাকাআতটি গণ্য
করবে কি করবে না? অর্থাৎ তার
সে রাকাআতটি হয়ে যাবে না হবে না? এ
বিষয়ে ইসলামী বিদ্ব্যানদের দুটি মত দেখা যায়।
প্রথম মতঃ তার রাকাআত হয়ে যাবে এবং সে এটি রাকাআত
ধরে নিবে। এই মতে সমস্ত ফুকাহদের ঐক্যমত রয়েছে। [ফিকহ
বিশ্বকোষ ৩৭/১৬৩]
তাদের দলীলাদি নিম্নরূপঃ
১- আবু বাকরা থেকে বর্ণিত, তিনি একদা লাইনে পৌঁছানোর
পূর্বে রুকু করেন এবং ঝুকেই লাইনে প্রবেশ করেন।
বিষয়টি নবী (সাঃ) কে বলা হলে তিনি (সাঃ) বলেনঃ “ আল্লাহ
তোমার আগ্রহকে বাড়িয়ে দিক আর পূনরায় এমন করো না”। [বুখারী,
আযান অধ্যায়, নং৭৮৩] তারা বলেনঃ নবী (সাঃ) তাকে সেই
রাকাআতটি পুনরায় পড়ার আদেশ দেন নি, যা দ্বারা বুঝা যায় রুকূ
পেলে রাকাআত হয়ে যায়।
‘পুনরায় করো না’ এর অর্থে ইবনে হাজার আসক্বালানী (রহ)
বলেনঃ দৌড়ে চলা এবং লাইনে প্রবেশের পূর্বে রুকূ
করা অতঃপর সেই অবস্থায় ঝুকে হেঁটে লাইনে প্রবেশ করা, এমন
কাজ আর করো না। তিনি ত্বাবারানীর বরাতে একথাও উল্লেখ
করেন যে, নবী (সাঃ) জিজ্ঞাসা করেনঃ এই
নিঃশ্বাসী ব্যক্তি কে? (দৌড়ে দূর থেকে রুকূ করার
কারণে তাঁর নিঃশ্বাস স্ফীত হয়ে গেছিল) তখন
তিনি বলেনঃ আমার ভয় হচ্ছিল যে, আপনার সাথে রাকাআতটি পাব
না”। [ফাতহুল বারী ২/৩৪৭] অর্থাৎ রাকাআতটি যেন ছুটে না যায়
তাই তিনি এমন করেছিলে, যা থেকেও ইঙ্গিত মিলে যে, রুকূ
পেলে রাকাআত হয়ে যায়। অনেকে বলেনঃ পুনরায় করো না,
মানে লাইনের বাইরে তাকবীরে তাহরীমা দেওয়ার কাজটি আর
করো না। কেউ বলেনঃ নামাযে আসতে ঢিলেমি করো না। রুকু
অবস্থায় হেঁটে লাইনে প্রবেশ করো না কারণ; এটি চতুষ্পদ
জন্তুর চলন। [নায়লুল আউত্বার, শাওকানী, ৩/২৩৬] রুকূ
পেলে রাকাআত হয়ে যায়, মত পোষণকারীগণ উপরোক্ত
অর্থগুলি থেকেও দলীল পেশ করে বলেনঃ কোনো অর্থের
মাধ্যমে এটা বুঝা যায় না যে, নবী (সাঃ) তাকে পুনরায় সেই
রাকাআতটি পড়তে বলেছেন, যা দ্বারা বুঝা যায় যে, রুকূ
পেলে রাকাআত হয়ে যায়।
২- নবী (সাঃ) বলেনঃ “যে নামাযের এক রাকাআত পেল, সে নামায
পেয়ে গেল”। [বুখারী, মাওয়াক্বীতুস স্বালাত, নং ৫৮০] অন্য
বর্ণনায় এসেছে, যখন তোমরা নামাযে আসবে আর আমরা সাজদায়
থকবো তখন তোমরাও সাজদা করো এবং তা গণ্য করো না। আর
যে ব্যক্তি রাকাআত পেলো সে নামায পেয়ে গেল”। [আবু দাঊদ,
বায়হাক্বী, আলবানী (রহ) যয়ীফ বলেছেন, ইরওয়া ২/২৬০]
আপত্তিঃ হাদীস থেকে রুকূ পেলে নামায পেলো, বা নামাযের
ফযীলত পেলো, এটা বুঝা যায় কিন্তু রাকাআত
পেলো তা বুঝা যায় না কারণ; তা উল্লেখ হয় নি।
উল্লেখ্য, (যে রুকূ পেল সে রাকাআত পেয়ে গেল) বলে আবু
দাঊদের বরাতে যেই হাদীসটি বর্ণনা করা হয়, তা বর্তমান অনেক
গবেষকের নিকট সাব্যস্ত নয়; যদিও বহু ফিকহ তথা অন্যান্য
গ্রন্থে এমনই উল্লেখ হয়েছে।[দেখুন, সালেহ বিন মুহাম্মদ
আল্ আমূদী কর্তৃক লিখিত প্রবন্ধ ‘তাহকীকুল খিলাফ
ফী হাদীসে মান আদ্ রাকার রুকূ ফাক্বাদ আদ রাকার রাকাআহ’।
http://www.majles.alukah.net এ প্রকাশিত]
৩- তাঁরা এছাড়া আরো কিছু সাহাবার আমল দ্বারা দলীল দিয়েছেন
কিন্তু এসব বর্ণনা দোষ মুক্ত নয়।
দ্বিতীয় মতঃ রুকূ পেলে রাকাআত হবে না; বরং তাকে রুকূর
পূর্বে কিয়াম অবস্থায় সূরা ফাতিহা পড়ার সুযোগ থাকতে হবে।
এটি ইবনু হাযম সহ অনেকেরে মত।[আল্ মুহাল্লা, ইবনু হাযম ৩/২৪৪]
এই মতের দলীলাদিঃ
১- নবী (সাঃ) বলেনঃ “… যা পাবে তা পড়ে নিবে আর
যা ছুটে যাবে তা পূরণ করে নিবে”।[বুখারী, অধ্যায়, আযান
নং ৬৩৫, ৬৩৬, মুসলিম, মাসাজিদ অধ্যায়, নং ১৩৬২]
যে ইমামকে রুকূ অবস্থায় পায়, তার কিয়াম ছুটে যায়। তাই
তাকে সালামের পর সেটা পূরণ করতে হবে।
২- কিয়াম নামাযের রুকন, যা ব্যতীত নামায হয় না। নবী (সাঃ)
বলেনঃ “দাঁড়িয়ে নামায পড়, যদি না পারো তো বসে পড়, তাও
না পারলে কাঁত হয়ে পড়”। [বুখারী, তাকস্বীরুস স্বালাত,
নং ১১১৭]
বুঝা গেল,
নামাযে দাঁড়ানো জরূরী তা বিনা ওজরে ছাড়া যাবে না। তাই
রুকূ পাওয়া ব্যক্তির কিয়াম ছুটে যায় বলে তাকে সেই রাকাআত
আবারো পড়তে হবে।
৩- নবী (সাঃ) বলেনঃ “ সূরা ফাতিহা পড়া ব্যতীত নামায হয় না”।
[বুখারী, আযান অধ্যায়, নং৭৫৬]
বুঝা গেল, সূরা ফাতিহা ছাড়া নামায হয় না। তাই রুকূ
পাওয়া ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পড়েনি বলে তাকে পরে তা কাযা
করতে হবে।
অগ্রাধিকার প্রাপ্ত মত নির্ণয়ঃ প্রথম মতের দিকে লক্ষ্য
করলে দেখা যাচ্ছে, ইমাম চতুষ্টয় সহ জমহূর উলামা আবু
বাকরা (রাযিঃ) এর হাদীস থেকে রুকূ পেলে রাকাআত হয়ে যায়
বুঝেছেন এবং এটি সঊদী স্থায়ী উলামা পরিষদও সমর্থন করেছেন।
তাই তাঁদের বুঝের বিপরীতে কোন রায় দেওয়া আমার
পক্ষে কষ্টকর। অন্য দিকে নামাযে সূরা ফাতিহা পাঠ
এবং কিয়ামের গুরুত্বের দিকে লক্ষ্য করলে রুকু
পাওয়া ব্যক্তির রাকাআত হওয়া মেনে নেওয়াতে একটু কিন্তু
থেকেই যায়। তবে উভয় মত দলীল দ্বারা সমাদৃত হওয়ায় দুটির
প্রতি আমল করা সঙ্গত হবে ইনশা আল্লাহ।
৯-জুমআর এক রাকাআত নামায ছুটে গেলেঃ
যে ব্যক্তি জুমআর এক রাকাআত নামায পেয়েছে, সে জুমআ
পেয়েছে। এই সময় সে ইমামের সালামের পর বাকি এক রাকাআত পূরণ
করে নিবে। নবী (সাঃ) বলেনঃ “ যে ব্যক্তি জুমআর এক রাকাআত
পেল, সে যেন আর এক রাকাআত মিলিয়ে নেয় এবং তার সালাত
পূর্ণ”। [নাসাঈ নং ৫৫৭, ইবনু মাজাহ নং ১১২১, সূত্র সহীহ,
ফাতাওয়া লাজনা দাইমাহ ৮/২২৪]
আর যে ব্যক্তি এক রাকাআতের কম পেয়েছে, যেমন দ্বিতীয়
রাকাআতের সাজদা বা তাশাহ্হুদ পেয়েছে, তাহলে সে জুমআর
সালাত পায় নি। এমতাবস্থায় সে ইমামের সালাম শেষে উঠে চার
রাকাআত যহরের নামায আদায় করবে।
[সউদী স্থায়ী ফাতাওয়া বোর্ড ৮/২২৭]
১০-ঈদের নামাযের মাসবূকঃ
ঈদের নামাযে প্রথম রাকাআতে ইমামের অতিরিক্ত তকবীর দেওয়ার
সময় কেউ জামাআতে প্রবেশ করলে,
প্রথমে সে তাকবীরে তাহরীমা দিয়ে নামাযে প্রবেশ করবে। এই
সময় যদি সে কিছু তকবীর ইমামের সাথে পায় তো দিবে নচেৎ
বাকি কাজে ইমামের অনুসরণ করবে। নামায শেষে এই অতিরিক্ত
তাকবীর (তাকবীরে যাওয়াঈদ) তাকে পূরণ করতে হবে না। [মাজমূউ
ফাতাওয়া ইবনু উসায়মীন,১৬/২৪৫]
আর কেউ যদি দুই ঈদের দ্বিতীয় রাকাআতের তাশাহ্হূদে শরীক
হয়, তাহলে সে ইমামের সালাম ফিরানোর পর ইমামের মতই তকবীর,
কিরাআত, রুকূ ও সাজদা করে দুই রাকাআত নামায আদায় করবে।
[সঊদী স্থায়ী ফতোয়া বোর্ড ৮/৩০৭] এই ভাবে এক রাকাআত
ছুটে গেলেও অনুরূপ পদ্ধতিতে আদায় করবে।
১১-জানাযার নামাযের মাসবূকঃ
যদি কেউ এমন অবস্থায় জানাযার নামাযে শরীক হয় যখন ইমাম
একটি তাকবীর শেষ করে দ্বিতীয় তাকবীরে আছেন বা দ্বিতীয়
শেষ করে তৃতীয়তে অবস্থান করছেন বা তৃতীয় শেষ
করে চতুর্থের স্থানে রয়েছেন। তাহলে সে ইমামের সাথে যত
তাকবীর পাবে তার অনুসরণ করতঃ আদায় করবে এবং ইমামের সালাম
ফিরানোর পর এবং জানাযা উঠানোর
পূর্বে সে বাকি তাকবীরগুলি দিয়ে সালাম ফিরাবে।
কাযা তকবীরগুলি
আদায় করার সময় তার উপর সর্বনিম্ন যা জরুরী তা করলেই যথেষ্ট
হবে। যেমন দ্বিতীয় তাকবীরে যদি বলে,
আল্লাহুম্মা সাল্লি আ’লা মুহাম্মদ (হে আল্লাহ! নবীর
প্রতি রহমত প্রেরণ করো) এবং তৃতীয়ের পর
যদি বলেঃ ‘আল্লাহুম্মাগ্ ফির লাহু’ (হে আল্লাহ!
তুমি তাকে ক্ষমা করো), তাহলে তা যথেষ্ট হবে।
[সঊদী স্থায়ী ফতোয়া বোর্ড,৮/৩৯৯]
ইমামের ভুল-ত্রুটি (সাজদায়ে সাহুর বিধান)
‘সাহু’ ও সাজদায়ে সাহুঃ
সাহুর আভিধানিক অর্থ, ভুল, অমনোযোগ এবং বেখেয়াল। তাই
নামাযে সাহু হওয়া মানে নামায সম্পাদনের সময়
ভুলে তথা বেখায়ালে কিছু
ছেড়ে দেওয়া বা বেশী করে দেওয়া বা সন্দেহে পড়া। আর
সাজদায়ে সাহু হচ্ছে, সেই ভুল সংশোধনের উদ্দেশ্যে সালাম
ফিরানোর পূর্বে বা পরে দুটি সাজদা করা।
১-সাজদায়ে সাহুর মাধ্যমে কি ধরণের ভুল সংশোধিত হয়?
নামাযে সংঘটিত ভুলগুলি সমমানের নয়। কিছু ভুল বড় পর্যায়ের,
যা সাজদায়ে সাহুর মাধ্যমে সংশোধন হয় না; বরং তা হলে অনেক
সময় নামায বাতিল হয়ে যায়, আর অনেক সময় ছুটে যাওয়া সেই
কাজটি পুনরায় করা ব্যতীত নামায শুদ্ধ হয় না। এই সব বড় ভুলের
উদাহরণ হচ্ছে, নামাযের রুকন ছুটে যাওয়া। সেই রুকন গুলির
মধ্যে যদি কেউ তাকবীরে তাহরীমা ভুলে ছেড়ে দেয়,
তাহলে তার নামায বাতিল হয়ে যাবে এবং সাজদায়ে সাহুর
মাধ্যমে তা পূরণ হবে না। এ ছাড়া অন্য কোনো রুকন
ছুটে গেলে, যেমন রুকু কিংবা সাজদা ছুটে গেলে অতঃপর তার
পরের রাকাআতের কিরাআত শুরু করার পূর্বে স্মরণ
হলে তৎক্ষণাৎ তা করতে হবে এবং তার পরের বাকি কাজও
করতে হবে। আর যদি পরের রাকাআত শুরু করার পর স্মরণ হয়,
তাহলে যেই রাকাআতে সেই রুকন ছুটে গেছে তা বাতিল
হয়ে যাবে এবং তার পূর্বে সংঘটিত রাকাআতটি সেই
স্থানে স্থলাভিষিক্ত হবে। [দেখুন, শারহুল মুমতি,৩/৩৭১-৩৭২/
আল্ মুলাখ্খাস আল্ ফিকহী, ড. ফাউযান/৭৫]
এতদ্ব্যতীত নামাযের কোনো ওয়াজিব ভুলে ছুটে গেলে,
তা সাজদায়ে সাহুর মাধ্যমে পূরণ তথা সংশোধন হয়ে যায়। যেমন
প্রথম তাশাহ্হুদ ছুটে যাওয়া, তকবীরে তাহরীমা ব্যতীত
বাকি তাকবীর সমূহের কোনো একটি ছুটে যাওয়া,
সামিআল্লাহুলিমান হামিদাহ ভুলে না বলা ইত্যাদি। নবী (সাঃ)
একদা প্রথম তাশাহ্হুদ ভুলে ছেড়ে দিলে সাহুর
দুটি সাজদা করেন। [আহমদ, ৪/২৫৩, তিরমিযী, আবু দাঊদ ও বায়হাক্বী]
নামাযের সুন্নাহ কিছু ছুটে গেলে সাজদায়ে সাহু
দেয়া জরুরী নয়; বরং অনেক উলামার নিকট তা না দেয়াই ভাল। কারণ
নামাযের সুন্নাহ ছুটে যাওয়ার ফলে নবী (সাঃ) সাজদায়ে সাহু
করেছেন মর্মে কোনো দলীল পাওয়া যায় না। তবে একটি আম
(ব্যাপক অর্থবোধক) হাদীস তা বৈধতার ইঙ্গীত করে। নবী (সাঃ)
বলেনঃ “প্রত্যেক সাহুর বদলে রয়েছে দু’টি সাজদা”। [ইবনু
মাজাহ নং ১২১৯, আবু দাঊদ নং১০৩৮, সূত্র হাসান দেখুন ইরওয়াউল
গালীল ২/৪৭]
উল্লেখ থাকে যে, নামাযের রুকন ইচ্ছা বা অনিচ্ছায়
ছুটে গেলে নামায হয় না যতক্ষণে তা না করা হয়। ওয়াজিব
ইচ্ছাকৃত ছাড়লে নামায বাতিল হয়ে যায় কিন্তু অনিচ্ছায়
ছাড়লে সাজদায়ে সাহুর মাধ্যমে তা সংশোধন হয়ে যায়। আর
নামাযের সুন্নাহ ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় ছুটে গেলে নামায বাতিল
হয় না, তবে পূর্ণ সওয়াব হতে বঞ্ছিত হয়। [মুলাখ্খাস আল
ফিকহী/৬৩]
২-যে সব কারণে সাজদায়ে সাহু বৈধ হয়ঃ
সাধারণতঃ যে সব কারণে সাজদায়ে সাহু করা বৈধ সেগুলো হল
তিনটি। যথা:
ক-নামাযের কিছু বেশী হওয়া।
খ- নামাযের কিছু কম হওয়া।
গ- নামাযে সন্দেহ হওয়া। [শারহুল্ মুমতি,৩/৩৩৮]
৩-সাজদায়ে সাহু সালামের পূর্বে না পরে?
অধিকাংশ উলামার মতে সাজদায়ে সাহু সালামের
পরে বা পূর্বে দিলে, তা যথেষ্ট হবে এবং নামায শুদ্ধ হবে।
কারণ নবী (সাঃ) সাজদায়ে সাহু সালামের পূর্বেও করেছেন
এবং পরেও করেছেন। শাওক্বানী বলেনঃ ‘ক্বাযী ইয়ায
এবং শাফেয়ীর অনুসারী এক দল বলেনঃ এই সকল
মতভেদকারী উলামা এবং অন্যান্য উলামাদের
মধ্যে এতে কোনো মতবিরোধ নেই যে, যদি কেউ নামাযের কম
বা বেশীর কারণে সালামের পূর্বে বা পরে সাজদায়ে সাহু দেয়,
তাহলে তা যথেষ্ট হবে এবং নামায বিনষ্ট হবে না। মূলতঃ তাদের
মতভেদ হচ্ছে, উত্তম কি? [সালামের আগে না পরে?] [নায়লুল্
আউত্বার, শাওক্বানী,৩/১৪২/ আর রাউযাতুন্নাদিয়্যাহ, মুহাম্মদ
সিদ্দীক হাসান খাঁ,১/৩২৭/শারহুল মুমতি,৩/৩৯৪]
অতঃপর আমাদের জানা ভাল যে, সাজদায়ে সাহু সালামের
পূর্বে না পরে, কখন হওয়া উত্তম? এ বিষয়ে ইসলামী পণ্ডিতদের
মধ্যে বড় মতভেদ রয়েছে। কম-বেশী আট টি মত পাওয়া যায়।
ইমাম আবু হানীফা (রহ) এর মতে সর্বাবস্থায় সাজদায়ে সাহু
সালামের পরে হবে। কিন্তু এই মত গ্রহণ করলে সেই সব হাদীস
প্রত্যাখ্যান করা হয়, যাতে নবী (সাঃ) সালামের পূর্বে সাহুর
সাজদা করেছেন বলে প্রমাণিত।
ইমাম শাফেয়ী (রহ) এর মতে সর্বাবস্থায় সাজদায়ে সাহু সালামের
পূর্বে হবে। আর এই মত গ্রহণ করলে সেই সব হাদীসের প্রতি আমল
হয় না, যেই সব হাদীসে নবী (সাঃ) সালামের পরে সাজদায়ে সাহু
করেছেন বলে প্রমাণিত।
তাই এমন একটি সমাধানের পথ হওয়া উচিৎ, যা গ্রহণ করা হলে উভয়
প্রকার হাদীসের প্রতি আমল করা সম্ভব হয়। এমন
মতকে সমন্বয়সাধনকারী মত বলে। উলামায়ে কেরাম হতে এই রকম
দুটি সুন্দর সমন্বয়কারী মত পাওয়া যায়।
প্রথম মতটি ইমাম শাওক্বানীর। তিনি বলেনঃ সে সব
স্থানে সালামের পূর্বে সাজদায়ে সাহু করা উত্তম যে সব
স্থানে নবী (সাঃ) সালামের পূর্বে করেছেন। অনুরূপ ঐসব
স্থানে সালামের পর সাজদায়ে সাহু করা উত্তম যে সব
স্থানে নবী (সাঃ) সালামের পর সাজদায়ে সাহু করেছেন।
এছাড়া অন্য স্থানে ভুল হলে নামাযী সালামের
পূর্বে কিংবা পরে সাজদায়ে সাহু করতে স্বাধীন; কারণ এসব
স্থানে কোথায় করতে হবে, তা তিনি (সাঃ) থেকে প্রমাণিত নয়।
[নায়লুল আউত্বার,৩/১৪৩]
দ্বিতীয় মতটি ইবনু তায়মিয়াহ এবং ইমাম আহমদের
একটি বর্ণনানুযায়ী মত। এই মতানুযায়ী যদি সাজদায়ে সাহু
নামাযের কোনো কিছু কমের কারণে হয়, তাহলে সালামের
পূর্বে হবে আর যদি কোনো কিছু বেশীর কারণে হয়,
তাহলে সালামের পরে হবে। আর সন্দেহের
কারণে হলে দুটি অবস্থা হবে। প্রথমতঃ সন্দেহের সময় সঠিক
নির্ণয়ে প্রয়াস করতঃ তা নির্ণয় সম্ভব হবে। এমন হলে সালামের
পর সাজদায়ে সাহু করতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ তিন রাকাআত হল
কি চার? এমন হলে তৎক্ষণাৎ সে চেষ্টা চালাবে যে, আসলে কত
রাকাআত হল। যদি অনুমানের পাল্লা এক দিকে বেশী হয়,
তাহলে সেটিই গণনা করবে। তিনের দিকে মনটা বেশী হলে তিন
ধরবে আর চারের দিকে বেশী হলে চার ধরবে। এই
নিয়মকে ‘তাহার্রী’ বলে। দ্বিতীয়তঃ সন্দেহের পর
কোনো দিকেই অনুমানের পাল্লা বেশী হবে না। যেমন তিন হল
কি চার? দুই দিকেই বরাবর সন্দেহ। এমন হলে কম সংখ্যা গণনা করবে।
অর্থাৎ তিন রাকাআত ধরবে। এটাকে (আল বিনাউ আলাল্ ইয়াক্বীন)
ইয়াক্বীনে প্রতি ভিত্তি করা বলে। এমন হলে সাজদায়ে সাহু
সালামের পূর্বে করবে। এই মতানুসারে প্রায় সকল দলীলের
প্রতি আমল সম্ভব। এই মতটি আগের মতের তুলনায় বেশী ভাল ও
আমলের দিক দিয়ে ব্যাপক কারণ প্রথম মতানুযায়ী যে সব
স্থানে সাজদায়ে সাহু প্রমাণিত নেই সেই সব স্থানে ভুল
হলে নামাযী আগে বা পরে সাজদায়ে সাহু
করতে পারে মর্মে যা বলা হয়েছে তা কোনো দলীলের উপর
ভিত্তিশীল নয় কিন্তু দ্বিতীয় মতটি তিন ক্ষেত্রে, কম,
বেশী ও সন্দেহের সময় যে সমাধান দেওয়া হয়েছে তাতে যেমন
প্রমাণিত স্থানে সাজদায়ে সাহুর প্রতি আমল হয়, তেমন
অপ্রমাণিত স্থানে এই সব দলীলের আধারে সমাধান দেওয়া হয়।
[আল্লাহই ভাল জানেন]
৪-যে সব কারণে এবং স্থানে নবী (সাঃ) সাজদায়ে সাহু করেছেন,
তার বর্ণনাঃ
১- চার রাকাআতের স্থানে পাঁচ রাকাআত পড়া হলে তিনি (সাঃ)
সাজদায়ে সাহু সালামের পর করেছেন। আর
এটা হচ্ছে নামাযে বেশী হওয়ার উদাহারণ।
ﻋﻦ ﻋﺒﺪ ﺍﻟﻠﻪ ﺑﻦ ﻣﺴﻌﻮﺩ: ﺃﻥ ﺍﻟﻨﺒﻲ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭ ﺳﻠﻢ ﺻﻠّﻰ ﺍﻟﻈﻬﺮَ ﺧﻤﺴﺎ ﻓﻘﻴﻞ ﻟﻪ : ﺃﺯِﻳﺪَ ﻓﻲ
ﺍﻟﺼﻼﺓِ؟ ﻓﻘﺎﻝ : ﻭ ﻣﺎ ﺫﺍﻙ؟ ﻗﺎﻟﻮﺍ: ﺻﻠّﻴﺖَ ﺧﻤﺴﺎ، ﻓﺴﺠﺪ ﺳﺠﺪﺗﻴﻦ ﺑﻌﺪﻣﺎ ﺳﻠّﻢ. ﺭﻭﺍﻩ ﺍﻟﺠﻤﺎﻋﺔ .
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ হতে বর্ণিত, একদা নবী (সাঃ) যহরের
নামায পাঁচ রাকাআত পড়ালেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, নামায
কি বেশী করে দেওয়া হয়েছে? তিনি বললেনঃ এ প্রশ্নের কারণ?
সাহাবাগণ বললেনঃ আপনি পাঁচ রাকাআত পড়ালেন। তখন
তিনি দুটি সাজদা করলেন সালাম ফিরানোর পর”। [বুখারী, স্বালাত
অধ্যায়, অনুচ্ছেদ নং ৩২, হাদীস নং (৪০৪)/ মুসলিম, মাসাজিদ
অধ্যায়, নং (১২৮১)]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, এটা শুনার পর তিনি (সাঃ) তাঁর দুই
পায়ে বসলেন এবং কিবলামুখী হলেন। অতঃপর দুটি সাজদা করলেন
তারপর সালাম ফিলালেন”। [বুখারী, স্বালাত অধ্যায়, নং (৪০১)]
২- চার রাকাআতের স্থানে দুই রাকাআত পড়ে সালাম
ফিরালে কিংবা চার রাকাআতের স্থানে তিন রাকাত পড়ে সালাম
ফিরালে, নবী (সাঃ) বাকি রাকাআত সালামের পর পূর্ণ করেন
এবং সালাম ফিরান তারপর সাজদায়ে সাহু করেন। বাহ্যত
এটা নামাযে কম হওয়ার উদাহারণ মনে হলেও ঐ সকল
উলামা এটাকে নামাযে বেশী করার উদাহারণ মনে করেছেন,
যারা নামাযের কোনো কিছু বেশী হলে সালাম ফিরানোর পর
সাজদায়ে সাহু হবে বলে মত ব্যক্ত করেছেন। তাদের
মতে বর্তমান অবস্থায় সে নামায পূর্ণ করার পূর্বে সালাম
ফিরিয়েছে যা, মূলতঃ নামাযে বেশী করা। [শারহুল মুমতী,৩/৩৪১]
ক- আবু হুরাইরা (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, একদা আল্লাহর রাসূল
(সাঃ) আমাদের যহর কিংবা আসরের নামায পড়ালেন। তিনি দুই
রাকাআত পড়িয়ে সালাম ফিরালেন। [কিছু লোক
বলাবলি করতে লাগলো, নামায মনে হয় কম করে দেওয়া হয়েছে!]
লোকদের মধ্যে এক ব্যক্তি ছিল, যাকে যুল ইয়াদাঈন বলা হত।
সে নবী (সাঃ) কে বললঃ আপনি কি ভুলে গেলেন না নামায কম
হয়ে গেছে? তিনি (সাঃ) বললেনঃ না আমি ভুলেছি আর না কম
করা হয়েছে। অতঃপর তিনি (সাঃ) বাকি লোকদের বললেনঃ যুল্
ইয়াদাঈন কি ঠিক বলছে? তারা বললঃ হাঁ। অতঃপর তিনি (সাঃ)
বাকি নামায আদায় করলেন। তারপর সালাম ফিরালেন। তারপর তকবীর
দিলেন এবং তাঁর সাজদার মত সাজদা করলেন বা তার চেয়েও একটু
দীর্ঘ সাজদা। তারপর তাঁর মাথা উঠালেন এবং তকবীর দিলেন।
অতঃপর তকবীর দিয়ে সাজদা করলেন তাঁর সাজদার মত কিংবা তার
থেকেও একটু দীর্ঘ সাজদা। তারপর তাঁর মাথা উপরে উঠালেন
এবং তকবীর দিলেন। অতঃপর সালাম ফিরালেন”। [বুখারী, সাহু
অধ্যায়, নং১২২৯/মুসলিম, মাসাজিদ অধ্যায়, সাহু অনুচ্ছেদ,
নং ১২৮৮]
খ- ইমরান বিন হুসাঈন হতে বর্ণিত, একদা নবী (সাঃ) আসরের নামায
তিন রাকাআত পড়িয়ে সালাম ফিরান এবং নিজ বাসস্থানে প্রবেশ
করেন। অতঃপর খিরবাক নামক ব্যক্তি তাঁকে এটা অবগত
করালে তিনি (সাঃ) রাগান্বিত অবস্থায় বাসা থেকে বের
হয়ে লোকদের মাঝে উপস্থিত হলেন
এবং জিজ্ঞাসা করলেনঃ একি সত্য বলছে? তারা বললঃ হাঁ!
অতঃপর তিনি (সাঃ) এক রাকাআত নামায পড়লেন এবং সালাম
ফিরালেন। তারপর দুটি সাজদা করলেন এবং সালাম ফিরালেন”।
[মুসলিম, মাসাজিদ অধ্যায়, সাহু অনুচ্ছেদ, নং (১২৯৩)/আবু দাঊদ
নং (১০১৮) নাসাঈ নং (১২৩৬) ইবনু মাজাহ নং (১২১৫)]
৩- প্রথম তাশাহ্হুদ [চার রাকাআত বা তিন রাকাআত বিশিষ্ট
নামাযের দুই রাকাআত শেষে তাশাহ্হুদ] ছুটে গেলে,
নবী (সাঃ) সালামের পূর্বে সাজদায়ে সাহু করেন অতঃপর সালাম
ফিরান। এখানে নামাযের অংশ কম হওয়ায় সাজদায়ে সাহু সালামের
পূর্বে হবে।
আব্দুল্লাহ বিন বুহাইনা (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, একদা নবী (সাঃ)
তাদের যহরের নামায পড়ান। প্রথম দুই রাকাআত শেষে না বসেই
উঠে যান। লোকেরাও তাঁর সাথে উঠে পড়েন। যখন নামায শেষ হয়
এবং লোকেরা তাঁর সালাম ফিরানোর অপেক্ষা করতে লাগে,
তিনি (সাঃ) বসা অবস্থায় তকবীর দেন, সালামের
পূর্বে দুটি সাজদা করেন অতঃপর সালাম ফিরান”। [বুখারী, সাহু
অধ্যায়, নং (১২২৪-১২২৫)/নাসাঈ, নং (১১৭৬)]
উপরোক্ত অবস্থায় ইমাম যদি পুরোপুরি দাঁড়ানোর পূর্বে তাঁর
এই ভুল জানতে পারে, তাহলে বসে পড়বে। আর
পুরো দাঁড়িয়ে যাওয়ার পর জানতে পারলে বসবে না।
বরং সাজদায়ে সাহু করবে। [আবু দাঊদ, স্বালাত অধ্যায়, নং (১০৩৬)
ইবনু মাজাহ, নং (১২০৮)]
৪- নামাযের রাকাআত সংখ্যায় সন্দেহ হওয়ার পর কোনো এক
দিকে ধারনা প্রবল হলে, নবী (সাঃ) সাজদায়ে সাহু সালামের পর
করতে বলেছেন। যেমন কারো সন্দেহ হল, তিন রাকাআত হল কি চার?
অতঃপর অনুমান তিনের দিকে বেশী হল, তখন তা তিনই
ধরতে হবে এবং এই সন্দেহের কারণে সালামের পর সাজদায়ে সাহু
করতে হবে।
নবী (সাঃ) বলেনঃ “তোমাদের কেউ
নামাযে সন্দেহে পড়লে সে যেন সঠিক
নির্ণয়ে চেষ্টা করে এবং তা করে। অতঃপর সে যেন সালাম
ফিরায় এবং তার পর দুটি সাজদা করে”। [বুখারী, স্বালাত অধ্যায়,
নং (৪০১) মুসলিম, নং (১২৭৪)]
৫- নামাযের রাকাআত সংখ্যায় সন্দেহ হওয়ার পর কোনো এক
দিকে ধারনা প্রবল না হলে, কম সংখ্যা ধরতে হবে এবং এই রকম
ক্ষেত্রে সাজদায়ে সাহু সালামের পূর্বে হবে। যেমন
কারো সন্দেহ হল যে, দুই রাকাআত পড়েছে কি তিন? আর
কোনো দিকেই অনুমান বেশী হয় না। এমন ক্ষেত্রে কম
সংখ্যা গণনা করতে হবে অর্থাৎ দুই রাকাআত
ধরতে হবে এবং সালামের পূর্বে সাজদায়ে সাহু করতে হবে।
আবু সাঈদ খুদরী (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেছেনঃ “যখন
তোমাদের মধ্যে কেউ নামাযে সন্দেহে পড়বে আর
জানতে পারবে না যে, সে তিন রাকাআত পড়লো না চার রাকাআত,
তাহলে সে যেন সন্দেহকে প্রত্যাখ্যান করে আর
যাতে সন্দেহ নেই তার উপর ভিত্তি করে। অতঃপর সালামের
পূর্বে সে যেন দুটি সাজদা দেয়। যদি তার অবস্থা এমন হয় যে,
সে পাঁচ রাকাআত পড়েছে, তাহলে (সেই দুটি সাজদা) তার
নামাযকে জোড়া করে দিবে। আর যদি সে চার রাকাআত
পূরণার্থে পড়েছে, তাহলে সেই দুটি সাজদা শয়তানকে লাঞ্ছিত
করা স্বরূপ হবে”। [মুসলিম, মাসাজিদ অধ্যায়, নামাযে সাহু
অধ্যায়, নং ১২৭২/মুসনাদ আহমদ,৩/৭২]
উপরের বর্ণনাসমূহের সারাংশঃ
উপরে বর্ণিত হাদীস সমূহ থেকে নবী (সাঃ) এর যে সব
স্থানে সাহু হয়েছে, তার বিবরণ নিম্নরূপঃ
১- চার রাকাআতের স্থানে পাঁচ পড়েছেন এবং এমন সময়
তিনি (সাঃ) সাজদায়ে সাহু সালামের পর করেছেন।
২- চার রাকাআতের স্থানে দুই রাকাআত পড়ে সালাম ফিরিয়েছেন
অনুরূপ চার রাকাআতের স্থানে তিন রাকাআত পড়িয়ে সালাম
ফিরিয়েছেন এবং এই সময়ে তিনি (সাঃ) সালাম ফিরানোর পর
সাজদায়ে সাহু করেছেন।
৩- প্রথম তাশাহ্হুদ না পড়েই তৃতীয় রাকাআতের জন্য
উঠে পড়েছেন। এমতবস্থায় তিনি (সাঃ) সাজদায়ে সাহু সালামের
পূর্বে করেছেন।
৪ এবং ৫-নামাযের রাকাআত সংখ্যায় সন্দেহ হওয়া অতঃপর
কোনো এক সংখ্যার দিকে একীন হওয়া কিংবা না হওয়া। এই দুই
স্থানে তাঁর সাহু হয়েছে বলে প্রমাণ নেই কিন্তু তাঁর হাদীস
রয়েছে। সন্দেহের পর কোনো এক সংখ্যার দিকে অনুমান
বেশী হলে তিনি (সাঃ) সাজদায়ে সাহু সালামের পর
করতে বলেছেন। আর সন্দেহের পর দুই সংখ্যার কোনো দিকেই
একীন না হলে কম সংখ্যা ধরতে বলেছেন এবং এই সময় তিনি (সাঃ)
সাজদায়ে সাহু সালামের পূর্বে করতে বলেছেন।
তাই উপরোক্ত স্থানে সাহু হলে বর্ণনানুযায়ী সালামের
আগে বা পরে সাজদায়ে সাহু করা উত্তম। আর অন্য স্থানে সাহু
হলে দেখতে হবে সেই সাহু উপরোক্ত কোন্ সাহুর সাথে মিল
রাখে? অতঃপর সেই অনুযায়ী আগে বা পরে সাজদায়ে সাহু
করতে হবে। আর কেউ যদি তা নির্ণয় করতে সক্ষম না হয়,
তাহলে আগে বা পরে যে কোনো সময় সাজদায়ে সাহু করা বৈধ
হবে ইন্ শাআল্লাহু তাআ’লা।
৫-সাজদায়ে সাহু করার নিয়মঃ
সাজদায়ে সাহুর পূর্বে তকবীর দিয়ে ঐ
ভাবে দুটি সাজদা করতে হবে যেভাবে নামাযে সাজদা করা হয়। এই
সময় নামাযের সাজদার যা বিধান, তা এই সাজদায়েও প্রযোজ্য।
[উপরোক্ত দলীলগুলির আলোকে]
৬-ইমাম সাজদায়ে সাহু করলে মুক্তাদীদেরও সাজদায়ে সাহু
করতে হবে:
কারণ মুক্তাদীগণ ইমামের অনুসরণ করতে আদিষ্ট। কিন্তু ইমামের
পিছনে মুক্তাদীর সাহু হলে, মুক্তাদী পৃথক
ভাবে সাজদায়ে সাহু করবে না। এ বিষয়ে ইবনুল মুনযির ঐক্যমত
বর্ণনা করেছেন। [আল্ ইজমা, ইবনুল মুনযির, পৃ ৮]
৭-সাজদায়ে সাহুর জন্য ভিন্ন তাশাহ্হুদঃ
সাজদায়ে সাহুর পরে আবার আলাদা কোনো তাশাহ্হুদ নেই। এ
বিষয়ে ইমরান বিন হুসাইন থেকে যেই হাদীস আবু দাঊদ ও
তিরমিযীতে বর্ণিত হয়েছে যে, “একদা নবী (সাঃ) নামাযে সাহু
করেন এবং দুটি সাজদা করেন। অতঃপর তাশাহ্হুদ করেন তারপর
সালাম ফিরান”, তা অসংরক্ষিত বর্ণনা; বরং সংরক্ষিত সহীহ
বর্ণনায় (অতঃপর তাশাহহুদ করেন) শব্দটি নেই। উক্ত
শব্দটিকে বায়হাকী, ইবনু আব্দুল বার্র, ইবনু হাজার
এবং আলবানী (রাহেমাহুমুল্লাহ) ‘শায’ বলেছেন। অর্থাৎ সৎ
রাভির এমন বর্ণনা যা, তিনি তার থেকে অধিক সৎ বর্ণনাকারীর
বিপরীত বর্ণনা করেছেন।[ইরওয়াউল গালীল,২/১২৮]
প্রকাশ থাকে যে, তাহিয়্যা পড়ার পর এক দিকে এক সালাম
ফিরানোর পর সাজদায়ে সাহু করার কোনো সহীহ হাদীস পাওয়া যায়
না।
৮-একই নামাযে একাধিক সাহু হলে:
একাধিক সাজদায়ে সাহু নয়; বরং এক বার সাজদায়ে সাহু যথেষ্ট
হবে। নবী (সাঃ) এর সাহুতে একাধিক সাহু ঘটেছিল, যেমন রাকাআত
কম হওয়া, নামাযের পূর্বে সালাম ফিরিয়ে দেওয়া অতঃপর অন্যের
সাথে বাক্যালাপ করা, তার পরেও তিনি এক বারই সাজদায়ে সাহু
দেন।[বুখারী, সাহু অধ্যায়, নং১২২৯/মুসলিম, মাসাজিদ অধ্যায়,
সাহু অনুচ্ছেদ, নং ১২৮৮]
ইমাম ও মুক্তাদীর বিবিধ ভুল-ত্রুটি
আমরা এ পর্বে ইমাম ও মুক্তাদীর কিছু ভুল-
ত্রুটি সংক্ষিপ্তাকারে আলোচনা করবো ইন্ শাআল্লাহু
তা’আলা। এসব ভুলের মধ্যে অনেক ভুল এমন রয়েছে যা ছোট
প্রকারের কিন্তু তা থেকেও আমাদের সতর্ক থাকা উচিৎ যেন
আমরা পূর্ণ সওয়াবের অধিকারী হতে পারি এবং এ সব ভুল যেন
একটি স্বভাবে পরিণত না হয়।
১-ইমামের সুতরা ব্যবহার না করা।
ইমাম মসজিদে ইমামতি করুক বা মসজিদের বাইরে, যদি তার
সামনে দেয়াল, পিলার, লাঠি বা এই জাতীয় কোনো আড়
না থাকে তাহলে তাকে সুতরা করা প্রয়োজন। এ
সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আদেশ
ব্যাপক অর্থবোধক। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
বলেনঃ
“যখন তোমাদের কেউ নামায আদায় করবে, তখন সে যেন
সুতরা সামনে করে নামায আদায় করে এবং সুতরার নিকটবর্তী হয়,
তার ও সুতরার মাঝে কাউকে অতিক্রম করতে না দেয়।” [আবু দাঊদ,
ইবনু খুযায়মাহ (৮১৮) বায়হাক্বী ২/২৬৭]
২-চাঁদ-তারার নকশা আছে এমন জায়নামাযে নামায অবৈধ মনে করাঃ
কিছু লোক এই কারণে সেই সব জায়নামাযে নামায আদায় অবৈধ
মনে করে যে, মহান আল্লাহ চন্দ্র-সূর্যকে সাজদা করতে নিষেধ
করেছেন। কিন্তু এটা তাদের বুঝার ভুল। কারণ এসব
জায়নামাযে নামাযী চন্দ্র-
সূর্যকে সাজদা করে না বরং আল্লাহকে সাজদা করে। চন্দ্র-
সূর্যকে সাজদা করা আলাদা বিষয় আর চাঁদ-তারার উপর
সাজদা করা আলাদা বিষয়। যেমন মাটিকে সাজদা করা ভিন্ন বিষয় আর
মাটির উপর সাজদা করা ভিন্ন বিষয়। আমাদের ভাল করে জানা দরকার
যে, মহান আল্লাহ শুধু চাঁদ ও সূর্যকে সাজদা করতে নিষেধ
করেন নি বরং সকল সৃষ্টিকে সাজদা করতে নিষেধ করেছেন
এবং কেবল তাঁকে সাজদা করতে বলেছেন যিনি এসবের
সৃষ্টিকর্তা। হ্যাঁ, তবে এমন জায়নামাযে বা বিছানায় নামায
না পড়াই ভাল, যাতে নকশা ও কারুকার্য থাকে, যার ফলে নামাযীর
মনযোগে ব্যাঘাত ঘটে।
৩-কিবলামুখী হওয়ার গুরুত্ব না দিয়ে মাইক্রোফোনমুখী হওয়ার
গুরুত্ব বেশী দেওয়া।
লাউড স্পীকারে নামায পড়ান এমন অনেক ইমামকে দেখা যায়,
তারা ইমামতির সময় লাউড স্পীকার ও স্টান্ডকে সম্মুখে ও
নিকটে রাখার চেষ্টা করেন। আর এমন করতে গিয়ে অনেক সময়
তারা কিবলা থেকে বেঁকে যান, যা ভুল। কারণ
আমরা কিবলামুখী হয়ে দাঁড়াতে আদিষ্ট। স্বেচ্ছায় জেনে-
বুঝে কিবলা থেকে বেঁকে দাঁড়ানো অবশ্যই আদেশ উল্লংঘন।
আমাদের সোজা কিবলার দিকে দাঁড়ানো প্রয়োজন
তাতে মাইক্রোফোন সম্মুখে আসুক বা দূরে থাক। এ
ক্ষেত্রে ওয়্যারলেস বিশিষ্ট পকেট মাইক্রফোন ব্যবহার
করা হলে সমস্যার সমাধান হতে পারে।
৪-ইমাম ও মুক্তাদীর লাইন সোজা ও বরাবর না করা:
অনেক ইমামকে দেখা যায়, মুয়াজ্জিনের ইক্বামত শেষ
হওয়া মাত্রই তকবীরে তাহরীমা দিয়ে নামায শুরু করে দেন। আর
অনেকে সেই সময় লাইন সোজা করার কথা বললেও সোজা হল কি না,
তা ভ্রুক্ষেপ না করেই নামায আরম্ভ করে দেন।
অন্যদিকে অনেক মুক্তাদী এমনও আছে যারা এটাকে ইমামের
রুটিন মনে করে তাঁর কথার তোয়াক্কাই করে না;
বরং অনেককে দেখা যায়, তার সামনের লাইনে স্থান
খালি আছে তা সত্ত্বেও সেই স্থান পূরণ করে না।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেমন লাইন বরাবর করা,
পূর্ণ করা, মাঝে ফাঁক না রাখা এবং কাঁধে কাঁধ
মিলিয়ে দাঁড়ানোর আদেশ করতেন, তেমন তিনি ইক্বামতের পর
স্বয়ং লাইনের দিকে মুখ করে বরাবর হওয়ার আদেশ করতেন, অনেক
সময় লাইনের শেষে গিয়ে তাদের বরাবর করতেন। [বুখারী, আযান
অধ্যায়, নং ৭১৯, সহীহ ইবনু খুযায়মা নং ১৫৫১-১৫৫২]
৫-বিশেষ শব্দের মাধ্যমে বিভিন্ন নামাযের নিয়ত পড়াঃ
আরবী নিয়ত শব্দটির অর্থ, ইচ্ছা করা, মনস্থ করা। নিয়তের স্থান
অন্তর। মনে মনে মানুষ যা ইচ্ছা করে তাই তার নিয়ত।
তা সশব্দে নামায শুরু করার পূর্বে পড়া বা নিরবে বলা উভয়ই
একটি ভুল এবং তা দ্বীনের বিধান মনে করে করা বিদআত। এমন নিয়ত
করতে গিয়ে অনেকে ইমামের
পরে পরে তাকবীরে তাহরীমা না দিয়ে অনেকটা দেরীতে দেয়,
যা সুন্নার পরিপন্থী। আর অনেকে বিড় বিড় করে পড়ার
কারণে তার পাশের নামাযীকে কষ্ট দেয়। নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকবীরে তাহরীমার মাধ্যমে নামায শুরু
করতেন এবং অন্যকে তা দ্বারা শুরু করার আদেশ করতেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
নামাযে ভুলকারীকে শিক্ষা দেনঃ “যখন নামাযে দাঁড়াবে,
পূর্ণরূপে অযু করে নিবে, অতঃপর কিবলামুখী হবে, তারপর
তাকবীর দিবে, অতঃপর কুরআনের সহজতর যা তোমার মুখস্ত
আছে তা পড়বে”।[বুখারী, নং৭৯৩]
৬-তাকবীর বলার সময় আল্লাহু আকবার এর (বা–) টেনে পড়াঃ
আযান হোক বা নামায, এই সময় আল্লাহু আক্ বার বলার সময় (বা) টান
দিয়ে বলা নিষেধ। কারণ (বা) এ মাদ্দ দিলে অর্থ পাল্টে যায়।
বিনা মাদ্দে (আকবার) অর্থ সবচেয়ে বড় আর মাদ্দ সহকারে আকবা—
র অর্থ, তবলা। ইমাম আল্লাহু আক্ বা—র দীর্ঘ
করে বললে আরো একটি সমস্যা হয়ে থাকে, তা হলঃ ইমামের
তাকবীর শেষ হওয়ার পূর্বে অনেক মুক্তাদীর তাকবীর শেষ
হয়ে যাওয়া; কারণ মুক্তাদী তত দীর্ঘ করে বলে না। আর ইমামের
পূর্বে তাকবীর দেওয়া নিষেধ। বিষয়টি যদি তাকবীরে তাহরীমার
ক্ষেত্রে হয়, তাহলে নামায বাতিল হওয়ারও আশংকা থাকে।
[ইরশাদাত আন বা’যিল মুখালাফাত, সাদহান,পৃঃ ৯৬]
আবার কিছু ইমামকে দেখা যায় তারা বিশেষ বিশেষ স্থানের
তাকবীর টেনে বলেন আর বাকিগুলো সাধারণ ভাবে। যেমন
তাশাহ্হুদে বসার সময় কিংবা রুকূ থেকে উঠার সময়
কিংবা রুকূতে যাওয়ার সময়ের তাকবীর দীর্ঘ করেন আর
বাকিগুলো স্বাভাবিক; অথচ এমন পার্থক্য করার কোনো দলীল
নেই। তাই সব তাকবীর সাধারণতঃ বরাবর হবে এটাই সঠিক নিয়ম।
৭-তাকবীরে তাহরীমার সময় কান স্পর্শ করা এবং হাতের তালু
চিপের দিকে রাখাঃ
অনেক মুসাল্লীকে দেখা যায়, তারা নামায শুরু করার সময়
কানের লতি স্পর্শ করে; অথচ নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম কান স্পর্শ করতেন না বরং তাঁর হাতের
আঙ্গুল অনেক সময় বাহু বরার উঠাতেন আর অনেক সময় কান বরাবর।
যারা কানের লতি স্পর্শ করে, তারা আরো একটি ভুল করে তা হল,
কানের লতি ছোয়াঁর কারণে তাদের হাতের তালু কানের
দিকে থাকে; অথচ এই সময় নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাতের তালু কিবলামুখী থাকতো। [আবু
দাঊদ (৭৭৫) তিরমিযী (২৪২) মুসলিম (৩৯৮)]
৮-এমন বিশ্বাস রাখা যে, মুয়াজ্জিন ব্যতীত অন্য কেউ ইকামত
দিতে পারে না:
এ সম্পর্কে বর্ণিত হাদীস “যে আযান দিবে সেই ইক্বামত দিবে”
খুবই যয়ীফ। [সিলসিলা যয়ীফা নং (৩৫)] নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মুয়াজ্জিনকে ইক্বামত দেয়ার আদেশ
করলে সে ইক্বামত দিত। তাই ইমাম মুয়াজ্জিনকে যখন ইক্বামত
দেওয়ার আদেশ করবেন, তখন সে ইক্বামত দিবে। আর মুয়াজ্জিনের
অনুপস্থিতিতে ইমাম যাকে ইক্বামত দিতে বলবেন, সেই ইক্বামত
দিতে পারে।
৯-নামাযে কিরাআত, দুআ ও যিকর পড়ার সময়
জিহব্বা না নাড়িয়ে মনে মনে পড়াঃ
অনেকে একাকি কিংবা ইমামের পিছনে নামায পড়ার সময়, কিরাআত,
তাকবীর, রুকু-সাজদা সহ অন্যান্য স্থানের দুআ সমূহ
মনে মনে পড়ে, যেন নামায কিছু কাজের নাম মুখে কিছু পড়ার নয়।
জিহব্বা ও ঠোঁট না নাড়িয়ে মনে মনে কিছু বলা বা করার
ইচ্ছা করা, সেটা অবৈধ কিছু হলেও আল্লাহ তাআলা তা পাকড়াও
করবেন না। নবী (সাঃ) বলেনঃ “আল্লাহ তাআ’লা আমার
উম্মতকে ক্ষমা করেছেন, যা তাদের অন্তর বলে”। [হাদীস সহীহ,
দেখুন ইরওয়াউল গালীল নং ২০৬২] তাই মনের কথা শরীয়ার
দৃষ্টিতে অবিবেচ্য। আর এমন হলে নামাযে মনে মনে সূরা, দুআ ও
যিকর পাঠকারীর আমলও অধর্তব্য।
১০-ইমামের পিছনে মুক্তাদীদের তাকবীর, রাব্বানা ওয়ালাকাল্
হাম্দ সহ ইত্যাদি দুআ-যিকর সশব্দে পড়াঃ
ইমামের পিছনে মুক্তাদীদের অবস্থা হচ্ছে সিররী অবস্থা।
অর্থাৎ সূরা ফাতিহা সহ ইত্যাদি দুআ-যিকর নিরবে পাঠ করা। এসব
সশব্দে পাঠ করা যেমন ভুল তেমন এমন করলে ইমাম সহ অন্যান্য
মুক্তাদীদের খুশু-খুযুতে ব্যাঘাত ঘটে ও
জটিলতা সৃষ্টি হয়। এ ক্ষেত্রে কোনো সাহাবীর নির্দিষ্ট
স্থানে সরবে কিছু পড়া একটি খাস বা নির্দিষ্ট ঘটনা, তা সাধারণ
ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
১১-নামাযে চোখ বন্ধ রাখা কিংবা আকাশের দিকে দেখাঃ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাযের সময় তাঁর
চক্ষু বন্ধ রাখতেন না; বরং তাশাহ্হুদের সময় তাঁর
দৃষ্টি শাহাদাত (তর্জনী) অঙ্গুলির
দিকে থাকতো এবং দন্ডায়মান অবস্থায় সাজদার স্থানে থাকতো।
অনুরূপ তিনি নামাযের সময় আকাশের দিকে তাকাতে কঠোর
ভাবে নিষেধ করতেন। অনেকে নামাযে একাগ্রতা সৃষ্টির জন্য
এমন করে থাকে, যা সুন্নত বিরোধী। [আল্ কাউলুল মুবীন
ফী আখত্বাইল মুসাল্লীন, পৃঃ ১১০-১১২]
১২-ঝটকা দিয়ে রুকূতে যাওয়া এবং ঝটকা দিয়ে রুকূ
থেকে উঠাঃ
অনেকে রুকূ করার সময় শরীরে একটা ঝটকা দিয়ে দ্রুত
গতিতে রুকূতে যায় এবং এই সময় রুকূ অবস্থায় তার শরীরে কম্পন
থাকে। দুই তিনবার কম্পনের পর তার শরীর স্বাভাবিক অবস্থায়
ফিরে আসে। অনুরূপ সাজদা ও সাজদা থেকে উঠার সময় এবং সালাম
ফিরানোর সময় অনেককে এমন করতে দেখা যায়,
যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামাযের
পদ্ধতির বিপরীত। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
রুকূ সাজদায় যাওয়ার সময় স্বাভাবিক ভাবে যেতেন, না দ্রুত
যেতেন আর না অতি ধীর গতিতে।
১৩-সূরা ফাতিহা কিংবা সূরা ফাতিহার পর অন্য সূরা পাঠ শেষ
করার পূর্বেই হাত ছেড়ে দেওয়া। এসময় সূরা-কিরাআত শেষ হওয়ার
পর হাত ছাড়া উচিৎ।
১৪-ইমাম যখন ‘সামিআল্লাহুলিমান হামিদাহ’ বলেন, তখন
মুক্তাদীদের অনেকে শুধু ‘রব্বানা ওয়ালাকাল্ হামদ’
বলে থাকে; অথচ ইমাম ও মুক্তাদী উভয়কে সামিআল্লাহু…
এবং রাব্বানা ওয়া… বলা দরকার। [তামামুল্ মিন্নাহ, পৃঃ ১৯০-১৯১]
১৫-রুকূ-সাজদায় স্থীর না হওয়া অনুরূপ রুকূ-
সাজদা থেকে উঠে বরাবর হয়ে স্থীরতা অবলম্বন না করা:
মনে রাখা দরকার এদুটি নামাযের রুকন তা না করলে নামায বাতিল
হওয়ার সম্ভাবনা আছে। নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামায ভুলকারীকে রুকু-সাজদায় স্থীর
হতে বলেন এবং উভয় স্থান থেকে উঠেও স্থীর হতে বলেন
এবং তার পরে নামাযের পরের কাজটি করতে আদেশ করেন। [বুখারী,
নং৭৫৭ মুসলিম নং ৩৯৭]
১৬-সাজদার সময় সাতটি অঙ্গ মাটিতে না রাখাঃ
সাজদার সাতটি অঙ্গ হচ্ছে যথাক্রমে কপাল সহ নাক, দুই হাত, দুই
হাঁটু এবং দুই পার সামনের পাতা। অনেকে কপাল
মাটিতে রাখে কিন্তু নাক রাখে না। আর অনেকে সাজদার সময় দুই
পা মাটি থেকে উপরে রাখে কিংবা এক পা আর এক পার উপর রাখে,
যা বড় ভুল। এই সময় উপরোক্ত সাতটি অঙ্গের মাধ্যমে সাজদা হবে।
নবী (সাঃ) বলেনঃ “আমাকে আদেশ করা হয়েছে, যেন
আমি সাতটি অঙ্গের উপর সাজদা করি”। [মুসলিম নং ৪৯১,
তিরমিযী নং ২৭২] অন্য বর্ণনায় সাতটি হাড়ের কথা এসেছে।
১৭-সাজদার পদ্ধতিতে ভুল করাঃ
সাজদা যেমন সাতটি অঙ্গের উপর হবে, তেমন সাজদার সময় দুই ঊরু
থেকে পেট পৃথক থাকবে, দুই বাহু পার্শ্বদেশ থেকে যথাসম্ভব
দূরে থাকবে, হাতের জঙ্ঘা (হাতের কুনুই
থেকে কব্জি পর্যন্ত অংশ)
মাটি থেকে উপরে থাকবে মাটিতে বিছানো থাকবে না এবং দুই
হাতের তালু দুই কাঁধ বা দুই কান বরাবর থাকবে। দুই পায়ের পাতার
সামনের ভিতরের অংশ মাটিতে ঠেকে থাকবে,
গোড়ালি সম্মিলিত ভাবে উপরে থাকবে এবং আঙ্গুলসমূহ
কিবলামুখী থাকবে। [বিস্তারিত দেখুন,আল্ কাউলুল মুবীন,
ফী আখত্বাইল মুস্বাল্লীন, মাশহূর হাসান, নং১৩৭-১৩৮]
১৮-অসুস্থতা কিংবা অন্য
কারণে নামাযী মাটিতে সাজদা করতে অক্ষম হলে, বালিশ, টেবিল
বা উঁচু কিছুতে সাজদা করাঃ
নামাযী কোনো কারণে যদি সরাসরি মাটিতে কপাল
ঠেকিয়ে সাজদা করতে না পারে, তাহলে সে কোনো উঁচু যিনিস
যেমন বালিশ, কাঠ, টেবিল কিংবা অন্য কিছুতে সাজদা করবে না;
বরং যতটা পারবে সাজদার জন্য ঝুকবে এবং ইশারায় সাজদা করবে।
আর রুকূ অপেক্ষা সাজদায় বেশী ঝুকবে। [ত্বাবারানী, সূত্র
সহীহ, দেখুন সিলসিলা সহীহা নং (৩২৩)]
১৯-তাওয়াররুক ও ইফতিরাশে ভুল করা:
ইফতিরাশ হল, দুই রাকাআত বিশিষ্ট নামাযে তাশাহ্হুদে বসার সময়
ডান পা খাড়া রাখা এবং বাম পায়ের উপর বসা। আর তাওয়াররুক
হচ্ছে তিন বা চার রাকাআত বিশিষ্ট নামাযের শেষ বৈঠকে ডান
পা খাড়া রেখে বাম পা ডান পায়ের জঙ্ঘার মাঝ দিয়ে বের
করে দিয়ে নিতম্বের ভরে বসা। এই আমল অনেকে করেই না। আর
অনেকে প্রথম তাশাহ্হুদে কিংবা দুই রাকাআত বিশিষ্ট
নামাযের শেষ তাশাহ্হুদে তাওয়াররুক করে; অথচ এটা তিন বা চার
রাকাআত বিশিষ্ট নামাযের শেষ বৈঠকে হবে। [হাদীস আবু হুমাইদ,
বুখারী, নং (৮২৮)]
২০-লম্বা স্বরে সালাম ফিরানোঃ
সালাম ফিরানোর সময় স্বাভাবিক নিয়মে সালাম
ফিরানো সুন্নাত। এই সময় অনেকে সালামের কোনো শব্দ যেমন
(আস্ সালা–মু) বা (বারাকা–তুহূ) দীর্ঘ স্বরে টেনে পড়ে। এই
রকম টেনে বলার কারণে অনেক সময় মুক্তাদী ইমামের
পূর্বে সালাম ফিরিয়ে দেয় নচেৎ ইমামের পূর্বে তার সালাম
উচ্চারণ সমাপ্ত হয়ে যায়, যা অবশ্যই সুন্নাহ বিরোধী কাজ,
যেটা ইমামের দীর্ঘ স্বরে সালাম ফিরানোর কারণে হয়ে থাকে।
২১-সালামের পর মুসাফাহা করাঃ
অনেকে ফরয নামাযের সালামের পর তার ডান-বাম পাশের মুসল্লীর
সাথে মুসাফাহ করে, যা একটি নতুন আমল। নবী করীম
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর সাহাবাগণ
থেকে নামাযের সালাম শেষে মুসাফাহা করা প্রমাণিত নয়।
অনেকে আবার বিশেষ করে ফজর ও আসর নামাযান্তে এমন
করে থাকে। উল্লেখ্য যে, দূর থেকে আগত ব্যক্তির জন্য
এটা সুন্নাহ যে, সে মুসলিম ভাইর সাথে সালামের পর
মুসাফাহা করবে। তাই এমন ব্যক্তি হলে সে পাশের নামাযীর
সাথে মুসাফাহা করতে পারে; নচেৎ না।[আল্ ইরশাদাত আন্ বা’যিল
মুখালাফাত/১২০] এই মুসাফাহা করতে গিয়ে অনেকে নামাযীর
যিকর ও তাসবীহ কাজে ব্যাঘাত ঘটায়।
২২-আঙ্গুলের গিরা ছেড়ে তসবীহ দানায় তাসবীহ পাঠঃ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ডান হাতে তাসবীহ
পাঠ করতেন। [আবু দাঊদ নং (১৫০২) তিরমিযী নং (৩৪৮৪)]
এবং তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আঙ্গুলের
গিরায় তাসবীহ পাঠ করার আদেশ দেন
এবং বলেনঃ সেগুলোকে কথা বলানো হবে।”। [আবু দাঊদ
নং (১৫০১) হাদীসটিকে হাকেম ও যাহাবী সহীহ বলেছেন, নভবী ও
আসক্বালানী হাসান বলেছেন এবং আলবানী যয়ীফ বলেছেন] শাইখ
আলবানী (রহ) বলেনঃ“ তসবীহ দানায় তাসবীহ পড়ার মন্দসমূহের
মধ্যে একটিই যথেষ্ট যে, এই নিয়ম
আঙ্গুলে গুণে গুণে তাসবীহ পড়ার সুন্নতকে শেষ
করে দিয়েছে কিংবা প্রায় শেষ করে দিয়েছে”।
[সিলসিলা যয়ীফা,১/১১৭]
২৩-ইমামের সাথে একজন মুক্তাদী থাকলে ইমামের একটু
আগে অবস্থান করাঃ
এ সম্পর্কে সহীহ নিয়ম হচ্ছে, ইমাম ও মুক্তাদী উভয়ে এক অপরের
বরাবর দাঁড়াবে। ইমাম একটু আগে অবস্থান করবে না আর
না মুক্তাদী ইমামের একটু পিছনে দাঁড়াবে। ইমাম বুখারী এ
সম্পর্কে এক অনুচ্ছেদ রচনা করেনঃ (অনুচ্ছেদ, দুই জন
হলে মুক্তাদী ইমামের ডান পাশে তার বরাবর দাঁড়াবে) [বুখারী,
আযান অধ্যায়, অনুচ্ছেদ নং ৫৭, হাদীস নং ৬৯৭] অতঃপর
ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) এর ঐ ঘটনা উল্লেখ করেন, যাতে তিনি তার
খালা উম্মুল মুমেনীন মায়মূনা (রাযিঃ) এর নিকট রাত অতিবাহিত
করেন এবং রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর
সাথে কিয়মুল লাইল আদায় করেন। মুসনাদ আহমদে বিষয়টি আরোও
স্পষ্ট এসেছে। [দেখুন, সিলসিলা সহীহা, নং (৬০৬)]
২৪-নফল স্বালাত আদায়কারীর সাথে কেউ ফরয আদায় করার ইচ্ছায়
তার সাথে শরীক হলে, নফল আদায়কারীর তাকে হাত
দ্বারা বা ইশারা-ইঙ্গিতে সরিয়ে দেওয়া। এটি ভুল।
২৫-নামায অবস্থায় হাই আসলে তা অপসারণের চেষ্টা না করাঃ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
“যদি তোমাদের কেউ নামাযে হাই তোলে, তাহলে সে যেন
যথা সম্ভব তা চেপে রাখে; কারণ শয়তান প্রবেশ করে”। [আহমদ,
মুসলিম নং২৯৯৫]
চেপে রাখার নিয়ম হবে, সে যেন তার হাত মুখে রাখে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
“যদি তোমাদের কেউ হাই তোলে, তাহলে সে যেন তার হাত
মুখে দেয়”। [মুসলিম, নং২৯৯৫]
২৬-ফরয নামাযান্তে ইমাম ও মুক্তাদীদের সম্মিলিতভাবে দুআ
করা।
এছাড়াও ইমাম ও মুক্তাদীদের অনেক ভুল-
ত্রুটি নামাযে ঘটে থাকে। কিন্তু এ স্থানে সব ভুলের
আলোচনা সম্ভব নয়। তাই এই বিষয়ের এখানেই সমাপ্তি ঘটানো হল।
তাছাড়া আমাদের ধারাবাহিক পর্বে বিভিন্ন
স্থানে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরো অনেক ভুল-ভ্রান্তির
আলোচনা হয়েছে। আল্লাহর কাছে দুআ করি তিনি যেন আমাদের
সঠিক সুন্নাহ অনুযায়ী নামায আদায় করার তাওফীক দেন
এবং তা কবূল করেন। আমীন।
ফরয নামাযান্তে ইমাম ও মুক্তাদীদের হাত তুলে সম্মিলিত
ভাবে দুয়া করা
আল্ হামদু লিল্লাহি রাব্বিল্ আলামীন, ওয়াস্ স্বালাতু
ওয়াস্ সালামু আলা রাসূলিহিল কারীম। আম্মা বাদঃ
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিষয়টি বহু প্রাচীন এবং এ
সম্পর্কে বিগত উলামাগণ যথেষ্ট লেখা-লেখি ও করেছেন।
কিন্তু যেহেতু বিষয়টির সম্পর্ক আমাদের আলোচ্য বিষয় ইমাম ও
ইমামতির সাথে রয়েছে তাই কিছু আলোচনা করা সঙ্গত মনে করছি।
ওয়া মা তাওফীকী ইল্লা বিল্লাহ।
১-সমাজের সাধারণ লোকদের এই দুয়া সম্পর্কে ধারণাঃ
যেই সমাজে এই দুয়ার প্রথা রয়েছে সেখানকার লোকেরা এই
দুয়া সম্পর্কে যে ধারণা ও বিশ্বাস রাখে তার সামান্য
বর্ণনা নিম্নে তুলে ধরলাম।
যেখানে এই দুয়ার প্রথা চালু
আসে সেখানে কোনো কারণে কাউকে যদি ইমামতি করতে হয়
এবং ইমাম সালাম শেষে দুয়া না শুরু করে, তাহলে পিছনের
মুসল্লারা দুয়ার অপেক্ষায় থাকে। অনেক সময় মুক্তাদীদের
কেউ আদেশ কিংবা আবেদনের সুরে বলেই দেয়, দুয়া করে দিন।
ভাবটা এমন যে, এই দুয়া তারা নিজে করতে পারে না ইমামের
নেতৃত্বেই করতে হবে এবং এই কাজ ব্যতীত যেন তাদের নামায
শেষ হয় নি, তাই তারা সমাপ্ত করার উদ্দেশ্যে অপেক্ষায়
রয়েছে।
অনেক স্থানে কোনো ইমাম নিয়মিত দুয়া না করার
কারণে ইমামতি হারায়। অর্থাৎ আপনি এই সম্মিলিত
দুয়াকারী হলেই তাদের ইমাম হতে পারেন; নচেৎ নয়। তাদের এই
আচরণে এটাই প্রকাশ পায় যে, তারা এই কাজকে খুবই গুরুত্ব দেয়
এবং তা না করলে তার পিছনে নামায আদায় করে না।
অতঃপর দুয়া না করে কোনো ইমাম যদি সুন্নত নামায শুরু
করে দেয় কিংবা মসজিদ থেকে বেরিয়ে যায় তাহলে শুরু হয়
মন্তব্যের পর মন্তব্য। এটা কেমন ইমাম নামাযের পর মুনাজাতই
করলো না! একে কে ইমাম বানালো? দুয়া করা কি অপরাধ?
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি দুয়া করতেন না?
আল্লাহ তাআলা কি কুরআনে দুয়া করতে বলেন নি?
দুয়া করলে ক্ষতিটা কি? কেউ আবার উপমা পেশ করে বলেঃ এই
ইমাম ভাত খাওয়ালো কিন্তু পানি খাওয়ালো না।
ইত্যাদি মন্তব্য যার অনেকেটা অবান্তর ও বিরক্তকরও বটে।
কোথাও আবার বাহ্যত সম্মিলিত দুয়ার প্রথা নেই কিন্তু
কৌশলে সেই প্রথা জিইয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। তাই কেউ
ফরমাইশ করে বলেঃ অমুক সমস্যা রয়েছে, তমুক অসুস্থ, কিছু
না পেলে সবসময়ের সমস্যা উল্লেখ করে বলেঃ বর্তমান
বিশ্বে মুসলিমদের অবস্থা শোচনীয় তাই দুয়া করে দিন। কেউ
যেন তাদের শিক্ষা দিয়েছে যে এমনি এমনি এই রকম দুয়া ঠিক নয়
কিন্তু ফরমাইশী দুয়া (আবেদনের দুয়া) ঠিক আছে।
যাই হোক উপরোক্ত সকলের কথা ও ভাবে এটা স্পষ্ট হয় যে,
তারা এই দুয়ার একটি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
অনেকে এটাকে নামাযের একটি অংশও মনে করে থাকে,
তা না করলে নামাযের ঘাটতি মনে করে। কম পক্ষে বলতে পারেন,
তারা এমন করাকে ভাল মনে করে।
এখন প্রশ্ন হল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি এমন
করতেন; অথচ তিনি নামায ফরয হওয়ার পর সারা জীবন ইমামতি করেছেন?
এমন করার প্রথা কোনো সাহাবী কি বর্ণনা করেছেন; অথচ
তারা বহু সংখ্যায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর
অনুকরণে তাঁর পিছনে নামায আদায় করেছেন? এমন একটি ইবাদত
যা দিন-রাতে পাঁচবার আদায় করা হয়, তাতে এমন দুয়ার নিয়ম
থাকলে তাঁরা কি বর্ণনা করতেন না? আর যদি এই নিয়মেই না থাকে,
তাহলে আমাদের এমন করা দ্বীনে নতুল আমল সৃষ্টি করা নয় কি?
২-সালাম শেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
যা করতেনঃ
মহান আল্লাহ বলেনঃ (যখন তোমরা নামায আদায় করে নিবে, তখন
দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে আল্লাহর যিকর করবে) [সূরা নিসা/১০৩]
অনুরূপ মহান আল্লাহ গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত শেষে তাঁর যিকর
করার আদেশ করেন। যেমন রামাযানের সিয়াম
শেষে [সূরা বাকারাহ/১৮৫] এবং হজ্জ সম্পাদন শেষে।
[বাকারাহ/২০০]
তাই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামায
শেষে বেশী বেশী যিকর-আযকার করতেন, যার বিস্তারিত
বর্ণনা হাদীসের গ্রন্থসমূহে এবং সীরাতে বর্ণিত হয়েছে।
দ্বীনের সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম বিষয়ের বিশিষ্ট গবেষক বাকর আবু
যাইদ (রাহেঃ) বলেনঃ ‘ফরয নামাযের সালামের পর সুন্নত হচ্ছে,
কতিপয় যিকর সামান্য সশব্দে করা সমূহ যিকর সশব্দে নয়, দুয়া করা,
কুরআনুল কারীম থেকে যা বর্ণিত তা পাঠ করা… এবং সুন্নত
হচ্ছে প্রত্যেক মুসল্লীর নিজে নিজে এসব করা’।
[তাস্বহীহুদ্দুআ/৪৩৮] অতঃপর তিনি সহীহ বর্ণনার
আলোকে সেগুলি তুলে ধরেন।
উল্লেখ্য যে, যিকর এমন শব্দ ও
বাক্যকে বলে যা দ্বারা আল্লাহর মহত্ব, বড়ত্ব এবং তাঁর
গুণগান করা হয়। আর দুয়া এমন শব্দ বা বাক্যকে বলা হয়, যার
মাধ্যমে আল্লাহকে ডাকা হয়, তাঁর নিকট প্রার্থনা করা হয়, তাঁর
কাছে আবেদন করা হয়। কোনো কোনো সময় দুটি এক অপরের অর্থেও
ব্যবহৃত হয়।
ক-নামায শেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
থেকে প্রমাণিত যিকরের বর্ণনাঃ (সংক্ষিপ্তাকারে)
তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সালাম ফিরানোর পর
তিন বার ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ বলতেন। অতঃপর বলতেনঃ “
আল্লাহুম্মা আনতাস্ সালাম ওয়া মিনকাস্ সালাম,
তাবারাকতা ইয়া যাল্ জালালি ওয়াল্ ইকরাম”। [সহীহ মুসলিম,
মাসাজিদ অধ্যায় নং ৫৯১] তিনি সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই সময় কিবলামুখী হয়ে প্রায় ততক্ষণ
থাকতেন যতক্ষণ উপরোক্ত যিকর বলতে সময় লাগে। তার পর
মুসাল্লীদের দিকে মুখ করে ফিরে বসতেন। [যাদুল্
মাআ’দ,১/২৯৫]
সহীহাইনের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামায শেষ করার পর
বলতেনঃ “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্ দাহু লা শারীকা লাহু,
লাহুল্ মুলকু ওয়ালাহুল্ হামদু ওহুআ আলা কুল্লি শায়ইন্
ক্বাদীর। আল্লাহুম্মা লা মানিআ লিমা আ’ত্বায়তা ওয়া লা-
মুত্বিয়া লিমা মানা’তা, ওয়ালা ইয়ানফাউ যাল্ জাদ্দি মিনকাল্
জাদ্দু”। [বুখারী, নামাযের নিয়ম অধ্যায়, নং ৮৪৪/মুসলিম, নং ৫৯৩]
আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর (রাযিঃ) বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক নামাযের শেষে যখন সালাম
ফিরাতেন, তখন এই বাক্যগুলি বলতেনঃ “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু
ওয়াহ্দাহু লা শারীকা লাহু, লাহুল্ মুলকু, ওয়া লাহুল্ হামদু
ওয়া হুআ আলা কুল্লি শায়ইন ক্বাদীর।
লা হাওলা ওয়ালা কুওআতা ইল্লা বিল্লাহ।
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ … ওয়া লাও কারিহাল কাফিরূন” পর্যন্ত।
[সহী মুসলিম, মাসাজিদ অধ্যায়, নং ৫৯৪]
অতঃপর তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৩৩ বার
সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আল্ হামদুলিল্লাহ, ৩৩ বার আল্লাহু
আকবার এবং ১০০ পূরণে বলতেনঃ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু
ওয়াহ্দাহূ, লা শারীকা লাহু, লাহুল মুলকু, ওয়ালাহুল্ হামদু,
ওয়া হুআ আলা কুল্লি শায়ইন ক্বাদীর। [মুসলিম, মাসাজিদ অধ্যায়,
নং ৫৯৭] এই তাসবীহ পাঠের আরো ৫টি পদ্ধতি প্রমাণিত। [দেখুন,
তাস্বহীহুদ দুয়া পৃঃ ৪৩২ এবং যাদুল মাআদ, ১/২৯৮-২৯৯]
খ-নামায শেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
কর্তৃক কুরআনের কিছু অংশ ও সূরা পড়ার বর্ণনাঃ
আয়াতুল্ কুরসী পাঠ করাঃ নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “যে ব্যক্তি প্রত্যেক নামাযের
পশ্চাদে আয়াতুল্ কুরসী পাঠ করবে, তার জান্নাতে প্রবেশ
করা থেকে মৃত্যু ব্যতীত কোনো কিছু বাধা হবে না” [নাসাঈ,
নং ৯৯২৮, তারগীব ও তারহীব, ২/২৬১, ইবনু হিব্বান]
সূরা ইখলাস, সুরা ফালাক্ব এবং সূরা নাস পাঠ করাঃ উক্ববা বিন
আমের থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমাকে রাসুল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশ করেছেন যেন
আমি প্রত্যেক নামাযের পশ্চাদে মুআব্বিযাত (আশ্রয় চাওয়ার
সূরাসমুহ যথাক্রমে ইখলাস, ফালাক্ব ও নাস) পাঠ করি। [মুসনাদ
আহমদ ৪/২১১, আবু দাঊদ নং (১৫২৩), ইবনু হিব্বান (২৩৪৭),
তিরমিযী (২৯০৫) তবে তাতে কেবল সূরা নাস ও ফালাক উল্লেখ
হয়েছে]
গ-নামাযান্তে সালামের পর নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে দুয়ার প্রমাণঃ
আবু উমামাহ থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে জিজ্ঞাসা করা হয়ঃ কোন্
দুয়া বেশী কবূল হয়? তিনি সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “রাতের শেষাংশে এবং ফরয
নামাযের পশ্চাদে।”। [তিরমিযী, অধ্যায় দাআওয়াত, অনুচ্ছেদ
নং ৭৯, হাদীস নং (৩৪৯৯] হাদীসটিকে স্বয়ং ইমাম তিরমিযী হাসান
বলেছেন এবং শাইখ আলবানীও হাসান বলেছেন]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুয়ায (রাযিঃ)
কে অসিয়ত করেন, সে যেন প্রত্যেক নামাযের
পশ্চাদে বলেঃ “আল্লাহুম্মা আইন্নী আলা যিকরিকা ওয়া
শুকরিকা ওয়া হুসনি ইবাদাতিকা”। অর্থঃ হে আল্লাহ! আপনার
যিকর, আপনার কৃতজ্ঞতা এবং আপনার উত্তম ইবাদত
করতে আমাকে সাহায্য করুন। [আবু দাঊদ, স্বালাত অধ্যায়,
ইস্তিগফার অনুচ্ছেদ নং (১৫২২), নাসাঈ, সূত্র সহীহ, ইবনু
হিব্বান (২৩৪৫)] উল্লেখ্য যে, মুআয (রাযিঃ) কে অসিয়তকৃত
বাক্যগুলি দুয়া’র বাক্য।
আবু দাঊদ সহীহ সূত্রে আলী বিন আবী ত্বালিব (রাযিঃ)
হতে বর্ণনা করেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
যখন নামাযে সালাম ফিরাতেন, তখন বলতেনঃ “আল্লাহুম্মাগ্
ফির্ লী মা কাদ্দাম্তু ওয়া মা আখ্খারতু, ওয়া মা আসরারতু,
ওয়া মা আ’লানতু, ওয়া মা আসরাফতু, ওয়া মা আন্তা আ’লামু
বিহী মিন্নী, আন্তাল্ মুকাদ্দিমু ওয়া আন্তাল্ মুআখ্
খিরু, লা ইলাহা ইল্লা আন্তা”। [আবু দাঊদ, স্বালাত অধ্যায়,
অনুচ্ছেদঃ সালাম ফিরানোর পর মানুষ যা বলবে, সূত্র সহীহ,
তিরমিযী দাআওয়াত নং (৩৪১৯)] অর্থঃ “হে আল্লাহ! আমি যে সব
গুনাহ অতীতে করেছি, পরে করেছি, গোপনে করেছি,
প্রকাশ্যে করেছি, সীমালঙ্ঘনে করেছি, তা তুমি মাফ করে দাও।
মাফ করে দাও আমার সেই সব গুনাহ যা তুমি আমার
অপেক্ষা বেশী জানো, তুমি যা চাও আগে কর এবং যা চাও
পিছে কর, তুমি ছাড়া উপসনাযোগ্য কোনো সত্য মা’বূদ নেই”।
ইবনুল ক্বায়্যিম (রাহেঃ) উপরোক্ত দুয়াটির সম্পর্কে সহীহ
মুসলিমের বরাতে বলেনঃ মুসলিমের বর্ণনানুযায়ী দুটি শব্দ
এসেছে। এক, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
এটা তাশাহ্হূদ ও সালামের মাঝে বলতেন। দুই, সালামের পর
বলতেন। অতঃপর তিনি উভয়ের সমন্বয় করতঃ বলেনঃ মনে হয়,
তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উভয় স্থানে বলতেন।
[যাদুল মাআদ,১/২৯৭]
ইমাম বুখারী কিতাবুত্ দাআওয়াতে, নামাযের
পরে দুয়া করা শিরোনামে অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন
এবং বুখারীর ভাষ্যকার ইবনু হাজার এই অনুচ্ছেদ
সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেছেনঃ এই অনুচ্ছেদ তাদের খণ্ডন
করে, যারা মনে করে যে, নামাযের পর দুয়া করা বৈধ নয়। [ফাতহুল
বারী,১১/১৫৯]
উপরোক্ত দলীল-প্রমাণের আলোকে আমরা এ
সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, ফরয নামাযে সালামের পর
দুয়া করা বৈধ। কিন্তু তা হাত তুলে করতে হবে না সম্মিলিত
ভাবে করতে হবে, এর প্রমাণ উপরোক্ত দলীল সমূহে উল্লেখ হয়
নি।
উল্লেখ্য যে, ইমাম ইবনু তাইমিয়া হাদীসে উল্লেখিত শব্দ
(দুবুরুস্ স্বালাত) নামাযের
পশ্চাদে দুয়া করা বলতে নামাযের শেষাংশে সালামের
পূর্বে তাশাহ্হুদে দুয়া করা মনে করেছেন। অর্থাৎ ঐসকল
দুয়া নামাযের ভিতরে হবে নামাযের পরে নয়। তাঁর মন্তব্য হল,
দুবুর (পশ্চাদ) শব্দটি কবুল (সম্মুখ) এর বিপরীত। আর
কোনো কিছুর দুবুর বলতে সেই বস্তুর পশ্চাদ বুঝায়, যা তার
সাথে মিলিত থাকে তা থেকে পৃথক থাকে না। যেমন মানুষের
পশ্চাদ বা পাছা, যা মানুষের সাথেই মিলিত, মানুষ থেকে পৃথক
নয়। তাই নামাযের পশ্চাদে দুয়া করা অর্থ হবে নামাযের
শেষাংশে দুয়া করা, নামায শেষ করার পর নয়। কারণ সালামের পর
দুয়া করলে দুয়া নামাযের বাইরে হয়, নামাযের পশ্চাদে হয় না।
কিন্তু তাঁর এই মত সরাসরি গ্রহণীয় নয় কারণ; দুবুর (পশ্চাদ)
শব্দটির অর্থ যেমন সেই বিষয়ের পাছা বুঝায়, যা তার সাথে মিলিত
থাকে, তেমন কোনো কিছুর পশ্চাদ বুঝায়, যা তা থেকে পৃথক
থাকে।
ইবনু হাজার (রহ) বলেনঃ ‘আমরা বলেছি প্রত্যেক নামাযের
(দুবুরে) পশ্চাদে যিকরের আদেশ এসেছে। আর এর অর্থ
সর্বসম্মতিক্রমে সালামের পর’। [ফাতহুল বারী,১১/১৬০] অর্থাৎ
তিনি বলতে চাচ্ছেন, নামাযের পর যে যিকর সমূহ
করতে বলা হয়েছে, তাতেও দুবুরুস্ স্বালাত (নামাযের
পশ্চাদে) শব্দটি এসেছে এবং উলামাদের
ঐক্যমতানুযায়ী এখানে দুবুর অর্থ নামাযের পর। তাই দুয়া যেমন
নামাযের শেষাংশে সালামের পূর্বে করা বৈধ তেমন নামায
শেষে সালামের পরেও করা বৈধ।
৩-কোনো সময়ে বা স্থানে দুয়ার প্রমাণ থাকলেই কি হাত
তুলে দুয়া করা বৈধ হয়?
আমরা অনেকে মনে করি যে, কোথাও দুয়ার প্রমাণ থাকলেই
মনে হয়, হাত তুলে দুয়া করতে হয় বা তুলা বৈধ হয়। দুয়ার প্রমাণ
যেহেতু আছে, তাই হাত তুলে দুয়া করলে অসুবিধা কি?
তাছাড়া সমাজে অনেকের নিকট দুয়া মানে হাত তুলে চাওয়া। হাত
না তুলেই আল্লাহর নিকট চাওয়া যায়, এটা তাদের ধারণাই নেই।
অতঃপর দুয়ার প্রমাণ পেলেই হাত তুলার পক্ষে সেই আম হাদীসও
দলীল হিসাবে পেশ করা হয় যাতে নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “ অবশ্যই তোমাদের রব্ব
লজ্জাশীল, ত্রুটি গোপনকারী, বান্দা যখন দুই হাত তুলে তার
নিকট চায়, তখন তিনি তাদের শূন্য
হাতে ফিরিয়ে দিতে লজ্জা করেন”।[তিরমিযী নং ৩৫৫৬]
আমাদের মনে রাখা উচিৎ যে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বহু স্থানে ও বিভিন্ন সময়ে দুয়ার
প্রমাণ এসেছে কিন্তু তিনি এসব ক্ষেত্রে অনেক
স্থানে হাত তুলেছেন আর অনেক স্থানে তুলেন নি। তাই তাঁর
সুন্নতের প্রতি আমল করতে হলে, আমাদের সেই সব স্থানে হাত
তুলা উচিৎ যেখানে তিনি তুলেছেন আর
যেখানে তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তুলেন
নি সেখানে না তুলাই সুন্নাহ। নিম্নে কিছু এমন সময় ও
স্থানে দুয়ার বর্ণনা দেওয়া হল, যেখানে দুয়া প্রমাণিত
কিন্তু হাত তুলা প্রমাণিত নয়ঃ
অযু শেষে দুয়া করা প্রমাণিত। নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাহাদাতাইন পাঠ করতেন
এবং বলতেনঃ “হে আল্লাহ! আমাকে তাওবা কবূলকারীদের
অন্তর্ভুক্ত করো এবং পবিত্রতা অর্জনকারীদের দলভুক্ত
করো”। [মুসলিম (২৩৪) তিরমিযী (৫৫)] কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ স্থানে দুই হাত তুলে সেই দুয়া করতেন
না।
তাওয়াফ করার সময় দুয়া করা প্রমাণিত, বিশেষ
করে রুকনে ইয়ামানী ও হাজরে আসওয়াদের
মাঝে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
বলতেনঃ (হে আমাদের রব্ব! আমাদের দুনিয়াতে কল্যাণ দাও ,
আখেরাতে কল্যাণ দাও এবং জাহান্নামের আযাব
থেকে পরিত্রান দাও)। [বাক্বারা/২০১] কিন্তু তিনি এখানে হাত
না তুলেই এই দুয়া করতেন।
জুমআর খুতবায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
থেকে দুয়া করা প্রমাণিত, কিন্তু তিনি সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাতে হাত তুলে দুয়া করতেন না।[মুসলিম,
নং ৮৭৪] তবে এই সময় ইস্তিসকার (বৃষ্টির জন্য দুয়া-প্রার্থনা)
করলে তিনি দুই হাত তুলে দুয়া করতেন। [বুখারী,
ইস্তিসক্বা অধ্যায়, নং ৯৩৩]
সফর শুরু করার সময় এবং বাহনে আরোহণকালে দুয়া করা প্রমাণিত
কিন্তু হাত তুলা প্রমাণিত নয়। তিনি সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বাহনে পা রাখতেন তখন বিসমিল্লাহ
বলতেন। আর আরোহণ করলে বলতেনঃ আল্ হামদু
লিল্লাহিল্লাযী সাখ্খারা লানা.. [তিরিমিযী নং৩৪৪৩)
আরো বলতেনঃ আল্লাহুম্মা ইন্না নাসআলুকা ফী সাফারিনা
হাযা… [মুসলিম হাজ্জ অধ্যায় নং ১৩৪২]
নামাযের মধ্যেই রুকু, সাজদা এবং তাশাহ্হুদে দুয়া প্রমাণিত
কিন্তু হাত তুলা প্রমাণিত নয়। আরো ও বহু
স্থানে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
হতে দুয়া প্রমাণিত কিন্তু হাত তুলা অপ্রমাণিত যেমন,
মসজিদে প্রবেশের সময় এবং বের হওয়ার সময় দুয়া, বাড়িতে প্রবেশ
কালে এবং বের হওয়ার সময় দুয়া, শৌচালয়ে প্রবেশ ও বের হওয়ার
সময় দুয়া, বিছানায় ঘুমাবার পূর্বে দুয়া এমন
কি স্ত্রী সহবাসের সময় দুয়া। এসব স্থানে দুয়া প্রমাণিত
কিন্তু হাত তুলা প্রমাণিত নয়।
তাই এমন মত পোষণ করা ভুল যে, ফরয সালামান্তে যেহেতু দুয়ার
প্রমাণ রয়েছে তাই হাত তুলে দুয়া করা যায় বা করা ভাল। কারণ
এটি একটি দুয়ার এমন স্থান যাতে দুয়ার প্রমাণ
তো রয়েছে কিন্তু হাত তুলার প্রমাণ নেই। যেমন উপরোক্ত
একাধিক প্রমাণে একাধিক স্থানে দুয়া করা সাব্যস্ত কিন্তু
হাত তুলা সাব্যস্ত নয়।
শাইখ সালিহ ফাউযান (হাফেঃ) বলেনঃ “অতঃপর এই যিকর সমূহ শেষ
করার পর চুপি চুপি যা ইচ্ছা দুয়া করবে। কারণ এমন ইবাদতের পর
এবং এসব মহান যিকরের পর দুয়া বেশী কবূল হওয়ার সম্ভাব্য স্থান।
অতঃপর ফরয নামায শেষে দুয়ার সময় দুই হাত তুলবে না, যেমন
অনেকে করে; কারণ এটি বিদআত। এটা কখনো কখনো নফলের পর
করা যায়”। [আল্ মুলাখ্খাস আল্ ফিক্বহী/৭৯]
৪-কোনো সময়ে বা স্থানে দুয়ার প্রমাণ থাকলেই কি সম্মিলিত
ভাবে দুয়া করা বৈধ হয়?
আমরা যখন উপরোক্ত আলোচনায় বুঝাতে সক্ষম হয়েছি যে, দুয়ার
প্রমাণ থাকলেই হাত তুলা বৈধ হয় না, তখন বর্তমান প্রসঙ্গ
বুঝতে আশা করি সহজ হবে যে, কোথাও দুয়ার প্রমাণ থাকলেই
তা সম্মিলিত ভাবে করা বৈধ হবে না; যতক্ষণে সম্মিলিত
আকারে করার প্রমাণ না পাওয়া যায়। উদাহারণ স্বরূপ জুমআর
খুত্ববায় দুয়া করা। এই সময় নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রায় সব খুত্ববাতে দুয়া করতেন কিন্তু
তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাত তুলতেন না আর
না নামাযীগণ তুলতেন। কিন্তু এই স্থানেই যখন
ইস্তিসকা তথা বৃষ্টি চাওয়ার দুয়া করলেন, তখন তিনি ও উপস্থিত
সাহাবীগণ সকলে হাত তুলে দুয়া করলেন। তাই যেখানে ও যেই
সময়ে তিনি সম্মিলিত ভাবে দুয়া করলেন, আমাদের
সেখানে সম্মিলিত আকারে করা সুন্নত আর
যেখানে তিনি একা একা করলেন সেখানে একা একাই করা সুন্নত।
একটি আরোও সুস্পষ্ট উদাহারণ উল্লেখ করা ভাল মনে করছি।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
হাজারো সাহাবীকে সাথে নিয়ে হজ্জ পালন করছেন এবং বলছেন
“তোমরা আমার কাছ থেকে হজ্জের নিয়ম জেনে নাও” [মুসলিম১২৯৭]
এই হজ্জ পালনের সময় তিনি বহু স্থানে দুয়া করেছেন।
তন্মধ্যে ৬য় স্থানে তাঁর হাত তুলার প্রমাণ এসেছে। ১-
সাফাতে ২-মারওয়াতে ৩-আরাফার দিনে সন্ধায় ৪-মুযদালিফায়
ফজরের পর ৫- তাশরীকের দিনগুলিতে ছোট জামরায় পাথর মারার পর
৬- মধ্যম জামরায় পাথর মারার পর। [তাস্বহীহুদ দুয়া/৪৩৭]
লক্ষণীয় হচ্ছে, উক্ত স্থান সমূহে দুয়ার প্রমাণ
রয়েছে এবং হাত তুলারও প্রমাণ রয়েছে কিন্তু সম্মিলিত
ভাবে দুয়ার প্রমাণ মিলে না; অথচ সাহাবাদের একটি বড়
সংখ্যা তাঁর সাথে রয়েছেন। না নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সাথে নিয়ে দুয়া করছেন আর
না সাহাবাগণ তাঁর সাথে দুয়ায় শরীক হয়ে আমীন আমীন বলছেন।
যা দ্বারা বুঝা যায় যে, দুয়া করার সময় ও স্থান এবং তাতে হাত
তুলার প্রমাণ থাকলেও সম্মিলিত রূপ দেওয়া বৈধ নয়। যেমন
আমাদের অনেক অজ্ঞ ভাই বিশেষ বিশেষ সমাবেশের সময়
বলে থাকেঃ বহু লোকের সমাগম হয়েছে আল্লাহ
কারো না কারো দুয়া কবূল করবে তাই দুয়া করে দিন বা এই ধরণের
অন্য যুক্তি। অথচ এসব বৈঠক ও সমাবেশ দুয়া কবূলের স্থান
হিসাবে প্রমাণিত নয়। আর তা না হলে হাত তুলে দুয়া করা ও
সম্মিলিত ভাবে করা দূরের প্রশ্ন।
যারা এসব ক্ষেত্রে সাধারণ সমস্যার দিকে ইঙ্গিত
করে ফরমায়েশী দুয়ার আবেদন করে হাত তুলে সম্মিলিত
দুয়া করেন, তাদের জন্যও একটি নববী সুন্নত পেশ করতে চাই। এসব
সাধারণ অবস্থা নয় বরং জিহাদ-কিতালের সময়
হয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রায় ৩১৪ জন
সাহাবীকে সাথে নিয়ে বদর প্রাঙ্গনে হাজির হয়েছেন।
শত্রুদের সংখ্যা হাজারেরও অধিক। তাদের যুদ্ধ সরঞ্জামও
অনেক বেশী। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
রাতে মহান আল্লাহর নিকট অতি কাকুতি-
মিনতি সহকারে দুয়া করেন। তিনি তার দুয়ায় বলেনঃ হে আল্লাহ!
ইসলামের এই গোষ্ঠী যদি আজ ধ্বংশ হয়ে যায়, তাহলে তোমার
জমিনে ইবাদত করার আর কেউ থাকবে না। এই দুয়ার এমনই অবস্থা ছিল
যে, তাঁর কাঁধ থেকে চাদর পড়ে যায়। এই সময় আবু বাকর (রাযিঃ)
চাদর তুলে আল্লাহর রাসূলের কাঁধ ঢেকে দেন
এবং বলেনঃ হে আল্লাহর নবী! যথেষ্ট হয়েছে, নিশ্চয় আল্লাহ
আপনার সাথে কৃত অঙ্গীকার পূরণ করবেন। [বুখারী ও মুসলিম]
বলুন তো এমন অবস্থাতেও কি নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের সাথে নিয়ে দুয়া করলেন? আর
না সাহাবাগণ পিছন থেকে এসে তাঁর সাথে দুয়ায় শরীক হলেন? এমন
কি আবু বাকর পাশে থাকা সত্ত্বেও কি তাঁর সাথে দুয়ায় শরীক
হলেন? আর না কেউ ফরমাইশ করল যে, কাল যুদ্ধ তাই একটু
দুয়া করে দিন। তাই বলছিলাম ছোট-খাট অজুহাতকে কেন্দ্র
করে সম্মিলিত দুয়ার অভ্যাসও পরোক্ষভাবে বিদআতী দুয়ারই
অন্তর্ভুক্ত।
৫-ফরয নামায শেষে দুয়ার দলীলগুলির অবস্থাঃ
যারা ফরয নামায শেষে সম্মিলিত দুয়ার পক্ষে মত ব্যক্ত করেন,
তারা কিছু দলীল পেশ করে থাকেন। কিন্তু সত্যিকারে সে সব
দলীল মূলতঃ দলীল নয়; কারণ হয় সেগুলো জাল, যয়ীফ
কিংবা সে সবের অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। নিম্নে ঐসব
প্রমাণের কয়েকটির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলঃ
ক- আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর হতে বর্ণিত, তিনি এক
ব্যক্তিকে নামায শেষ করার পূর্বে দুই হাত
তুলে দুয়া করতে দেখেন। যখন সে নামায শেষ করে, তখন
তিনি তাকে বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর দুই হাত নামায শেষ করার
পূর্বে তুলতেন না। [ত্বাবারী, মুজাম আল কাবীর, ১৩/১২৯]
কিন্তু হাদীসটি যয়ীফ কারণ; বর্ণনাকারীদের মধ্যে মুহাম্মদ
বিন আবী ইয়াহইয়া ও আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর (রাযিঃ) এর
মধ্যে সূত্র বিচ্ছিন্ন (মুনকাত্বা)। তাছাড়া ইবনু
আবী ইয়াহইয়াকে ঐক্যমতানুযায়ী প্রত্যাখ্যাত (মাতরূক)
রাবী বলা হয়েছে এবং তার থেকে বর্ণনাকারী ফুযাইল বিন
সুলাইমান নামক অপর রাবীর স্মরণশক্তি ও দুর্বল প্রকৃতির। তাই
হাদীসটি সূত্র বিচ্ছিন্নতা এবং দুর্বলতার দোষে দুষণীয়।
তাছাড়া সেই হাত তুলা নফল না ফরযান্তে হবে তাও বর্ণিত হয় নি।
আর না তাতে সম্মিলিত দুয়ার কথা আছে।
খ- ইয়াযীদ বিন আসওয়াদ আল্ আমেরী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত,
তিনি বলেনঃ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
এর সাথে ফজরের নামায আদায় করলাম। যখন তিনি সালাম ফিরালেন,
মুখ ফিরে বসলেন এবং দুই হাত তুললেন এবং দুয়া করলেন ।” [ইলাউস
সুনান, ৩/২০৭]
পর্যালোচনাঃ উপরোক্ত হাদীসের শেষাংশ আন্ডার লাইন
করা হয়েছে, “এবং দুই হাত তুললেন এবং দুয়া করলেন।” এই
বাক্যটি হাদীসের মূল গ্রন্থে নেই। হানাফী মাযহাবের
প্রসিদ্ধ বই ইলাউস্ সুনান সহ অন্য মুতাআখ্খির
বইতে বাক্যটি আছে। কিন্তু হাদীসের মূল গ্রন্থ
যা থেকে হাদীসটি সংকলন করা হয়েছে, তাতে এই বর্ধিত বাক্য
নেই। আর এই বর্ধিত বাক্য না থাকলে হাদীসটি নামাযের পর
একা বা সম্মিলিত ভাবে হাত তুলে দুয়া করার প্রমাণই
হতে পারে না। হাদীসটির মূল গ্রন্থ হচ্ছে মুসান্নাফ ইবনু
আবী শাইবা। আর তাতে দুই হাত তুললেন এবং দুয়া করলেন
বাক্যটি নেই। [বর্ধিত অংশ ছাড়াই হাদীসটি দেখুন, আবু দাঊদ,
স্বালাত অধ্যায়, অনুচ্ছেদঃ সালামের পর ইমাম ঘুরে বসবে,
নং ৬১০/মুসনাদ আহমদ ৪/১৬০-১৬১, ইবনু আবী শায়বা, ১/৩০২ ও ১৪/১৮৬]
অনেকে এটা সালাম শেষে দুয়ার গোঁড়া সমর্থকদের
কারচুপি মনে করেন, যারা নিজ মতের
সমর্থনে হাদীসে কারচুপি পর্যন্ত করেন। উপরোক্ত বর্ণনাটির
সম্পর্কে বিস্তারিত দেখুন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম কা স্বাহীহ ত্বারীকায়ে নামায, রাইস
নাদভী, পৃঃ ৫৪৩-৫৪৭ এবং তাস্বহীহুদ দুয়া পৃঃ ৪৪১।
গ- ফযল বিন আব্বাস থেকে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “ নামায দুই দুই রাকাআত,
প্রত্যেক দুই রাকাআতে তাশাহ্হূদ হবে। বিনয়, বিনম্রতা, অসহায়
প্রকাশ পাবে এবং দুই হাত তুলতে হবে। অতঃপর
বর্ণনাকারী বলেনঃ তুমি উভয় হাতকে মহান রব্বের দিকে এমন
ভাবে তুলবে যেন, হাতের অভ্যন্তরীন ভাগ চেহারার
দিকে থাকে এবং বলবেঃ হে আমার রব্ব! হে আমার রব্ব! আর
যে এমন করবে না, তার নামায এমন হবে এবং এমন হবে।” [তিরমিযী,
স্বালাত অধ্যায়, অনুচ্ছেদ নং ২৭৯, হাদীস নং ৩৮৩]
পর্যালোচনাঃ তুহফাতুল্ আহওয়াযীর লেখক
মুবারকপূরী বলেনঃ এই হাদীসটি আব্দুল্লাহ বিন নাফি বিন
ইবনুল উমইয়ার উপর ভিত্তিশীল। আর সে অজ্ঞাত রাভী যেমন
হাফেয বলেছেন। ইমাম বুখারী বলেনঃ তার হাদীস স্বহীহ নয়।
ইবনে হিব্বান তাকে আস্ সিক্বাত গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন”।
[তুহফাতুল আহওয়াযী, ২/৩২৮] তাছাড়া হাদীসটি সহীহ হলেও তা নফল
তথা রাতের নামাযকে বুঝায়; কেন না তাতে দুই দুই রাকাআতের
বর্ণনা এসেছে অন্যদিকে ফজর নামায ছাড়া সব ফরয নামায দুইয়ের
বেশী।
ফরয নামাযান্তে হাত তুলে সম্মিলিত আকারে দুয়ার
সমর্থনে উপরোক্ত দলীলগুলি ছাড়া আরো কিছু দলীল ও সাহাবার
আসার দ্বারা দলীল দেওয়ার চেষ্টা করা হয় কিন্তু সবগুলির
অবস্থা এমন যা হাদীসবিষারদদের নিকট অগ্রহণীয়।
৫-উপরোক্ত আলোচনার সারাংশঃ
উপরোক্ত দলীল-প্রমাণের আলোকে আমরা বলতে পারি যে, ফরয
নামাযে সালাম ফিরানোর পরের সময়টি যেমন যিকর-আযকার করার সময়
তেমন এই সময় দুয়ারও সময় কিন্তু এই দুয়া একা-
একা চুপি চুপি হবে এবং তাতে হাত তুলা প্রমাণিত নয় আর
না সম্মিলিত ভাবে করা প্রমাণিত। তাই যে বা যারা এই সময় হাত
তুলে ইমামের নেতৃত্বে সম্মিলিত ভাবে দুয়া করে তারা এই
দুয়া করার নিয়ম-পদ্ধতি আবিষ্কারক, যা দ্বীনে নবাবিষ্কার। তাই
তা বিদআহ ও প্রত্যাখ্যাত।
৬- সউদী স্থায়ী ফতোয়া বোর্ড কি বলে?
সউদী স্থায়ী উলামা পরিষদকে প্রশ্ন করা হয়, ফরয নামায বাদ
দুয়া করা কি সুন্নত, এই দুয়া কি দুই হাত তুলে হবে…?
তাঁরা উত্তরে বলেনঃ ফরয নামায বাদ দুয়া সুন্নত নয়, যদি তা হাত
তুলে হয়। চাই এটা একা ইমামের পক্ষ থেকে হোক,
কিংবা একা মুস্বল্লীর পক্ষ থেকে হোক কিংবা উভয় কর্তৃক
হোক; বরং এটা বিদআত। কারণ এমন করা নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত নয়, আর না তাঁর
সাহাবা (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। এ ছাড়া দুয়াতে সমস্যা নেই এ
সম্পর্কে কতিপয় হাদীস উল্লেখ থাকার কারণে। [ফাতাওয়াল
লাজনা আদ্ দায়িমাহ,৭/১০৩]
সমাপ্ত
লেখক: শাইখ আব্দুর রাকীব মাদানী,
লিসান্স, মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়
দাঈ, খাফজী দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব।
Email: a.raquib1977@yahoo.com
সম্পাদক: শাইখ আবদুল্লাহিল-হাদী মু. ইউসুফ
লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব
লিসান্স, মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়
দাঈ, খাফজী দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব।
Email: a.raquib1977@yahoo.com
সম্পাদক: শাইখ আবদুল্লাহিল-হাদী মু. ইউসুফ
লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব
No comments:
Post a Comment